অভিমত- চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও বাস্তবতা

লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ আসাদ আলী ০১ জুন, ২০১৪, ০৩:৫৩:৫২ দুপুর

দেশে নিরাপত্তাহীনতা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে তা কমবেশি সবারই জানা আছে। এও জানা আছে যে, দিন যতই যাচ্ছে ততই আমরা একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পানে এগিয়ে চলেছি। ভয় দেখানোর জন্য বলছি না, আবেগের বশবর্তী হয়েও নয়; নিষ্ঠুর বাস্তবতাকে এড়ানোর কোনো উপায় দেখছি না বলেই কথাটা বলা। বাংলাদেশের দুর্যোগ বহুমাত্রিক। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ধকল কাটাতে হয় প্রায় প্রতিবছরই। এছাড়া অধিক জনসংখ্যা ও তার অনুপাতে কর্মসংস্থানের অপ্রতুলতা হচ্ছে আরেক নীরব দুর্যোগ যার কোনো মৌসুম নেই। বছরের বারোটা মাসই আমাদেরকে এই দুর্যোগের মোকাবেলা করে কাটাতে হয়। আর সবচেয়ে বড় দুর্যোগ হলো রাজনৈতিক দুর্যোগ যা সভ্য ভাষায় রাজনৈতিক সঙ্কট বা রাজনৈতিক বিপর্যয় নামে পরিচিত। দেশের সাম্প্রতিক অবস্থা প্রমাণ করছে যে, এবার রাজনৈতিক বিপর্যয় বেশ শক্তপোক্তভাবেই বাংলাদেশে খুঁটি গেড়েছে। মাসের পর মাস যাচ্ছে কিন্তু রাজনৈতিক যে বিপর্যয় আমাদের দেশে তৈরি হয়েছে তার কোনো ছেড়ে কথা নেই। বোঝা যাচ্ছে, নিকট ভবিষ্যতে এ বিপর্যয় কেটে যাবারও কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে কেউ আশা রাখলে তাকে দোষ দেব না।

কথা বলতে চাই প্রচলিত সিস্টেমে সরকার, বিরোধী দল, গণমাধ্যম, রাষ্ট্র ও জনগণ নিয়ে। কারণ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী যে রাজনৈতিক সঙ্কটগুলোর উত্থান ঘটেছে তার সাথে এই শব্দগুলো ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। যদিও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এই শব্দগুলোর অর্থ ও ব্যাখ্যা উদাহরণসহ অতি সহজভাবে বিন্যাস্ত রয়েছে কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সে ব্যাখ্যার সাথে খুব কমই মিল পরিদৃষ্ট হয়। আমাদের দেশে সরকার, বিরোধী দল, গণমাধ্যম ও বিরাট আকারের জনগণ এ সবই আছে, যা নেই তাহলো তাদের কাজের সুনির্দিষ্ট ভারসাম্য। শক্তিশালী সরকার ও বিরোধী দল, স্বাধীন গণমাধ্যম ও জনগণ নিয়েই তো গণতন্ত্র, তাই নয় কি? তাহলে আসুন আমাদের দেশের গণতন্ত্র দেখা যাক।

ক. সরকার ও বিরোধী দল: গত বছরের শেষ মাসের শেষ দিনটি অবধি আমাদের দেশে কথিত গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের আন্দোলন চলেছে। প্রধান প্রধান গণতান্ত্রিক দলগুলো নাকি তখন দেশে গণতন্ত্রের অস্তিত্ব-অনস্তিত্বের সঙ্কট দেখতে পাচ্ছিল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো এই গণতন্ত্রের অস্তিত্ব রক্ষার্থে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যেই শুরু করলো হানাহানি-মারামারি, নৈরাজ্য ও দমন-পীড়ন। প্রশ্ন হলো উভয়েরই দাবি যখন গণতন্ত্র, তখন এত পরস্পরবিরোধী সহিংসতার কারণ কী? প্রশ্নটির যথার্থ উত্তর দেশের ষোল কোটি মানুষ পেয়েছে কিনা আমি তা জানি না, কিন্তু আমি আজও এর কোনো কূল-কিনারা করতে পারি নি। যাক সে কথা। এরপর একটি নির্বাচন হলো। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াতেই সেটি অনুষ্ঠিত হলো। কিন্তু বড় কয়েকটি রাজনৈতিক দল আবার সে নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করল। তাদের দাবি- তারা এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেবে না। যুক্তি হলো সরকারের উপর তাদের বিশ্বাস নেই। তাই আওয়ামী লীগ সরকার ফাঁকা মাঠে গোল দিল। কেননা কোনো দল যদি সরকারের উপর বিশ্বাস করতে না পারে তাহলে তাদের মধ্যে বিশ্বাস সঞ্চার করতে হবে- এমন কোনো ধারা বাংলাদেশের সংবিধানে নেই। ফলে প্রতিদ্বন্দ্বীহীন নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ এখন পুনরায় সরকারে। অপরদিকে বিরোধী পক্ষে রয়েছে নির্বাচন প্রত্যাখ্যানকারী বিএনপি-জামাত। তারা বিরোধী দলে নেই ঠিকই কিন্তু সরকারের বিরোধিতা মোটেও থেমে নেই। যতভাবে পারা যায় সরকারের সমালোচনা চলছেই। সেই সাথে চলছে কীভাবে সরকারের টুঁটি চিপে ধরে সরকারকে কার্যত অচল করে ফেলা যায় এবং ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করা যায় তার অবিরাম প্রচেষ্টা। সরকার কোনো ত্র“টি করলে তাদের নীরব-নিথর শরীরে প্রাণের সঞ্চার হয়; যেন সরকার একটি ভুল সিদ্ধান্ত নেবে এবং তাতে জনগণের ব্যাপক ক্ষতি সাধন হওয়ায় সরকার জনসমর্থন হারাবে- এই আশাতেই তারা বসে ছিল। নারায়ণগঞ্জের সেভেন মার্ডার ও ফেনীর নৃশংস হত্যাকাণ্ড দেশের মানুষের আত্মা কাঁপিয়ে দিয়েছে- এবিষয়ে কারও কোনো দ্বিমত নেই। এমন কি সরকারেরও কোনো দ্বিমত নেই। ঘটনাটির পর যে অভিযোগগুলো উঠেছে তার মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগানো অভিযোগ উঠেছে র‌্যাবের বিরুদ্ধে। র‌্যাবের যে কর্মকর্তাগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তারা র‌্যাবে এসেছে সেনাবাহিনী থেকে। এই বাহিনীর নিজস্ব বিচারালয় রয়েছে। কাজেই তাদের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ উঠলে তার বিচার করার ব্যাপারে সরকার হুট করে একটি সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। এটি একটি জটিল বিষয় যা বিএনপি-জামাতসহ সব দলেরই জানা আছে। কিন্তু তাতে কী আসে যায়? তারা যেহেতু একটি ইস্যু পেয়ে গেছে কাজেই শুরু হলো সরকারকে নাজেহাল করার তীব্র ও তির্যক বাক্যব্যয়। শুধু শক্তির অভাবে রাজপথে আন্দোলন করা বাদে সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করা হলো এই ইস্যুটিকে নিয়ে সরকারকে বিপদে ফেলার। ওদিকে সভা-সমাবেশের আয়োজন তো চলছেই। গুঞ্জন উঠেছে- বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অধঃপতনের সার্বিক চিত্র তুলে ধরে নাকি বিদেশেও চিঠি পাঠানো হয়েছে। উদ্দেশ্য একটিই, সরকারকে চাপে রাখা। কিন্তু সরকার চাপে পড়লেই যে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়ে যাবে, গুম-খুন-অপহরণ বন্ধ হয়ে যাবে এমন নিশ্চয়তা সাধারণ মানুষ পাবে কীভাবে?

খ. গণমাধ্যম: আসা যাক গণমাধ্যমের বিষয়ে। গণমাধ্যমের কাজ যেহেতু জাতির সম্মুখে যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা এবং

এতদ্বারা জাতিকে সচেতন করে তোলা কাজেই তাদের কাজ-কর্ম সার্বিক বিচারে জনহিতকর হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবতা বলছে অন্য কথা। গণমাধ্যমকে পুঁজি করে যে যা খুশি তাই বলছে, যা খুশি তাই করছে। সাধারণ মানুষকে উস্কানী দিয়ে বিভিন্নভাবে উত্তেজিত করে তোলা হচ্ছে। মিথ্যা-বানোয়াট ও কল্পনাপ্রসূত খবর ছাড়া এক শ্রেণির গণমাধ্যমের দিন অতিবাহিত হয় না। এদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পেছনে গণমাধ্যমের যোগসাজস পাওয়া যায়। কাবার গেলাফ পরিবর্তনের ছবিকে ছাপানো হয় মানববন্ধনের ছবি হিসেবে। আর তাদের এই অমানবিক অন্যায় কাজে সরকার বাধা দিলেই তা হয়ে যায় গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। সাংবাদিকরা তাদের কাজের পরিধির বাইরে গিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ভাড়াটে কর্মী হিসেবে কাজ করছে, স্বীয় ভাবমূর্তি সৃষ্টি বা পত্রিকার কাটতি বাড়ানোর উদ্দেশ্যে দুর্ধর্ষ অপরাধীদের আস্তানায় ঢুকে পড়ছে; যে তথ্য সংগ্রহ করার দায়িত্ব গোয়েন্দা সংস্থার সেই তথ্য উদ্ধারের জন্য বিপদসংকুল চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। কিন্তু এই অযাচিত কাজের পরিণতিসরূপ যখন প্রাণ হারাতে হয় তখন দোষ দেয়া হয় সরকারের উপর। পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয় অমুক সরকারের আমলে এতজন সাংবাদিক খুন হয়েছে, এতজন সাংবাদিক চাকরি হারিয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি।

গ. জনগণ: বাকি থাকলো কোটি কোটি আপামর জনতা। চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সবচেয়ে বেশি নাজেহাল হয় সাধারণ জনগণ। গণতন্ত্র তাদের আশ্বাস দিয়েছে যে, তারাই রাষ্ট্রের পরিচালক, বিধায়ক ও সার্বভৌমত্বের মালিক। জনগণের সেবা করার জন্য, জনগণের সমর্থন নিয়ে কতিপয় ব্যক্তি সরকার গঠন করে মূলত জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার উদ্দেশ্যে। এই যে আশ্বাস, এই যে মন ভোলানো আদর্শ; এটা জনগণের মনে-মস্তিষ্কে পোক্ত রয়েছে বেশ ভালোভাবেই। তাই যখনই কোন দল সরকার গঠন করে তখনই তারা হাজারও দাবি-দাওয়া ও চাওয়া-পাওয়ার হিসাব কষতে শুরু করে। তাদের এই হিসাবে সামর্থ্যরে তুলনায় আকাক্সক্ষার পরিমাণ কখন যে আকাশছোঁয়া হয়ে যায় সে খেয়াল তাদের থাকেনা মোটেও। ফল হয় এই যে, কোনো সরকারই জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার বাস্তব প্রতিফলন ঘটাতে সক্ষম হয় না। কেন হয় না এর উত্তর জনগণের কাছে অদ্বিতীয়। তাদের মতে সরকারের অযোগ্যতাই এর জন্য দায়ী। কিন্তু তারা ভুলেও একবার জাতি হিসেবে তাদের সীমাবদ্ধতার কথা চিন্তা করে না। সব দোষ সরকারের ঘাড়ে চাপিয়ে নিজেরা পবিত্র থাকার এই রীতি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে।

এখন কথা হলো, এই যে বিরোধী দল, গণমাধ্যম, এমনকি জনগণ পর্যন্ত সরকারের উপর বিরূপ ধারণা লাভ এবং সর্বদাই সরকারের সমালোচনা, সরকার বিমুখতা এবং সব দায়িত্ব সরকারের ঘাড়ে চাপিয়ে নিজের দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিচ্ছে, এটাই কি প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির বাস্তবতা নয়? চারিদিকে এত বিরোধিতা, সমালোচনা, সীমাবদ্ধতা ও বাধা-বিঘেœর মধ্যে কোনো সরকারই কি জাতিকে উন্নতির সোপানে আরোহন করাতে সক্ষম হবে? না, হবে না। আজ আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে দেশের যে অবস্থা, বিএনপি থাকলেও এর চেয়ে ভালো অবস্থা বিরাজ করতো এমন নিশ্চয়তা পাওয়া যায় না। তাদের শাসনকাল জাতি এখনও ভোলে নি। কাজেই সর্বাগ্রে প্রয়োজন প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন। অতি শীঘ্রই আমাদের মধ্যে এই বাস্তবতাবোধ জাগ্রত হোক- এমনটাই কামনা করি।

বিষয়: রাজনীতি

৯৫০ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

229056
০১ জুন ২০১৪ বিকাল ০৪:১১
সন্ধাতারা লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File