কে জাগাবে এই সুপ্ত জাতিকে?
লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ আসাদ আলী ০৭ আগস্ট, ২০১৪, ০৯:২৮:২৩ রাত
বাঙালি জাতি সম্পর্কে কবি সুকান্ত ভট্টচার্য লিখেছিলেন-
এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়,
জ্বলে-পুড়ে মরে ছারখার
তবু মাথা নোয়াবার নয়!
কিন্তু সে বাঙালি বোধহয় অন্য জাতি ছিল, আজকের এই জাতি নয়। আজকের বাঙালির মধ্যে অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করে জ্বলে-পুড়ে মরে ছারখার হওয়ার সে স্পৃহা অনুপস্থিত। মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি স্বাধীনতা হলেও এরা স্বাধীনতা, স্বকীয়তা বা স্বতন্ত্রতা পছন্দ করে না। এ জাতি সর্বদাই প্রভু খোঁজে। দাসত্বের শৃঙ্খল নিজেদের শরীরে নিজেরাই বেঁধে রাখে। এর একটি কারণ যেমন অজ্ঞতা, তেমন আরেকটি কারণ হলো হীনমন্যতা। এটা আমার ব্যক্তিমত নয়, বাস্তবতা। যে কেউ চোখের সামনে থেকে আবেগ ও হীনমন্যতার পর্দা সরালেই এ দৃশ্য চোখে পড়বে। সে দেখবে এ জাতির অধঃপতনের খাদ কত গভীরে প্রোথিত, জাতি ধ্বংসের পথে কতদূর এগিয়ে গেছে। আমরা বুঝছিনা, কারণ আমরা চোখের সামনে থেকে এই হীনমন্যতা ও অজ্ঞতার পর্দা সরাতে পারি নি। বরং পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র যেখানেই যাই সেখানেই এ পর্দার আস্তরণ আরও পুরু হতে থাকে। ফলে বিশাল দেহের হস্তি যেমন শত চেষ্টা করলেও তার নিজের আপাদমস্তক অঙ্গসমূহ অবলোকনে ব্যর্থ হয়, আমরাও আমাদের এ বৃহৎ দুর্বলতা অনুভবে সফল হই না। কিন্তু তাই বলে আমাদের অধঃপতন থেমে নেই।
পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় অঙ্গনে আমরা এক ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছি। এমন অবস্থা অতীতে ¬কখনোই হয় নি। আমরা বাঙালিরা আমাদের গৌরবকে হারিয়ে ফেলেছি অনেক আগেই। তবে সেটা হঠাৎ করে নয়। একটা নির্দিষ্ট ছাঁচে পড়ে ক্রমে ক্রমে আমরা নিজেদেরকে নিঃস্ব করেছি। প্রথমে স্বাধীনতা হারিয়েছি, তারপর স্বকীয়তা হারিয়েছি, একই সাথে নিজেদের মর্যাদা ক্ষুন্ন করেছি, সর্বশেষে নিজেদের চিন্তা-চেতনাকে সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের পদতলে সমর্পণ করে চরিত্র হারিয়েছি। এ সবকিছুই হয়েছে দখলদার শক্তির ষড়যন্ত্র আর আমাদের দুর্বলতাকে পুঁজি করে। এখন এ জাতি নিঃস্ব, প্রাণহীন। কিন্তু যখন আমাদের প্রাণ ছিল আমরা এতটাই দুরন্ত ছিলাম যে, আমাদের দিকে বহিঃবিশ্ব ঈর্শার দৃষ্টি ফেলে রাখতো, আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ ও উর্বর মাটি তাদের বিমোহিত করতো। তারা অবাক নয়নে আমাদের স্বর্গভূমির পানে চেয়ে থাকতো।
অনেক ঐতিহাসিক মুঘলদেরকে বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত করতে প্রিয় মনে করেন। অথচ মুঘল আমলে এবং তারও পূর্বে আফগানদের শাসনামলে বাংলার সামগ্রিক উন্নয়ন ছিল চোখে পড়ার মতো। মুঘল আমলে বাংলায় চলতো নবাবী শাসন। তখনও আমরা এক প্রকার স্বাধীনতা, স্বতন্ত্রতা ভোগ করতাম। আমাদের মধ্যে আত্মমর্যাদা, শৌর্যবীর্য ও সম্প্রীতি-সহাবস্থান অবশিষ্ট ছিল। অর্থনৈতিকভাবে আমরা তখন বর্তমানের মতো এত হতদরিদ্র ছিলাম না। তখন জিনিসপত্রের দাম বর্তমানের মতো এক লাফে আকাশে উঠতো না। অন্ততপক্ষে বিনা দুর্ভিক্ষে কাউকে না খেয়ে মরতে হতো না। তখন সমাজে এত অশান্তি ছিল না, রাষ্ট্রে এত গোলযোগ ছিল না।
কিন্তু মুঘলদের পর ভারতবর্ষে আসলো পরদেশলোভী সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশরা। তারা আসলো আমাদেরই কৃত ষড়যন্ত্রের মই বেয়ে। ব্রিটিশদের আমলে শুরু হলো এ উপমহাদেশের জাতিগোষ্ঠীগুলোর আক্ষরিক অর্থেই গোলামীর জীবনযাপন। অস্ত গেল এতদঞ্চলের স্বাধীনতা, স্বকীয়তার সূর্য। এভাবে চলল দীর্ঘ আড়াই শতাব্দী। আর এ দীর্ঘ সময়ে ব্রিটিশরা আমাদেরকে শাসন ও শোষণ করে এখানকার মাটির ধন-সম্পদ নিজেদের দেশে পাচার করে নিজেদেরকে সম্ভ্রান্ত করলো, আর আমাদেরকে নিঃস্ব বানিয়ে দিল। শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে কৌশলে আমাদের মধ্যে বিভেদের বিষ ঢুকিয়ে দেয়া হলো। ভারতীয়দেরকে হাতে কলমে শেখানো হলো গণতন্ত্র। ব্রিটিশ প্রশাসকের ছত্রছায়াতেই তৈরি করা হলো রাজনৈতিক দল। কীভাবে সে দল পরিচালিত হবে, তাও নিজেরা নেতৃত্ব দিয়ে শিখিয়ে দিল। তারপর যা হবার তা এমনি এমনিই হয়ে গেল। বিভেদের মন্ত্রণা পেয়ে ভারত ভেঙে পাকিস্তান হলো, কথিত মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের পশ্চিম অংশের দুসহ্য অত্যাচার-অবিচার থেকে বাঁচার আশায় আমরা বাঙালিরা স্বাধীনতা যুদ্ধ করে স্বাধীন হলাম। স্বাভাবিকভাবেই এক ভারতবর্ষ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। এমনটা যে হবে তা ব্রিটিশরা জানতো। আরও একটু গভীরে গেলে বলতে হয়- এই অবস্থা সৃষ্টির জন্যই তারা আমাদের মধ্যে বিভেদের প্রাচীর দাঁড় করিয়েছিল, ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করেছিল। শুধু তাই নয়। ব্রিটিশরা আরও একটি গুরুতর বিষবৃক্ষ রোপন করে গেছে। সেটা হলো গণতন্ত্র। গণতন্ত্রই বোধ হয় পৃথিবীর একমাত্র শাসনব্যবস্থা যেটি অনৈক্য আর দলাদলিকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়। ক্ষেত্রবিশেষে উৎসাহও যোগায়। আর সে উৎসাহে সাড়া দিয়ে আমরা জাতির সর্বনাশ ডেকে এনেছি। গণতান্ত্রিক দলাদলির নগ্ন খেলার বীভৎস রূপ আমাদেরকে প্রতিনিয়তই দেখতে হচ্ছে। এ খেলায় আমরা এক ভাই আরেক ভাইয়ের রক্তে নিজের হাত রঞ্জিত করে চলেছি। এক কথায়, পশ্চিমা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে তাদের শোষণে নিঃস্ব হয়ে এবং তাদের পড়া বিভেদের মন্ত্রে মোহাচ্ছন্ন হয়ে আমরা আজকের দিনটি পর্যন্ত নিজেদের অনিষ্ট নিজেরাই সাধন করছি, আর অন্যদিকে আমাদেরকে রক্তের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা জয়ধ্বনী বাজাচ্ছে। কি নিষ্ঠুর পরিহাস!
এভাবে চলতে দেয়া যায় না। আর কতকাল আমরা নি¯প্রাণ, নির্জীব, নিবীর্য হয়ে থাকবো? এখনও কি আমাদের জাগার সময় হয়নি? জানি, এ প্রশ্ন উঠলেই সাথে সাথে আরেকটি প্রশ্ন ওঠা অনিবার্য। সেটা হলো- কে জাগাবে এই জাতিকে? হয়ত এ জাতির জাগার সময় হয়ে এসেছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী কেবল মার খেয়ে আসা এই জাতিটির ভাগ্য হয়ত এবার খুলবে। তারা আবারও তাদের প্রকৃত স্বাধীনতা, স্বকীয়তা, মর্যাদা ও সচ্চরিত্র ফিরে পাবে। কিন্তু তার জন্য তো জাতির দুয়ারে শক্ত করাঘাত করতে হবে। এ দায়িত্ব নেবে কে?
কবি কাজী নজরুল এসলামের ভাষায়,
ধর্ম বর্ণ জাতির উর্ধ্বে জাগো রে নবীন প্রাণ
তোমার অভ্যুদয়ে হোক সব বিরোধের অবসান
সে নবীন প্রাণ কি এসেছে?
বিষয়: রাজনীতি
৯২২ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন