সমকালীন প্রশ্ন- মানবতা বড়, না ধর্ম বড়?

লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ আসাদ আলী ১৮ আগস্ট, ২০১৪, ০৩:১৪:৪১ দুপুর

ধর্ম বড়, না মানবতা বড়? এক সময় প্রশ্নটি অমূলক হিসেবেই বিবেচিত হোত। হয়তো কেউ ভুলেও এ ধরনের প্রশ্ন কোরত না। কিন্তু আজকের সামাজিক পরিস্থিতির বিবেচনায় প্রশ্নটি যথেষ্ট প্রাসঙ্গিকতা লাভ করেছে। বস্তুত ধর্ম ও মানবতা একই সত্ত্বা, একই বৃক্ষের দু’টি শেকড়। এর একটি ছাড়া অপরটি অসম্পূর্ণ। যুগে যুগে ধর্মের প্রধান শিক্ষা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে মানবতা। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমাদের সমাজ আজ এমন একটি পরিস্থিতিতে পতিত হয়েছে যেখানে ধর্মকে দাঁড় করানো হয়েছে মানবতার মুখোমুখি অবস্থানে। প্রকৃতপক্ষেই ধর্ম আর মানবতার ফারাক এখন স্পষ্ট এবং ক্রমেই তা প্রকট আকার ধারণ কোরছে। কারণ, আজ ধর্মের নামে যা চোলছে তা প্রকৃত ধর্ম নয়, প্রকৃত ধর্মের খোলসমাত্র, অর্থাৎ বিকৃত ধর্ম। মানবতার সাথে সাংঘর্ষিক এই বিকৃত ধর্মের অনুসরণের ফল হয়েছে এই যে, মানুষ এখন দুইভাগে বিভক্ত হোয়ে গেছে। একদল মানবতাহীন এই বিকৃত ধর্মকেই অতি নিষ্ঠার সাথে পালন কোরে চলেছে, আরেকদল ধর্মকে মানবতাবিরোধী আখ্যা দিয়ে মানবতার কল্যাণ সাধনের জন্য নাস্তিক্যের পথে পা বাড়িয়েছে। অথচ ধর্মহীন মানবতা এবং মানবতাহীন ধর্ম- দুটোই অচল, অসার, অবাস্তব। উভয়েরই চূড়ান্ত পরিণতি অশান্তি।

আমরা সেই অশান্তিতে পতিত হয়েছি। সমাজের ধর্মাশ্রয়ী শ্রেণিটির দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, উপাসনা-এবাদতকে তারা তাদের জীবনের সাথে এমনভাবে অঙ্গিভূত কোরে ফেলেছে যে, কারও কারও ক্ষেত্রে এ উপাসনা-এবাদতগুলোই জীবনের ধ্যান-জ্ঞান, সাধনাতে পরিণত হোয়েছে। আজকের মোসলেম সমাজের দিকে দৃষ্টিপাত কোরলে আমরা কী দেখি? নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত, ফেতরা, দান-খয়রাত ইত্যাদিতে তাদের কোনো কমতি নেই। নামাজ পড়তে পড়তে তাদের অনেকের কপালে কড়া পড়ে গেছে। বড় বড় সোনার ডোম বসানো মসজিদে তিল ধারনের জায়গা পাওয়া যায় না। দাড়ি-টুপি, পাঞ্জাবি, পাজামা, কুলুখ, মেসওয়াক, পাগড়ী, টাখনু ইত্যাদি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ব্যাপারেও এদের তোড়জোড়ের কমতি নেই। এরা গভীর রাতে ঘুম ভাঙিয়ে তাহাজ্জুদ পড়েন, দোয়া-মোনাজাত করেন। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে তাদের এই এবাদত-উপাসনা, ধর্মকর্ম কি মানুষকে শান্তি এনে দিতে পেরেছে? শুধু যে শান্তি আনতে ব্যর্থ হয়েছে তাই নয়, তাদের ধর্মকর্মই অনেক ক্ষেত্রে অশান্তির আগুন প্রজ্বলিত কোরেছে। আজকের ইরাক, পাকিস্তান বা সিরিয়ার দিকে দৃষ্টি দিলে যে বীভৎস লীলা চোখে পড়ে তার প্রধানতম কারণ হোল শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব তথা ধর্মীয় মতভেদ। এ মতভেদের জালে শুধু যে এসলাম ধর্মের অনুসারী মোসলেমরাই বন্দি রোয়েছে তা নয়, পৃথিবীর প্রধান প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রায় সবক’টিতেই ধর্মীয় মতভেদ স্পষ্ট। কোথাও সেটা হত্যাযজ্ঞে রূপ লাভ কোরছে কোথাওবা সীমিত পরিসরেই সীমাবদ্ধ আছে। এই মতভেদ, দ্বন্দ্ব ও অন্তর্কোন্দল নিয়ে কি কখনও মানুষকে শান্তি দেওয়া যায়? যায় না। কারণ, শান্তি দেবে যে ধর্ম সেখানে অবশ্যই কোনো মতভেদ থাকতে পারবে না। আর যে ধর্মের আত্মা তথা মানবতার দিকটা উহ্য থাকে বা পারিপার্শ্বিক চাপে অপ্রকাশিত থাকে সে ধর্মে মতভেদ হবেই। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, মানবতাহীন ধর্ম মানুষকে শান্তি দিতে ব্যর্থ।

ঠিক একইভাবে সমাজের ধর্মহীন মানবতাবাদীদের দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক। আমাদের দেশে একটি ধর্মবিমুখ শ্রেণি রোয়েছে। বিভিন্ন সময়ে তাদেরকে প্রচলিত ধর্মীয় রীতি-নীতি ও কর্মকাণ্ডের সমালোচনাপূর্বক মন্তব্য ও লেখালেখি কোরতে দেখা যায়। এরা নিজেদের নাম দিয়েছেন প্রগতিশীল গোষ্ঠী। ধর্মীয় গোড়ামী থেকে সমাজকে মানবতাবাদের প্রতি সঞ্চালন করার দায়িত্ব নিয়েছেন তারা। তারা যুক্তি তুলে ধরেন- ধর্মের এই বিষয়টা আধুনিকতা পরিপন্থী, ঐ বিষয়টা মানবতাবিরোধী, এটা মধ্যযুগীয়, ওটা প্রগতিবিরোধী ইত্যাদি ইত্যাদি। ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা প্রতিষ্ঠিত থাকলে তারা এ ধরনের যুক্তি উপস্থাপনের সুযোগ পেতেন না। কিন্তু বর্তমানে ধর্মের নামে যা চোলছে সে হিসেবে তাদের এই যুক্তি প্রাসঙ্গিক। তাই সচরাচর দেখা যায়, তাদের যুক্তির সামনে ধর্মাশ্রয়ী গোষ্ঠী অসহায়ভাবে নিজেদের সমর্পণ করতে বাধ্য হন। তবে তার মানে এই নয় যে, ধর্মের সাথে সম্পর্ক না রেখে নাস্তিকরা যে মানবতার জন্য চিৎকার-চ্যাঁচামেচি কোরছে তা সফল হোয়ে গেছে। বস্তুত তাদের এই চিৎকার মানুষের জীবনে শান্তি আনয়নের কাজে কোনো ভূমিকাই রাখতে পারে নি। বিকৃত ধর্মের অসারতা উপলব্ধি কোরে মানুষ যতই নাস্তিক্যের পথে হাঁটছে ততই অশান্তি বাড়া বৈ কমছে না। কারণ, শান্তি আছে ঐক্যের ভেতরে, শৃঙ্খলার ভেতরে, আনুগত্যের ভেতরে, ন্যায় ও সত্যের প্রতি নিজেকে সমর্পণের ভেতরে, যে উপাদান রোয়েছে শুধুমাত্র ধর্মে। এগুলো প্রতিষ্ঠিত হোলেই মানবতা বিকশিত হয়, জনজীবনে শান্তি নেমে আসে। এটাকে অস্বীকার কোরে মানবতার জন্য কান্নাকাটি করা পণ্ডশ্রম ছাড়া আর কিছুই নয়। আজকের ইউরোপ আমেরিকার দিকে তাকালেই এর প্রমাণ মিলবে। পশ্চিমা সভ্যতায় ধর্মকে অস্বীকার করা হয়েছে। তাই এ সভ্যতা ধর্মনিরপেক্ষ বস্তুবাদী সভ্যতা নামে পরিচিত। কার্যত সমস্ত পৃথিবী এখন এই সভ্যতার অনুগত। প্রশ্ন হোল ধর্মবর্জিত এ সভ্যতার অনুসারী বর্তমান পৃথিবীতে মানবতা কই? মানবতার ছিটে-ফোঁটাও আছে কি? গত শতাব্দীতে ও চলতি শতাব্দীর প্রারম্ভে এই ধর্মনিরপেক্ষ সভ্যতার আগ্রাসনে যে যুদ্ধ-রক্তপাত ঘটেছে তা মানব ইতিহাসে বিরল। যে কোনো সময় পশ্চিমা বস্তুবাদী, কথিত মানবতাবাদী এই সভ্যতার তৈরি পারমানবিক অস্ত্রের দানবীয় ধ্বংসলীলা এ পৃথিবীকে ধ্বংস কোরে দিতে পারে। তাই বাইরে যতই সফলতার অহংকারে স্ফিত থাকুক না কেন, ভেতরে ভেতরে পশ্চিমা বস্তুবাদী সভ্যতার অনুগত বর্তমান মানবজাতি ভীত-সন্ত্রস্ত, দেউলিয়া। এটাই কি তাহলে কথিত মানবতার নমুনা? সুতরাং, যে মানবতাবাদে ধর্মকে অস্বীকার করা হয়, স্রষ্টাকে অস্বীকার করা হয় সেই মানবতাবাদ আসলে তাসের ঘরের মতোই দুর্বল, ভঙ্গুর। তার কোনো ভিত্তি নেই। কার্যত সে মানবতা মানুষের সাথে প্রতারণা-প্রবঞ্চনা ছাড়া আর কিছুই নয়। আবার যে ধর্মের সাথে মানবতার সংস্পর্ষ নেই, যে ধর্ম মানুষের উন্নতি-প্রগতি-সমৃদ্ধির পথকে রূদ্ধ করে সে ধর্মও স্রষ্টা প্রেরিত প্রকৃত ধর্ম নয়। সেটা ঐ কথিত মানবতাবাদের মতোই প্রবঞ্চনা বিশেষ। প্রকৃত শান্তি প্রতিষ্ঠা হয় সেখানেই যে সমাজে মানবতা ও ধর্মের সুষ্ঠু ভারসাম্য বজায় থাকে। এমন সমাজ প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রয়োজন স্রষ্টা প্রেরিত জীবনব্যবস্থাগুলোর শ্বাশ্বত-সনাতন বিধানের বাস্তব প্রতিফলন ঘটানো।

বিষয়: বিবিধ

১০৪০ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

255566
১৮ আগস্ট ২০১৪ বিকাল ০৪:৩৭
দুষ্টু পোলা লিখেছেন : মানবতা বড়
255588
১৮ আগস্ট ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:০৭
বুড়া মিয়া লিখেছেন : ভালোই লিখেছেন আসাদ ভাই
255627
১৮ আগস্ট ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:৫০
গ্রামের পথে পথে লিখেছেন : মানুষের মাঝে মানবতা সবসময় ছিল, আছে এবং থাকবে। কিন্তু ধর্মই যত অনিষ্টের মূল। মানুষে-মানুষে বিভাজন, বৈষম্য, হানাহানি ধর্মের কারনেই।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File