ফেতনা নয় যুদ্ধ চাই (রম্য)
লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ আসাদ আলী ০২ জানুয়ারি, ২০১৫, ০৬:২০:৩৩ সন্ধ্যা
প্রিয় রাজনীতিকবৃন্দ,
আমার অন্তরের অন্তস্তল থেকে শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন। আমি আপনাদের শাসিত রাজ্যের এক ক্ষুদে প্রজা। আপনাদের শুভাকাক্সক্ষীও বটে। আমি জানি আপনারা নিজ নিজ দল ও দলের আগামী কর্মসূচি নিয়ে বেশ ব্যস্ত ও উত্তেজিত সময় অতিক্রম করছেন। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য রাজনৈতিক অভিধানের যত মাসলা-মাসায়েল ও ধারা-উপধারা আছে তার চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ করছেন। কারণ কেউ জানে না কোন মাসায়েলে প্রতিপক্ষ নাস্তানাবুদ হবে। এমতাবস্থায় আপনাদের বিরক্ত করা এক প্রকার অপরাধই বটে। তাই অনাকাক্সিক্ষত বিরক্তির উদ্রেগ করার কারণে প্রথমেই ক্ষমা প্রার্থনা করছি। দয়া করে ক্ষমা মঞ্জুরপূর্বক এ অধমের কিছু কথা শুনবেন। আপনাদের আমাদের সকলের ভালোর জন্যই কথাগুলো বলা।
আসলে আমি একটি প্রস্তাবনা পেশ করতে চাই। তবে তারও আগে বলতে চাই কেন প্রস্তাবনা পেশ করতে চাচ্ছি। কারণ প্রজা হয়ে রাজার কাছে প্রস্তাব নিবেদন করা যা তা ব্যাপার নয়। উপযুক্ত কারণ না দেখাতে পারলে এ কাজকে রাজা তার অবমাননা হিসেবেও গণ্য করতে পারেন। তাই আমি রাজনীতিক মহোদয়গণের সুদৃষ্টি কামনা করে প্রস্তাব নিবেদনের কারণটি ব্যক্ত করছি। আশা করছি তা শোনার পর মহোদয়গণ আমার প্রতি সদয় হবেন।
নির্বাচনের এক বছর পর এসে আবারও আগামী ৫ জানুয়ারি নিয়ে আপনারা রাজনীতিকবৃন্দ ব্যাপক হম্বিতম্বি শুরু করেছেন। অনেকেই বলছেন এবার নাকি গত বছরের চেয়েও ভয়াবহ আন্দোলন (আমার আশঙ্কা হরতাল, অবরোধ, অগ্নিসংযোগ, বাসে আগুন, মানুষ পোড়ানো ইত্যাদি) হবে। হাত ভাঙ্গা হবে, পাও ভাঙ্গা হবে, কল্লা কাটা হবে। যেখানে পাওয়া যাবে সেখানেই পুঁতে ফেলা হবে। অতীত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এ কথাগুলো শুনে ভয়ে-আতঙ্কে আমার গায়ের লোম তরতর করে খাড়া হয়ে যাচ্ছে। তীব্র শীতেও শরীর ঘেমে যাচ্ছে। সুরা, কেরাত, দোয়া-দরুদ তো কম পড়লাম না কিন্তু কিছুতেই যেন মনকে স্থির করতে পারছি না। কেন জানি বারবার ২০১৩ সালের কথা মনে পড়ছে। ওই দিনগুলোর স্মৃতি মনে পড়লে আজও ভয়ে আমার শরীর কেঁপে ওঠে। জানের ভয় কার নেই বলুন? বাঘ-সিংহেরও জানের ভয় আছে, আমি তো মানুষ, ভয়ই যার বড় শত্র“। কিন্তু এই ভয়ের মধ্যেই হঠাৎ আমার মাথায় একটি প্রশ্নের উদয় হলো; আর ওই প্রশ্ন থেকেই আসলো প্রস্তাবনা।
আমি ভাবলাম- এই যে আমাদের রাজনীতিক মহাশয়রা ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে এতদিন নিজেদের মধ্যে হানাহানি, মারামারি, কাটাকাটি, বোমাবাজী, হামলা, সংঘর্ষ ইত্যাদি করলেন এবং আগামীতেও আরও ব্যাপকভাবে তা চালিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন সেই কর্মকাণ্ডকে আসলে কী নামে অভিহিত করা যায়? যুদ্ধ নাকি ফেতনা? যেমন ধরুন, যুদ্ধ হবার জন্য স্পষ্ট দু’টি পক্ষের প্রয়োজন। সেটা আমাদের রাজনীতিকদের মধ্যে সদা-সর্বদা বিদ্যমান। তেল ও জলের মিশ্রণের মতো একত্রে থেকেও যেন হাজার মাইলের দূরত্বের প্রতিফলন ঘটে তাদের কাজকর্মে। কাজেই যুদ্ধের প্রথম শর্ত অনুযায়ী পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে কোনো চিন্তা করতে হচ্ছে না। কিন্তু সমস্যা হলো অন্য জায়গায়। যুদ্ধের আক্রমণ-প্রতিআক্রমণ হয়ে থাকে স্পষ্ট এবং তা অবশ্যই যুদ্ধের ময়দানে, লোকালয়ে নয়। যারা প্রকৃত যোদ্ধা তারা কেবল শত্র“পক্ষের সেনাকেই আক্রমণ করে, শত্র“ব্যুহ বিধ্বস্ত করাই থাকে তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। তারা কখনোই শত্র“র আক্রমণের জবাবে দস্যুবাহিনীর মতো সাধারণ নিরাপরাধ মানুষের ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে না, জান-মাল কেড়ে নেয় না। এখানে ওখানে চোরা গোপ্তা হামলা করে সাধারণ মানুষের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করে না। এসব কাজকে আর যাই হোক যুদ্ধ বলা চলে না। এগুলো নিঃসন্দেহে ফেতনা, যুদ্ধের চেয়েও যার ভয়াবহতা বহুগুণ বেশি। কারণ যুদ্ধের শেষ আছে ফেতনার শেষ নেই। কোনো কোনো যুদ্ধের পেছনে মহৎ উদ্দেশ্যও থাকে, কিন্তু ফেতনা হয় শুধুই ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থ আদায়ে।
এতসব চিন্তা করে অতি দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে- আপনাদের কাজকর্মগুলোকে ফেতনা ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। আপনারাও একবার ভাবুন। প্রায় সারা দেশ জুড়েই আপনাদের বিশাল কর্মী বাহিনী ছড়িয়ে আছে। আছে থাকুক, সমস্যা নেই। কিন্তু যেই না আপনারা তাদের গলায় কোনো গরম ইস্যু ঝুলিয়ে দেন, পকেট ভর্তি টাকা পয়সা আর ঝোলা ভর্তি ছোটখাট বিস্ফোরকের মাধ্যমে ফুল চার্জ করে মাঠে ছেড়ে দেন তারা মুহূর্তের মধ্যে পরিণত হয় ভয়ংকর ক্যাডার বাহিনীতে। তারা রাতের অন্ধকারে প্রতিপক্ষ দলের উপর হামলা করে, বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেয়, মুহূর্তে হাওয়ায় মিশে যায়। আবার দেখা হয় রাজপথে, হাতে ককটেল কিংবা পেট্্রল বোমা। ছুঁড়েই উধাও। পাছে শত্র“পক্ষের হাতে ধরা পড়ে যেতে হয়। একবার ধরা পড়লে সাপ পেটানো থেরাপি উপভোগ করতে হবে তা সকলেই জানে। এদিকে আরেক পক্ষ তো জ্বলে-পুড়ে মরছে। ‘ধর শালারে মার শালারে’ ছাড়া মুখে কথাই নেই। এদের অতুলনীয় মেধা। সন্দেহভাজন ব্যক্তির চেহারা দেখে কোন পার্টির লোক তা নির্দ্বিধায় বলে দিতে পারে। তারপর শত্র“পক্ষের হলে তো বুঝতেই পারছেন। এখন বলুন এদের এই দেশ কাঁপানো কর্মকাণ্ডকে কেউ যুদ্ধের মর্যাদা দিতে পারে? আচ্ছা, এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে না। আমাকে এখন বলুন এই হামলা, সংঘর্ষ, বোমাবাজী, জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর, হত্যা- এসবের শেষ কোথায়? আগামী দশ বছর বা বিশ বছর পর আপনাদের এই ফেতনাবাজী শেষ হবে- এমন কোনো সময় বেঁধে দিতে পারবেন কি? পারবেন না। যেহেতু পারবেন না কাজেই শুনুন। আমি একটি ভালো আইডিয়া বের করেছি। এ আইডিয়া দ্বারা খুব অল্প সময়ের মধ্যে সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বলে আমি মনে করি।
আমি দেখলাম- আপনারা শুধু শুধুই নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে দলবাজী করে নিজেদেরই বদনাম কামাই করছেন। এর চেয়ে বরং একটি কাজ করুন- আপনারা দু’পক্ষ একে অপরের সাথে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করে দিন। দেখুন আপনাদের কাজকর্মের ফলে দেশে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে তাকে এক প্রকার যুদ্ধাবস্থাই বলা চলে। কিন্তু এতে কারোই কোনো লাভ হচ্ছে না। বরং সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিসহ হয়ে পড়ছে। এর চেয়ে কি এটাই ভালো নয় যে, আপনারা এই বিরোধকে একটি সুশৃঙ্খল ধারায় প্রবাহিত করবেন? আজ আপনারা যারা নিজেদের বীরত্ব দেখাতে এখানে ওখানে বোমা ফাটান অথবা বিরোধী পক্ষের একজনকে একা পেয়ে নিজেদের কব্জার জোর প্রদর্শন করেন তাদেরও একটি সুযোগ আসবে নিজেদের প্রকৃত শক্তি বা বীরত্ব প্রদর্শনের। কার হাতে কত জোর আছে আমরা আম পাবলিকরাও আরেকটু ভালোভাবে গ্যালারী থেকে দেখার সুযোগ পাব। যুদ্ধ করার মতো কারণের তো অভাব নেই। সকাল-বিকাল, ঘণ্টায় ঘণ্টায় কত ইস্যুই না সৃষ্টি হয়। ওরই একটিকে সূত্র ধরে যুদ্ধ শুরু করুন। হয়তো ভাবছেন কীভাবে যুদ্ধ করবেন, যুদ্ধের নিয়ম-শৃঙ্খলা কী হবে, ফলাফল কী হবে? এসব নিয়ে কোনো চিন্তার প্রয়োজন নেই। ওটা আমি প্রস্তুত করেই রেখেছি। যখন ভাবলাম আপনাদেরকে ফেতনা সৃষ্টি বন্ধ করে যুদ্ধ করার প্রস্তাব দেব তখন থেকেই আমি আর এক মুহূর্তও সময়ক্ষেপণ করি নি। কীভাবে যুদ্ধ হবে তার একটা রূপরেখা মোটামুটি নিজের মতো করে দাঁড় করিয়ে ফেলেছি। এ নিয়ে আপাতত আপনাদের কোনো চিন্তা করতে হচ্ছে না। অবশ্য পছন্দ না হলে প্রয়োজনীয় পরিমার্জন-পরিবর্ধন করে নিতে পারবেন, এ ক্ষেত্রে কপিরাইট আইন প্রযোজ্য হবে না। এখন শুনুন প্রস্তাবিত সম্ভাব্য যুদ্ধের পালনীয় নিয়ম-শৃঙ্খলাসমূহ:
যুদ্ধ হবে লোকালয়ের বাইরে কোনো এক জনশূন্য স্থানে। এবার আর রাস্তা-ঘাটে বা হাটে-বাজারে যুদ্ধের সুযোগ পাবেন না। এ জন্য আপনারা সারা দেশ খুঁজে শুকিয়ে যাওয়া কোনো নদীর চর বেছে নিতে পারেন। এ যুদ্ধে যোগদান করার জন্য কোনো সাধারণ মানুষের উপর জোর করা যাবে না এবং যুদ্ধকালীন সময়ে এমন কিছু ঘটানো যাবে না যাতে যুদ্ধসংশ্লিষ্ট নয় এমন কারও সামান্য পরিমাণ ক্ষতি সাধিত হয়। তবে যুদ্ধের পূর্বে উভয় পক্ষই নিজ নিজ শক্তি-সামর্থ্য অনুযায়ী ক্যাম্পেইন করে, হাটে-বাজারে, বাড়ী-বাড়ী ঘুরে মানুষকে নিজেদের পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য অনুপ্রাণিত করতে পারবেন। কিন্তু মানুষ যাকে পছন্দ হয় কেবল তার পক্ষেই লড়বে। এমনও হতে পারে যে, যুদ্ধে প্রাণের ভয় আছে দেখে হয়তো খোদ নিজ দলের অনেক হোমড়া-চোমড়া নেতাও দল ত্যাগ করে নির্বিবাদী সাধারণ মানুষ হয়ে যেতে পারেন, আবার এমনও হতে পারে যে, দেশের ষোল কোটি মানুষই আট কোটি করে দু’ভাগ হয়ে জীবনের মায়া ত্যাগ করে তাদের পছন্দের দলকে জয়ী করানোর জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। উভয় পরিস্থিতির জন্যই আপনাদেরকে প্রস্তুত থাকতে হবে। এ যুদ্ধের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- যুদ্ধে কোনো সরকারি বাহিনী জড়াবে না, কোনো সরকারি অস্ত্র ব্যবহৃত হবে না, রাষ্ট্রের এক পয়সাও কোনো পক্ষ খরচ করতে পারবে না। যুদ্ধের সমস্ত আয়োজন করবেন আপনারা। যেহেতু সরকারি বাহিনী ও অস্ত্র-শস্ত্র কোনো নির্দিষ্ট দলের সম্পত্তি নয় কাজেই ওসব ব্যবহার করার অনুমতি কেউ পাবে না। যদি আপনারা প্রয়োজনীয় অস্ত্র সংগ্রহ করতে না পারেন তাহলে এতদিন ফেতনা সৃষ্টি করার জন্য যে উপাদানগুলো ব্যবহার করতেন যেমন- ইট-পাটকেল থেকে শুরু করে লগি-বৈঠা হয়ে ককটেল পর্যন্ত যা কিছু আছে এসব নিয়েই যুদ্ধ করবেন। যুদ্ধ শেষে অবশ্যই কোনো না কোনো পক্ষকে মৃত্যুবরণ করতে হবে অথবা বন্দী হয়ে যুদ্ধজয়ী পক্ষের করুণার উপর ভরসা করে বেঁচে থাকতে হবে। অর্থাৎ যুদ্ধ শেষে জয়ী হবে মাত্র একটি পক্ষ এবং এই বঙ্গরাজ্যের উপর খবরদারিও করবে সেই পক্ষটিই। তারা হবে রাজ্যের একচ্ছত্র সার্বভৌম ক্ষমতাধারী। কেননা যুদ্ধবিজয়ী জাতির সিদ্ধান্তই বিজিত রাজ্যের বৈধ সিদ্ধান্ত- এটাই ইতিহাস স্বীকৃত পন্থা। কাজেই দেশের সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব, বিডিয়ার থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ সকলেই তখন ওই যুদ্ধজয়ী দলের আনুগত্য করতে বাধ্য থাকবে। ওই দল যদি কোনোদিন চায় তারা ক্ষমতা অন্য কোনো দলকে হস্তান্তর করবে তাহলেই কেবল অন্য কেউ ক্ষমতার অধিকারী হতে পারবে, অন্যথা কেয়ামত পর্যন্ত ওই যুদ্ধজয়ী দলই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকবে।
এ হচ্ছে আমার প্রস্তাবিত যুদ্ধসংক্রান্ত নিয়ম-শৃঙ্খলা। আগেই বলেছি, আপনাদের পছন্দ-অপছন্দের নিরিখে এটাকে পরিবর্ধন-পরিমার্জন করতে পারবেন কিন্তু দয়া করে আমার প্রস্তাবনাটা বিবেচনা না করে অট্টহাসি দিয়ে উড়িয়ে দেবেন না। অনেক হয়েছে আর নয়। এবার অন্তত আমাদের মতো প্রজাসাধারণের প্রতি সদয় হোন।
বিষয়: বিবিধ
১৬৮১ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন