সরকারের সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ (পর্যবেক্ষণ)
লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ আসাদ আলী ২৭ মে, ২০১৪, ০২:৪২:২০ দুপুর
নারায়ণগঞ্জ থেকে ফেনী, ফেনী থেকে লক্ষ্মীপুর; ঘুরে ফিরেই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে অপহরণ, গুম, খুন, সহিংসতা, নৃশংসতা ও বর্বরতার হৃদয়বিদারী চিত্র। কিছুদিন আগেও বলা হচ্ছিল- নারায়ণগঞ্জ এখন আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়েছে। এরপর নারায়ণগঞ্জের শোকের ছায়া কাটতে না কাটতেই যোগ হলো ফেনীর নৃশংস হত্যাকাণ্ড। অন্যদিকে গণমাধ্যমসূত্রে জানা যাচ্ছে যে, এ সমীকরণ থেকে পিছিয়ে নেই লক্ষ্মীপুরসহ দেশের অন্যান্য জেলাগুলোও। ক্ষমতার দাপট, আধিপত্য বিস্তার ও স্বার্থকেন্দ্রিক লড়াইয়ের প্রতিযোগিতা এখন সারা দেশব্যাপী বিস্তার লাভ করেছে। অর্থাৎ গোটা দেশই এখন আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়েছে- এমনটা বলা মোটেও অতিরঞ্জন হবে না। স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টিকে সরকারের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
বলা বাহুল্য, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের জন্য সাম্প্রতিক সময়টি মোটেও ভালো যাচ্ছে না। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার পর থেকেই শুরু হয়েছে এই দুঃসময়। দিন যতই এগোচ্ছে ততই যেন আওয়ামী লীগের চলার পথ সংকীর্ণ হয়ে পড়ছে। আর এই সংকীর্ণতা কাটিয়ে উঠার সম্ভাবনাও ম্লান করে দিচ্ছে যে ঘটনাগুলো তার মধ্যে সাম্প্রতিক নারায়ণগঞ্জ ও ফেনীর নৃশংসতা অন্যতম। এই দু’টি ঘটনার সাথেই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর নাম। ঘটনাগুলোর ভিক্টিম ও অপরাধী উভয় খাতাতেই আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের নাম শোভা পাচ্ছে। নারায়ণগঞ্জের হত্যাকাণ্ডের পেছনে যে আওয়ামী লীগের অন্তর্কোন্দল ও আধিপত্য বিস্তার দায়ী তাতে কোনো বিতর্কের অবকাশ নেই। আর ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হক একরাম হত্যাকাণ্ডের পেছনেও আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরাই ইন্ধন যুগিয়েছে এমন খবরও আকাশে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। একইভাবে লক্ষ্মীপুরের দুই আওয়ামী লীগ কর্মীর খুনের পেছনেও যদি আওয়ামী লীগেরই কেউ জড়িত থাকে তাহলেও অবাক হবার কিছু নেই। এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, সাম্প্রতিক এই হত্যাকাণ্ডগুলোতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকার। জনগণের ইচ্ছা ও আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটানো তো দূরের কথা এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে সরকারের প্রতি জনতা তাদের ন্যূনতম আস্থাও হারাতে বসেছে, এটা উপলব্ধি করার সক্ষমতা নিশ্চয়ই সরকারের আছে। এভাবে চলতে থাকলে নিশ্চিতভাবেই আওয়ামী লীগ সরকারকে আরও করুণ ভবিষ্যতের মোকাবেলা করতে হবে।
৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের পর আশা করা হচ্ছিল যে, “নব্য এই সরকারের প্রধান ত্র“টি অর্থাৎ নৈর্বাচনিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে তারা ব্যাপকভাবে জনহিতকর উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করবে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতি নির্ধারণে পূর্বের তুলনায় আরও সচেতন হবে। এছাড়া বিগত বছরগুলোতে বহু বিতর্কের জন্ম দেওয়া ছাত্রলীগ, যুবলীগ ইত্যাদি অঙ্গসংগঠনসমূহকে ভালোভাবে ঢেলে সাজাবে। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজী, টেন্ডারবাজী, আধিপত্যের লড়াই, হত্যা, ধর্ষণসহ যত অভিযোগ সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে উঠেছে তা বন্ধে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তাদেরকে দিয়ে জনহিতকর বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে জনগণের সাথে সরকারের দূরত্ব ঘোঁচানোর চেষ্টা করা হবে।” হয়তবা চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো ফলাফল যা আশা করা হচ্ছিল তার বিপরীত দৃশ্যই দেখতে হচ্ছে। আওয়ামী লীগের মাঠ পর্যায়ের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নেতাকর্মীর বেপরোয়া কর্মকাণ্ড, লাগামহীন দৌরাত্ম্য, আধিপত্য বিস্তারের আত্মঘাতী লড়াই ইত্যাদি প্রমাণ করেছে যে, তারা নিজেদের দলীয় সুবিধা-অসুবিধা, সুসময় বা দুঃসময় অনুধাবন করতে সম্পূর্ণ অপারগ।
দ্বিতীয় বারের মতো ক্ষমতা গ্রহণের পর সরকারকে সর্বপ্রথম নির্বাচনের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হতে হয়। বিভিন্ন মহল থেকে সরকারকে জনবিচ্ছিন্ন সরকার হিসেবে চিত্রায়িত করার চেষ্টা হয়। কিন্তু পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ বেশ কিছু দেশের সমর্থন নিয়ে পথচলা শুরু করে নবনির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকার। তারপর থেকে গত কয়েক মাসের মধ্যে অপর যে ঘটনাটির কারণে সরকারকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে তাহলো বহুল আলোচিত নারায়ণগঞ্চের সেভেন মার্ডার। ঘটনাটির সাথে র্যাবের সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠায় তা আরও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। সেই সাথে সরকারের জন্য বয়ে আনে ব্যাপক অস্বস্তি। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে রাষ্ট্রীয় এই এলিট বাহিনীর অপব্যবহার নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে একের পর এক প্রশ্ন উত্থাপিত হতে থাকে। অতঃপর অভিযুক্ত র্যাব কর্মকর্তাদের গ্রেফতার ও আইনের অধীনে আনার মাধ্যমে সরকার কিছুটা আত্মপক্ষ সমর্থন করার প্রয়াস পায়। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের এই আলোচিত-সমালোচিত ঘটনাটির রেশ কাটার আগেই ফেনীতে ঘটে যায় সরকারের জন্য আরও একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা। দিনে-দুপুরে প্রকাশ্যে রাস্তায় গাড়ি আটকিয়ে ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানকে গুলি করে এবং আগুনে পুড়িয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী এ ঘটনাতেও আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও আধিপত্য বিস্তারের নগ্ন নেশা প্রধানত দায়ী। ফলে আওয়ামী সরকারের জন্য ঘটনাটি কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতই পরিদৃষ্ট হচ্ছে। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ এখন নিজের হাতে নিজেই নিরাপদ নয়, জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা তো পরের বিষয়। এমতবস্থায় সরকারের ভবিষ্যৎ কতটা স্বচ্ছ হতে পারে তা পরিষ্কার নয়।
যে কোন প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে কোনো একটি সংগঠন, দল বা জাতির জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন ঐক্য। আর আওয়ামী লীগের এত করুণ অবস্থার সৃষ্টিই হয়েছে ঐক্যের অভাবে। তাই, চলমান দুর্গতি থেকে সরকারের সহসা মুক্তি মিলবে বলে মনে হচ্ছে না। তবে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলে এখনও সফলতা লাভ সম্ভব হতে পারে। সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ যদি দল হিসেবে তাদের আশু বিপর্যয় মোকাবেলা করতে চায় তাহলে সর্বপ্রথম তাদেরকে দলীয় ঐক্যের প্রতি নজর দিতে হবে। অপরদিকে যদি জাতীয়ভাবে সমস্যার মোকাবেলা করতে চায় তাহলে দরকার হবে জাতীয় ঐক্য। এখন প্রশ্ন হলো আওয়ামী লীগ সরকার কি পারবে সারাদেশে চলমান নিরাপত্তাহীনতাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করে এবং দলীয় ও জাতীয় ঐক্যকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে সে চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে? সময়-ই এর উত্তর দেবে।
বিষয়: রাজনীতি
১১৫০ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
নৃশংসতাই তাদের পরিচায়ক!
মন্তব্য করতে লগইন করুন