যে কারণে আইনমন্ত্রীর মন্তব্য প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে
লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ আসাদ আলী ০২ জুন, ২০১৪, ০৪:০১:২৮ বিকাল
‘প্রচলিত আইনে দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিচার করা সম্ভব নয়’- আইনমন্ত্রীর এমন মন্তব্যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধূম্রজালের সৃষ্টি হয়েছে। চলছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। অবশ্য আলোচনার তুলনায় সমালোচনাই বেশি হচ্ছে। যারা সর্বদাই আওয়ামী লীগ সরকারকে সমর্থন দিয়ে এসেছেন, সরকারের পক্ষে জনমত তৈরির চেষ্টা চালিয়ে এসেছেন তারাও এই সমালোচনার বৃত্তের বাইরে নেই। বস্তুত, পরপর দ্বিতীয় বারের মতো ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে থেকে এমন মন্তব্য অনেকেই আশা করে নি। তাই আইনমন্ত্রীর মন্তব্যটি শুনে অনেকেই আকাশ থেকে পড়েছেন। বিশেষভাবে গণজাগরণ মঞ্চ ও তৎসংশ্লিষ্ট সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখানো হচ্ছে। আবার অনেকে ‘সরকারের সাথে জামায়াতের গোপন সমঝোতা হয়েছে’ এমন সন্দেহের আবর্তেও ঘুরপাক খাচ্ছেন। এ সবকিছুকেই আমি স্বাভাবিক হিসেবেই ধরছি। শুধু আমি কেন, আইনমন্ত্রী নিজেও নিশ্চয়ই জানতেন যে, তাঁর এমন মন্তব্য দেশের একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করবে। কিন্তু তিনি সেটাকে গুরুত্ব দেন নি। হয়তবা অন্য কোনো বিষয়কে এর চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে গিয়ে এটার গুরুত্ব কমে গেছে। তেমন কোনো রহস্য আদৌ আছে কিনা তা খুঁজে বের করা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি মূলত একটু অতীত নিয়ে ঘাটাঘাটি করবো। কে জানে, হয়ত অতীত-ই বর্তমান ও ভবিষ্যতের সিংহভাগ প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেবে!
২০০৮ সালে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকারের কেন্দ্রীয় কোনো কর্তৃপক্ষ জামায়াতে ইসলামীর দল হিসেবে বিচার করার ঘোষণা দিয়েছে- এমন কোনো ইতিহাস পাওয়া যায় না, যদিও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতিশ্র“তি তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে ছিল। অতঃপর জয়ী হয়ে নির্বাচনী ইশতেহারের প্রতিশ্র“তি মোতাবেক আওয়ামী লীগ সরকার ৭১ এর যুদ্ধাপরাধী বা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের কার্যক্রম হাতে নেয়। গঠন করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। বেশ ক’জনকে অভিযুক্ত করে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। অভিযুক্তদের মধ্যে অধিকাংশই ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিল। শুরু হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের স্বাভাবিক কার্যক্রম। এই যে এত কিছু হচ্ছে, এসময় দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিচারের প্রসঙ্গ মূলত আলোচনাতেই আসেনি।
এরপর ২০১৩ সালে এসে ট্রাইব্যুনাল প্রথম রায় ঘোষণা করে- কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। কিন্তু সে রায় মনোপূর্ত না হলে দেশের একটি বিরাট জনগোষ্ঠী রাজধানীর শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচী ঘোষণা করে। গড়ে ওঠে গণজাগরণ মঞ্চ। সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ সেখানে এসে একত্রিত হয় কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে। ফলে সরকারও বেশ নড়েচড়ে বসে। ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের সুযোগ না থাকায় এবার সরকার সংসদে আইন সংশোধন করে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে। সেখানে দল হিসেবে কোনো সংগঠনের বিচার করার আইনও পাশ হয়েছিল, তবে সে অপরাধী সংগঠন বা দলের শাস্তি কী হবে তার কোনো সুনির্দিষ্ট উল্লেখ না থাকায় সে আইন কার্যকর করা মোটেও সহজ ছিল না। বিষয়টিকে তৎকালীন সময়ে খুব বেশি গুরুত্বও দেয়া হয় নি। বলা যায়, জামায়াতে ইসলামীকে দল হিসেবে বিচারের মুখোমুখি করার ব্যাপারে সরকার সম্পূর্ণ নীরব ছিল। ফলে বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন জায়গা থেকে কদাচিৎ সেই দাবি উঠলেও খুব বেশি চড়াও হবার সুযোগ পায় নি। এরপর জামায়াত নেতা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী, কামারুজ্জামান, গোলাম আযমসহ আরও বেশ কয়েকজন অভিযুক্তের রায় প্রদান করা হয়। তবে দল হিসেবে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা বা বিচারের মুখোমুখি করা নিয়ে সরকারের কোনো পদক্ষেপ দৃষ্টিগোচর হয় নি।
কিন্তু সরকার হঠাৎ করেই তাদের এই নীরবতা ভেঙে ফেলে গত বছরের শেষ পর্যায়ে এসে। এই প্রথম আওয়ামী লীগ সরকার দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করে। গত বছরের ২৮ আগস্ট জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালীন হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, ঘড়-বাড়ী লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের উপর ভিত্তি করে তদন্ত শুরু হয়। এরপর একাত্তরে গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধের জন্য জামায়াতে ইসলামী ও এর তৎকালীন সহযোগী সংগঠন ও নেতাকর্মীদের দায়ী করে সংশ্লিষ্টদের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধের সুপারিশ জানায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তারা। গত ২৭ মার্চ জামায়াতের বিরুদ্ধে ৩৭৩ পৃষ্ঠার চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদনসহ ৯ হাজার ৫৫৭ পৃষ্ঠার নথিপত্র চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুর কাছে দাখিল করা হয়। আবার এর আগে দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিলের দাবিতেও মামলা হয়, যা এখন আপিল বিভাগে বিচারাধীন রয়েছে। এই যে দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে সরকারের পদক্ষেপ, এটা সরকার বাধ্য হয়ে করেছে এমনটা বলার উপায় নেই। এর জন্য অপর একটি গণজাগরণ মঞ্চেরও দরকার পড়ে নি। সরকার স্বতস্ফূর্তভাবেই এই পদক্ষেপ নেয়। ফলে এতদিন যারা দল হিসেবে জামায়াতের বিচার হবার ব্যাপারে কিঞ্চিৎ আশাবাদী ছিল তারা পুর্ণদ্যোমে আশান্বিত হয়। সরকারের উপর জামায়াতবিরোধী বা সাম্প্রদায়িক রাজনীতিবিরোধী এই বিরাট সংখ্যক জনগোষ্ঠীর সমর্থন এসে যায়।
এই জনসমর্থন সরকার সুযোগমতো ব্যবহারও করেছে। দ্বিতীয় বারের মতো ক্ষমতায় এসে সরকারের সামনে যে চ্যালেঞ্জগুলো এসেছে তার মোকাবেলায় এই জনসমর্থন ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। সাম্প্রদায়িক রাজনীতিবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠী কার্যত সরকারের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনে ক্ষমতাগ্রহণের প্রশ্নে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেছে। এটি সরকারের টিকে যাবার পেছনে অনন্য ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু হঠাৎ আজ সরকার কেনই বা ভোল পাল্টে ফেলছে তা বলা যাচ্ছে না নিশ্চতভাবে। আইনের যে মারপ্যাঁচের কথা মাননীয় আইনমন্ত্রী বললেন এবং তাঁর মন্তব্যের স্বপক্ষে তিনটি যুক্তি তুলে ধরলেন সেগুলো ফেলে দেবার নয়। অবশ্যই তাঁর কথাগুলো বিবেচনার দাবি রাখে। কিন্তু কথা হলো এই আইন তো আর হঠাৎ করেই তৈরি হয় নি। একই আইন তখনও ছিল যখন তারা জামায়াতের বিচারের ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করে। তাহলে এতদিন যে তদন্ত করা হলো, অভিযোগ গঠনের চেষ্টা করা হলো সেগুলো কি শুধুই আই-ওয়াশ ছিল? একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে দ্বিতীয় বারের মতো ক্ষমতা গ্রহণের পর সরকারের সামনে যে চ্যালেঞ্জগুলো আসবে তা অনুমান করে সে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্যই কি এটি নিছক একটি রাজনৈতিক চতুরতার আশ্রয়? পূর্বেই বলেছি- সরকারের বা আইনমন্ত্রীর এমন মন্তব্যে আজ কারোরই কিছু আসত-যেতনা যদি সাম্প্রদায়িক রাজনীতিবিরোধী একটি পক্ষকে আশান্বিত করে রাখা না হতো। সরকার যেটা করেছে তা অনেকটা গাছে তুলে মই কেড়ে নেয়ার মতো। কাজেই এর প্রতিক্রিয়া আসবেই। এই পদক্ষেপে সরকারের বেশ কিছু সুবিধা আছে বটে, কিন্তু একুল-ওকুল দু’কুলই হারানোর একটি শঙ্কাও থেকে যাচ্ছে। আবার যে কথা আকাশে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে- অর্থাৎ ‘জামায়াতের সাথে সরকারের সমঝোতার বিষয়’ সেটাই যদি বাস্তব হয়ে থাকে তাহলে সেটা আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য যে কতবড় আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। আইনমন্ত্রী যদিও বলেছেন যে, জামায়াতের সাথে আওয়ামী লীগের মিলবন্ধন কোনোদিনই সম্ভব নয়, কিন্তু বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী যে বিরাট সংখ্যক জামায়াত কর্মী আওয়ামী লীগে যোগদান করছে এবং আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ তাদেরকে সাদরে গ্রহণ করে নিচ্ছে তাতে ঐ সন্দেহকে অসার বলে ফেলে দেয়াও যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে আসল ঘটনা যাই ঘটুক, বাস্তবতার আলোকে বলতে গেলে- আওয়ামী লীগ সরকার নিজের হাতেই সমালোচকদের কাছে বিতর্কের খোরাক তুলে দিচ্ছে।
আইন প্রণয়ন করা সরকারের কাজ। কখন কোন আইন প্রয়োজন, কোন আইনের সংশোধন, পরিমার্জন বা পরিবর্ধন প্রয়োজন তাও দেখার দায়িত্ব সরকারেরই। রাষ্ট্রের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে এ বিষয়ে মন্তব্য করা শোভনীয় নয়। আমি তা করবও না। কিন্তু সরকারের উদ্দেশ্যে যে কথাটি বলব তাহলো, সরকার যদি প্রথম থেকেই দল হিসেবে জামাতের বিচারের ব্যাপারে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার রাখতে পারতো তাহলে আজ আইনমন্ত্রীর এই মন্তব্যে কোনো প্রশ্নই উঠার কারণ থাকতো না। তাই সরকারের সর্বাগ্রে উচিত হবে এ ব্যাপারে আন্তরিকভাবে একটি যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং সে ব্যাপারে জাতিকে সর্বদাই পরিষ্কার ধারণা দেওয়া। এছাড়া কোনো রকম জটিলতার সৃষ্টি করলে সে জটিলতার জালে সরকারের নিজেরই জড়িয়ে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
বিষয়: বিবিধ
৯২৪ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সুন্দর বিশ্লেষণ । অনশেষ ধন্যবাদ ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন