ধর্ম কাকে বলে, প্রকৃত ধার্মিক কে?

লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ আসাদ আলী ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০৩:২৪:২১ দুপুর

কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রাক্তন অধ্যাপক শৈলেন্দ্র বিশ্বাস এম. এ প্রণীত সংসদ্ বাঙ্গালা অভিধানে ধর্ম শব্দের অর্থ করা হয়েছে- ‘স্বভাব, শক্তি, গুণ’ অর্থাৎ বস্তুর অভ্যন্তরস্থ সেই নীতি যা সে মেনে চলতে বাধ্য থাকে। যেমন আগুনের ধর্ম হলো পোড়ানো, পানির ধর্ম ভেজানো ইত্যাদি। আগুন ও পানির এই গুণ সনাতন শাশ্বত। লক্ষ বছর আগেও আগুন পোড়াতো, লক্ষ বছর পরও পোড়াবে। এটাই তার ধর্ম।

এখন প্রশ্ন হলো ধর্মের সংজ্ঞা যদি এই-ই হয় তাহলে মানুষের ধর্ম কী? মানুষের ধর্ম হলো তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, গুণ, স্বভাব। আর সেটা হচ্ছে মনুষ্যত্ব। মানুষের চারিত্রিক প্রধান বৈশিষ্ট্য, সভাব, গুণ যাই বলা হোক না কেন সেটা হচ্ছে মনুষ্যত্ব, মানবতাবোধ। সেটা কী? সেটা হলো সৃষ্টির প্রতি সহানুভূতি, অন্য একজন মানুষের সুখ-দুঃখ অনুভব করা। অন্যের দুখে দুঃখিত হওয়া, অন্যের আনন্দে আনন্দিত হওয়া। এটাই মানুষের বৈশিষ্ট্য, এটাই তার চারিত্রিক নীতি যা তার মানুষ হবার পরিচয় বহন করে। সুতরাং মানুষের ধর্ম দাঁড়াল মানবতা। এখানে অন্য কোনো শর্ত রইল না। কারণ সহমর্মিতা কোনো শর্তের দ্বারা আবদ্ধ নয়। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি যদি কপট হয়, অধর্মী হয়, এমনকি নাস্তিকও হয়, তারপরও তার কষ্টে অপর একজন মানুষের সহানুভূতি জাগ্রত হয়। এটাই জগতে মানবজাতির চিরন্তন শাশ্বত নিয়ম, নীতি। আর মানুষের এই নীতির নামই মানবধর্ম। কারণ, সে কষ্ট পায় মানবতাবোধের কারণে। যতক্ষণ একজন মানুষ অন্য একজন মানুষের অসহায়ত্বে, দুঃখে-কষ্টে, রোগে-শোকে, অশান্তিতে নিজে কষ্ট অনুভব করে ততক্ষণ সে ব্যক্তি ধার্মিক হিসেবেই পরিগণিত হবার যোগ্য। তাকে অধার্মিক বলার কোনো কারণ নেই। এতে সে স্রষ্টার পূজা-উপাসনা-অর্চনা করুক আর না করুক।

কিন্তু যদি অন্যের দুঃখ, ব্যথা, যন্ত্রনা কোনো মানুষের হৃদয়কে বিগলিত না করে, আর্তপীড়িতের হাহাকার তাকে আন্দোলিত না করে তাহলে বুঝতে হবে তার মানবতাবোধ নিস্কৃয় হয়ে গেছে, তার মনুষ্যত্ব লোপ পেয়েছে। অর্থাৎ সে ব্যক্তি অধার্মিকে পরিণত হয়েছে। যদি সে স্রষ্টার উপাসনা-এবাদত, পূজা অর্চনা করে আকাশ-পাতাল পরিপূর্ণও করে ফেলে তথাপি সে ধার্মিক হতে পারবে না। স্রষ্টার দৃষ্টিতে সে অধার্মিকও রোয়ে যাবে। এটাও জগতেরই চিরন্তন সনাতন নিয়ম। স্রষ্টার বেঁধে দেওয়া এই নিয়মের কোনো ব্যত্যয় নেই। দাহ্যশক্তিহীন আগুন যেমন ধর্মহীন, মূল্যহীন, তেমনি মনুষ্যত্বহীন বিবেকহীন মানবতাহীন মানুষও ধর্মহীন, মূল্যহীন। এই পৃথিবীতে মানুষের মর্যাদা নিয়ে বসবাস করার অধিকার তার নেই। এদের সম্পর্কেই আল কোর’আনে বলা হয়েছে- তারা পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট। কারণ পশুরও একটি ধর্ম আছে, কিন্তু তার তাও নেই।

এরাই সেই ব্যক্তি যারা সমাজের শত অন্যায়-অবিচার, অত্যাচার, যুলুম, শোষণ, বৈষম্য, হানাহানি স্বচক্ষে দেখার পরও আনন্দচিত্তে বলে থাকে- ‘আমরা তো ভালোই আছি। আমাদের তো কোনো সমস্যা হচ্ছে না। আমরা কেন শুধু শুধু ঝামেলায় জড়াবো?’ এরা যখন দামি গাড়ি-বাড়ি ব্যবহার করেন, দামি হোটেলের দামি খাবার খান, মহামূল্যবান পোশাক পরেন তখন একটি বারও সমাজের বুভূক্ষ, হাড্ডিসার, আর্তপীড়িত মানুষের করুণ চিত্র তাদের নয়নে ভাসে না, অন্তরে দাগের সৃষ্টি করে না, সমবেদনা জাগ্রত হয় না। এদের শরীর অর্থ-সম্পদের দাস, আর আত্মা মৃতপ্রায়। আবার এক শ্রেণি রোয়েছে যাদের মন-মগজ মসজিদ-মন্দির-গীর্জা-প্যাগোডার চার-দেয়ালের ভেতরে আবদ্ধ। এরা সারাদিন রোজা রাখেন, গভীর রাতে তাহাজ্জুদ পড়েন, পূজার বেদিতে প্রসাদ অর্পন করেন, ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেন, রোজ রোজ জীবে প্রেম করার শপথ বাক্য পাঠ করেন, মনোযোগ দিয়ে বুদ্ধং শরনং গচ্ছামি যপেন, শ্রদ্ধার সাথে ধর্মগ্রন্থ পাঠ করেন, কিন্তু ঐ মসজিদ ঐ মন্দির, ঐ প্যাগোডা বা ঐ গীর্জার পাশেই যে বুভূক্ষ হাড্ডিসার দুর্বল মানুষটি দু’দিন হলো না খেয়ে পড়ে আছে তার দিকে ভুলেও চেয়ে দেখেন না। সমাজের অত্যাচারিত, মজলুম, আর্তপীড়িত মানুষের ক্রন্দদের দিকে ভ্রক্ষেপ করেন না। ওটা তাদের কাছে দুনিয়াদারী। তারা দুনিয়াদারী করেন না, সদা ধর্মপালনে রত থাকেন। এরাও প্রকারান্তরে ঐ শ্রেণির মধ্যেই পড়ে যাদেরকে স্রষ্টা পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট বলেছেন। দাড়ি, টুপি, পাগড়ি, পয়জামা, রোজারি, গেরুয়া বষন এসব বেশ ভুষা ধারণ কোরে ধার্মিক হওয়া যায় না। ধার্মিক হতে হলে ধর্ম তথা মানবতাকে ধারণ করতে হয়। কাজের মাধ্যমে মানবতার প্রতিফলন ঘটাতে হয়। মানুষের কল্যাণের জন্য, মানবতার মুক্তির জন্য আত্মবিসর্জন দিতে হয়। তবেই স্রষ্টার সন্তুষ্টি, তবেই স্বর্গপ্রাপ্তি।

আজকে আমরা ধার্মিক বলতে মানবতা বা মনুষ্যত্বকে বুঝি না, বুঝি ঐ দাড়ি, টুপি, পাঞ্জাবি তথা ধর্মীয় বেশ-ভূষা ধারণকারীদেরকে। অথচ আল্লাহ বলেছেন, আমি মানুষের পোশাক দেখি না, দেখি অন্তর ও তার কাজ। আল্লাহ মানুষকে এবাদত করার জন্য সৃষ্টি করেছেন। কী এই এবাদত? এবাদত মানে কি নামাজ-রোজা, পূজা-পার্বন, প্রার্থনা, উপবাস? মোটেও নয়। মানুষের নামাজ রোজা, পূজা অর্চনা স্রষ্টার কোনো কাজে আসে না। তিনি অমুখাপেক্ষী, তিনি আমাদের উপাসনার কাঙাল নন। তাই তিনি এই উপাসনা করার জন্য আমাদেরকে সৃষ্টি করেন নি। তিনি যে এবাদতের কথা বলেছেন তার অর্থ হলো স্রষ্টার দেওয়া বিধান মোতাবেক নিজেদের জীবন পরিচালনা করে অন্যায়-অবিচার, অশান্তিমুক্ত জীবনযাপন করা। মানুষ শান্তিতে থাকলেই স্রষ্টার সন্তুষ্টি। আর মানুষের অশান্তিতে স্রষ্টার অসন্তুষ্টি। তাই তিনি যুগে যুগে অবতার-নবী-রসুল পাঠিয়ে মানুষকে শান্তির পথনির্দেশ করেছেন। এই এবাদাত করার জন্য আপন লোকের সাথে লড়ায় করছেন অবতাররা, মহামানবরা। তারা বসে বসে স্রষ্টার পূজা করে নি, তারা কার্যত পূজা করেছেন মানবতার, মানুষের কল্যাণের। তাদের জীবন ছিল সংগ্রামী, বহির্মুখী। বুদ্ধ (আ) এর কীসের অভাব ছিল? তিনি কি পারতেন না তার সম্পদশালী পিতাকে বলে রাজভবনের কোনো এক জায়গায় একটি মন্দির বা উপাসনালয় নির্মাণ করে আরাধনা, পূজা-অর্চনা করতে? বেশ পারতেন। কিন্তু তিনি কী করেছেন? তিনি রাজ্য, স্ত্রী-সন্তান, সুখ, আরাম-আয়েশ ত্যাগ করে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি দিয়েছেন, হাসিমুখে গৃহত্যাগ করেছেন কেবলমাত্র মানুষের শান্তির উপায় অন্বেষণ করার জন্য, মানবতার তাগিদে। অথচ তার অনুসারীরা আজ কী করছে?

কৃষ্ণ (আ) যুদ্ধ করলেন আপন মামার বিরুদ্ধে, যুধিষ্ঠির (আ) যুদ্ধ করলেন আপন আচার সাথে, এব্রাহিম (আ) যুদ্ধ করলেন তার বাবার বিরুদ্ধে, মুহাম্মাদ (সা) যুদ্ধ করলেন চাচাদের বিরুদ্ধে। এটাই হলো মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের সংগ্রাম, অধর্মের বিরুদ্ধে ধর্মের সংগাম, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের, অশান্তিকে শান্তি দিয়ে প্রতিস্থাপিত করার আপ্রাণ প্রচেষ্টা। এটাই মানবতার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। তারা এত বড় ত্যাগ সাধন করতে পেরেছিলেন বলেই তারা অবতার, পবিত্র, নিষ্পাপ। তারা স্বর্গবাসী। কিন্তু বর্তমান মানবজাতির কাছে তাঁদের সেই মানবতার কল্যাণে কৃত সংগ্রামের কোনো মূল্যই নেই, কোনো অর্থই নেই। এদের কাছে ধর্মের সংজ্ঞা পাল্টে গেছে। সংগ্রামী অবতার-নবী-রসুলদের অনুসারী দাবিদাররা এখন মানবতার কল্যাণে নিস্কৃয়, তবে উপাসনা, পূজা-অর্চনা, নামাজ-রোজায় খুব সক্রিয়!

বিষয়: বিবিধ

১৫২৭ বার পঠিত, ১৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

264235
১২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ দুপুর ০৩:২৮
দুষ্টু পোলা লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ
১২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ দুপুর ০৩:৩৬
207760
মোহাম্মদ আসাদ আলী লিখেছেন : ধন্যবাদ
264243
১২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ দুপুর ০৩:৩১
চোথাবাজ লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
১২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ দুপুর ০৩:৩৭
207761
মোহাম্মদ আসাদ আলী লিখেছেন : ধন্যবাদ
264252
১২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ বিকাল ০৪:০৭
সন্ধাতারা লিখেছেন : অনেক অনেক ধন্যবাদ খুব ভালো লাগলো
১২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ বিকাল ০৪:৫০
207773
মোহাম্মদ আসাদ আলী লিখেছেন : আপনাকেও ধন্যবাদ
264258
১২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ বিকাল ০৫:১০
পাতা বাহার লিখেছেন : ধর্ম বিষয়ে এই লেখক, গুরুজীর লেখাকে নকল করেছেন।

গুরুজীর লেখাধমর্ম পরিচয় পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
১২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:২৪
207823
মোহাম্মদ আসাদ আলী লিখেছেন : গুরুজী নামের কোনো ব্যক্তির লেখা আমি আজ অবধি পড়ি নি, কপি করা তো পরের কথা। কারও সম্পর্কে মন্তব্য করার পূর্বে আরও সচেতন হবেন আশা রাখি।
১২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:৩৪
207827
পাতা বাহার লিখেছেন : গুরুজী চার বছর ধরে ধর্ম বিষয়ে যে দর্শণ দিয়ে ব্লগ লিখেছেন। ধর্ম বিষয়ে আপনার এই লেখাটি, গুরুজীর ধর্ম বিষযে লেখার নকল হয়েছে। এটা আমার দেওয়া লিংকে গিয়ে পড়ে দেখলে, সকলেই বুঝতে পারবে। আপনি গুরুজীর লেখা পড়েছেন কি পড়েন নাই, এটা প্রমাণ করা জরুরী নয়।
264284
১২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:০১
দিশারি লিখেছেন : ভালো লাগলো
১২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:২৪
207824
মোহাম্মদ আসাদ আলী লিখেছেন : ধন্যবাদ
264321
১২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ০৯:০৪
বুড়া মিয়া লিখেছেন : হুম, আসাদ ভাই, অনেকদিন পর সুন্দর কথা বলেছেন ...

তবে একটা বিষয় হচ্ছে – বুদ্ধ, কৃষ্ণ এর ব্যাপারে আপনার (আঃ) ব্যবহার; যেহেতু এটার কোন অকাট্য প্রমাণ নেই (আমার জানামতে), আমার মনে হয়ঃ তাদের নামের সাথে ঐটা না লাগালেই আপনার লেখা সাধারণ মুসলমানদের হৃদয় আরও বেশী আন্দোলিত করবে।
১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সকাল ১০:০০
207987
মোহাম্মদ আসাদ আলী লিখেছেন : পরামর্শের জন্য ধন্যবাদ। তবে আমি কোনো নবীর নাম লেখার ক্ষেত্রে অসম্মান করতে আগ্রহী নই।
264423
১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ০৩:৪৯
আফরা লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File