বঙ্গভবনে কি মৃদু হুশিয়ারি দিল সিনহাকে ?

লিখেছেন লিখেছেন মুক্তআকাশ ০৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১০:৩৯:৪০ সকাল



অলিউল্লাহ নোমান: আগেও একবার বঙ্গভবনে যাওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন তিনি। তখন বঙ্গভবন ছিল আতঙ্ক। সেখানে যাওয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করতে অনেক কাটখড় পুড়িয়েছিলেন। বঙ্গভবনে যাতে না যেতে হয়, সেজন্য চেষ্টা তদবীরের অন্ত ছিল না তখন। ড. কামাল হোসেন থেকে শুরু করে অনেক সিনিয়র আইনজীবী তাঁকে রক্ষায় দৌড়ঝাপ করেছিলেন। সবার চেষ্টা ছিল বঙ্গভবনে যাওয়া থেকে তাঁকে রক্ষা করা। অজানা আশঙ্কায় সেদিন বাড়িতে না গিয়ে রাত্রি যাপন করেছিলেন সুপ্রিমকোর্টে। সাহস যোগান এবং সঙ্গ দিতে অনেক আইনজীবী তাঁর সাথে রাত কাটিয়েছেন। অবস্থান করেছিলেন বিচারপতিদের জন্য তৈরি করা খাস কামরায়। ভয় ছিল বাড়িতে থাকলে যৌথ বাহিনী জোড় করে বঙ্গভবনে নিয়ে যেতে পারে। সেই দিন ও রাতের থমথমে পরিস্থিতি এবং বঙ্গভবনে তাঁকে আমন্ত্রণের চিঠি প্রসঙ্গে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় লিড নিউজ প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁকে রক্ষায় সর্বশেষ এগিয়ে এসেছিল পাশবর্তি একটি দেশের হাইকমিশন। সর্বাত্মক চেষ্টা আর তদবীরে তিনি রক্ষা পান বঙ্গভবনে যাওয়া থেকে। সেটা ছিল ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারী জরুরী অবস্থা জারির পর। তখন বঙ্গভবনে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। চা-এর আমন্ত্রণ জানিয়ে লিখিত চিঠি দেয়া হয়েছিল বঙ্গভবন থেকে। অগণতান্ত্রিক অসাংবিধানিক জরুরী আইনের সরকার বিচারপতিদের বঙ্গভবনে ডেকে নিয়ে পদত্যাগ পত্র রেখে দিতেন। বিশেষ করে যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল তাদেরকেই বঙ্গভবনে আমন্ত্রণ পত্র তৈরি হয়েছিল। তাঁকে আমন্ত্রণের আগে বিচারপতি বদরুল হক বাচ্চুকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। চা-এর আমন্ত্রণে সারা দিয়ে বঙ্গভবনে যান বদরুল হক বাচ্চু। সেখানে তাঁর নিকট থেকে পদত্যাগ পত্র রেখে বিদায় দেয়া হয়। বদরুল হক বাচ্চুর পরিণতি দেখে আতঙ্কিত ছিলেন আমন্ত্রণপত্র পাওয়া বিচারপতিরা। আমন্ত্রণ পাওয়া দ্বিতীয় ব্যক্তিটি ছিলেন বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। উপরে যে বর্ণনা দেয় হয়েছে সেটা ছিল সুরেন্দ্র কুমারকে ঘিরে ঘটে যাওয়া ঘটনার বিবরণ। প্রসঙ্গক্রমে একটু উল্লেখ করা বঞ্চনীয় মনে করছি। বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল দুর্নীতি দমন কমিশনে। প্রথম গঠিত কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন বিচারপতি সুলতান হোসেন খান। তাঁর কাছে নানা তথ্যসহ অভিযোগ করা হয়েছিল। এ অভিযোগের নথি তিনি পাঠিয়েছিলন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ জে আর মোদাচ্ছির হোসেনের কাছে। সুলতান হোসেন খান ঘটনা প্রসঙ্গে এ প্রতিবেদকের কাছে বিষয়টি উল্লেক করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যেহেতু বিচারপতিদের অভিযোগ তদন্তের এখতিয়ার সংবিধানে সুপ্রিম জুডিশিয়ালকে দেয়া আছে। তাই প্রধান বিচারপতির কাছে পাঠানো বাঞ্চনীয় মনে করা হয়।

এবার ডাক পড়ার সাথে সাথে বঙ্গভবনে হাজির হলেন সুরেন্দ্র কুমার। এবারের আমন্ত্রণ যেন আশির্বাদ। কারন তাঁর আত্মবিশ্বাস এখন তুঙ্গে। নিজের রাজনৈতিক বিশ্বাসের দল ক্ষমতায়। যদিও স্বঘোষিতভাবে তিনি ছিলেন রাজাকার। পাকিস্তান সরকারের তৈরি করা শান্তি কমিটির স্থানীয় সভাপতি । হালে তিনি আওয়ামী লীগার। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বিচারপতি হয়েছিলেন। এই রাজনৈতিক বিশ্বাস এখনো পোষণ করেন তিনি। গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ইস্যু গুলোতে আওয়ামী লীগের বিশ্বাসকেই প্রতিষ্ঠিত করেছেন আইনের অপব্যাখ্যা দিয়ে। এক্ষেত্রে বলা চলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, পঞ্চম সংশোধনী বিষয়ে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত করার পক্ষেই ছিল তাঁর অবস্থান। তাই বঙ্গভবনে যাওয়া থেকে বিরত থাকতে কোন চেষ্টা তদবীরের প্রয়োজন মনে করেননি এবার। হাজির হয়েছেন স্বগৌরবে। গত বৃহস্পতিবার (২৮ জানুয়ারী) রাতে বঙ্গভবনে নৌশভোজের নামে রাষ্ট্রের ৩ অঙ্গের প্রধান ব্যক্তিদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই নৈশভোজে উপস্থিত ছিলেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। যেহেতু বৈঠকে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও আইনমন্ত্রী এবং অ্যাটর্নি জেনারেল ছিলেন। সে কারনে এ বৈঠক নিয়ে শঙ্কা এবং কৌতুহল তৈরি হওয়াই স্বাভাবিক।

এই নৈশভোজ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন চলছে অনেক কানাঘুষা। কৌতুহলের অন্ত নেই অনেকের মাঝে। কি কথা হয়েছে তাদের। আবার কোন ষড়যন্ত্র নয়তো! অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি যেমন রয়েছে সামনে, তেমনি সুরেন্দ্র কুমারের বক্তব্য নিয়ে চলছে তোলপাড়। কোন বিষয়ে তারা কথা বলেছেন! নাকি সব বিষয় তাদের আলোচনায় এসেছে!

ঘটনা-১

গত ১৭ জানুয়ারী প্রধান বিচারপতি হিসাবে বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে সুপ্রিমকোর্ট ওয়েবসাইটে বাণী দেন সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। বাণীতে তিনি বোমা ফাটান। অবসরে গিয়ে বিচারপতিদের রায় লেখার বিষয়টিকে অবৈধ এবং অসাংবিধানিক হিসাবে আখ্যায়িত করেন প্রধান বিচারপতি। তখনই সরব হয়ে উঠে রাজনৈতিক অঙ্গন। বিরোধী দলীয় জোট লোপে নেয় তাঁর এ বক্তব্য। তারা বক্তব্যটির সারমর্মে না গিয়ে শুধু রাজনৈতিক ফায়দার জায়গাটিতে হৈ চৈ শুরু করেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে আপিল বিভাগের রায়টি লিখেছিলেন বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। যিনি প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে ১০ লাখ টাকা খয়রাতি গ্রহন করেছিলেন। যদিও জরুরী আইনের আমলে ত্রাণের টিন মসজিদ মাদ্রাসায় দেওয়ার কারনে অনেক সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে তখন মামলা হয়েছিল। এবং এসব মামলায় অনেকের সাজা দিয়েছিলেন খায়রুল হকরা। কারন ত্রাণের টিন মসজিদ মাদ্রাসায় দেয়াটাও বেআইনি ছিল তখন। এই খায়রুল হক অবসরে গিয়ে শুধু রায় লিখেননি। তিনি রায়ে মৌলিক পরিবর্তনও এনেছিলেন।শেখ হাসিনার সরকার যাতে কোন রকম বিভ্রান্তি ছাড়াই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করতে পারে সেই ব্যবস্থাটি করা হয় রায়ে মৌলিক পরিবর্তন এনে। সুপ্রিমকোর্টের ওপেন বেঞ্চে ঘোষিত রায়ে বলা হয়েছিল পরবর্তি ২ মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকতে পারে। কিন্তু অবসরে গিয়ে খায়রুল হকের লেখা রায়ে এ বিষয়টি আর থাকেনি। অবসরে গিয়ে রায় পরিবর্তন করা গুরুতর অপরাধ। রায়টি প্রকাশিত হওয়ার এ উক্তি করেছিলেন প্রবীন আইনজীবী ব্যারিষ্টার রফিক উল হক। বিরোধী জোট যৌক্তিক জায়গা গুলোতে টাচ না করে শুধু তত্ত্বাবধায়ক নিয়ে তোলপাড় শুরু করছে। বঙ্গভবনে বৃহস্পতিবারের বৈঠকে এবিষয়টি উঠে আসা খুবই স্বাভাবিক। কারন এটি নিয়ে সংসদেও আওয়ামী লীগের কিছু সদস্য চিল্লাপাল্লা করেছে। সরকার কিছুটা হলেও বিব্রত এতে। সিনহাকে হয়ত: স্মরণ করিয়ে দেয়া হতে পারে খায়রুল হকের অবৈধ রায়ে তিনিও সাক্ষর করেছেন। সুতরাং খায়রুল হকের রায় নিয়ে কথা উঠলে তাঁর পরিণতিও ভাল হবে না। মাথা টানলে কান অটোমেটিক চলে আসে। এযুক্তি দেখিয়ে মৃদু হুশিয়ারি দেয়া হতে পারে সুরেন্দ্র কুমারকে।

ঘটনা-২

সামনে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ন বিষয় রয়েছে সুপ্রিমকোর্টে। বিরোধী জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা একটি মামলা জেলা বিশেষ জজ আদালতে নিষ্পত্তির শেষ পর্যায়ে রয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নেজামীর মামলার রায় হয়েছে। রায় প্রকাশের পর রিভিও হবে। শোনা যায় মতিউর রহমান নিজামীর রায়ের আগের দিন আইনমন্ত্রীসহ একাধিক মন্ত্রী কাকরাইলে অবস্থিত প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমারের বাসভবনে গিয়েছিলেন। কারন মাওলানা নিজামীর মামলার শুনানীকালে সুরেন্দ্র কুমার কত গুলো মৌলিক প্রশ্ন রেখেছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে। প্রশ্ন গুলো যেহেতু উত্থাপন করেছিলেন স্বয়ং প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। এতে মাওলানা নিজামীর ফাঁসি নিশ্চিত করা নিয়ে শঙ্কিত ছিল সরকার। এই শঙ্কা দূর করতেই রায়ের আগের দিন সুরেন্দ্র কুমারের সাথে দেখা করেন আইনমন্ত্রীসহ একাধিক মন্ত্রি। সুতরাং অবসরে গিয়ে রায় লেখা অবৈধ, অসাংবিধানিক বলার পর সরকারের মূল ইস্যু গুলো নিয়ে কিছুটা হলেও শঙ্কা তৈরি হয়। তাই এই বৈঠকের মাধ্যমে ভবিষ্যতে বিব্রত হওয়া থেকে রেহাই পেতে আগেই কঠোর অবস্থান নেয়ার ব্যবস্থা করে সরকার।

ঘটনা-৩

তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে আল্লামা দেলওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলায় রিভিউ পিটিশন। আপিল বিভাগে আল্লামা সাঈদীকে আজীবন কারাদন্ড দেয়া হয়। অনেকেই বলেন যাবজ্জীবন। এটা আসলে যাবজ্জীবন নয়। যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রাপ্ত ব্যক্তি একটি নির্দিষ্ট সময় শেষে জেল থেকে মুক্তি পেয়ে থাকেন। কিন্তু আল্লামা সাঈদীর মামলার আপিল বিভাগের বিভক্ত রায়ে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে আজীবন কারাদন্ড। অর্থাৎ জীবিত অবস্থায় তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পাবেন না। যদিও বিভক্ত রায়ে একজন বিচারপতি তাঁকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন। আরেকজন দিয়েছেন মৃত্যুদন্ড। সংখ্যাগরীষ্ঠ বিচারপতিরা দিয়েছেন আজীবন কারাদন্ড। এ রায়ের বিরুদ্ধে মৃত্যুদন্ড চেয়ে রিভিউ পিটিশন করেছে সরকার। আবার খালাস চেয়ে রিভিউ পিটিশন করেছেন আল্লামা সাঈদী। সরকার যেখানে মামলার বাদী সেখানে সরকার প্রধানের সাথে বৈঠক করলেন প্রধান বিচারপতি।

আল্লামা সাঈদীর মামলার বিষয়টিও উঠতে পারে বৈঠকে। থাকতে পারে সরকারের দিন নির্দেশনা। বাদী এবং বিচারপতির বৈঠক নিয়ে জনমনে শঙ্কা, কৌতুহল তৈরি হওয়াই স্বাভাবিক। শুধু তাই নয়, বৈঠকে বাদী পক্ষের আইনজীবী অ্যাটর্নি জেনারেল ও আইনমন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। সুতরাং নৈশভোজের নামে গোপন বৈঠকে গুরুত্বপর্ণ ষড়যন্ত্র গুলো চুড়ান্ত হওয়াই নিয়ে সন্দেহ তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। এই বৈঠকে উপস্থিত ব্যক্তিদের কেউ যদি ভবিষ্যতে রিমান্ডের মুখোমুখি হন, তখন হয়ত: প্রকৃত ঘটনা জানার সুযোগ তৈরি হতে পারে। নতুবা এ বৈঠক রহস্য আর কৌতুহলের বেড়াজালেই থাকবে। তবে নৈশভোজের নামে বহু গুরুত্বপূর্ণ স্পর্শকাতর মামলার বাদীর সাথে বৈঠকে উপস্থিত হয়ে সুরেন্দ্র কুমার। এতে সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন কিনা সেটাও প্রশ্ন সাপেক্ষ বিষয়। বৈঠক থেকে কি নির্দেশ নিয়ে এলেন সেটা বোঝা যাবে আগামীতে সুরেন্দ্র কুমারের আচরণ থেকেই।

লেখক: দৈনিক আমার দেশ-এর বিশেষ প্রতিনিধি, বর্তমানে যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত।

বিষয়: বিবিধ

৪৯৮২ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

358348
০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সকাল ১১:০৮
হতভাগা লিখেছেন : আসল সময়ে না বলে এখন বললে কি লাভ হবে ? নিজেকে ভাল ভানুষ হিসেবে পরিচয় দিতে চায় ?
358360
০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ দুপুর ০২:১০
কুয়েত থেকে লিখেছেন : বিচার পতিও বন্ধী, অবৈধ সরকারের নীতির কাছে। আইনের শাসন প্রতিষ্টর জন্য প্রয়োজর বৈধ সরকার যে দেশের সরকারই অবৈধ সে দেশের আইন কি করে বৈধ হয়..? আপনাকে ধন্যবাদ
358389
০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ রাত ০৮:৫১
শেখের পোলা লিখেছেন : হয়ত আরও জটিল রহস্য লুকিয়ে রয়েছে৷ অপেক্ষায় জানা যাবে৷ ধন্যবাদ৷

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File