ভারতের সাথে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক কাম্য, বৈষম্য নয়
লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ আসাদ আলী ১৭ মে, ২০১৪, ০৩:০৮:৩৭ দুপুর
ভারতীয় উপমহাদেশের পথে-প্রান্তরে, অফিস-আদালতে, আকাশে বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে যার নাম তিনি হলেন ভারতের বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদী। গুজরাটের চা বিক্রেতা মোদী উত্তরোত্তর উন্নতির সোপান বেয়ে এখন বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের কাণ্ডারিতে পরিণত হয়েছেন। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে বিজয়ী বিজেপি ও হব প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এখন তাই বাংলাদেশেরও আলোচনার বিষয়বস্তু। মোদীর শাসিত ভারতের প্রতিবেশি হিসেবে বাংলাদেশের কোন দল সুবিধা পাবে, সাহায্য পাবে বা সমর্থন পাবে আর কোন দল দাদাদের দৃষ্টি আকর্ষণে ব্যর্থ হয়ে প্রতিপক্ষের করুণার বস্তুতে পরিণত হবে সে উত্তেজনায় বিশেষ এক মুহূর্ত অতিক্রম করছে বাংলাদেশের রাজনৈতক অঙ্গন।
বিজেপি জিতলে মোদীর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বিষয়টি সবার কাছে পূর্ব হতেই পরিষ্কার ছিল। শুধু ফলাফলই বাকি ছিল। অতঃপর শুক্রবারের ফলাফল প্রকাশ হবার পর থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠে শুরু হয় তুমুল হৈ চৈ। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়েছে যেন এতদিন যাবৎ সবাই মোদীর বিজয়ের জন্য প্রতিক্ষা করে বসে ছিলেন। ফল প্রকাশের পরপরই শুরু হয় চিঠি চালাচালি। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামীসহ আরও বেশ কিছু রাজনৈতিক দলের মধ্যে চিঠি প্রদান মারফত নরেন্দ্র মোদীকে শুভেচ্ছা জনানোর জন্য একপ্রকার হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। উদ্দেশ্য একটাই- ভারতের হব প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ, অতঃপর কিছু অনুগ্রহ। কিন্তু সেটা তো আর সবার ভাগ্যে জোটে না। রাজনীতিকরাও এটা চান না যে, ভারতের নতুন সরকারের সাথে বাংলাদেশের প্রতিটি দলেরই সুসম্পর্ক থাকুক। মুখে যাই বলা হোক, বাস্তবে তাদের মূল চাওয়া হলো আত্মকেন্দ্রিক। বাংলাদেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দলই চায় ভারতের বিশেষ আস্থাভাজন হয়ে যাবতীয় রাজনৈতিক সুবিধা আদায় করতে। অবশ্য পরিস্থিতিও এর জন্য কিছুটা হলেও দায়ী। কারণ, ভারতের সাথে বাংলাদেশের ভৌগলিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কটাই এমন যে, ভারতের সমর্থন ছাড়া বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেওয়া এক প্রকার দুঃসাধ্য ব্যাপার। বাংলাদেশের জাতীয় সমস্যাগুলোর একটি বিরাট অংশ রয়েছে যেগুলোর সমাধানে ভারতের সহযোগিতা বাঞ্ছনীয়। আবার ভারতের সামান্য অসহযোগিতাই এদেশে শত শত সমস্যা সৃষ্টি করার জন্য যথেষ্ট। তাই, এটা একটা অলিখিত ও অঘোষিত বিধান যে, বাংলাদেশে সরকার পরিচালনা করতে হলে ভারতের সাথে সুসম্পর্ক থাকা জরুরি। সেটা বাস্তবায়িত না হবার অর্থই হলো ‘জলে বাস করে কুমিরের সাথে লড়াই করা’। সুতরাং, ভারতের নবনির্বাচিত দল ও হব প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর এমন প্রচেষ্টা সমালোচিত হবার নয়। পাশাপাশি দু’টি দেশের সরকার ও জনসাধারণ একে অপরের সাথে সাহায্য-সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও মহানুভবতার সংমিশ্রণে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করবে এটাই তো স্বাভাবিক চিরন্তন নিয়ম।
কিন্তু সমস্যা হলো বাস্তবতা সেটা স্বীকার করছে না। বিগত বছরগুলোতে ভারতের সাথে বাংলাদেশের যে সম্পর্ক আমরা দেখেছি তাকে কোনোভাবেই পারস্পরিক সহযোগিতামূলক ও ভারসাম্যযুক্ত সম্পর্ক বলা যায় না। মূলত সে সম্পর্ক ছিল একপেশে ও মারাত্মকভাবে ভারতের স্বার্থকেন্দ্রিক। এই স্বার্থ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বাংলাদেশের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দেওয়া হয়েছে বারংবার। দেশের অনেক বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষের আপত্তি থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের মাটিতে ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এতে অর্থনৈতিকভাবে ভারত বিপুল পরিমাণ সুবিধা আদায় করতে সক্ষম হয়। কিন্তু বিনিময়ে আমরা কী পেয়েছি? কিছুই না। পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা ব্যানার্জী যখন মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী তাকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন প্রতিবেশি হিসেবে, যদিও এরকম করার নিয়ম নেই। কিন্তু রূঢ় বাস্তবতা হলো এই মমতা ব্যানার্জীই টিপাইমুখ ইস্যুতে বাংলাদেশের তীব্র বিরোধিতা করেন, এমনকি এ বিষয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে পর্যন্ত বসতে রাজী হন নি। বাংলাদেশ বিষয়ে তিনি বলেছিলেন, “সম্পর্ক গড়া যত কঠিন, ভাঙ্গা তার চেয়েও সহজ।” বাংলাদেশ ও ভারতের অভীন্ন ৫৪ টি নদীর উপর ৫৩ টি বাঁধ নির্মাণ করে বাংলাদেশকে ন্যায্য পানি থেকে বঞ্চিত করে রাখা হচ্ছে, এখানকার কৃষকরা ফসল ফলাতে না পেরে দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হচ্ছে, অর্থনৈতিক ও ভৌগলিকভাবে বাংলাদেশ ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতির শিকার হচ্ছে, অন্যদিকে সেই পানির গতিপথ ঘুরিয়ে ভারত নিজেদের ইচ্ছামত ব্যবহার করছে।
আবার বিশ্বায়নের যুগ বলা হলেও পার্শবর্তী দেশ ভারতে এখনও বাংলাদেশের মিডিয়া প্রবেশ করতে পারে নি। ভারতের চ্যানেলগুলোকে বাংলাদেশে দেখানোর জন্য এখনও প্রতি বছর প্রায় ৩০০০ থেকে ৪৫০০ কোটি টাকা ভারতকে পরিশোধ করতে হয়, কিন্তু এটা জানা কথা যে, উল্টো ভারতকে টাকা দিলেও তারা বাংলাদেশের চ্যানেল ভারতে দেখাতে দেবে না। অন্যদিকে সীমান্ত হত্যা নিয়ে কথা বলাই বাহুল্য। বারবার আলোচনা করার পরও এই সমস্যার কোনো যথাযোগ্য সমাধান আজ পর্যন্ত আসে নি। এভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নমনীয় মনোভাব ও ভারতের স্বার্থন্বেষী তৎপরতা দু’দেশের সম্পর্ককে করেছে ভারসাম্যহীন। অথচ আশ্চর্যের বিষয় হলো এতকিছুর পরও ভারত সরকারের সাথে বাংলাদেশ সরকারের সামান্য পরিমাণ দূরত্ব সৃষ্টি হয় নি। গভীর সম্পর্ক ক্রমেই আরও গভীরতর হয়েছে- এমন প্রমাণই পাওয়া গেছে বিগত বছরগুলোতে। কিন্তু উচিত ছিল এই সম্পর্ক শুধুমাত্র সরকারের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে দু’দেশের জনগণের মধ্যে বি¯তৃত হওয়া, দুই দেশের জনগণের মধ্যেই পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়াবলীর আদান-প্রদান। অথচ তার কোনো নমুনা আজও আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় নি।
যাই হোক, বলছিলাম নরেন্দ্র মোদীর বিষয়ে। তিনি ক্ষমতায় আসার পূর্বেই বাংলাদেশ নিয়ে বেশ কিছু বিতর্কিত মন্তব্য ইতোমধ্যেই করে ফেলেছেন। পৃথিবীব্যাপী তিনি একজন সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। সে হিসেবে বিগত কংগ্রেস সরকারের বৈষম্যমূলক বাংলাদেশ নীতির পথ থেকে বিজেপি সরকার সরে আসবে কি না এখনও পরিষ্কার নয়। বিষয়টি ভবিষ্যতে প্রমাণযোগ্য। বর্তমান দেখে বা অতীতকে স্মরণ করে যে কোনো মন্তব্য করা মোটেও সমীচীন হবে না। কিন্তু এটাও বুঝতে হবে যে, নিজের ভাগ্য নিজে পরিবর্তন করার জন্য চেষ্টা না করলে স্রষ্টাও সে ব্যক্তির ভাগ্য পরিবর্তন করেন না। কাজেই আমাদের চাওয়া-পাওয়া, সুবিধা অসুবিধাকে যদি আমরা তুলে না ধরি, নিজেদের অধিকার আদায় করতে সত্যিকার অর্থে সচেষ্ট না হই তাহলে আমাদের স্বার্থ ভারত নিজে উদ্যোগী হয়ে যাচাই-বাছাই করবে না। তাই, আমাদেরকে আগে শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়াতে হবে। পার্শবর্তী দেশ হিসেবে ভারতের সাথে সুসম্পর্ক ও সৌহাদ্র্যপূর্ণ আচরণ আমরা অবশ্যই করবো কিন্তু সে সম্পর্ক যাতে হয় সম মর্যাদা ও সমঅধিকার বাস্তবায়নের ভিত্তিতে- এ বিষয়টি আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে ভালোভাবে স্মরণ রাখতে হবে। আমাদের উচিত হবে সুসম্পর্ক নিশ্চিত করা, দাসত্ব নয়। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো একাজে কতটা সফল হবেন তা প্রশ্নাতীত নয়। তাদের অনেকেই বলছেন- ভারতের নতুন সরকারের আমলে যেহেতু ভারতের পররাষ্ট্রনীতি পরিবর্তন হবে না বলে মতামত দিচ্ছেন ভারতের অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, কাজেই এই বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের চিন্তার কোনো কারণ নেই। কিন্তু তাদের বোঝা উচিত ছিল যে, এতদিন বাংলাদেশের সাথে ভারত যে পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করে এসেছে সেটাও বাংলাদেশের জন্য একটি আতঙ্কের বিষয়। সেটা বহাল থাকা অর্থই হলো সাধারণ মানুষের অশেষ ভোগান্তি, কৃষকদের প্রতি অবিচার, সীমান্তে নিরাপত্তাহীনতা। আমরা কেনো এগুলো বহাল থাকা পর্যন্ত সন্তুষ্ট হবো? ভারতের উচিত হবে, বাংলাদেশের ব্যাপারে তারা যে বৈষম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতি ধারণ করে এসেছে, তা থেকে অচিরেই বেরিয়ে আসা। এই নীতি আধিপত্যকেন্দ্রিক না হয়ে হোক উভয় দেশের শান্তি ও সৌহার্দ্র্যপ্রেমিক জনগণের ভারসাম্যপূর্ণ স্বার্থকেন্দ্রিক।
বিষয়: রাজনীতি
৭৭১ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
নেই।ভারত নামক কুকুরখানায় যারাই আসুক
আমাদের দেশের লাভ হবেনা।আমাদের লাভ
হবে আমাদের নিজেদের জাতিগত স্বকীয়তা ও
আদর্শকে ধারণ করতে পারলে।সার্বভৌমত্বের
ব্যাপারে নিজেদের সজাগ হতে হবে।আম
জনতাকে স্বাধীনতা নিয়ে রুখতে হবে আগ্রাসীদের।
বিজেপি বা কংগ্রেসে কোনো মৌলিক পার্থক্য
নেই।দু দল হল মুদ্রা একি পিঠ!
মন্তব্য করতে লগইন করুন