সরিষার ভেতরেই যখন ভূত! (প্রসঙ্গ- অপহরণ, গুম, খুন)
লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ আসাদ আলী ০৫ মে, ২০১৪, ১০:১৮:৪৩ রাত
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক গুম-খুনের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাওয়ায় রাষ্ট্রীয়ভাবে গৃহীত বেশ কিছু প্রতিরোধমূলক তৎপরতা দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। বহুদিন যাবৎ বিচ্ছিন্নভাবে চলে আসা এই ইস্যুটিকে নিয়ে এর আগে খুব কমই চিন্তা-ভাবনা করা হয়েছে। বিশেষ করে বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী থেকে শুরু করে তৎপরবর্তী বেশ কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির গুম হয়ে যাওয়া এবং তাদের খুঁজে বের করতে প্রশাসনের কার্যত ব্যর্থতা দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে বারবার। কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে এবারে সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে নারায়নগঞ্জের সাত জনকে অপহরণ করে খুন করার ঘটনা। এর কয়েকদিন পূর্বে একই জেলার ‘বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি’র নির্বাহী সৈয়দা রেজওয়ানা হাসানের স্বামী আবু বকর সিদ্দিকের অপহৃত হওয়া এবং অজানা কারণে অক্ষত মুক্তি পাওয়ার ঘটনা ঘটে। কে বা কারা, মূলত কী উদ্দেশ্যে তাকে অপহরণ করেছিল তা জানা যায় নি আজও। সব মিলিয়ে নারায়নগঞ্জ পরিণত হয়েছে আতঙ্কপুরিতে।
এ ধরনের ঘটনায় সরকারের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এমনিতেই ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে ও আন্তর্জাতিকভাবে বহু বিতর্ক রয়েছে। সাধারণ মানুষ এখনও নতুন সরকারের স্থায়ীত্বের উপর কতটা আস্থা আনতে পেরেছে তা পরিষ্কার নয়। তাছাড়া এই ইস্যুটিকে বিরোধীপক্ষও যে ব্যাপকভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে তাও সরকারের অজানা নয়। সম্ভবত, এসব কারণে এবারে আন্তরিকভাবেই দেশ থেকে অপহরণ-গুম-খুনের ঘটনা দূরিভূত করতে সরকার বদ্ধ পরিকর। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে এমনই কিছু নমুনা দৃশ্যমান হচ্ছে। যেমন- এই ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত সরকারি পদস্থ ব্যক্তিরা। প্রধানমন্ত্রী নিজে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে তলব করেছেন, বৈঠক করেছেন। নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার থেকে শুরু করে ডিসি পর্যন্ত প্রশাসনে ব্যাপক রদবদল এসেছে। এরই মধ্যে অপহরণ ও ৭ খুনের মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনের বাসায় তল্লাশী করে ১২ জন গ্রেফতার, রক্তমাখা গাড়ি জব্দ করেছে পুলিশ। এছাড়া অপহরণ ঠেকাতে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে গাড়িতে রঙিন কাঁচ ব্যবহার ও বিনা অনুমতিতে সাদা পোশাকে পুলিশি অভিযান।
তবে সবচেয়ে নতুন যে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তাহলো- ডিএমপির ৪০ জন চৌকশ পুলিশ সদস্যর সমন্বয়ে ‘এন্টি কিডন্যাপিং স্কোয়াড’ গঠন। এখন প্রশ্ন হলো, সরকারের এই উদ্যোগগুলো কতটা বাস্তবভিত্তিক, বিশেষত শেষের এই পদক্ষেপটি? নতুন নতুন বাহিনী গঠন করে এই ধরনের সমস্যা থেকে মুক্তি মিলবে কি? স্বাধীনতা পরবর্তী গত ৪২ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে কী পাওয়া যায়?
বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম একটি কলঙ্কের নাম হলো দুর্নীতি। বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে দুর্নীতি-সন্ত্রাসে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি প্রবেশ করে দেশকে কার্যত ব্যর্থ রাষ্ট্রের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। একটি দেশের দুর্নীতি-সন্ত্রাস দমনের দায়িত্ব ন্যস্ত থাকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উপর। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যেন তার উল্টোটা ঘটেছে। কারণ, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে উঠে এসেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নাম। যে বাহিনীর জন্মই হয়েছে আইনের শাসন বলবৎ রেখে দেশের সামগ্রিক উন্নতিতে অবদান রাখার জন্য সে বাহিনী যখন দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে তখন সে দেশের অবস্থা যে কতটা ভয়ানক হতে পারে তা বিশ্বের অন্য কোন দেশের অধিবাসীরা না জানলেও আমরা জানি। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা হলো, এখানকার জনসাধারণ অতি ঠুনকো বিষয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়, গণপিটুনি দিয়ে মানুষ মেরে ফেলা এ দেশে কোন ব্যাপারই নয়। এটা যে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি আস্থাহীনতা থেকে জন্ম লাভ করেছে তা সহজেই অনুমেয়। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক ঘুষ, ছিনতাই, চাঁদাবাজী, অন্যায়ভাবে ধরে নিয়ে এসে নির্যাতন ইত্যাদি কর্মকাণ্ড ধারাবাহিকভাবে চলায় আমজনতার মনে প্রশাসন সম্পর্কে সবসময় একটি নেগেটিভ চিন্তা-চেতনা কাজ করে থাকে। ফলে এমন বেগতিক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যে, সাধারণ মানুষ এখন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে যতটা বন্ধু ভাবার কথা ঠিক ততটা ভয় পায়। তাদের থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলার চেষ্টা করে। একান্ত বাধ্য না হলে কেউ থানা-পুলিশ এলাকা মাড়াতে চায় না। এই বাস্তবতা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। কাজেই এই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরই নতুন স্কোয়াড দিয়েই যে গুম-খুন-অপহরণ রোধ করা সম্ভব হবে- এমন নিশ্চয়তা পাওয়া যাচ্ছে না।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাস দমনের উদ্দেশ্যে চৌকশ বাহিনী হিসেবে পরিচিত ‘র্যাব’ গঠন করা হয় ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ। অতঃপর একই বছরের ১৪ই এপ্রিল এই বাহিনী তাদের কার্যক্রম শুরু করে। আশা করা হয়েছিল যে, বহু বছর যাবৎ বাংলাদেশের জাতীয় ইস্যুতে একের পর এক কলঙ্ক লেপন করে চলা ‘সন্ত্রাস’ প্রতিরোধে র্যাব যথাযথ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। কিন্তু অল্পদিনের ব্যবধানেই সে আশা নিরাশার চাদরে ঢেকে যায়। গুটিকতক সফলতা অর্জিত হলেও এই বাহিনী মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে তাদের ভাবমূর্তি ক্ষুইয়ে বসে। বর্তমানে বাহিনীটির ভাবমূর্তি সাংঘাতিকভাবে ক্ষুণ্ন। নানা সময়ে নানান অভিযোগ উঠে এসেছে তাদের বিরুদ্ধে, যা সাধারণ পুলিশ-প্রশাসনকে ছাড়িয়ে গেছে অনেক আগেই। সাম্প্রতিক যে ঘটনাটি নিয়ে অপহরণ-গুম-খুন দমনে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর নতুন ‘এ্যান্টি কিডন্যাপিং স্কোয়াড’ গঠন করা হয়েছে খোদ সেই ঘটনার সাথেই র্যাবের সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠছে। গত রবিবার নারায়ণগঞ্জের রাইফেল ক্লাবে সাংবাদিকদের আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে নিহত নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম ওরফে শহীদ চেয়ারম্যান র্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে বলেছেন- ‘নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র ও কাউন্সিলর নজরুল ইসলামকে র্যাব তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে। এ ঘটনায় র্যাবের সিও (অধিনায়ক) এবং আরও দুই মেজর মিলে ছয় কোটি টাকা নিয়েছেন।’ (সূত্র: প্রথম আলো)
সারা দেশব্যাপী আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে এহেন অভিযোগের কোন শেষ নেই। প্রায় প্রতিটি সরকারের বিরুদ্ধেই র্যাবকে দলীয় বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করার অভিযোগ উঠেছে। ফলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে র্যাবকে বিলুপ্ত করার দাবি উঠে এসেছে বারংবার। বস্তুত এভাবে নতুন নতুন বাহিনী সৃষ্টি করে বা কোন বাহিনীকে দমন করে চলমান সঙ্কটের কোন সমাধান করা যাবে না। অতীতে যায় নি, ভবিষ্যতেও যাবে না। কেন এই সমস্যার সমাধান করা যাবে না, তা জানতে হলে আমাদেরকে আগে জানতে হবে যে, কেন এই সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে? কেন দেশের কল্যাণে কাজ করার তীব্র বাসনা নিয়ে বাহিনীতে যোগ দিয়ে দেশপ্রেমিক বাহিনীর সদস্যরা দুর্নীতিবাজ ও অপরাধী হয়ে যাচ্ছে? কেন তারা রাজনৈতিক দলগুলোর লেজুড়বৃত্তি করতে গিয়ে নিজেদের বিবেক, মনুষ্যত্বকে বিসর্জন দিচ্ছে?
উত্তর একটিই- সিস্টেম। সকল সমস্যার শেকড় প্রোথিত রয়েছে প্রচলিত সিস্টেমে। প্রত্যেক মানবশিশু জন্ম নেয় ফেতরাতের (প্রকৃতির) উপর, অতঃপর সে সর্বপ্রথম পরিচিত হয় পরিবার নামক সিস্টেমের সাথে। এই সিস্টেমের প্রভাবে পরিবার থেকে যেভাবে একটি শিশুর প্রাথমিক চরিত্র নির্ধারিত হয়, ঠিক তেমনি সমাজব্যবস্থাও মানুষকে নিজস্ব কাঠামো অনুযায়ী গড়ে তোলে। সমাজব্যবস্থা যদি বস্তুবাদী, ভোগবাদী হয়, মানুষও হবে বস্তুবাদী ও ভোগবাদী, সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হয়, মানুষগুলিও ধীরে ধীরে হবে দুর্নীতিগ্রস্ত। পক্ষান্তরে সমাজব্যবস্থা যদি ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে, মানুষগুলিও হবে ন্যায়নিষ্ঠ। মানুষ প্রকৃতপক্ষে কাদা মাটির ন্যায়। এই কাদামাটিকে যে ডাইসের মধ্যে ফেলা হবে, কাদা মাটি সেই ডাইসের রূপ, আকৃতি ধারণ কোরবে। সমাজব্যবস্থাও এমনই একটি ডাইস। কখনও কোন মানুষ মায়ের গর্ভ থেকে চোর হোয়ে, ডাকাত হোয়ে, অন্যায়কারী, দুর্নীতিবাজ হোয়ে জন্ম নেয় না। কিন্তু অন্যায় সমাজব্যবস্থার প্রভাবে ধীরে ধীরে তারা এমন অপরাধী চরিত্রের হোয়ে যায়। যারা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীতে চাকরি কোরতে যান তাদের অনেকেই এই অভিপ্রায় নিয়ে যান না যে ইচ্ছা মতো ঘুষ খাবেন, অপহরণ করবেন, গুম করবেন বা খুন করবেন, বরং সৎ জীবনযাপনের ইচ্ছা নিয়েই যান চাকুরিতে। কিন্তু সিস্টেমই তাদের অধিকাংশকে ঘুষখোর, দুর্নীতিপরায়ণ, ক্ষমতার অপব্যবহারকারী এবং খুনি বানিয়ে ফেলে। তারা এমন পরিস্থিতির শিকার হন যে অসৎ না হোয়ে তাদের কোন উপায় থাকে না। সুতরাং এমন সিস্টেম কার্যকর করে যতই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী গঠন করা হোক বা যতই তাদেরকে অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত করা হোক, সেটা যে হিতে-বিপরীত হবে তার উদাহরণ আমাদের অতীত ইতিহাসেই পাওয়া যাবে। সরিষার ভেতরেই যদি ভূতের আবাস হয় তাহলে যেমন সে সরিষা দ্বারা কখনও ভূত দূরিভূত হবে না, তেমনি প্রচলিত ঘুণে ধরা সিস্টেমকে চালু রেখে কোনভাবেই অন্যায় অবিচার, গুম-খুন দূর করা সম্ভব হবে না। এটা আমরা যত দ্রুত অনুধাবন করতে সক্ষম হবো ততই আমাদের মঙ্গল।
বিষয়: রাজনীতি
১১০৮ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
পাঠ ও মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
পাঠ ও মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন