পড়োবাড়ীর বদ্ধ কুঠিরে..... (সমস্ত পর্ব)
লিখেছেন লিখেছেন ইশতিয়াক আহমেদ ০৬ ডিসেম্বর, ২০১৪, ১১:২০:৫২ রাত
বৃদ্ধ বটগাছের নিকট অসংখ্য মানুষের ভীড়। সকলের মুখে একই কথা , অাজও মানুষ খুন ! এভাবে প্রতিদিন মানুষ খুন হলে তো গ্রাম শূণ্য হয়ে যাবে। কিন্তু কারা এই ঘাতক বাহিনী? তারা কেন মানুষ হত্যা করে, তাদের উদ্দেশ্যই বা কি? সকলের মনে একই প্রশ্ন।
জনতার ভীড় ঠেলে এগিয়ে গেল অাজীম ও ফারুক। সম্মুখে দৃষ্টি ফেলতেই তাদের চোখ ছানাবড়া। বটগাছের ডালে ঝুলছে একজন মধ্যবয়সী পুরুষের লাশ। সম্ভবতঃ গলায় ফাঁস দিয়ে মারা হয়েছে লোকটিকে।
জিঙ্গাসা করে তারা জানতে পারল- লোকটির নাম অাবদুর রহীম। এই গ্রামে তার বাড়ী। সে গত চারদিন যাবত নিখোঁজ ছিল। কারা তাকে অপহরণ করেছিল কেউ জানেনা। হঠাৎ অাজ ভোরবেলা লোকজন দেখতে পায় - তার মৃত দেহ গাছের ডালে ঝুলছে। ঘটনাটি কিছু সময় ধরে পর্যবেক্ষণ করলো তারা দু'জন।
অাজীম ও ফারুক উভয়ই চট্টগ্রাম ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বাড়ী ফতেহপুর গ্রামে। ছোটবেলা থেকে একই সাথে লেখা-পড়া করছে। একারণে স্বাভাবিক ভাবেই তাদের দুজনের মধ্যে বেশ ভাব। যেখানেই যায় একসঙ্গে যায়।
দুদিন হল তারা বাড়ীতে এসেছে। অাজ ফজরের নামায পড়ে হাঁটাহাঁটি করার জন্য নদীর তীরে এসেছিল। কিন্তু মাঝ পথেই তারা দেখতে পেল হত্যাযঙ্গের নির্মম চিত্র। ব্যথায় তাদের হৃদয়টা মোচড় দিয়ে উঠল। সেই সাথে এর প্রতিকারের স্পৃহা তাদের রক্তকে উত্তপ্ত করে দিল।
কিছুক্ষণ চলার পর তারা নদীর তীরে পৌছে কোমল ঘাসের বিছানায় বসে পড়ল। নীরবতার মধ্য দিয়ে কেটে গেল বেশ কিছুক্ষণ। উভয়ের হৃদয় অাজ শোকাহত। কি শুরু হল এই সোনার বাংলায়? সন্ত্রাসী নামক ঘাতক বাহিনীর হাতে বাংলার মেহনতী মানুষ অাজ জিম্মী ! তাদের মুক্ত অাকাশে স্বাধীনভাবে নিঃশ্বান নেয়ারও অবকাশ নেই। এর জন্যই কি স্বাধীন করা হয়েছে এই দেশকে?
ত্রিশ লক্ষ প্রাণ অার এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার সাধ কেন অাজ এভাবে খর্ব হতে চলেছে?
অাচ্ছা ফারুক , এই হত্যাকান্ড কারা ঘটাতে পারে? নীরবতা ভেঙ্গে প্রশ্ন করল অাজীম।
ঃ অামার চাচাতো ভাই মিজানের কাছ থেকে জানতে পারলাম- এই এলাকায় নাকি সন্ত্রাসীদের বড় অাখড়া রয়েছে। তাই অামার মনে হয় , এটা সন্ত্রাসীদের কাজ।
ঃ অামারও তা-ই মনে হয়। কিন্তু প্রায় প্রতিদিন এভাবে খুন হচ্ছে অার প্রশাসন মুখে কুলুপ এটে বসে অাছে?
ঃ কি করবে প্রশাসন। সন্ত্রাসীদের ভয়ে প্রশাসনই কাঁপে থরথর করে।
ঃ কিন্তু কোথায় তাদের অাস্তানা? এরা থাকেই বা কোথায়?
ঃ মিজানের কাছ থেকে অামি শুনলাম- অামাদের পাশের গ্রামে নাকি অনেক পুরাতন একটা বাড়ী অাছে, বাড়ীটি "পড়োবাড়ী" নামে পরিচিত। ইংরেজরা যখন অামাদের দেশ শাষণ করত, তখন নাকি তারা বসবাসের জন্য এই প্রাসাদ নির্মাণ করেছিল। কিন্তু কালের অাবর্তে ঐ বাড়ীটা এক সময় বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ে।
তারপর থেকে ঐ বাড়ীকে নিয়ে মানুষ অাঁকড়ে থাকে কল্পনা-জল্পনার নানা চিত্র। কেউ বলে, ওখানে ভূত-পেত্নী বাস করে। অবার কেউ কেউ বলে, সেখানে প্রাণ সংহারক এক দানব থাকে। অাশ্চর্যের বিষয়- যে ঐ বাড়ীতে প্রবেশ করে, সে অার ফিরে অাসতে পারে না। এই ভয়ে বাড়ীতে কোন মানুষ প্রবেশ করে না।
কিন্তু অামার দৃঢ় বিশ্বাষ , ঐ বাড়ীতেই সন্ত্রাসীরা অাখড়া গেড়েছে। ভূত-পেত্নী বা দানব-টানব কিছুই নেই সেখানে।
ঃতাই ! বিস্মিত হয়ে বলল অাজীম। তাহলে তো অার চুপ করে বসে থাকা যায় না। যেভাবেই হোক, ওদের বিরুদ্ধে দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
ফারুক অাজীমের কথায় পূর্ণ সমর্থন জানাল। অতঃপর দু'জন প্রতিঙাবদ্ধ হল- যেভাবেই হোক সন্ত্রাসীদের এই এলাকা থেকে উৎখাত করবেই। তারপর দুজন নিজ নিজ বাড়ীর পথ ধরল।
পরদিন গভীর রাত। সারা গ্রামবাসী নিদ্রাকোড়ে শায়িত। কিন্তু অাজীম ও ফারুকের চোখে কোন ঘুম নেই। তারা রাতের নিরবতাকে খান খান করে নির্ভীকভাবে পথ চলছে পড়োবাড়ীর উদ্দেশ্যে। সঙ্গে নিয়েছে ১টি টর্চলাইট, ২টি লাইসেন্সকৃত রিভলবার ও একটি ক্লোরোফরম যুক্ত রুমাল।
নিরাপত্তার জন্য রিভলবার দু'টি তারা সবসময় তাক করে রাখল। বেশ কিছুদূর চলার পর তারা পৌছে গেল পড়োবাড়ীর নিকটে।
ঘন অাঁধারের মধ্যেও বাড়ীর বিশাল দেহটি তাদের অবাক করে দিল। এ-তো সাধারণ কোন বাড়ী নয়, বিরাট এক রাজপ্রাসাদ। চারিদিকে ঘন গাছ-গাছালীতে পরিপূর্ণ। মনে হয় যেন গভীর অরণ্যের মাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে অাছে। মাঝে মাঝে দেয়ালের প্লাস্টার খসে খসে পড়েছে। কোথাও কোথাও দেয়ালের গা ফেটে বেরিয়ে গেছে বৃক্ষের শিকড়।
তারা দুজনে বিড়ালের মত ফেলে চুপি চুপি পৌছে গেল প্রাসাদের প্রধান ফটকে। প্রাসাদটির দরজা অসংখ্য, কিন্তু প্রধান ফটক একটাই। তারা খুব সাবধানে একটি কক্ষের মধ্যে প্রবেশ করল।
মানুষের অাগমনের অাওয়াজে বাদুরগুলো ডানা ঝাপটিয়ে উড়তে লাগল। হঠাৎ বাদুরের চেচামেচিতে তাদের অন্তর ধুকধুক করে উঠল। কিন্তু পরক্ষনেই ব্যাপারটি স্বাভাবিক হয়ে এল।
এরপর তারা অারেকটি কক্ষে প্রবেশ করল। কিন্তু সেখানেও একই ব্যাপার। জনমানবের কোন চিহ্ন নেই।
এভাবে ধীরে ধীরে তারা সমস্ত কক্ষ পরিদর্শন করল। কিন্তু কোথাও সন্ত্রাসী ঘাতকদের খুঁজে পেল না।
অাজীম হতাশ হয়ে পড়ল। কিন্তু ফারুক তার বিশ্বাসে অটল, এখানে কোথাও সন্ত্রাসীদের অাড্ডাখানা অবশ্যই অাছে।
এবার তারা সর্বশেষ যে কক্ষে প্রবেশ করল,সেটা ছিল অন্যান্যগুলী থেকে পৃথক। এ কক্ষে ঝোঁপ-ঝাড়ও অন্যান্য কক্ষের থেকে তুলনামূলক বেশী। সবচেয়ে অাশ্চর্যের বিষয়, এই কক্ষে অন্যান্য কক্ষের মত কোন বাদুর নেই। দেখলেই বোঝা যায়- এই ঘরে সর্বদা মানুষ চলাচল করে। কিন্তু কোন জনমানবের চিহ্ন দেখা গেল না।
হাঁটতে হাঁটতে তারা পৌছে গেল ঘরের একেবারে পুর্বপাশে। হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল একটি পিলারের কাছে। চিন্তা করছিল এখন কি করবে?
এমন সময় হঠাৎ একটি শব্দ কানে এল। পরক্ষণেই পিলারের মধ্য হতে একটি সুড়ঙ্গ পথ উন্মুক্ত হল। সঙ্গে সঙ্গ তারা দুজন নিজেদের কর্তব্য নির্ধারণ করে নিল। পিলারের পাশ থেকে দুজন দু'দিকে ছিটকে পড়ল। রিভলবার তাদের হাতেই তাক করা ছিল। অতিরিক্ত সতর্কতার জন্য পকেট থেকে ক্লোরোফরম রুমাল বের করল।
একটু পরই ঘট ঘট শব্দে একটি লোক সুড়ঙ্গ থেকে বের হল। দেরী করল না অাজীম। ঝাঁপিয়ে পড়ল লোকটির উপর । কোন কথা মুখ থেকে বের হবার পূর্বেই নাকে চেপে ধরল রুমাল। সঙ্গে সঙ্গে সঙা হারাল লোকটি।
ফারুকও ততক্ষণে চলে এসেছে ঘটনাস্থলে। পাশেই পড়ে ছিল একটি রশি । ফারুক হাত-পা বেঁধে ফেলল লোকটির। তারপর তারা লোকটিকে ঝুপড়ির মধ্যে লুকিয়ে রাখল।
অতঃপর অাল্লাহর নাম স্মরণ করতে করতে দুজন নেমে পড়ল সুড়ঙ্গ পথে। কিছুক্ষণ পর পৌছল একটি সমতল ভূমিতে।
চতুর্দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল। চারপাশে ঘর। তার মধ্যে একটি ঘরের বাতায়ন দিয়ে অালোর রশ্মি ঠিকরে বের হচ্ছিল। বাকিগুলো অন্ধকার। অালোকিত ঘর থেকে চাপা কথাবার্তার শব্দ ভেসে অাসছে।
তারা দুজন খুব সতর্কতার সঙ্গে সেই ঘরের একদম দরজার নিকট পৌছে গেল। অাজীম উঁকি দিয়ে দেখল- চারজন লোক তাস খেলছে অার মাঝে মাঝে অট্টহাসি দিচ্ছে।
একজন বললঃ কিরে, চুন্নু তো গেল, কিন্তু এখনও ফিরতেছে না ক্যান? কোন সমস্যা-টমস্যা হলো না তো?
অারেকজন বললঃ ওরে, তোর মনে যে এতো ডর শালা, মাইয়্যা হইয়া জন্মাইতে পারস নাই?
প্রথমজন বললঃ ডর না, ডর না। এইসব করতে হইলে সাবধানে থাকতে হয়। কহন কোন অসুবিধা হইয়া যায়, বলা তো যায় না।
দ্বিতীয় ব্যক্তি উঠতে উঠতে বললঃ অারে থো তোর সাবধান, অামিই দেখতাছি চুন্নু কোথায় গেল।
তৃতীয় ব্যক্তি বললঃ দেহিস, তুইও অাবার উধাও হইয়া যাইস না।
অারে রাখ' বলে লোকটি গর্বের সাথে উঠে দরজার দিকে পা বাড়াল।
অপ্রত্যাশিতভাবে লোকটির অাগমণে কিছুটা চমকে উঠল অাজীম ও ফারুক। পরক্ষনেই নিজেদের সামলে দুজন দাঁড়িয়ে গেল দরজার দু'পাশে। লোকটি যখন দরজা পার হচ্ছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে তাকে পিছন থেকে ঝাপটে ধরল অাজীম। লোকটির মুখ থেকে সামান্য গোঙ্গানী বেরিয়ে এল। তারপর রুমাল চেপে ধরল নাকে। ঙান হারিয়ে ফেলল লোকটি।
গোঙ্গানীর শব্দে তার সাথীরা তৎপর হয়ে উঠল। ঘটনা জানার জন্য যখন তারা বের হতে যাচ্ছিল, সেই মুহূর্তে ফারুক রিভলবার উঁচিয়ে বললঃ একজনও নড়াচড়া করতে পারবে না। পালানোর ব্যর্থ চেস্টা করলে গুলী করে মাথার খুলি উড়িয়ে দিব।
ঘটনার অাকস্মিকতায় লোকগুলো ভেবাচেকা খেয়ে গেল। কোন কর্তব্য স্থির করতে না পেরে হাত উঁচু করে দাঁড়িয়ে গেল।
ওদিকে অাজীম প্রথম লোকটিকে বাঁধার কাজে ব্যস্ত ছিল। তাকে বাঁধা হয়ে গেলে, সে বাকী তিনজনকেও ঝটপট বেঁধে ফোলল।
তারপর অাজীম জিঙ্গাস করলঃ বল্ ! তোরা এখানে কি করিস? তোদের সঙ্গে অার কারা থাকে?
প্রথমে সবকিছু অস্বীকার করল লোকগুলো। কিন্তু যখন উত্তম মাধ্যম শুরু হল, তখন সবকিছুই স্বীকার করল।
সর্দার গোছের লোকটি বললঃ অামরা দীর্ঘদিন এখানে অাস্তানা গেড়ে অাছি। অামরা অাশ-পাশের গ্রামের লোকদের অপহরণ করে মুক্তিপণের বিনিময়ে ছেড়ে দেই। কিন্তু কেউ যদি মুক্তিপণ দিতে অস্বীকার করে , তাহলে তাকে হত্যা করি।
লোকগুলোর সংক্ষিপ্ত জবানবন্দী নিয়ে অাজীম সমস্ত ঘরে তল্লাশী চালাল। যে ঘরে সন্ত্রাসীরা ছিল, সে ঘর থেকে পাওয়া গেল, পাঁচটা স্টেনগান, কয়েক রাউন্ড গুলী, কয়েক বোতল মদ ও বেশ কিছু টাকা-পয়সা। পাশের কক্ষে থেকে উদ্ধার করা হল পাঁচজন বন্দীকে। তারা মুক্তি পেয়ে কৃতঙ্গতায় ভেঙ্গে পড়ল অাজীম ও ফারুকের প্রতি।
রাত যখন প্রায় শেষ, অাজীম ও ফারুক সন্ত্রাসীদের এবং উদ্ধারকৃত সকল অস্ত্র-শস্ত্র ও বন্দী গ্রামবাসীদের নিয়ে গ্রামের পথ ধরল।
তারা যখন গ্রামে পৌছল, তখন ফজরের অাজান হচ্ছিল। অাজীম নিজের ঘরে সন্ত্রাসীদের অাটকে রেখে গ্রামবাসীদের নিয়ে নামায পড়তে গেল মসজিদে।
বন্দী গ্রামবাসীদের দেখে মসজিদের মুসল্লীরা অবাক হয়ে গেল। কেননা, তারা গত তিন-চারদিন যাবত নিখোঁজ ছিল। কিন্তু এখন হঠাৎ কোথা থেকে অাগমণ করল?!
নামাযের পর তারা সবকিছু খুলে বলল।
কাহিনী শুনে সকলেই বিস্মিত হল। তারা অাজীম ও ফারুকের প্রশংসায় ব্যস্ত হয়ে উঠল।
কিছুক্ষণ পর থানা থেকে পুলিশ অাসলো। ফারুকের নিকট থেকে সবিস্তারে সবকিছু জেনে নিলেন পুলিশ অফিসার অাকরাম খান। তারপর উদ্ধারকৃত সকল অস্ত্র-শস্ত্র এবং সন্ত্রাসীদের নিয়ে গেলেন থানায়।
গ্রামবাসীদের সকল শংকা দূর হয়ে গেল। তারা শান্তিতে দিন কাটাতে লাগল। সরকারের পক্ষ থেকে অাজীম ও ফারুককে পুরস্কৃত করা হল।
বিষয়: সাহিত্য
১৪১০ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন