যে ভয় তাড়া করছে আওয়ামী লীগকে

লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ আসাদ আলী ২৮ মে, ২০১৪, ০৫:৩৮:১২ বিকাল



একদিকে নৈর্বাচনিক দুর্বলতা ও বহির্বিশ্বের স্বীকৃতিহীনতা, অন্যদিকে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা, হত্যা, গুম, অপহরণ, সন্ত্রাস; সব মিলিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের অবস্থা এখন খুব একটা ভালো নেই। এটা ঠিক যে, এই ভালো না থাকার পরিবেশ আজকে হঠাৎ করেই তৈরি হয় নি। এটা গত প্রায় এক বছর ধরে চলে আসা আওয়ামী লীগের ধারাবাহিক সঙ্কটের একটি পর্যায় মাত্র। গত এক বছর যাবৎ বিভিন্ন ইস্যু তাড়া করে বেড়াচ্ছে সরকারকে। ফলে কখনও সঙ্কটাপন্ন, কখনও বিপর্যস্ত, আবার কখনও খেইলুপ্ত বিশেষণে বিশেষায়িত হয়েছে সরকার। কেউ শুনতে পেয়েছে সরকারের পতনধনি, আবার কেউ শুনেছে জয়ধ্বনী। এমনই একটি বহুল আলোচিত ইস্যু হলো ৭১ এর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কার্যক্রম।

মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কার্যকর করার উদ্যোগ সরকারের সাহসী মনোভাবের প্রকাশ ঘটিয়েছে বটে, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সরকারকে যত বাধা-বিঘœ ও বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে তা মোটেও অপ্রতুল নয়। এর জন্য সরকারকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে এবং হচ্ছে। পশ্চিমা পরাশক্তিগুলোর সাথে সরকারের সম্পর্কের অবনতির পেছনে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার অন্যতম একটি কারণ। পশ্চিমারা যে স্বার্থেই হোক সর্বাত্মকভাবে চেয়েছে এই বিচার বন্ধ করতে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানের মিডিয়ার দৌরাত্ম্যও এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করার মত। যদিও সরকারের দৃঢ়তার সামনে সে চেষ্টা তেমন একটা সুবিধা করতে পারে নি, কিন্তু সরকারকে ক্রমাগত চাপের মোকাবেলা করে আসতে হয়েছে প্রতিনিয়ত। অন্যদিকে একই ইস্যুতে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরের চাপও কম পোহাতে হয় নি সরকারকে। গত বছর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বন্ধের দাবিতে যে হরতাল-অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি হয়েছে তার সম্পূর্ণ নেতীবাচক প্রভাব পড়েছে সরকারের উপর। উপর্যুপরি আন্দোলন-সহিংসতার কবলে পড়ে দেশ কার্যত অচল হয়ে পড়েছিল। অর্থনৈতিকভাবে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির শিকার হতে হয়েছিল। জনমানসে বাসা বেঁধেছিল তীব্র অস্বস্তি ও অসহায়ত্ব। একদিকে পশ্চিমা দুনিয়ার ক্রমাগত চাপ, অন্যদিকে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে চলা অস্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তাহীনতা- এই উভয় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সরকারের জন্য মোটেও সহজ ছিল না, বলা যায় অসম্ভবই ছিল। কিন্তু আওয়ামী সরকার উভয় চাপকেই দক্ষতার সাথে প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছে। কীভাবে হয়েছে সেটা একটু পরে বলছি।

দ্বিতীয়ত যেটা আলোচনায় আসে তাহলো তত্ত্বাবধায়ক ইস্যু। এই ইস্যুতে বাংলাদেশের প্রায় সবক’টা রাজনৈতিক দল জড়িয়ে পড়ে। শুরু হয় হরতাল-অবরোধ আর সহিংসতার মহোৎসব। নিরাপত্তাহীনতার চূড়ান্ত পর্যায় পরিদৃষ্ট হয়েছে সেসময়। কথিত আন্দোলনের নামে শুরু হয় অরাজকতা। যত্রতত্র ঘটতে থাকে প্রাণহানি, অঙ্গহানি। হরতাল, অবরোধ, সহিংসতা, হামলা-মামলা, সংঘর্ষ বাঙালির নিত্য সিডিউলে স্থান করে নেয়। বাসের মধ্যে ছোঁড়া হয় ককটেল বোমা ও পেট্রোল বোমা। মুহূর্তের মধ্যে জ্বালিয়ে অঙ্গার করা হয় তরতাজা সাধারণ মানুষকে। রাস্তার পাশে পড়ে থাকে খেলনা সদৃশ ককটেল। খেলনা ভেবে তুলে নেয়ায় ঝলসে যায় অবুঝ শিশুর শরীর। এক কথায় বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম একটি নিকৃষ্ট সময় অতিক্রান্ত হয় গত বছরের শেষের কয়েকটি মাসে। বলা বাহুল্য, এই সবকিছুই হচ্ছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার পতন বা সরকারকে নমনীয় করার উদ্দেশ্যে, ক্ষেত্রবিশেষে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া বন্ধের উদ্দেশ্যে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার এখানেও নমনীয়তার কোনো চিহ্ন রাখে নি, যা ছিল অবাক করার বিষয়।

শুধু তাই নয়, প্রধান প্রতিপক্ষকে বাইরে রেখে আওয়ামী লীগ একতরফা নির্বাচনের ব্যবস্থা করে এবং স্বাভাবিকভাবেই পুনরায় নির্বাচিত হয়ে এখন তারা ক্ষমতাসীন। আবার এই সময়ের মধ্যেই জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসিও কার্যকর করা হয়। কিন্তু বলতে গেলে সরকার বিরোধীরা এবার তেমন কোনো বাধার সৃষ্টি করতে সক্ষম হয় নি। ফলে নির্বাচন পরবর্তী প্রায় ৪/৫ মাস পেরিয়ে গেলেও বিরোধী পক্ষটি সরকারকে মোকাবেলা করার জন্য রাজপথে নামে নি। তাদের যাবতীয় সরকার বিরোধিতা ও সমালোচনা সীমাবদ্ধ রয়েছে প্রচার প্রচারণা, বক্তব্য-বিবৃতি ও জনসমাবেশের ভেতরেই। এখন আর কথায় কথায় হরতাল হয় না, অবরোধ হয় না। বিরোধী পক্ষের ভাঙচুর, জ্বালাও-পোড়াও এর খবরও তেমন একটা চোখে পড়ে না। অবশ্য তেমনটি করার সক্ষমতাই বা কতটা আছে তাও বিবেচনার বিষয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো এই স্তব্ধ পরিস্থিতিও আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য অশনিসংকেত হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে। বলা বাহুল্য আওয়ামী লীগ সরকার এখন পূর্বের যে কোনো সময়ের চেয়ে কম চাপ মোকাবেলা করছে- এমনটা বলার উপায় নেই। চলমান ঘটনাবলীর দিকে দৃষ্টি দিলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, আওয়ামী লীগ এখন এক অজানা আতঙ্কে ভুগছে, ভয় তাড়া করে বেড়াচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকারকে। কিসের ভয়? ব্যাখ্যা করছি।

একটি প্রশ্ন ঝুলিয়ে রেখেছিলাম যে, আওয়ামী লীগ কীভাবে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সরকার বিরোধী সহিংস আন্দোলন শক্তভাবে প্রতিরোধ করল? উত্তর হচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকারের যত বিপর্যয়ের কথা বলে আসলাম তা কাটিয়ে উঠতে তারা একচেটিয়াভাবে আইনÑশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করেছে। র‌্যাব-পুলিশ, বিজিবি কখনও স্বতন্ত্রভাবে আবার কখনও যৌথভাবে অপারেশন চালিয়ে বিরোধী পক্ষের সহিংসতা-সন্ত্রাস বা আন্দোলন, যাই বলা হোক না কেন তার মোকাবেলা করেছে। এই কাজ করতে গিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে বিরোধী পক্ষের বহু নেতা-কর্মীর প্রাণহানি ঘটেছে। বিরাট সংখ্যক মানুষ আহত হয়েছে, পঙ্গু হয়েছে। অনেকে এখনও জেলে আছে। আবার ক্ষেত্রবিশেষে দেখা গেছে, সহিংস আন্দোলনকারীদের আক্রমণে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও হতাহত হয়েছেন। কিন্তু সম্পূর্ণ নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে থেকেও প্রশাসন আন্তরিকভাবে সরকারের আনুগত্য করে গেছে। সে সময় র‌্যাব-পুলিশের সামান্য দায়িত্বহীনতা বা উদাসীনতাও সরকারের জন্য বিরাট ক্ষতির কারণ হতে পারতো, কিন্তু তেমনটি হয় নি। তাই অনেক সরকারপক্ষের বুদ্ধিজীবীর মুখেও শোনা গেছে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আন্তরিক আনুগত্যই সরকারের টিকে যাবার মূল কারণ। অর্থাৎ প্রশাসন হচ্ছে এই সরকারের অন্যতম শক্তিশালী একটি বাহু। বিষয়টি প্রশাসনও ভালোভাবেই জানে। আর এটাই সরকারের জন্য ভয়ের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। র‌্যাব-পুলিশকে আলাদা করে বলার দরকার হচ্ছে না যে, তাদের যে কোনো দাবি বা চাহিদা পূরণে সরকার বাধ্যতামূলকভাবেই অগ্রাধিকার দেবে। তাছাড়া এই সরকারের কতটা জনসমর্থন রয়েছে তাও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অজানা নয়।

এই বাস্তবতা প্রশাসনের বেশ কিছু কর্মকর্তাকে ক্রমেই স্বেচ্ছাচারী করে তুলছে। তারা হয়ে পড়ছেন অনিয়ন্ত্রিত। জবাবদিহিতা হয়ে পড়ছে অনিশ্চিত। ফল হয়েছে এই যে, অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের পরিমাণ অনেক বেশি। সাম্প্রতিক নারায়ণগঞ্জের সেভেন মার্ডারের সাথে র‌্যাবের সম্পৃক্ততার অভিযোগ এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে র‌্যাবের বিরুদ্ধে সারা দেশব্যাপী উত্থাপিত অভিযোগগুলো প্রমাণ করে যে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখন সরকারের গলার কাঁটাতে পরিণত হয়েছে। এমতবস্থায় বর্তমান সরকার না পারছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি কঠোর হতে, না পারছে তাদের অপকর্মকে ঢেকে রাখতে। কঠোর হতে গেলে প্রশাসনের নিরবচ্ছিন্ন সমর্থন ও আনুগত্য থেকে সরকার বঞ্চিত হয়ে যেতে পারে যা সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় ভয়ের বিষয়। আবার যদি তাদের সকল স্বেচ্ছাচারিতা ও অনিয়ন্ত্রিত অপকর্মকে চলতে দেয়া হয় তাহলে ক্রমেই জনগণের মধ্যে সরকার-বিদ্বেষ বাড়তে থাকবে এবং এক পর্যায়ে তার গণবিস্ফোরণ ঘটাও অস্বাভাবিক কিছু হবে না। অর্থাৎ সরকার এখন উভয় সঙ্কটে। এরই মধ্যে আবার ভারতের লোকসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বান্ধব কংগ্রেসের ভরাডুবি আওয়ামী লীগ সরকারের দুশ্চিন্তার নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

বিশ্লেষকদের ধারণামতে, একটি সরকার কখনও সম্পূর্ণ প্রশাসন নির্ভর হয়ে থাকতে পারে না। যে কোনো সিস্টেমেই সরকারের জন্য জনসমর্থন অপরিহার্য। জনসমর্থনকে উপেক্ষা করে শুধু প্রশাসনকেই শক্তি হিসেবে বিবেচনা করলে গুটিকতক সঙ্কট মোকাবেলা করা যায় বটে, কিন্তু এর করুণ পরিণতি এড়ানো সম্ভব হয় না। এই পরিণতি শুধু সংশ্লিষ্ট সরকারকেই নয়, জনগণকেও ভোগ করতে হয়। এমতবস্থায় বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের সামনে একটি পথই খোলা রয়েছে, তথা জনসমর্থন পুনরুদ্ধার। কিন্তু সেটা আওয়ামী লীগের জন্য যে মোটেও সহজ হবে না, তা আওয়ামী লীগ ভালোভাবেই অবগত আছে। এখন দেখার বিষয় ভয়কে জয় করার পরীক্ষায় আওয়ামী লীগ কতদূর যেতে পারে।

আজকের দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত আমার একটি লেখার লিংক

বিষয়: রাজনীতি

৯৬৩ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

227586
২৮ মে ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:৩০
বুঝিনা লিখেছেন : Thinking Thinking Thinking At Wits' End At Wits' End At Wits' End
227619
২৮ মে ২০১৪ রাত ০৮:০৮
ভিশু লিখেছেন : মানুষ খুন-গুমকারী র‍্যাব-পুলিশ দিয়ে এই অপশাসনকে কিছুতেই জনগণের সরকার বলা তো দুরের কথা - ভাবাই যায় না!

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File