ধর্মব্যবসায়ীদের অর্থদান করা কেন অর্থহীন এবং অন্যায়?
লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ আসাদ আলী ০৯ এপ্রিল, ২০১৪, ০৭:১২:০৭ সন্ধ্যা
ধর্ম নিয়ে যারা ব্যবসা করে, পার্থিব স্বার্থে ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে ও সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে সমাজে দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করে তারাই হলো ধর্মব্যবসায়ী। রসুলাল্লাহ অক্লান্ত চেষ্টা কোরে যে উম্মতে মোহাম্মদী জাতি গঠন কোরেছিলেন সেই জাতির মধ্যে আজকের মতো আলেম-মাওলানা, পীর-দরবেশ, মোহাদ্দেস, ফকীহ, মুফতি, মোফাসসের ইত্যাদি টাইটেলধারী কেউ ছিল না। জাতির প্রতিটি সদস্যই ছিলো আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠার জন্য নিবেদিতপ্রাণ মোজাহেদ বা যোদ্ধা। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে কিছুদিন পরেই জাতি তার মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ভুলে গিয়ে দীন প্রতিষ্ঠার জেহাদ ত্যাগ করে। এই সময় জাতির মধ্যে জন্ম নেয় দীনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণকারী তথাকথিত আলেম শ্রেণি। তারা দীনের বিধানাবলী নিয়ে পুংখানুপুংখ বিশ্লেষণ, মতভেদ ও অবিশ্রান্ত কুটতর্কে লিপ্ত হোয়ে জাতিকে শত শত ফেরকায় মাজহাবে বিভক্ত কোরে ফেলে। এদেরই উত্তরসুরী হোচ্ছেন আজকের আলেম-মাওলানা, মোহাদ্দেস ও মোফাসসেরগণ তথা ধর্মব্যবসায়ীরা। খ্রিস্টানদের প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসায় খ্রিস্টানদের শেখানো এসলাম শিখে সেটাকে ব্যবহার কোরে পার্থিব স্বার্থ হাসিল করাই এই শ্রেণির জীবনের উদ্দেশ্য। এরা সমাজের একটি পরাশ্রয়ী, পরজীবী ও পরভোজী শ্রেণি। সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষকে ধোঁকা দিয়ে তাদের কষ্টার্জিত ধন-সম্পদ, টাকা-পয়সা কুক্ষিগত করাই তাদের পেশা। সুরা তওবার ৩৪ নং আয়াতে আল্লাহ এই কথাটি বোলেছেন যে, হে মো’মেনগণ! পণ্ডিত এবং সুফীবাদীদের মধ্যে অনেকেই মানুষের ধন অন্যায়ভাবে ভোগ করে থাকে এবং মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে নিবৃত্ত করে।’ আল্লাহর এই বাণীকে উপেক্ষা কোরে আমরাও প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধোরে বিশ্বাস কোরে আসছি যে এই আলেম শ্রেণি আল্লাহর খুব প্রিয়পাত্র। তাদেরকে খুশি রাখতে পারলে, তারা দোয়া কোরলে ওপারে নাজাত নিশ্চিত। তাই ধর্মপ্রাণ মানুষ এদের পেছনে অকাতরে ধন-সম্পদ ব্যয় কোরছে, এদের হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে ভাবছে আল্লাহর রাস্তায় দান কোরলাম, হাজার হাজার টাকায় তাদেরকে ভাড়া কোরে আনছে ওয়াজ করার জন্য, বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা তুলে, মুষ্টির চাল সংগ্রহ কোরে মসজিদের এমাম সাহেবের বাসায় পৌঁছে দিচ্ছে। তারা দেখেও দেখছে না যে, মসজিদের উন্নতির জন্য আদায় করা টাকার সিংহভাগই যাচ্ছে মওলানা সাহেবের পকেটে। হাঁস-মুরগীর প্রথম ডিমটা, গাছের প্রথম কাঠালটা ‘হুজুর’-এর জন্য বরাদ্দ, কারণ তিনি যে আল্লাহর ‘খাস বান্দা’। কিন্তু আসলেই কি এই অর্থদান আখেরাতে তাদের কোনো কাজে আসবে? আসুন দেখা যাক:
(১) আমাদের কারও অজানা নেই যে, সমাজের আলেম-মাওলানা হিসেবে পরিচিত পুরোহিত শ্রেণিটি যাবতীয় ধর্মকর্ম কোরে থাকে অর্থের বিনিময়ে। ওয়াজ ও মিলাদ-মাহফিল, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, জুমার নামাজ, তারাবীর নামাজ, ঈদের নামাজ, জানাজার নামাজ, জিকির-আসগার, কুলখানি, বিয়ে, কোর’আন খতম ইত্যাদি ধর্মীয় কাজ বোলতে আজ যা বোঝানো হয় তার কোনোটাই অর্থব্যয় ছাড়া হয় না। কিন্তু দীনের বিনিময়ে অর্থ-সম্পদ গ্রহণ আল্লাহ হারাম কোরেছেন। আল্লাহ বোলেছেন, “আল্লাহ যে কেতাব অবতীর্ণ কোরেছেন যারা তা গোপন করে এবং বিনিময়ে তুচ্ছমূল্য গ্রহণ করে তারা ধ নিজেদের পেটে আগুন ছাড়া কিছুই পুরে না,ধ কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাদের সঙ্গে কথা বোলবেন না, ধ আল্লাহ তাদের পবিত্রও কোরবেন না, ধ তারা ক্ষমার পরিবর্তে শাস্তি ক্রয় কোরেছে,ধ তারা হেদায়াতের পরিবর্তে পথভ্রষ্টতা বা গোমরাহী ক্রয় কোরেছে,ধ তারা দীন সম্পর্কে ঘোরতর মতভেদে লিপ্ত আছে ধ আগুন সহ্য কোরতে তারা কতই না ধৈর্যশীল”। (সুরা বাকারা ১৭৪-১৭৫)অর্থাৎ যাদেরকে সাধারণ মানুষ ধর্মের কাণ্ডারি বোলে বিশ্বাস করে, ‘হুজুর’, ‘মওলানা সাহেব’ বোলে তাজীম করে তারা পার্থিব জীবনেই জাহান্নামের আগুন ভক্ষণ কোরছে, সুতরাং তাদেরকে পোষণ ও তোষণ কোরলে যে জাহান্নামেই যেতে হবে সেটা বোধ কোরি বলার প্রয়োজন পড়ে না। তথাপি আল্লাহ বোলছেন- অনুসরণ করো তাদের, যারা বিনিময় নেয় না এবং হেদায়াহপ্রাপ্ত (সুরা আল ইয়াসীন- ২১)। তাহলে যাদেরকে অনুসরণ করা অবৈধ তাদেরকে অর্থ-কড়ি প্রদান করা কীভাবে বৈধ বা পূণ্যের কাজ হতে পারে? সুতরাং নিশ্চয়ই এই ধর্মজীবী আলেম-মাওলানাদের আর্থিক সাহায্য দেওয়া মানেই হলো- আল্লাহর হুকুম অমান্য করা। যদি কেউ মানবতার খাতিরে দান কোরতে চান তবে এমন কাউকে দান করুন যে অন্তত ধর্মকে বিক্রি করে না। মনে রাখবেন, ধর্মব্যবসায়ীরা মানবতার শত্র“, এসলামের শত্র“।
(২) ধর্ম নিয়ে ব্যবসা কোরলে বা ধর্মকে পণ্যের মতো বেচা-কেনা কোরলে সেটা বিকৃত হবেই। পণ্যকে যেমন ক্রেতার চোখে আকর্ষণীয় কোরে তোলার জন্য আকর্ষণীয় মোড়ক ব্যবহার করা হয়, রং দেওয়া হয়, প্রয়োজনে ফর্মালিন-কার্বাইড জাতীয় বিষাক্ত কেমিক্যাল প্রয়োগ করা হয় তেমনভাবে ধর্মকে নিয়ে যখন ব্যবসা করা হয় তখন ধর্মকেও অতিরঞ্জিত করা হয়। ধর্মকেও একেকজন ক্রেতার কাছে একেকরূপে ক্রেতার রুচিমাফিক রঙ-রস দিয়ে উপস্থাপন করা হয়। ঠিক এই প্রক্রিয়াতেই ধর্মজীবীরা যুগে যুগে স্থান-কাল-পাত্রভেদে দীনের যোগ-বিয়োগ কোরেছেন। আর সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষ এই ধর্ম বিকৃত-কারীদেরকেই নবী-রসুলের উত্তরসুরী জ্ঞান কোরে সম্মানের স্থানে বসিয়েছে। নিজেরা না খেয়ে থেকে তাদেরকে অর্থ-সম্পদের পাহাড় গড়ে দিয়েছে। এভাবে সাধারণ মানুষ যুগে যুগে ধর্মজীবীদের দ্বারা প্রতারিত হোয়েছে।
(৩) রসুলাল্লাহ কঠিন সংগ্রাম কোরে একটি জাতি গঠন কোরেছিলেন। সেই জাতির নেতা ছিল একজন, লক্ষ্যও ছিল মাত্র একটি। ইতিহাস সাক্ষী যতদিন সেই জাতি তাদের ঐক্যকে ধরে রেখেছিল ততদিন তাদের সামনে কোন শক্তি দাঁড়াতে পারে নি। তারা সরল-সঠিক পথের অনুসারী ছিলেন। কিন্তু যখনই জাতির মধ্যে ধর্মজীবীদের আবির্ভাব ঘোটল, ধর্ম নিয়ে অতি বিশ্লেষণ শুরু হোল তখনই মতভেদ হোয়ে জাতি বিভক্ত হোয়ে গেল। জন্ম হোল শিয়া-সুন্নী, হাম্বলী, মালেকী, আহলে হাদীস, ওয়াহাবী, হানাফী, শাফেয়ী, পীর-ফকীর, দরবেশ ইত্যাদির। এদের এক এক ফেরকার আকীদা এক এক রকম। এই ফেরকাগুলোতে অনুসারীরও কোন অভাব নেই। যেটা তর্ক-বিতর্কের কোনো বিষয়ই নয়, দেখা যাচ্ছে সেটাকে বিশ্লেষণ-অতি বিশ্লেষণ কোরে জাতি শুধু যে বিভক্তই হোয়েছে তাই নয়, নিজেরা নিজেরা মারামারি, হানাহানি, রক্তপাত ঘটাচ্ছে। এই ফেরকা মাজহাব কি সাধারণ মানুষেরা সৃষ্টি কোরেছে নাকি ধর্মের লেবাসধারী আলেম-ওলামারা সৃষ্টি কোরেছেন? এর উত্তর সবাই জানেন। যখন থেকে ধর্মজীবীদের আবির্ভাব ঘটেছে তখন থেকেই মোসলেম জাতির মধ্যে বিভক্তি ও পরিণামে অধঃপতন শুরু হোয়েছে। আর এই পতনের ধারবাহিকতায় তারা আজ অন্য জাতির দাসত্ব কোরে যাচ্ছে। এতকিছুর পরও এই ১৬০ কোটির মোসলেম জনসংখ্যার ঘুম ভাঙে নি। তারা এখনও টাকা-পয়সা খরচ কোরে ওয়াজকারী ভাড়া কোরে আনছে, পীরের দরবারে সোনা-দানা ভেট দিয়ে আসছে। তারা বুঝতে পারছে না যে, এই অর্থ সম্পদ তাদেরই জাহান্নামের ইন্ধন হবে।
(৪) ধর্মজীবীরা তাদের স্বার্থের পথে বিঘœ সৃষ্টিকারীকে নাজেহাল করার জন্য ধর্মকে অপব্যবহার করে। যখনই কেউ তাদের মিথ্যার মুখোস খুলে দিতে চায়, এদের অবৈধ কর্মকাণ্ডগুলির প্রতিবাদ করে তখনই তারা ঐ লোকের বিরুদ্ধে ফতোয়া দিতে শুরু করে। পরিবেশ বুঝে যখন যাকে ইচ্ছা নাস্তিক, কাফের, মুরতাদ ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে মানুষকে সহিংসতা দাঙ্গা-ফাসাদে লিপ্ত করে। বিগত বছরে আমাদের দেশে যে পরিমাণ সহিংসতা হয়েছে, পাঁচ শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, রাস্তাঘাট-রেল, যানবাহনের ক্ষয়ক্ষতি বা গাছপালা কেটে ফেলা হয়েছে, শত শত কোটি টাকার সম্পদ ধ্বংস হোয়েছে তার পেছনে দায়ী ধর্ম নিয়ে অপরাজনীতি এবং ধর্মব্যবসায়ীদের ইন্ধন। যারা ধর্ম নিয়ে অপরাজনীতি করে তারা তাদের অবৈধ কর্মসূচিকে জেহাদের সাথে তুলনা কোরে মানুষের থেকে অর্থ আদায় করে। তারাও মানুষকে প্রতারিত কোরে যাচ্ছে।
আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধ হই, শ্লোগান তুলি- ধর্মের নামে এই অরাজকতা ও যথেচ্ছাচার বন্ধ হোক, ধর্মকে ব্যক্তি বা গোষ্ঠির স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার না কোরে একে মানবতার কল্যাণে ব্যবহার করা হোক। এজন্য সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। সমাজের যারা সওয়াবের আশায় ধর্মব্যবসায়ীদেরকে পৃষ্ঠপোষণ কোরছেন তারা নিজেরা অন্যায়ের প্রশ্রয়দাতা। অন্যায়ের প্রশ্রয় দিলে তার পরিণতিও ভোগ কোরতে হয়। চোর, ডাকাত, সুদখোর, ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজকে প্রশ্রয় দেওয়া যদি অন্যায় হয় তবে ধর্মব্যবসাকে প্রশ্রয় দেওয়া তার চেয়ে বড় অন্যায়।
বিষয়: বিবিধ
১২০৭ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন