ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক ও রাজনীতির যত চমক!
লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ আসাদ আলী ১৬ এপ্রিল, ২০১৪, ০৫:০৯:৫৩ বিকাল
স্বাধীনতার পর ৪২ বছর পেরিয়ে গেলেও কার কী অবদান তা নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কের জট কিছুতেই খুলছে না। বরং দিন দিনই তা নতুন নতুন প্রশ্নের সৃষ্টি করছে। এর পেছনে মূল কারণটি হলো- আমাদের দেশের সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে স্বাধীনতার ইতিহাসও পরিবর্তিত হয়ে যায়। সে ইতিহাস যদি কিছুটা এদিক ওদিক হতো তা হলেও না হয় মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু তা নয়, দেখা যায় যে, একের ইতিহাস অন্যদের থেকে খোদ মৌলিক বিষয়গুলোতেই একেবারের বিপরীতমুখী ইতিহাস। যখন যে সরকার আসে তখন সে সরকার কোমলমতি শিশুদের পাঠ্যপুস্তকে তাদের মত করে ইতিহাস প্রবেশ করায়। আবার নতুন সরকার এসে তা মুছে দিয়ে নিজেদের পছন্দমত নতুন ইতিহাস প্রবেশ করায়। আর রাজনীতির ময়দানে তো কোন বালাই-ই নাই। একে অন্যের প্রতি ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, অসম্মানজনক কথা বলতে কোন রকম তোয়াক্কাই করা হয় না। যখন যার যা খুশি তাই বলে ফেলেন অবলীলায়। পুরো মানবজাতির মধ্যে অন্যদের সাথে বাঙালি চরিত্রের কিছু মৌলিক পার্থক্যের পাশাপাশি সরকার পরিবর্তনের সাথে ইতিহাস পাল্টে ফেলার কৃতীত্বের চরিত্র একমাত্র আমাদেরই রয়েছে।
আমাদের রাজনীতিকরা তাদের রাজনৈতিক স্বার্থে মুক্তিযুদ্ধ ও সমসাময়িক অন্যান্য ঘটনাগুলোকে নিয়ে এতই বেশি প্রচার-প্রচারণা ও যুক্তি-তর্ক করেছেন যে, বাঙালি জাতির ইতিহাস এখন শুধুমাত্র মুক্তিযুদ্ধের ক্ষুদ্র সময়ের পরিধির ভেতরেই আটকে আছে। বাকি ইতিহাস মাথা থেকে পুরোপুরি আউট হয়ে গেছে। ফল হয়েছে এই যে, আমরা নিজেদেরকে ইতিহাসহীন হঠাৎ আবির্ভূত হওয়া জাতিতে পরিণত করেছি। ইতিহাসের যে ক্ষুদ্র সময়টিকে নিয়ে আমরা এত তোড়জোর করছি স্বাভাবিকভাবেই সেই ইতিহাসটুকও আর নিখাঁদ রইলো না। সে ইতিহাসকে আমাদের রাজনীতিকরা তাদের রাজনৈতিক স্বার্থে পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা পরিমার্জন করে নতুন নতুন মোড়কে জাতির সম্মুখে উপস্থাপন করে চলেছেন। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, ইতিহাসশূন্য এবং বিতর্কে ভরা ইতিহাসের উপর নির্ভর করা জাতি এভাবে কতদিন চলতে পারে? যে জাতির ইতিহাসের কোনো ঠিক নেই সে জাতি কী অবলম্বন করে সামনে এগোবে?
জানিনা, আমাদের রাজনীতিকরা ইতিহাস নিয়ে যে নগ্ন খেলায় মগ্ন রয়েছেন তার পরিণাম কখনও চিন্তা করেছেন কি না। অবশ্য তাদের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড এটাই সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, এটা নিয়ে সিরিয়াসলি চিন্তা করা দূরে থাক বরং তারা ইতিহাস নিয়ে খেলা করতে বেশ মজাই পাচ্ছেন, আমোদিত হচ্ছেন। মনে হচ্ছে তারা খুশিই, কারণ নানা ধরনের ইস্যু সৃষ্টি করে আন্দোলনের নামে, দাবি-দাওয়ার নামে রাজপথে জ্বালাও-পোড়াও, হরতাল-অবরোধের মাধ্যমে মাঠ গরম করার বিকল্প হিসেবে ইতিহাস নিয়ে কচলা-কচলি করা উপাদান পেয়েছেন! সাম্প্রতিক উত্তপ্ত পরিস্থিতি অন্তত তাই বলছে।
গত বছরের শেষ দিনটি পর্যন্ত হরতাল-অবরোধ পালন করে এসেছে গত সংসদের বিরোধী দল। অতঃপর গত কয়েকমাস কোন রকম সহিংস আন্দোলন না করে তারা নিশ্চুপ ভূমিকায় ছিল। কিন্তু এরই মধ্যে হঠাৎ করে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে তারা। বর্তমানে লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমান সর্বপ্রথম বিতর্কের সূচনা করেছেন- ‘জিয়াউর রহমানই দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি’ ও ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ (প্রথম আলো, ২৬-০৩-২০১৪) ঘোষণা দিয়ে। এ নিয়ে গরম হওয়া মাঠ ঠাণ্ডা হওয়ার আগেই আবারো ‘বঙ্গবন্ধু দেশের প্রথম অবৈধ প্রধানমন্ত্রী’ (মানবজমিন, ১০-০৪-২০১৪) বলে আরো গরম করে তুললেন তিনি। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াও তারেক রহমানের এরূপ প্রতিটি মন্তব্যের সমর্থনপূর্বক মন্তব্য করতে থাকেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সরকারের মন্ত্রী-এম.পি ও সমর্থকদের মুখ ছুটতেও আর দেরি হয় নি। গত বৃহ¯প্রতিবার সংসদের প্রথম অধিবেশনে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ তারেক রহমানকে ‘আহাম্মক’ বলে গালমন্দ করেন। তিনি বলেন, ‘আরে আহাম্মক, তোর বাপও আমাদেরকে স্যার বলতো। স্যার বলতে বলতে মুখ দিয়ে লালা পড়ে যেতো’ (যুগান্তর, ১১-০৪-২০১৪)। এদিকে গত শনিবার ত্রাণ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া যেন পুরো ক্ষোভটাই বক্তব্যের মধ্যে ঢেলে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘বেগম খালেদা জিয়া শয়তানের বংশধর এবং তারেক রহমান এখন ছোট শয়তানের ভূমিকায় নেমেছে। তারেক রহমান হচ্ছে শয়তানের বাছুর’ (প্রথম আলো, ১২-০৪-২০১৪)। শুধু তাই নয়, তারেক রহমানের ইতহাস নিয়ে সম্পূর্ণ নুতন সেই মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া দেখাতে গিয়ে ইতোমধ্যেই তার ছোট ভাই আরাফাত রহমান কোকোর জন্ম নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন সরকারপক্ষের রাজনীতিবিদগণ। চুলাচুলি, গোলাপি-গোপালি আখ্যা, ট্রেন, শাড়ি-ব্লাউজ, প্রথম রাষ্ট্রপতি ও অবৈধ প্রধানমন্ত্রীর পর শেষ পর্যন্ত রাজনীতি ঠেকেছে জন্ম পরিচয়ে। এই যে বিতর্ক ও প্রহসনগুলো হচ্ছে তা কিন্তু দেশের সাধারণ অশিক্ষিত, অজ্ঞদের দ্বারা হচ্ছে না, হচ্ছে তাদের দ্বারাই যারা ১৬ কোটি বাঙালির ভাগ্য গড়ার দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছেন। তাই আবারো প্রশ্ন আসে, রাষ্ট্রের কর্ণধাররাই যখন এমন অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়াবলী নিয়ে মেজাজ হারিয়ে যাচ্ছেতাই বলেন তখন সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়? তারা মেজাজ ধরে রাখার মন্ত্র পাবে কোথায়?
মূলতঃ এভাবেই রাজনীতির মাঠ গরম রেখে চলেছেন আমাদের রাজনীতিবিদগণ। সরকারের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী যখন আন্দোলন-সহিংসতা করে সরকারকে উত্তেজিত করতে পারছে না, তখন নুতন এই কৌশল কাজে লাগিয়ে ঠিকই তারা মাঠ গরম করে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিয়ে যাচ্ছে। এই হচ্ছে আমাদের দেশীয় রাজনীতির প্রকৃত স্বরূপ। এভাবেই আমাদের পথ চলা। কিন্তু এই রাজনীতি নিয়ে এই পথে কতদিন আমরা চলতে পারব, কতদূর যেতে পারব? আজকে মতভেদ-তর্কাতর্কি, যার যা ইচ্ছা তাই বলার, তা করার বৈধতা দিয়েছে আমাদেরই পছন্দনীয় গণতন্ত্র। সেই অধিকারকে কাজে লাগিয়েই রাজনীতির নামে এসব হীন কর্মকাণ্ড করা সম্ভব হচ্ছে। শুধু ইতিহাসই নয়, যে কোন বিষয় নিয়েই মতভেদের কোন সুযোগ থাকতো না যদি আমাদের শক্তিশালী একটি প্লাটফর্ম থাকতো, যা আমাদের সবার উপরে অভিভাবকের ভূমিকায় আসীন হয়ে যা খুশি বলা, যা খুশি করাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, আমাদের গণতন্ত্রে তার কোন ব্যবস্থা নেই, যার মাশুল দিতে হচ্ছে ১৬ কোটি মানুষকেই।
বিষয়: বিবিধ
১০৭৪ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন