শিশুরা কি মানুষ?
লিখেছেন লিখেছেন তরবারী ২৯ জুন, ২০১৬, ০৪:০৭:২৬ বিকাল
"ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে।"-ধ্রুব সত্য,আর তাই সত্যকে তাচ্ছিল্য নয় সম্মান করতে হয়।
অত্যান্ত ছোট কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই শিশু।আমাদের সমাজে শিশুদের কে একটি শিশুই শুধু ভাবা হয়।আমার সাবেক অবস্থা যে শিশু এই বিষয়টাই আমরা ভুলে যাই এবং আমরা শিশুর সাথে অত্যন্ত বিমাতাসুলভ আচরণ করি।অনেকেই হয়তো কথাটির প্রতিবাদ করবেন যে আমার সন্তানকে আমি সবচেয়ে বেশী ভালোবাসি,আপনি এ কি বললেন?অবশ্যই আপনার সন্তানকে আপনি সবচেয়ে বেশী ভালবাসেন,কোন সন্দেহ নাই এখানে কিন্তু সেই ভালোবাসা কি গ্রোথিত নাকি স্রোতের ধারায় ভাসমান?
প্রথমত শিশু বাচ্চাটিকে আমরা অনেকেই মানুষ মনে করি না।তাকে আমাদের অধিনস্ত এমন একটা কিছু ভাবি যা আমাদের সুইচের টিপে চলবে,অথচ এই ধারনাটাই শিশুর স্বাভাবিক বিকাশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক।আমরা সাধারণত শিশুকে যে কোন বিষয়ে ধমক দেই বা থামিয়ে দেই ছোট বলে বা যে কারো সামনে তার গায়ে হাত পর্যন্ত তুলি।আপনি কি ভেবে দেখেছেন বা লক্ষ্য করে দেখেছেন তখন সে কি করে বা কি তার প্রতিক্রিয়া হয় ?
সে প্রহারের আঘাতে যতটা না কাঁদে বা ব্যাথা পায় তার চেয়ে সে নিজেকে খুব ছোট ভাবে,অপমানিত ভাবে আর তার মনে বদ্ধ ধারনা হয় যে যে মারতে পারে বা যে ধমক দিতে পারে সেই সম্মানিত আর বাকী সবাই অপমানিত।সে লজ্জা বোধ করে তৃতীয় ব্যাক্তিটির সামনে।সে মনে মনে কুঁকড়ে যায় আর নিজের মধ্যে এই যন্ত্রণাটা অজ্ঞাত সেন্সেই লুকিয়ে রাখে।কিন্তু এই রাখাটাই তাকে উগ্র করে,অথবা অস্বাভাবিক করে।প্রতিনিয়ত এই অপমান আপনার আমার চোখ এড়িয়ে গেলেও সে বোধ করে।
দ্বিতীয়ত একটি শিশু প্রতিটি বিষয়কেই অবজার্ভ করে,সে নিজের মাঝে সেই বিষয়টি নিয়ে খেলে এবং তার উত্তর প্রতিউত্তর তৈরি করে।আর বাবা মা বা মুরুব্বি কেউ সেই বিষয়ে কথা বলতে থাকলে সে সেখানে তার মতামতকে তুলে ধরতে গেলে বড়রা সাধারণত ছোট বলে তাড়িয়ে দেয়।এতে কি ভেবে দেখেছেন তার মাঝের পরিবর্তন?সে তখন মতামত সম্পর্কে ভাবতে বা দিতে বা গ্রহণ করতে আনমনাভাবেই অক্ষম হয়ে যায়।নিজেকে সে অপাংক্তেয় মনে করে এবং সে তার আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে।যা স্বাভাবিক বিকাশকে ধ্বংস করে।
আবার অনেক বাবা মা শিশুর সাথে খোলামেলা তো নয়ই বরং শিশুর দৃষ্টি এড়ায় না এমন সব বিষয়েও যখন লুকোচুরি করে তখন শিশুটি প্রতারণায় আশ্রয় খুঁজে।সত্যকে জানতে না পেরে সে অন্যায় আশ্রয় খুঁজে এবং সেই আশ্রয় অনেক সময় তাকে ধ্বংসের প্রান্তে নিয়ে যায়।
সমাজে আরেকটা জিনিষ খুবই প্রচলিত।তা হল,শিশুদের উপর চাপিয়ে দেয়ার মানসিকতা।চাপ কখনো সৃষ্টিশীল হতে পারে না,আর সৃষ্টিশীলতা ছাড়া সুন্দর বিকাশ সম্ভব নয়।যেমন বাচ্চাটি কি চায়,কেন চায় তা অনেক বাবা মা ই অনুধাবন করতে চায় না বরং তাদের চাপিয়ে দেয়া বিষয় থাকে শিশুর উপর।তোমাকে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হতেই হবে।এটা শিশুর সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতাকে গাঠনিকভাবে দুর্বল করে দেয়।শিশুটি ব্যাক্তিত্তসম্পন্ন আত্মনির্ভরশীল হতে পারে না।আর তাতে করে অনেকেই তার সাথে খাপ খাইয়ে নিয়ে একটি ধাপে পৌঁছাতে পারলেও বেশীরভাগই ছন্নছাড়া হয়ে যায় সাময়িক এর জন্য বা জীবনের লম্বা এক সময়ের জন্য।
গাইড করা,প্রত্যাশা করা আর জোর করা এক জিনিষ না।সবাই এক ধরনের না,এটা বুঝতে হবে।আর এই বুঝটা বুঝে শিশুকে ট্রিট করতে পারলে সে নিজেই পথ রচনা করতে পারবে।
একটি বিষয় খুব স্পর্শকাতর।আমরা শিশুদের ভাবি এমন একটা কাল যখন সে অবুঝ।আসলেই কি তাই?
হয়তো জাগতিক জ্ঞানের আলোকে সে তখন হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম না কিন্তু শিশুটি একটি কাঁদা মাটি সম।তাতে যত কিছু পড়বে সব কাঁদা মাটিতে আটকে যাবে।এক সময় এর প্রতিফলন ঘটবেই।যেমন একটি বাচ্চাকে বিকিনি পড়ানো হল এই ভেবে যে বড় হলে সে পড়বে না।কিন্তু এই সূচনা তাকে সাহসী করে।প্রকাশ্যে বিকিনি যে লজ্জার বিষয় সেটাকে তার অস্তিত্ব সহনীয় করে তুলে।তাই একটা সময় ছোট্ট প্ররোচনাও তাকে এই পোশাক নিতে দ্বিধায় ফেলতে পারে না।কিন্তু কখনোই স্পর্শ করে নাই এমন কেউ অনেক চাপের স্বীকার না হলে এমনটা খুব কমই করে।
এ ক্ষেত্রে গল্প মনে পড়ছে,"এক বাড়িতে একজন মারা গেলো আর সেখানে একজন এমনভাবে কাদতেছে যে অন্যদের মনে একটা প্রশ্নের বিষয় হয়ে গেলো যে সে ভিন্নভাবে কাঁদছে কেন?তখন কেউ একজন তাকে তার কান্নার ধরনের কারণ প্রশ্ন করলে সে বলল ভাই মারা গেছে এই জন্য কাঁদছি না ,কাঁদছি আসলে আজরাইল যে বাড়ি চিনে গেলো!"
এটা রূপক গল্প হলেও সত্য হল কোন বিষয় যদি গায়ে সহনীয় হয়ে যায় তখন তার জন্য সহনীয় বিষয় গুলোর রাস্তা প্রশস্ত হয়ে যায়।
আমরা বাবা মায়েরা অনেক সময় বলি যে আমার বাচ্চাকে আমি সবসময় সঠিক শিক্ষা দেই।সে তারপরেও কিভাবে এইরকম খারাপ করতে পারলো বা করে।আসলে এর মাঝে ঘটে যাওয়া বিষয়গুলো কি আমাদের ভাবনার উদ্রেক কখনো ঘটিয়েছে?এই যেমন বাচ্চাটিকে আমরা বলছি "সদা সত্য কথা বলবে,সত্যের কোন মাইর নাই।"-কথাটি খুব চমৎকার।কিন্তু তারপরেই সে স্কুলে একটু খেলে দেরী করে বাসায় ফিরলে যখন জেরা করি আর সে সত্য বলে যে আম্মু খেলা করেছি আর তখনই আম্মু অসময়ে খেলার বিষয়টাকে ভালোভাবে না বুঝিয়ে গায়ে আঘাত করে তখন সে সত্য বলার প্রতিদান কে ভুল বুঝে আর সত্য লুকানোর অভ্যাসের দিকে নিজেকে ঠেলে দেয়।আলটিমেটলি কথা ও কাজের এই যে ফারাক তা শিশুদের মনে দ্বিধা সৃষ্টি করে আর সে সেই দ্বিধা থেকে সাময়িক সুবিধা পাওয়া যায় এমন বিষয় বেছে নিয়ে তার ক্ষুরধার চর্চা শুরু করে দেয়।
আবার বাবা মা উপদেশ দেয় অনেক সুন্দর সুন্দর কথা,কিন্তু বাবা মা নিজেই করে ভিন্নধরনের কাজ।তখন শিশুটি উপদেশকে অনুসরণ করতে পারে না।বরং প্র্যক্তিক্যাল কাজটিই সে অনুসরণ করে কারণ এটাই শিশুদের স্বভাবগত প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য।
একটি শিশুই আগামিদিনের আইনস্টাইন,সক্রেতিস,নজরুল বা ইবনে সিনা।তাকে পিস্টনের চাপে আটকে রাখার নাম অত্যাচার।তাকে আত্মপ্রত্যয়ী,আত্মবিশ্বাসী এবং সাবলীল করতে হলে তাকে স্পেইস করে দিতে হবে সৃষ্টির জন্য,চাপিয়ে নয়।তার উপর বিশ্বাস রাখতে হবে,আর শাসক নয় গাইড হয়ে অভিভাবক হতে হবে।
ভয় আর হুমকি দিয়ে নয়,আশা আর সাহস দিয়ে তার পথ রচনা করতে হবে।
তাই তো শেরে বাংলা ফজলুল হক বলেছিলেন,"যে দেশের শিশুদেরকে ঘুম পাড়ানো হয়,বাঘ,সিংহ আর ভুতের ভয় দেখিয়ে তারা কিভাবে নেতৃত্ব দিবে,তারা তো ভয়কেই পুঁজি করে পথ চলবে"
রাস্তার ফুটপাতের ছেলেটি যতটা সাহসী হয় ননীর পুতুল ছেলেটি রাস্তা পেরুতেও তখন কাঁপতে থাকে।প্রকৃতপক্ষে শিশু একটি কাঁদা মাটির সম এবং তাকে যা দেয়া হবে তা সে জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারেই সেটিই গ্রহণ করে ফেলে।আদর্শ ধারাপাত সেখানে গৌণ ভূমিকাই পালন করতে পারে।
আসুন "আজ যে শিশু পৃথিবীর আলোয় এসেছে,আমরা তার তরে একটি সাজানো বাগান চাই" - এই শ্লোগান কে বাস্তবায়িত করি।
বিষয়: বিবিধ
১১১৬ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন