নিঃশেষিত গণজাগরণ মঞ্চ, ভিন্নসুরে হেফাজত; সরকারের জন্য কী বার্তা?
লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ আসাদ আলী ১৫ এপ্রিল, ২০১৪, ০৩:০৬:৫৫ দুপুর
সম্প্রতি আবারো আলোচনায় এসেছে এক সময়ের দেশ কাঁপানো আন্দোলন- গণজাগরণ মঞ্চ। অরাজনৈতিক দাবিদার হলেও গত প্রায় একটি বছর এই গণজাগরণ মঞ্চ বাংলাদেশের রাজনীতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল। এই এক বছরের ঘটনাপ্রবাহে দেখা গেছে- কোনো পক্ষ গণজাগরণ মঞ্চকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে বা খাইয়ে-দাইয়ে জিইয়ে রেখেছে আবার কোনো অংশ এর ধ্বংস ঘটানোর জন্য রাজপথে নেমেছে, সহিংস কর্মকাণ্ড ঘটিয়েছে, সাধারণ মানুষের জান-মালের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি সাধন করেছে। কেউ গণজাগরণ মঞ্চের নেতা-কর্মীদের মহান বীরের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে রীতিমত মাথায় তুলে নেচেছে, আবার কেউ তাদেরকে নাস্তিক, কাফের, মুরতাদ, নষ্ট-ভ্রষ্ট ইত্যাদি আখ্যা দিয়েছে। গত বছরের এপ্রিল-মে’র ঘটনাগুলো যাদের মস্তিষ্ক থেকে মুছে যায় নি তারা এটা স্বীকার করতে বাধ্য হবেন যে, শুধুমাত্র গণজাগরণ মঞ্চকে কেন্দ্র করেই সমগ্র বাংলাদেশ কার্যত দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। এক ভাগে ছিল গণজাগরণ মঞ্চ ও সরকার, আর অপরভাগে বিরোধী জোটগুলোর পাশে দাঁড়িয়েছিল কওমী মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। হেফাজতে ইসলাম ছিল বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠে হঠাৎ আবির্ভূত একটি বৃহৎ শক্তি। সংগঠনটি মাত্র এক মাসের ব্যবধানে রাজধানীতে দু’টি বড় বড় কর্মসূচি দিয়ে দেশবাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। তৎকালীন বিরোধী জোটগুলোর পক্ষে হেফাজতে ইসলাম ছিল এক অপ্রতিরোধ্য হাতিয়ার, তুরুপের তাস, যদিও সে হাতিয়ার ব্যবহৃত হয় পরোক্ষভাবে। তৎকালীন কর্মসূচিগুলোতে প্রকাশ্যে হেফাজত নেতাদের মুখ থেকে সরকারবিরোধী শ্লোগান উচ্চারিত হয়েছে। গণজাগরণ মঞ্চের সাথে সরকারের সখ্যতা থাকার কারণে সরকারকে নাস্তিক আখ্যা দিয়ে অনেক হেফাজত নেতাই ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, ‘নাস্তিক সরকারকে ক্ষমতা থেকে টেনে-হিঁচড়ে নামানো হবে’। প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছিল- ‘এক্ষুনি ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ান, নয়তো পালাবার পথ খুঁজে পাবেন না’- যা তৎকালীন প্রতিটি সংবাদপত্র এবং টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল। এভাবেই হেফাজতে ইসলাম নিজেদেরকে অরাজনৈতিক দাবি করলেও কার্যত রাজনীতি নিয়ন্ত্রকের মুখ্য ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছিল, যা ছিল ক্ষমতাসীনদের জন্য অশনিসংকেত।
কিন্তু যে কোন কারণেই হোক, দৃঢ় অবস্থান ধরে রাখার সুবাদে সরকার সে হুমকি কার্যকরভাবে মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়। হেফাজতের ধর্মীয় মুখোশের অন্তরালের রাজনৈতিক চেহারা যখন প্রকাশ পেয়ে যায়, তখন সরকার তাদেরকে কঠোরহস্তে দমন করে। ৫ মে’র অপারেশন এ ক্ষেত্রে বেশ ফলপ্রসূ হয়। হেফাজত নেতাদের গলা-ফাটানো চিৎকার আর হুমকি-ধামকি ব্যর্থ হয়ে যায় মাত্র ১০ মিনিটের এক সাড়াশি অভিযানে। কিন্তু এর পরের ঘটনাপ্রবাহ অন্য দিকে মোড় নেয়। শক্তির বিচারে সরকারের সাথে পেরে না উঠায় হেফাজতিরা নিশ্চুপ হয়ে যায়। তবে একটি মহল ৫ মে’র ঘটনা নিয়ে অপপ্রচারে নামে। সৃষ্টি করে তথ্য-বিভ্রাট। বলা হয়- হাজার হাজার হেফাজত কর্মী উক্ত সাড়াশি অভিযানে নিহত হয়। কথাটি বোদ্ধা মহলে কোন সমর্থন না পেলেও ফেসবুক, বিভিন্ন ব্লগসহ অন্যান্য ওয়েবসাইটে এই অপ্রমাণিত তথ্যটি গুরুত্বসহকারে প্রচার করা হয়। এই প্রচার-প্রচারণায় মহলটির সাথে সরকারবিরোধী অন্যান্য গোষ্ঠিও শামিল হয়। ছোট ছোট ডকুমেন্টরি নির্মাণ করে তা গ্রাম-গঞ্জের সাধারণ মানুষকে দেখানো হয় এবং বিশ্বাস করানো হয়। এমনকি কিছু আন্তর্জাতিক জনপ্রিয় মিডিয়াও এই ধরণের প্রচারণা চালায়। আল জাজিরা তার মধ্যে অন্যতম। আর এভাবেই হেফাজতে ইসলামকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষের মনে সরকারবিরোধী একটি তীব্র ইমেজ সৃষ্টি হয়। হাজার হাজার আলেম-ওলামা নিহত হবার কথা প্রচার করে সাধারণ মানুষের সহানুভূতি ও নৈতিক সমর্থন অর্জিত হয়। যার প্রমাণ পাওয়া যায় বিগত সিটি কর্পোরেশন, উপজেলা নির্বাচনের ফলাফলের মাধ্যমে। তবে ক্ষমতাসীন দলটির মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীগণ এ ব্যাপারটি কতটুকু উপলব্ধি করতে পেরেছে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েই গেছে।
যাই হোক, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরবর্তী কয়েকমাস পেরিয়ে এসে বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনেকটা ঘোলাটে আকার ধারণ করেছে। আর এই পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করেছে গণজাগরণ মঞ্চকে ঘিরে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে। সরকার গণজাগরণ মঞ্চের সাথে বিদ্যমান এতদিনের সখ্যতা হঠাৎ করেই যেন উঠিয়ে নিচ্ছে। ফলে চারিদিকে থেকে নানাবিধ প্রশ্ন আসছে। অনেকে অনেক রকম মতামত দিচ্ছেন। তবে বেশিরভাগ মত হচ্ছে- ‘সরকার এতদিন রাজনৈতিক প্রয়োজনে গণজাগরণ মঞ্চকে ব্যবহার করেছে। আর এখন যেহেতু সেই প্রয়োজন ফুরিয়েছে তাই তাদের এই নীতি পরিবর্তন ঘটেছে’। যদি তাই হয়, তাহলে অন্ততঃ এই কাজে সরকারের কোনো ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। যেহেতু গণজাগরণ মঞ্চের উত্থান হয়েছিল যে দাবিতে সেই দাবির বাস্তবায়ন ইতোমধ্যেই ঘটে গেছে, কাজেই স্বাভাবিকভাবেই সে আন্দোলন জিইয়ে রাখবার কোনো প্রয়োজন এখন নেই।
কিন্তু যদি সেটা না হয়ে সরকারের এই হঠাৎ নীতি পরিবর্তনের উদ্দেশ্য হয়- যারা এতদিন ধর্মব্যবসা করে এসেছে, ধর্মকে ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের সেন্টিমেন্ট নিয়ে খেলা করেছে তাদেরকে সন্তুষ্ট রাখা, তাহলে তা হবে একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। সরকার এটা ভাবতে পারে যে, ‘রাজনীতির সাথে সরাসরি যুক্ত নয়, এমন অনেক ধর্মাশ্রয়ী দল রয়েছে যারা সরকার বিরোধী অবস্থানে থাকার কারণেই সরকার অনেক জনসমর্থন হারিয়েছে।’ হ্যাঁ, সেটা ঠিক, তবে তার মানে এই নয় যে, এদের প্রতি সহানুভূতি দেখালে বা এদের সাথে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি করলেই তারা আবার মানুষকে আওয়ামী প্রেমে সিক্ত করে দেবে। তবে এর মাধ্যমে সরকার রাজনৈতিকভাবে দূরদর্শীতাস্বরূপ আপাতত লাভবান হতে পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে সেটা আওয়ামী লীগের জন্য স্থায়ী কোন সমাধান নয়।
প্রশ্ন আসতে পারে, সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে এমন কথা উঠছে কেন? কথাটি উঠছে এই কারণে যে, গণজাগরণ মঞ্চের সাথে সরকারের দূরত্ব সৃষ্টির কিছুদিনের মাথায় গত শুক্রবার হেফাজতে ইসলামের আমীর শাহ আহমেদ শফীর একটি বক্তব্য নতুন এই প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বোঝা যাচ্ছে- সরকারের ব্যাপারে হেফাজতের সুর বেশ পাল্টে যাচ্ছে। যে আওয়ামী লীগ এক সময় হেফাজতের প্রধান শত্র“ ছিল, যাদেরকে ‘নাস্তিক’ আখ্যা দিয়ে ক্ষমতা থেকে টেনে নামানোর জন্য হেফাজত নেতারা কড়া ভাষায় বক্তব্য দিয়েছিল, প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেছিল যে, ‘এক্ষুনি ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ান, নয়তো পালাবার পথ খুঁজে পাবেন না, সেই আওয়ামী লীগকেই তারা এখন বন্ধু বলে ঘোষণা দিচ্ছে। আর এই ঘোষণাও যার-তার মুখ থেকে আসেনি, এসেছে হেফাজতের আমির শাহ আহমদ শফীর মুখ থেকেই। তার বক্তব্য হচ্ছে- ‘হাসিনা সরকার, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ সবাই আমাদের বন্ধু। এদের সঙ্গে কোনো শত্র“তা নাই। কেউ যদি বলে হাসিনা সরকার, ছাত্রলীগ আমাদের দুশমন এটা বুঝাটা ভুল হবে। এদের কাউকে কোনো দিন আমি গালি দেই নাই।’ [১১-০৪-২০১৪, প্রথম আলো] তাই প্রশ্ন উঠছে এতদিনের শত্র“ হঠাৎ বন্ধু বনে যাবার কারণ কী? তবে কি গণজাগরণ মঞ্চের সাথে সরকারের দূরত্ব সৃষ্টির সুযোগটি কাজে লাগাতে চাচ্ছে হেফাজতে ইসলাম? নাকি, সরকারই সময়ের প্রয়োজনে গণজাগরণ মঞ্চকে দূরে সরিয়ে রেখে হেফাজতকে কাছে টানতে চাচ্ছে? ঘটনা যাই ঘটুক, বাস্তবতা হলো- এর কোনটাই ক্ষমতাসীনদের জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে না। ধর্মব্যবসায়ীরা যদি সরকারের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলতে সমর্থ হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবে তারা সরকারকে বিপদে ফেলবে। আদর্শগতভাবে তারা ইসলামের কথা বললেও কার্যত এরা ধর্মব্যবসায়ী। ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে পার্থিব স্বার্থ হাসিল করাই হলো এদের পেশা। প্রকৃত ইসলামের সাথে ধর্মব্যবসায়ী শ্রেণির দূরতম সম্পর্কও নেই। আর এরা যে আওয়ামী লীগকে কোনদিন ভোট দিবে এমন আশা-করাটাও নিতান্তই বোকামী। উপরন্তু এতদিন এদের বিরোধিতা করে এসে, এদেরকে জঙ্গি-সন্ত্রাসী ইত্যাদি ট্যাগে বিদ্ধ করে এখন যদি সরকার তাদের সাথে নতুনভাবে সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করে তাহলে মানুষ সরকারকেই ধর্মব্যবসায়ী হিসেবে মূল্যায়ন করবে, যা- আর যাই হোক আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের জন্য শোভনীয় নয়।পরিশেষে বলতে চাই- গণজাগরণ মঞ্চের ব্যাপারে সরকার বর্তমানে যে অবস্থান নিয়েছে তাতে অন্যান্য বিষয় বাদ দিয়ে যদি শুধু সরকারের লাভ-ক্ষতির পরিমাপ করা হয়, তাহলে তাতে লাভের পাল্লা-ই ভারি হবে। কিন্তু এই লাভ নিমেষেই ম্লান হয়ে যেতে পারে যদি সরকার ধর্মব্যবসায়ীদের ব্যাপারে বর্তমান অবস্থানকে কোনরূপ শিথিল করে। বরং সরকারের অবস্থান হওয়া উচিত ধর্মবিদ্বেষী ও ধর্মব্যবসায়ী উভয় শ্রেণির বিপরীতে। এই ভারসাম্য সরকার যখনই হারিয়ে ফেলবে তখনই তাদের ভুলের মাশুল গুণতে হবে।
বিষয়: বিবিধ
১০৫৭ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
এটা না বলে বলা উচিত '' জনগনের জন্য কি বার্তা ?''
সরকার এই দুইটাকে নিয়ে জনগনের সাথে ভালই খেলছে ।
সাঈদীর আপিলের শুনানী কিন্তু শেষ
মন্তব্য করতে লগইন করুন