আমার মাকে কেউ রত্নগর্ভা বলবে না!
লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ আসাদ আলী ১৩ মে, ২০১৪, ০৩:২৩:৪৫ দুপুর
“অভাব অনটন সংসারে লেগেই থাকত। তিনি নিজে সারাদিন জমি চাষ করা, গরু রাখা, ঘাস কাটা, হাঁস-মুরগি পালন, মাছ ধরাসহ সংসারের যাবতীয় কাজ করতেন। তবু রাতে সন্তানদের পড়তে বসাতে একটুও ক্লান্ত হননি। সপ্তম শ্রেণী পাস করা এই মা তার সন্তানদের স্কুলে কখনও দ্বিতীয় হতে দেননি। এসএসসি পাসের পর সব সন্তানকে অনেক কষ্টের মধ্যে শহরে পাঠিয়েছেন, লেখাপড়া ও থাকা-খাওয়ার যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করেছেন। এভাবে শত প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে সংগ্রাম করে তার আট সন্তানকে যোগ্য মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন।”
একটি জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকার গতকালের সংখ্যায় “৩৬ ‘রতœগর্ভা মা’ সম্মাননা পেলেন” শিরোনামে প্রকাশিত খবরের ভূমিকাটুকু পড়তে পড়তে মনে পড়ে গেল আমার ছোটবেলার কথা, মনে পড়ল মায়ের কথা। সেই সাথে মনে পড়ে গেলো আমার শৈশব ও কৈশোরে পরিবারের দুঃখ-দুর্দশাগ্রস্ত দিনগুলোর কথা। কীভাবে তিলে তিলে কষ্ট করে নিজে অর্ধাহারে-অনাহারে থেকেও আমাদের মুখে খাবার তুলে দিয়ে মা তৃপ্তির হাসি হাসতেন, তার মর্ম তখন না বুঝলেও এখন বুঝি। বস্তুত, সন্তানের প্রতি ভালোবাসা কোন মায়েরই কম নেই। সব মা-ই চান যে, তাঁর সন্তান ভালো হোক, ভালো থাকুক। আমার মাও তাই চেয়েছিলেন। সার্বক্ষণিক দারিদ্র্য আর ঋণের মাঝে থাকা সত্ত্বেও দুঃখ কি জিনিস তা কখনো উপলব্ধি করতে দেননি আমাকে। সর্বদা আমার সুখি-সমৃদ্ধ, উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্য স্রষ্টার কাছে আকুল নিবেদন জানিয়েছেন।
কিন্তু বাস্তবতা অন্য জিনিস। বাবা মায়ের পরম মমতায় আগলে রাখা কৃত্রিম পৃথিবী থেকে একটু বিচ্ছিন্ন হয়ে বাস্তব জীবনে যখন প্রবেশ করলাম, পৃথিবীটা যেন অন্য রকম মনে হলো। জীবনের এই পর্যায়ে এসে সমাজ, সভ্যতা ও পৃথিবীকে জানার জন্য, উপলব্ধি করার জন্য, প্রত্যক্ষ করার জন্য দু’চোখ মেলে তাকাতে বাধ্য হলাম। আর তখনই হতাশ হলাম। দেখলাম সমাজের এই প্রান্ত থেকে ঐ প্রান্ত পর্যন্ত সবই মিথ্যায় পরিপূর্ণ। দেখলাম মানুষের বুটের তলায় কিভাবে পিষ্ট হয় মানুষ, বুলেটের আঘাতে কিভাবে যুবকের বুক ঝাঝরা হয়ে যায়, কিভাবে বখাটের এসিডে ঝলসে যায় তরুণীর মুখ, শাসিতের সাথে শাসকের নির্মম প্রতারণা, দুর্বলের উপর সবলের খড়গহস্ত। দেখলাম অধিকার হারা মানুষের ভাগ্যকে নিয়ে রাজনীতির নির্মম খেলা। সেই সাথে অবাক হয়ে দেখলাম এই ভঙ্গুর সমাজেই প্রতিষ্ঠার জন্য মানুষগুলোর মধ্যে অবিরাম প্রতিযোগিতা, সেই প্রতিযোগিতায় মিথ্যা, অন্যায়, প্রতারণা আর ষড়যন্ত্রের সীমাহীন প্রশ্রয়, বিভিন্ন বাদ-মতবাদে বিভক্ত সমাজের মানুষগুলোর মধ্যকার অনৈক্য, সংঘাত আর পরস্পর রক্ত নিয়ে হোলি খেলার নেশা। মাদক আর নগ্নতায় পূর্ণ সংস্কৃতির করাল গ্রাসে আমাদের যুবসমাজ যেন এক ধ্বংসস্তুপ। দম বন্ধ হবার উপক্রম হলো। পৃথিবীটাকে বড়ই নিষ্ঠুর মনে হলো। নিজেকে মানুষ ভাবতে দ্বিধা হতো। অতঃপর ধর্মের মধ্যে মানবতা ও মুক্তির পথ খুঁজতে গিয়ে আরও বেশি বিস্মিত হলাম। মানবতার মুক্তির জন্য যে ধর্মের আগমন সেটাকে পরিণত করা হয়েছে ব্যবসা ও রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ারে। পৃথিবীতে যেন আমি একা, এই অমানবিকতা, নিষ্ঠুরতা, অন্যায়, অবিচার, প্রতারণা ও মিথ্যার জয়জয়কার যেন আর কারও চোখে পড়ছে না। কোনো মা তার সন্তানকে বিপ্লবী মন্ত্রে উজ্জীবিত করে সংগ্রামের পথ দেখিয়ে দিয়ে বলছে না যে, “যা খোকা, ঐ তোর গন্তব্য। ভঙ্গুর এই পৃথিবীটাকে যাবতীয় অভিশাপ থেকে মুক্ত করে নতুনভাবে গড়ে তোল্। অত্যাচারিত তার অধিকার ফিরিয়ে দে, সমাজ থেকে যাবতীয় অন্যায়-অত্যাচার, প্রতারণা ও ষড়যন্ত্রকে চিরতরে স্তব্ধ করে দে। মানুষকে শান্তি ফিরিয়ে দে”। কোন সন্তান ব্যক্তিস্বার্থের উর্ধ্বে উঠে মানবতার কল্যাণে কাজ করার জন্য মায়ের কাছে দোয়া নিতে গেল না। সবার দৃষ্টি, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য অর্থাৎ গন্তব্য ঐ একটিই- অর্থ উপার্জন করা, সমাজে মান-সম্মান, প্রভাব-প্রতিপত্তির অধিকারী হওয়া। অর্থাৎ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবসায়ী, জজ-ব্যারিস্টার হওয়াই যেন একটি মানবজীবনের গন্তব্য। এটা যারা হতে পারছে তারাই পরিচিতি পাচ্ছে সমাজের রত্ন হিসেবে, আর যে মা তাদেরকে জন্ম দিয়েছেন তাকে বলা হচ্ছে রত্নগর্ভা।
কিন্তু আমি এমন রহতে পারি নি, হবার আকাক্সক্ষাও জাগে নি। কারণ বিবেকের আদালত থেকে বাধা এসেছে। বরং, সমাজের অন্ধকারকে যেদিন পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করলাম সেদিন পৃথিবীর সবকিছুকেই নিরর্থক মনে হলো। তখন থেকেই খুঁজে বেড়াতে শুরু করলাম এই অবস্থা থেকে সমাজের মানুষগুলোকে মুক্তি দেওয়ার পথ। মহামহিম, অপার দয়াময় প্রভুর ইচ্ছায় অবশেষে সেই পথ খুঁজে পেলাম। যামানার এমাম, মহামান্য এমামুয্যামানের কাছ থেকে জানতে পারলাম কোন পথে মানবজাতির মুক্তি, কোন পথে আমার মুক্তি। আমরা সফলতা। জানতে পারলাম মানবজাতির আজকের এই নিদারুণ পরিণতির কারণ ও তা থেকে উত্তরণের উপায়। মহামানবের সেই শিক্ষার সামনে সারা জীবনের সকল শিক্ষা যেন শূন্য হয়ে গেল। আজ তাঁর দেওয়া শিক্ষা এবং দীক্ষাকে অবলম্বন করেই পথ চলছি। যে মহাসত্যের মশাল তিনি জ্বালিয়েছেন তার আলোকে মানুষের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ছুটে বেড়াচ্ছি। পিছে পড়ে থেকেছে আমরা সংকীর্ণ ব্যক্তিজীবনের সকল চাওয়া-পাওয়া, তথাকথিত ক্যারিয়ার। সীমাহীন প্রতিকূলতা আর নিজেদের সীমাবদ্ধতাকে মোকাবেলা করে সমাজের মানুষগুলোকে মুক্তি দেওয়ার মত কঠিন লক্ষ্যকে বাস্তবায়িত করতে গিয়ে হারিয়েছি মিথ্যায় পূর্ণ এই সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার যোগ্যতা। স্রোত হারিয়ে আমার শিক্ষাজীবন এখন এক মরা নদী। তবে এজন্য আমি মোটেও দুঃখিত নই। আমি জানি বিদ্যমান সমাজের মানুষগুলোর কাছে আমি এক নুড়িপাথর, তাই আমার মা কখনোই ‘রতœগর্ভা মা’ বলে বিবেচিত হবেন না। ক্লেদাক্ত এই সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আরও ‘উন্নত’ জীবনের রেসে ব্যতিব্যস্ত সন্তানদের যারা জন্ম দিয়েছেন তারাই তাদের দৃষ্টিতে ‘রত্নগর্ভা মা’। আজ মাকে খুব বলতে ইচ্ছে করছে, “মা, সমাজের অপরাপর পাঁচটি মায়ের সন্তানদের মত আমি এই সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে নিজের ফ্ল্যাট, সুন্দরী স্ত্রী, গাড়ি, বাড়ির জন্য ব্যতিব্যস্ত থাকি নি। বরং নিজের সমস্ত মেধা আর শ্রম দিয়ে মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছি প্রচলিত দানবিক সিস্টেমের বিরুদ্ধে। আমি জানি আমাদের এই সংগ্রামে আমরা বিজয়ী হবোই। তোমার এমন সন্তানের জন্য তুমি লজ্জিত বা দুঃখিত হয়ো না। জেনে রেখ তুমিও একদিন যথার্থ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হবে। এবং তা হবে এই পৃথিবীতে এবং পরের পৃথিবীতে। সেই দিনটি হবে আমার জন্য সবচেয়ে সুখের দিন যেদিন স্বয়ং স্রষ্টা তোমাকে ‘রতœগর্ভা মা’ বলে স্বীকৃতি দেবেন। আজ ভুল বুঝলেও সেদিন নিশ্চয়ই তুমি আমায় ঠিকই বুঝতে পারবে।”
বিষয়: বিবিধ
১২২৯ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন