তথ্যপ্রযুক্তি-যুগের হাওয়া লাগল গায়ে!

লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ আসাদ আলী ০৮ ডিসেম্বর, ২০১৪, ০৬:২৮:৪৫ সন্ধ্যা

‘মানুষ বড্ড বুদ্ধিমান প্রাণী’- তার প্রমাণ পৃথিবী ইতোমধ্যেই পেয়েছে। কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিতে পেরে মানুষ আজ আনন্দে আটখানা। আছে অহংকারও। বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীর প্রবহমান সময়কে মানুষের অহংকারের শতাব্দী বলাটা অবান্তর হবে বলে মনে হয় না। এ অহংকার হচ্ছে কৃতিত্বের অহংকার, সাফল্যের অহংকার। কী করেনি মানুষ? বহুকিছু করেছে। বহু রহস্যের দ্বার উন্মোচন করেছে। দুর্বোধ্য বিষয়ের সহজ-সাবলীল ব্যাখ্যা প্রদান করেছে। কল্পনা ও স্বপ্নকে সকল প্রকার সীমারেখার আচ্ছাদন হতে মুক্ত করেছে। মানুষ সব পারে। আজ পারেনি কাল পারবে, কাল না পারলে পরশু পারবে। এটা পারবে না, ওটা সম্ভব নয়- এমন কথা বলার যুগ শেষ হয়ে গেছে।

মানুষের এই অগ্রযাত্রায় ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি’ এক বিস্ময়ের নাম। পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশন-স্যাটেলাইটের এই যুগে পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা খবরাখবর আমরা পাচ্ছি হাতের নাগালে। অতীতে, অন্ততপক্ষে কয়েক শতাব্দী আগে এমনটা কল্পনা করাও ছিল বোকামির নামান্তর। পৃথিবী ক্রমেই ছোট হয়ে যাচ্ছে। এর মানে এই নয় যে, কয়েক শতাব্দীর মধ্যে পৃথিবী একটি ছোট্ট মার্বেলে রূপ লাভ করবে, আর আমরা কোটি কোটি মানুষ একজনের সাথে আরেকজন জড়িয়ে চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে পড়ে থাকবো। আসল কথা হলো, তথ্য-প্রযুক্তির ব্যাপক বিকাশের ফলে মানুষ দূরে বসে থেকেও সহজেই একে অপরের কাছে আসতে পারছে। কাছে আসছে মোবাইল, টেলিভিশন, রেডিও, ইন্টারনেট, স্যাটেলাইট ইত্যাদির মাধ্যমে। যেখানে আগে এক গ্রামে ঘটে যাওয়া তুলকালাম কাণ্ড অপর গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছতে কয়েক দিনের সময়ের ব্যাপার ছিল সেখানে আজ এক মহাদেশের ছোট্ট একটি দেশে ঘটে যাওয়া সড়ক দুর্ঘটনা পর্যন্ত অন্যান্য মহাদেশের মানুষ ঘরে বসে জানতে পারছে, দেখতে পারছে। এটাকেই বলা হচ্ছে পৃথিবীর ছোট হয়ে যাওয়া, বিশ্বের নামকরণ করা হয়েছে- বিশ্বগ্রাম, ওয়ার্ল্ড ভিলেজ।

তৃতীয় বিশ্বের দেশ বলে পরিচিত বাংলাদেশেও লেগেছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ছোঁয়া। আমাদের দেশও তথ্য-প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাচ্ছে, তবে গতিটা বেশ অসামঞ্জস্যপূর্ণ। নিন্দুকেরা এটাকে বলেন কচ্ছপের গতি। আর আশাবাদীরা খরগোশ কচ্ছপের দৌড় প্রতিযোগিতার গল্পে অনুপ্রাণিত হয়ে বলেন- লক্ষ্য ঠিক থাকলে কচ্ছপের গতিতেই আসবে সফলতা। হয়তো আসবে। কিন্তু গতিহীনতার পেছনে কারও ব্যর্থতা থাকলে সেটাও খতিয়ে দেখা দরকার বলে অনেকে অভিমত দিয়ে থাকেন।

তবে এটা মানতে হবে যে, যেটুকু তথ্য-প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে তাতেই দেশের আমূল পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে। আজ থেকে বছর দশেক আগেও আমাদের দেশে মিডিয়ার এত আধিক্য ছিল না। গ্রাম-গঞ্জের এবং শহরেরও অধিকাংশ মানুষকেই দেশের খবরাখবরের জন্য বিটিভির রাত আটটার খবরের উপর নির্ভর করতে হতো। এছাড়া টেলিভিশনে প্রচারিত নাটক, চলচ্চিত্র, গান-বাজনা, প্রামাণ্য অনুষ্ঠান ইত্যাদিও ছিল সীমিত পরিসরে। কিন্তু আজ এক দশক পেরিয়ে আমরা টিভি চ্যানেলের ভিড়ে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হবার অবস্থায় পৌঁছেছি। দেশে এখন প্রায় গোটা তিরিশেক স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল, আছে শত শত জাতীয় ও আঞ্চলিক দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্র-পত্রিকা। বিবিধ টিভি চ্যানেলের বিবিধ অনুষ্ঠান। কোনো চ্যানেল সিনেমা, নাটককেন্দ্রিক; কোনোটা সারাদিন শুধু গানই প্রচার করছে; কোনোটা খেলা প্রচার করছে; কোনোটা আবার ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে শুধু সংবাদ, সংবাদ বিশ্লেষণ ও টক শো প্রচার করছে। অনলাইন পত্রিকার সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন অনলাইন পত্রিকা যাত্রা শুরু করছে। ইদানীং অনলাইনভিত্তিক টিভি চ্যানেলেরও আনাগোনা শোনা যাচ্ছে। তবে এ দেশে দেশীয় চ্যানেলগুলোর চেয়ে বিদেশি চ্যানেলগুলোরই কদর দেখা যায় বেশি। টিভি চ্যানেল ও পত্র-পত্রিকার পর বাংলাদেশের তথ্য-যোগাযোগ প্রযুক্তির আকাশে হঠাৎ জ্বলে ওঠা নক্ষত্রের নাম ফেসবুক। অল্প দিনের ব্যবধানে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ‘ফেসবুক’ বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বর্তমানে প্রায় ১ কোটি বাংলাদেশি ফেসবুক ব্যবহার করছেন। কী হয় না ফেসবুকে! যে একটি স্থানে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ একত্রিত হচ্ছে এবং সারা দেশের ঘটনাবলী ও তার বহুমুখী বিশ্লেষণ একসাথে পাচ্ছে, তা হচ্ছে ফেসবুক। বন্ধু নির্বাচন, আড্ডা দেওয়া, রাজনৈতিক জ্ঞানগর্ভ স্ট্যাটাস দিয়ে হোমপেজ সরগরম রাখা থেকে শুরু করে রাজপথ সরগরম রাখার প্রচেষ্টা বা অপচেষ্টা কোনোটাও বাদ নেই। আবার সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম বলা হলেও ফেসবুক থেকে এখন ব্যবসায়ীরাও বিশাল সুবিধা আদায় করে নিচ্ছে।

এই আমাদের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির একটি দিক অর্থাৎ আপতদৃষ্টে উপকারের দিক। এবার আলোচনা করব অপর দিকটি নিয়ে, যাকে অকল্যাণের দিক বলা যেতে পারে। এটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না যে, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আমাদের জীবনে একটি নীরব বিপ্লব সম্পন্ন করে ফেলেছে। আমাদের জীবন-ধারার অধিকাংশই পরিবর্তন করে ফেলেছে। আধুনিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উদ্গাতা হচ্ছে পশ্চিমা বিশ্ব। পশ্চিমা বিশ্বকে অনুকরণ করে আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর তথ্য-প্রযুক্তি হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগোচ্ছে। এতে কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু সমস্যা বাঁধল তখন- যখন দেখা গেল আমাদের দেশে পশ্চিমা প্রযুক্তির সাথে সাথে পশ্চিমা সংস্কৃতি তথা ধ্যান-ধারণা, দৃষ্টিভঙ্গিও আমদানি করার চেষ্টা শুরু হলো। একবারও ভাবা হলো না যে, পশ্চিমা বিশ্বের সমাজব্যবস্থা আজ যে রূপ ধারণ করেছে তা একদিনে হয় নি। হয়েছে দীর্ঘ সময়ের ক্রমাগত বিবর্তনের মধ্য দিয়ে। ঐ সমাজ-সংস্কৃতি ও আমাদের সমাজ-সংস্কৃতি শুধু ভিন্নই নয়, একেবারে বিপরীতমুখী। এখানে ওটাকে জোর করে খাপ খাওয়ানো সম্ভব নয়। সম্ভব নয় বলেই আজ দেখা যাচ্ছে, আধুনিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সংস্পর্শ পাওয়া দেশের যুবসমাজের একটি বিশাল অংশ না পশ্চিমা আদর্শের ধারক হচ্ছে, না তাদের চরিত্রে এ দেশীয় স্বকীয়তা বজায় থাকছে- এরা পরিণত হচ্ছে এক প্রকার পরগাছায়। এরা পশ্চিমা আদর্শ অর্থাৎ চুরি করব না কারণ এটা দেশের সম্পদ- এই শিক্ষা যেমন পাচ্ছে না, তেমনি চুরি করলে পাপ হবে- প্রাচ্যের এই সাধারণ শিক্ষাটাও হারাচ্ছে। পরিণতিতে তারা জাতির ক্ষতি হয় এমন কাজ নির্বিকারভাবে করতে পারছে।

বাংলাদেশে ক্রমাগতহারে সামাজিক ও পারিবারিক অপরাধ বাড়ছে। পারিবারিক কলহের জের ধরে বা আর্থিক ও জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধে গ্রামাঞ্চলে হত্যা-সংঘর্ষের পরিমাণ বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। মানুষের মধ্যে ভয়ানক লোভ-লালসার বিস্তার লক্ষ করা যাচ্ছে। বাবা-মাকে জবাই দেওয়া, স্ত্রী-পুত্রকে হত্যা করা, কিংবা পরকীয়ার জেরে স্বামী-সন্তানকে হত্যা করার ঘটনা এখন প্রতিনিয়ত ঘটছে। বাংলাদেশে এ ধরনের নৃশংস ও অমানবিক ঘটনার সংখ্যা অতীতে খুব বেশি ছিল না। ইদানীং এসব বেড়ে গেছে এবং বেড়ে গেছে অতি আশঙ্কাজনক হারে। জেল-মামলা, আইন-আদালত কোনো কিছুই কাজে আসছে না। এ ধরনের পারিবারিক কলহের পেছনে ভিনদেশি টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত সিরিয়ালের একটি বড় প্রভাব আছে বলে অনেকে মতামত প্রকাশ করছেন। এ নিয়ে বহু লেখালেখিও হয়েছে। কিছু জায়গায় মানববন্ধনসহ বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয়েছে। বিশিষ্ট জনরা মনে করছেন, এসব বিদেশি চ্যানেলগুলো বাংলাদেশে চলতে দেয়া না গেলে হয়তো কিছুটা হলেও পারিবারিক কোন্দল প্রশমিত হবে।

সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমেও ইদানীং অসামাজিক কাজের প্রমাণ মিলছে। শোনা যাচ্ছে দেশের একটি বিরাট সংখ্যক তরুণ ক্রমেই এই মিডিয়াতে আসক্ত হয়ে পড়ছে। একবার ফেসবুক রোগ পেয়ে বসলেই আর রক্ষা নেই। নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে ইচ্ছামত ইন্টারনেট প্যাকেজ নিয়ে সারাদিন বসে থাকতে হয় কম্পিউটার-ল্যাপটপ বা মোবাইলের স্ক্রিনের সামনে। এ নিয়ে প্রায়শই বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে অভিভাবকদের। এ ছাড়া ফেসবুক ব্যবহার করে রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতা, পরীক্ষার গোপন প্রশ্নপত্র প্রকাশ, জঙ্গি কর্মকাণ্ড পরিচালনা ও ধর্মানুভূতিতে আঘাতসহ বিবিধ অপকর্ম করে চলেছে অনেকে। ফলে ফেসবুকের কল্যাণকর দিকের পাশাপাশি অকল্যাণকর দিক চিন্তা করে শঙ্কা প্রকাশ করছেন সমাজচিন্তকরা। অবশ্য ফেসবুক বন্ধ হয়ে যাক- এটাও কারও কাম্য নয়।

এর উপর আবার ভয়াবহ বিপদ দাঁড়িয়েছে ইন্টারনেটে পর্ণ সাইটগুলো। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা হ্যান্ডসেটের মাধ্যমে খুব সহজেই হাতের কাছে পেয়ে যাচ্ছে এসব অরুচিকর পর্ণ ভিডিও। অনেকেই রীতিমত তাতে আসক্ত হয়ে পড়ছে। ফলে জীবনের শুরুতেই তাদের সর্বাধিক মূল্যবান যে জিনিস অর্থাৎ চরিত্র- তারা তা হারিয়ে ফেলছে। স্বাভাবিক জীবনযাপনের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়ে তারা প্রবেশ করছে অস্বাভাবিক এক অন্ধকার জগতে। এর পরিণাম প্রাথমিকভাবে বোঝা না গেলেও, একটি পর্যায়ে তা ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও জাতির জন্য ভয়ানক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে; যার ছটা ইতোমধ্যেই লক্ষ করা যাচ্ছে।

এই সকল বিষয়কে একত্র করলে যা দাঁড়ায় তাতে আধুনিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সামনে বিরাট এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে দেয়। আমরা এর ব্যবহার নিয়ে যতই উচ্ছ্বসিত হই, অপব্যবহার নিয়ে তার খুব কমই মাথা ঘামাই। এ থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সমস্যা কেবল দু-একজনের নয়। জাতীয় সমস্যা। তাই এর সমাধানে ঐক্যবদ্ধ জাতীয় প্রচেষ্টা অপরিহার্য। এখানে দৃষ্টিভঙ্গির প্রশ্ন আসে। বিদেশি সংস্কৃতি-সভ্যতার প্রতি আমাদের অনুরাগ জন্ম নিয়েছে এবং নিজেদের সম্পর্কে হীনম্মন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। যাবতীয় বিপর্যয়ের এটা এক বড় কারণ। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে আমরা অবশ্যই এগিয়ে যাবো কিন্তু নিজ সত্তাকে বিসর্জন দিয়ে নয়, বিদেশ সংস্কৃতির আগ্রাসনকে নীরবে সমর্থন দিয়ে নয়। মনে রাখতে হবে- বাঙালির সংস্কৃতি-সভ্যতা অন্য কোনো জাতির চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। বাঙালির ব্যক্তি মূল্যবোধ, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক অন্যান্য জাতির জন্য অনুসরণীয় হবার যোগ্য। কাজেই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অপব্যবহার করে বৈদেশিক সংস্কৃতির আগ্রাসন ঘটানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই। জাতির সামগ্রিক কল্যাণের জন্য এখনই এই অপচেষ্টা রুখে দেওয়া অনিবার্য।

(দৈনিক বজ্রশক্তি পত্রিকায় প্রকাশিত ০৭.১২.১৪)

বিষয়: বিবিধ

১৪১৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File