শিক্ষার হার নয়, মান যাচাই আবশ্যক (পাশ করা বিদ্যা আর প্রকৃত সুশিক্ষা এক নয়)
লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ আসাদ আলী ১৯ মে, ২০১৪, ০৩:৩৯:২৮ দুপুর
“ছোট জিনিসের মোহে বড় জিনিস হারাতে যে দুঃখ বোধ করে না, সে আর যাই হোক, শিক্ষিত নয়। শিক্ষা তার বাইরের ব্যাপার, অন্তরের ব্যাপার হয়ে ওঠে নি। লেফাফাদুরস্তি আর শিক্ষা এক কথা নয়। শিক্ষার আসল কাজ জ্ঞান পরিবেশন নয়, মূল্যবোধ সৃষ্টি; জ্ঞান পরিবেশন মূল্যবোধ সৃষ্টির উপায় হিসেবেই আসে। তাই যেখানে মূল্যবোধের মূল্য পাওয়া যায় না, সেখানে শিক্ষা নেই।”- কথাগুলো আমার নিজের নয়। বিশিষ্ট সাহিত্যিক মোতাহের হোসেন চৌধুরীর ‘শিক্ষা ও মনুষ্যত্ব’ নামক প্রবন্ধের অংশবিশেষ। কথাগুলো এখানে উল্লেখ করার পেছনে কারণ আছে। আমাদের দেশে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষার মান নিয়ে যথেষ্ট ভাববার অবকাশ রয়েছে। আমরা দেখছি প্রতি বছর লাখ লাখ ছাত্র স্কুল-কলেজে ভর্তি হচ্ছে, আবার একই সংখ্যায় পাশ করে বেরও হচ্ছে। অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে ছেলে-মেয়েদের পাশের হার অনেক বেশি। কিছুদিন পূর্বে এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলো, যেখানে পাশের হার ছিল ৯১.৩৪ জন। জানা গেল এবারে ১৩ লক্ষের বেশি ছেলে-মেয়ে পাশ করেছে, যাদের মধ্যে আবার প্রায় দেড় লাখ পেয়েছে জিপিএ ৫। ফল নিয়ে স্বাভাবকিভাবেই গর্ব প্রকাশ করছেন পাশ করা শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষক থেকে শুরু করে রাজনীতিবদরা পর্যন্ত। আপাতদৃষ্টিতে দৃশ্যমান এই পাশের হার নিয়ে এত উচ্চবাচ্চ করা হলেও শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন খুব কম জনই। অথচ এটিই অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বিবেচ্য হওয়া উচিত ছিল।
শিক্ষার মান এককভাবে শিক্ষার্থীদের ফলাফলের ওপর নির্ভরশীল নয়। দেশের সব শিক্ষার্থী পরীক্ষায় কৃতকার্য হলেও বলা যাবে না যে, দেশের শিক্ষাব্যবস্থা গুনগতমানের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছেছে। শিক্ষার মান নির্ভর করে শিক্ষাক্রমের সফল বিস্তারণ, শিক্ষাদান পদ্ধতি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভৌত অবকাঠামো সুযোগ-সুবিধা, মানসম্মত শিক্ষক, গুণগত শিক্ষা ও সে শিক্ষার ফলাফলের ওপর। তাই বলা যায়, কেবল ফল বা জিপিএ বৃদ্ধি অথবা হাতেগোনো কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের শতভাগ পাসের হিসাব দিয়ে দেশের শিক্ষার মান কোনোভাবেই বিচার করা যায় না। পাস করা বিদ্যার প্রতি আমাদের যত আগ্রহ। নাম্বারের সূচকে আমরা শিক্ষার্থীর মেধা যাচাই করি। বেছে বের করি কে মেধাবী, কে মেধাশূন্য। এই মানদণ্ড এখন সর্বব্যাপী কার্যকর। এর ফলে একজন শিক্ষার্থীর যাবতীয় ধ্যান-জ্ঞান, কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে নির্দিষ্ট পরিমাণ মার্কস অর্জনের মধ্যে। স্কুল-কলেজ, কোচিং বা প্রাইভেট টিচারের কাছে যেখানেই সে শিক্ষা অর্জনের জন্য যাচ্ছে, তাকে ঘুরে ফিরেই ঐ নির্দিষ্ট কয়েকটি সাবজেক্টের নির্দিষ্ট পরিসীমার ভেতরে আটকে রাখা হচ্ছে। ইনিয়ে-বিনিয়ে ও ক্ষেত্রবিশেষ ধমক দিয়ে বা শাস্তি দিয়ে বাধ্য করা হচ্ছে সে বিষয়গুলোতে মনোনিবেশ করার জন্য। ফলে ছাত্র-ছাত্রীর মেধা, চিন্তা- চেতনা, মননশীলতা ও মূল্যবোধ বিকশিত হবার সুযোগ পাচ্ছে না। সে পথ রুদ্ধ হয়ে থাকছে।
হরেক রকম পাবলিকেসন্স এর নোট বা গাইড বই দিয়ে বাজার ভর্তি হয়ে আছে। অভিভাবকরা নিজে গিয়ে একই বিষয়ের একাধিক নোট বই ক্রয় করে আনছেন। সেটাকে মুখস্ত করার জন্য সহজ করে দিচ্ছে বিভিন্ন কোচিং সেন্টার ও প্রাইভেট টিচাররা। আর নিজের শত অনিচ্ছা সত্ত্বেও তা মুখস্ত করছে সাধারণ কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। ফলে যার স্মৃতিতে ধারণ ক্ষমতা বেশি, তার ফলাফল হচ্ছে ভালো। যার ধারণ ক্ষমতা দুর্বল, মেধা তালিকায় তার কোনো স্থান হচ্ছে না, বরং সে ছাত্র অভিভাবক-শিক্ষক ও বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে পরিচিতি পাচ্ছে বেয়াড়া ও অকর্মণ্য ছেলে হিসেবে। তার ভবিষ্যৎ নিয়ে সকলেই থাকে চিন্তিত, শঙ্কিত। এটাই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ব্যবহারিক রূপ। তাত্ত্বিকভাবে যা-ই দাবি করা হোক, বাস্তবতা হলো-আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় কোমলমতি ছেলে- মেয়েদের সিলেবাস নামক একপ্রকার অদৃশ্য শিকল দিয়ে আষ্টে-পৃষ্ঠে বেঁধে রাখা হয়। তারা নির্দিষ্ট কয়েকটি বই-এর নির্দিষ্ট কিছু লাইন পড়ে, ভালোভাবে মুখস্ত করে, মাসের পর মাস স্মৃতিতে ধারণ করে রাখে, অতঃপর পরীক্ষা এলে হুবহু লিখে দিয়ে আসে- এই হলো একজন শিক্ষার্থীর কর্মপরিধী। এর বাইরে সে যা-ই করবে, সেটাই অযৌক্তিক ও অপ্রয়োজনীয় হিসেবে পরিগণিত হয়। এর কুফল কিছুটা আন্দাজ করতে পেরে কয়েক বছর যাবৎ বিশ্বের কতিপয় দেশের মতো আমাদের দেশেও মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে তথাকথিত সৃজনশীল পদ্ধতির শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা হয়। কিন্তু উদ্দেশ্য সৎ হলেও কার্যক্ষেত্রে এ সিদ্ধান্তেরও আশানুরূপ ফলাফল আসছে না। বরং এ ব্যবস্থাতে শিক্ষার্থীদের সামর্থ্যরে বাইরে অতিরিক্ত ভার অর্পন করা হয়েছে- বিভিন্ন সময়ে এমনটাই অভিযোগ করা হয়েছে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে। এ ব্যবস্থা প্রয়োগ হবার পর থেকেই শিক্ষার্থীরা অনেকটা বাধ্যতামূলকভাবেই গাইড নির্ভর হয়ে গেছে। অর্থাৎ আগে যে কয়টা পৃষ্ঠা মুখস্ত করতে পারলেই তাদের মুক্তি আসতো, এখন তার দ্বিগুণ বা তিনগুণ বইয়ের পাতা মুখস্ত করতে হচ্ছে, ধারণ করতে হচ্ছে, আবার পরীক্ষায় গিয়ে তা উগলে দিতে হচ্ছে। এ পদ্ধতিতে একটি ছাত্র কতটুকু শিক্ষিত হবার সুযোগ পাবে তা অবশ্যই চিন্তার বিষয়। সুশিক্ষিত লোক মাত্রই স্বশিক্ষিত- তা কারও অজানা নয়। কিন্তু যে কোমলমতি ছেলেগুলো প্রচলিত ব্যবস্থায় প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার গণ্ডি অতিক্রম করলো, যাদেরকে বলা হচ্ছে দেশের সম্পদ, তারা কি স্বশিক্ষিত হবার সুযোগ পেয়েছে?
একটি জাতি শিক্ষিত হতে চায় কেন? শিক্ষার উদ্দেশ্য কী? প্রশ্নটি আমাদের জন্য নিতান্তই অস্বস্তিকর বটে, কারণ সচরাচর আমরা এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হই না। বস্তুত শিক্ষা হলো একটি জাতির চিন্তা-চেতনা, বিবেক ও আত্মমর্যাদাবোধ সৃষ্টির অন্যতম পাথেয়। শিক্ষা মানুষকে মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করে। মানুষের মধ্যে মূল্যবোধ সৃষ্টি করে, মানুষ হিসেবে তার অধিকার ও কর্তব্য নিশ্চিত করে। সে কেন পৃথিবীতে এসেছে, তার আসল কাজ কী, কীভাবে তার জীবনের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করা সম্ভব সে প্রশ্নের উত্তর দেয় শিক্ষা। এই শিক্ষা হতে পারে পারিবারিকভাবে, সামাজিকভাবে ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে। অথচ শিক্ষাকে এখন পরিপূর্ণভাবে ভারসাম্যহীন করে ফেলা হয়েছে। এখন আর কেউ মানবতার কল্যাণের উদ্দেশ্যে শিক্ষালাভের কথা ভাবে না। বর্তমানে ছাত্র-ছাত্রীরা স্কুল-কলেজে যায় ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হয়ে অর্থ উপার্জন করার লক্ষ্য নিয়ে। ফলে শিক্ষাজীবনের এক শিকল থেকে মুক্ত হয়ে তারা অর্থ নামক আরেক শিকলে নিজেদের জড়িয়ে ফেলেন। তারা এটা বোঝেন না যে, প্রচলিত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে তারা যতই অর্থ-সম্পদের সাগরে অবগাহন করুক না কেন তারা কার্যত শৃঙ্খলিত, পরাধীন। প্রচুর অন্নবস্ত্র পেয়ে আলো-হাওয়ার স্বাদবঞ্চিত মানুষ কারাগারকেই স্বর্গতুল্য মনে করে, কিন্তু আসলেই কি তাই? যে লোক বাইরের আলো-হাওয়ার স্বাদ পেয়েছে সে ঐ কারাগারকে কারাগারই মনে করবে। অন্নবস্ত্রের প্রাচুর্যের চেয়েও মুক্তি বড়, এই বোধটি মানুষের মনুষ্যত্বের পরিচয়। কিন্তু তা কি প্রচলিত শিক্ষায় শিক্ষিত বস্তুবাদীরা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে? যে শিক্ষায় মনুষ্যত্ববোধ, দেশপ্রেম, মানবতা, বিবেক অর্জিত হয় না, যে শিক্ষা মানুষকে আত্মকেন্দ্রিকতা বিসর্জন দিয়ে মানবতার কল্যাণে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করার অনুপ্রেরণা জোগায় না, সেই শিক্ষা দ্বারা কষ্মিনকালেও জাতির ভাগ্য পরিবর্তন হবে না। পাশ করা বিদ্যা দিয়ে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়া যায়, উচ্চ বেতনের সরকারি চাকুরিজীবী হওয়া যায়, কিন্তু সুশিক্ষার অভাবে সে পেশার পবিত্রতা রক্ষা করা সম্ভব হয় না। তাই দেখা যায়, যতই আমাদের দেশে তথাকথিত শিক্ষার হার বাড়ছে, লাখ লাখ লোক শিক্ষিত হয়ে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, প্রাতিষ্ঠানিক, ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন পদে বসছে ততই অন্যায়-অবিচার, যুলুম, ধনী-দরিদ্র বৈষম্য, ঘুষ, দুর্নীতি বাড়ছে। এই শিক্ষা মানুষকে অন্যায়-অসৎ কর্মকাণ্ড থেকে ফেরাতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। এত কিছুর পরও কি এই শিক্ষাব্যবস্থাকে ভারসাম্যপূর্ণ বলা সম্ভব? প্রশ্ন আসতে পারে, এই যখন অবস্থা তখন মুক্তির উপায় কী? মুক্তির উপায় আছে। কিন্তু তা গ্রহণ করার মানসিকতা এখনও আমাদের গড়ে ওঠে নি। যদি আমরা সত্যিকার অর্থেই প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার অকার্যকারিতা উপলব্ধি করতে পারতাম তাহলে বহু পূর্বেই এর একটি নিস্পত্তি হয়ে যেত। আমরা সেটা করি নি। তিক্ত অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও আমরা এখনও ছেলে-মেয়েদের পাশের হারের দিকে তাকিয়ে রয়েছি। দিন দিন পাসের হার বাড়ছে দেখে আমরা আনন্দে আহ্লাদিত হচ্ছি। তাই, সর্বপ্রথম আমাদের উচিত হবে পাশের হার না দেখে শিক্ষার মান যাচাই-বাছাই করা, কীভাবে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি করা যায় সে লক্ষ্যে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা। তবে সবচেয়ে বড় যে পরিবর্তনটা জরুরি তা হলো মনস্তাত্বিক। মনস্তাত্বিকভাবে আমাদেরকে অর্থ-বিত্তের সংকীর্ণ পরিধি থেকে মুক্ত হয়ে মানবতার কল্যাণে আত্মনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
বিষয়: বিবিধ
১২২৩ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সব কিছুতে ফেস ভ্যালুর একটা অগ্রাধিকার আছে এবং সে জন্যই যে কোন কিছুর বিজ্ঞাপনে মেয়েরাই থাকে ।
মহত পেশাগুলোতেও এখন ব্যবসা ঢুকে পড়েছে । তাই এই ব্যবসার প্রচার ও প্রসারে চাই সুন্দর ফেস ।
প্রোডাক্টের মান ও সংখ্যা পরষ্পর ব্যস্তানুপাতিক।
আর আপনার সাথে আমি সম্পূর্ণ সহমত।
মন্তব্য করতে লগইন করুন