বিহারী ক্যাম্প হত্যাকাণ্ড- সহনশীল জাতির সহিংস রূপ!
লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ আসাদ আলী ১৫ জুন, ২০১৪, ০৭:৫৪:১০ সন্ধ্যা
রাজধানীর পল্লবীতে বিহারিদের উপর স্থানীয় লোকজনের বর্বরোচিত হামলা ও ঘরে তালা দিয়ে অগ্নিসংযোগ করে ঘুমন্ত শিশু ও নারীসহ দশজন হত্যা করার ঘটনা দেশবাসীর বিবেককে নাড়া দিয়েছে। বিস্ময়ের সাথে অনুধাবন করতে হচ্ছে- বর্বরতার কোন পর্যায়ে পৌঁছেছি আমরা? তালাবদ্ধ ঘরে অগ্নিসংযোগ করে নিরীহ নারী-শিশুকে কয়লায় পরিণত করার দৃষ্টান্ত বাঙালি জাতির ইতিহাসে ছিল না। আজ সৃষ্টি হলো। উগ্রবাদ আমাদের জাতীয় চরিত্রের সাথে কোনো কালেই খাপ খায়নি। সর্বমহলে বাঙালি জাতি অন্য জাতির প্রতি শান্তিপ্রিয় হিসেবেই বিবেচিত হয়ে এসেছে। কিন্তু বিহারী ক্যাম্পের ঘটনাটিতে শুধু আমাদের উগ্রপন্থাই প্রকাশ পায় নি, রীতিমত দানবীয় চরিত্রের প্রকাশ ঘটেছে। নিঃসন্দেহে ঘটনাটি আমাদের জন্য অশনিসংকেত বহন করছে। অথচ অবাক হতে হচ্ছে যখন এতকিছুর পরও সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এমন অমানবিক কর্মকাণ্ডের পক্ষেও অনেককে সাফাই গাইতে দেখা যাচ্ছে।
সংবাদমাধ্যম সূত্রে যতটুকু জানা যাচ্ছে, তাতে এই আক্রমণের পেছনে তেমন গুরুতর কোনো কারণ দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। শুধুই আতশবাজি ফোটানোকে কেন্দ্র করে এই প্রাণঘাতী ঘটনা ঘটে গেল। ঘটনাটিতে জাতি হিসেবে আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়েছে ব্যাপকভাবে। আতশবাজী ফোটানোর ঘটনা বিহারী ক্যাম্পগুলোতে নতুন নয়। গত বছরও শবে বরাতে ঐ ক্যাম্পেই আতশবাজী ফোটানো হয়েছে। আবার ঘটনার রাতে শুধু বিহারীরাই আতশবাজী ফোটাচ্ছিল তাও নয়, একই এলাকায় বাঙালিরাও আতশবাজী ফোটাচ্ছিল। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে এলাকাবাসী ও প্রশাসন শক্ত কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে এমন খবর পাওয়া যায় নি। যদিও একই কর্ম বিহারীদের জন্য এতটা নির্মম ফল বয়ে আনলো। তাহলে কি নিছক আতশবাজীর কথা বলা হলেও ঘটনাটির পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে? থাকতেও পারে। কারণ আমাদের দেশের সব আলোচিত ঘটনার পেছনেই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক যোগসাজস খুঁজে পাওয়া যায়। ঘটনার পরদিন ‘ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন অব বিহারিজের’ সভাপতি মুশতাক আহমেদ অবশ্য এমনই কিছু তথ্য উত্থাপন করেছেন, যা মিডিয়াতে ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে। তিনি ঘটনাটির পেছনে কিছু ব্যবাসায়িক প্রতিষ্ঠান ও গ্র“পকে দায়ী করেছেন। (আমাদের সময়, ১৫-০৬-১৪) তার কথা সত্য হলে এটাই প্রমাণিত হবে যে, নিছক ছোট্ট একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতিকে উস্কে দিয়ে অন্য কোনো মহল ফায়দা লুটতে চেয়েছে। তবে ঘটনা যাই ঘটুক না কেন এমন মর্মান্তিক পরিণতি জাতির জন্য সাংঘাতিক অশুভ বার্তা বয়ে এনেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এর দ্রুত তদন্ত ও সুষ্ঠু বিচার করা দেশ ও জাতির স্বার্থে অপরিহার্য। কিন্তু তার নিশ্চয়তা কতটুকু রয়েছে সেটাও পরিষ্কার নয়। প্রতিটি নৃশংস ঘটনার পেছনে সরকারের হীনমন্যতা ও দায় এড়িয়ে চলার প্রবণতা দেখা যায় প্রকট। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বিহারী ক্যাম্পের ঘটনাটিকে নিছক দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়ার প্রবণতাও এরই পরিপূরক। তিনি ধারণা করছেন যে, যেভাবে পটকা ফোটানো হয়েছে, এর কোনও স্ফুলিঙ্গ থেকেও কোনওভাবে আগুন লেগে থাকতে পারে।’ তাঁর এই বক্তব্যের যথার্থতা তিনিই ভালো জানেন তবে আমরা আশা করি যেন, মর্মান্তিক এই ঘটনাটিকে নিয়ে রাজনীতি না করে সুষ্ঠু তদন্ত করা হয় এবং দোষীদের অতিদ্রুত আইনের অধীনে আনা হয়। এখানে কে পাকিস্তানী, কে বাঙালি সে বিচার করতে গেলে জাতি হিসেবে আমাদের সুনাম খুন্ন হবে সন্দেহ নেই।
‘বিহারী কা বাচ্চা, কাভী নেহি সাচ্চা’ প্রবাদটির সাথে আমাদের যথেষ্ট পরিচিতি রয়েছে। বাংলাদেশে বসবাসরত বিহারীদের জন্যই মূলত একচেটিয়াভাবে এটা ব্যবহৃত হয়। অবশ্য এই প্রবাদটি তৈরি হবার পেছনে তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কিছু না কিছু প্রভাব রয়েছেই। বিহারীদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি যে সমালোচনাটি করা হয়ে থাকে তাহলো ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানীদের পক্ষাবলম্বন। বাংলাদেশকে তারা কখনোই মেনে নিতে পারে নি। তাদের চরিত্রের সাথে পাকিস্তানপ্রীতি অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পৃক্ত রয়েছে। ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের পর উত্তেজিত জনতা থেকে বাঁচানোর জন্য সরকার তাদেরকে বিভিন্ন ক্যাম্পে বসবাস করার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। বস্তুত একই ধর্মবিশ্বাসী হবার পরও বাঙালি মুসলিমদের সাথে বিহারীদের রয়েছে ব্যাপক সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিভেদ। কিন্তু তাই বলে তাদেরকে চার দশক আগের পূর্বপুরুষদের কৃত পাপের শাস্তি ভোগ করতে হবে তা তো নয়। শুধুমাত্র এই সাংস্কৃতিক ও মানসিক ভিন্নতা থেকেই এমন একটি নৃশংস ঘটনার জন্ম নেবে তা আমরা কখনোই মেনে নিতে পারি না। কেননা তা বাঙালির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পরিপন্থী। বাঙালি হলো সহনশীল, শান্তিপ্রিয় জাতি। আমাদের এই গুণ নিছক সংকীর্ণতার অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে যাক তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমাদের উচিত ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা এড়িয়ে চলা এবং বিশ্বদরবারে বাঙালির যে সহনশীলতা ও উদারপন্থার কদর করা হয় তা অক্ষুণœ রাখতে সর্বদা সচেষ্ট থাকা।
বিষয়: বিবিধ
১০৬৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন