হতদরিদ্র জনগোষ্ঠির প্রাপ্তি কতখানি? (বাজেট ২০১৪-২০১৫)

লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ আসাদ আলী ০৭ জুন, ২০১৪, ০৩:৫১:৪৫ দুপুর



গত বৃহস্পতিবারে প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেফাকে ‘শহরের অতি দরিদ্রদের জীবিকা’ শিরোনামে জনাব তোফায়েল মো. আলমগীর আজাদের একটি কলাম প্রকাশিত হয়। লেখাটি বিশেষভাবে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কারণ লেখাটিতে তিনি ঢাকা শহরে বসবাসরত বস্তিবাসীদের সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ও বিস্ময়কর তথ্যাদি তুলে ধরেছেন। আলোকপাত করেছেন ঢাকার বস্তিবাসীদের অশেষ ভোগান্তির কিছু নমুনাও। তিনি উল্লেখ করেছেন- ‘ঢাকায় বর্তমানে ৩৫০০-৪০০০ বস্তি রয়েছে এবং শহরের বস্তিগুলোতে প্রায় ৩.৫ কোটি লোক বসবাস করছে। ২০১৫ সালের মধ্যে এই সংখ্যা বেড়ে গিয়ে ৬.৮ কোটিতে দাঁড়াবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।’ আর এর চেয়েও বেশি বিস্ময়কর তথ্যটি তিনি উল্লেখ করেছেন যে, ঢাকায় বসবাসরত এই বস্তিবাসীদের সংখ্যা শহরের মোট অধিবাসীর শতকরা ৪০ ভাগ, যা নিঃসন্দেহে বেশ উদ্বেগজনক।

প্রাকৃতিক পরিবেশের দিক দিয়ে এমনিতেই ঢাকা শহর মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। তার উপর যদি কোনো জনগোষ্ঠিকে সবরকম নাগরিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয় তাহলে তাদের অবস্থা কতটা করুণ হবে, তা সহজেই অনুমেয়। অথচ ঢাকা শহরের বিরাট এই জনগোষ্ঠি (বস্তিবাসী) এমনিভাবেই কার্যত কোনো রকম নাগরিক সুবিধা ছাড়াই দিনাতিপাত করছে। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদি মৌলিক অধিকার তো দূরের কথা শত চেষ্টা করেও তারা ন্যূনতম রাষ্ট্রীয় সাহায্য-সহায়তা থেকেও দিনের পর দিন বঞ্চিত থাকছে। এই বস্তিবাসীদের না আছে কোনো পুনর্বাসনের কার্যকরী সরকারি উদ্যোগ, না আছে মানসম্মত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা। তারা যেখানেই আশ্রয় নেয়, সেখানেই তাদের দুর্ভোগের সীমা থাকে না। কিন্তু এই হতদরিদ্র মানুষগুলোর জীবন-জীবিকার মান উন্নয়নের কথা বলে প্রতি বছর সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করছে মর্মে আমরা খবর পাই।

গত বৃহস্পতিবার ঘোষিত হলো ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরের বাজেট। আগে থেকেই খবর পাওয়া যাচ্ছিল যে, এই বাজেট হবে বাংলাদেশের স্মরণকালের সর্বোচ্চ বাজেট। বাস্তবেও তাই হলো। বিভিন্ন যুক্তির আশ্রয় নিয়ে অর্থমন্ত্রী শেষ পর্যন্ত ২ লাখ ৫০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকার একটি উচ্চাভিলাষী বাজেট ঘোষণা করেছেন। চলছে এর পক্ষে-বিপক্ষে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। মূলত বাজেটের আকার-আকৃতি নিয়ে আমার কোনো আপত্তি বা উচ্ছ্বাস কোনটিই নেই। আমার আলোচ্য প্রসঙ্গ তা নয়। প্রতি বছরই সরকারের তরফ থেকে সংসদে বাজেট পাশ হয়। তাতে আগামী অর্থবছর রাষ্ট্রীয় সম্ভাব্য আয় ও ব্যয়ের একটি হিসাব প্রকাশ করা হয় এবং সেই মাফিক কার্যসম্পাদন করার জন্য সরকার সর্বোতভাবে চেষ্টা করে যায়। রাষ্ট্রের বিভিন্ন সেক্টরে যেমন কৃষি, খাদ্য, শিক্ষা, প্রশাসন, প্রতিরক্ষা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, শিল্প উন্নয়ন ইত্যাদির জন্য নির্দিষ্ট হিসাবে সম্ভাব্য ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। সকল স্তরের নাগরিকের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতকরণ ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করার কথা বলে সে পারপাসে এই বাজেটগুলোতে হাজার হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। এবং বছর শেষে সে অর্থ ইতোমধ্যেই সংশ্লিষ্ট খাতে ব্যয় করা হয়েছে- এমন আশ্বাসের বাণীও কর্ণগোচর হয়। সুতরাং আমরা ধরেই নিতে পারি যে, উপরে উল্লেখিত রাজধানী ঢাকার মোট জনসংখ্যার যে ৪০ শতাংশ বস্তিবাসী সম্পূর্ণ মৌলিক সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে- নিশ্চয়ই তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নেও বিশাল অংকের অর্থ নির্ধারণ করা হচ্ছে, তাই নয় কি? কিন্তু তাহলে ঢাকা শহরের এই হাল কেন? এই বস্তিবাসীদের মৌলিক সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে কেন? পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে সক্ষম না হলেও অন্তত এই বস্তিতে বেড়ে ওঠা শিশুগুলোর শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি এবং তৎপরবর্তী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা কি রাষ্ট্রের কাছে খুবই কঠিন কোনো কাজ? আদৌ নয়। প্রকৃতপক্ষে তাদের জীবনযাত্রার উন্নয়নের লক্ষ্যে বাজেটে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ঠিকই কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সে অর্থ ব্যয় নিশ্চিত হয় কি না, বা হলেও তা বরাদ্দকৃত অর্থের কতভাগ তা স্পষ্ট নয়। প্রতি বছরই বাজেট ঘোষণা হচ্ছে, জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবার কথা শোনা যাচ্ছে, কিন্তু তার কার্যকরী ফল বলতে গেলে দৃশ্যমান নয়। অর্থাৎ হয় সে অর্থ সুষ্ঠুভাবে ব্যয় হয় না, অথবা সে অর্থ চাহিদার তুলনায় অতি নগন্য, যার কোনোটাই কাম্য নয়।

আমাদের জাতীয় বাজেটগুলোতে একটি সাধারণ বিষয় হচ্ছে, বাজেটে ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা রাষ্ট্রীয় মোট আয়ের চেয়ে বরাবরই অনেক বেশি হয়ে থাকে। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী যে বাজেট ঘোষণা করলেন সেটাও এর ব্যতিক্রম নয়। বরং বাজেটের আকার অনুযায়ী এবার ঘাটতির আকারও অনেক বেশি। এবারের বাজেট ঘাটতি ৬৭ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা। এই ঘাটতি সরকার কোথা থেকে পূরণ করবে তা কারও অজানা নয়। এর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পূরণ করা হবে চড়া সুদের শর্তে নেয়া বৈদেশিক ঋণ দিয়ে। এভাবে একের পর এক উন্নত দেশ ও দাতা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ঋণ নেবার ফলে দিন দিন নতুন নতুন ঋণের শিকল জাতির গলায় উঠছে। কিন্তু এতকিছুর পরও বিপুল সংখ্যক হতদরিদ্র্য এই মানুষগুলোর ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন নেই। তারা আজ থেকে দশ বছর আগে যতটুকু খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা সঙ্কটে ভুগতো, কর্মসংস্থানের অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করতো, আজও তাই করছে। কিন্তু যেটা যোগ হয়েছে তাহলো মাথার উপর বিরাট ঋণের বোঝা, যার খবর তাদের অধিকাংশেরই অজানা। যেকোনো সচেতন ব্যক্তিমাত্রই এই বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ সম্পর্কে অবগত হলে বিস্মিত হতে বাধ্য হবেন। বাংলাদেশে অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৩ অনুযায়ী, বাংলাদেশ সরকার গত ১০ বছরে (২০০২-০৩ থেকে ২০১১-১২ পর্যন্ত) বিভিন্ন দাতা সংস্থার কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে ৯৫ হাজার কোটি টাকা। এ সময় ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হয়েছে ১৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। আর আসল পরিশোধ করেছে ৪৬ হাজার ২১০ কোটি টাকা। এ হিসাবে ঋণ প্রাপ্তির ১৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ অর্থই সুদ পরিশোধে ব্যয় করতে হচ্ছে। আসল পরিশোধে ব্যয় হচ্ছে ৫০ শতাংশ। এই ঋণের কার্যকরী সুফল দেশের আপামর জনতার কাছে দৃষ্ট না হলেও ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে কিন্তু তাদেরই। সরকার নতুন নতুন কর বসিয়েই তার দায়িত্ব শেষ করছে।

আমাদের দেশের সহজ-সরল ও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অশিক্ষিত জনগণ বাজেট সম্পর্কে স্বাভাবিকভাবেই অজ্ঞ। আর স্বল্প-শিক্ষিত থেকে উচ্চশিক্ষিত যে মধ্যবিত্ত শ্রেণিটি রয়েছে তারাও জটিল এই বিষয়টিকে নিয়ে খুব কমই মাথা ঘামান। বাজেট তাদের কাছে একটি আতঙ্কের নাম। বাজেটকে তারা ভয় পান নিত্য-প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবার কারণে। বাজেট সম্পর্কে জনতার মুখে যে দু-একটা খৈ ফোটে তার কারণ মূলত এটাই। এর চেয়ে বেশি গভীরে তারা ঢুকতে পারে না, বা ঢুকতে চেষ্টা করে না। কিন্তু আরেকটু গভীরে গেলেই তারা দেখতে পেতো যে, তাদের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা এই বাজেট বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বিদেশি প্রভুদের কাছ থেকে কী অংকের ঋণ আনয়ন করছে। এবং প্রতি বছর সে ঋণের সুদ বাড়তে বাড়তে আজ কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে। তারা এটাও অনুধাবন করতে পারতো যে, এই ঋণ পরিশোধ করা তো দূরের কথা, প্রতিনিয়ত এর যে সুদ অশিক্ষা-কুশিক্ষা ও দারিদ্র্যতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ এই জাতিটির উপর আরোপিত হচ্ছে সেই সুদ পরিশোধ করাটাও দিন দিন আমাদের সামর্থ্যরে বাইরে চলে যাচ্ছে। অথচ আজ হোক আর কাল হোক শুধু সুদ নয়, পুরো ঋণের আসল টাকাও পরিশোধ করতে হবে। এই উদ্বেগ সমাজের ঐ নিুবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির কার্যত নেই, কারণ তারা এটা নিয়ে মাথা ঘামান না। মাথা ঘামানোর দায়িত্ব তারা দিয়ে রেখেছেন সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণিটিকে, যারা ইতোমধ্যেই নিুবিত্ত শ্রেণিটিকে বিভিন্নভাবে শোষণ করে ফুলে-ফেঁপে আছে। বাজেটের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত মূলত দেশের উচ্চবিত্ত কতিপয় শিল্পপতি, ব্যাংক-বীমা, কর্পোরেশনের মালিক ও এই জাতীয় সমাজের রুই কাতলারা। তারাই বিষয়টিকে হ্যান্ডেল করে থাকেন। এবং বাজেট থেকে সুফল বলতে যা পাওয়া যায় তাও এরাই ভোগ করে। বাজেটকে কেন্দ্র কোরে এদের মধ্যেই কোটি কোটি টাকা লেনদেন হয়। পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার চিরায়ত নীতি অনুযায়ী এই ফুলে ফেঁপে উঠা শ্রেণিটি স্বাভাবিকভাবেই আরও শোষণের সুযোগ পেয়ে যায়। তাদের এই শোষণের পথকেই প্রশস্ত করে ভারসাম্যহীন জাতীয় বাজেটগুলো। এক কথায় প্রতিটি ভারসাম্যহীন বাজেট নিুবিত্ত শ্রেণিটির জন্য অভিশাপ ডেকে আনলেও উচ্চবিত্ত শ্রেণিটির জন্য তা আশীর্বাদ হিসেবেই প্রতীয়মান হয়। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার এই বীভৎস চেহারা আমরা প্রতিদিনই দেখছি, ফলও ভোগ করছি। কিন্তু শিক্ষা নিচ্ছি না। আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন হবার কারণ থাকা সত্ত্বেও আমরা একে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে নিজে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছি। পাশ্চাত্য প্রভুদের চাপিয়ে দেওয়া পুঁজিবাদ জাতি হিসেবে আমাদেরকে কতটা নিচে নামিয়ে দিয়েছে তা সাধারণ জ্ঞানেই বোঝা যায়। কিন্তু আমাদের যেন সেই সাধারণ জ্ঞানটুকুও লোপ পেয়েছে।

বিষয়: রাজনীতি

১১৮২ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

231944
০৭ জুন ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:৪৬
সন্ধাতারা লিখেছেন : Really painful

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File