প্রতারণা ও মিথ্যাচারের প্রসারে পহেলা এপ্রিলের কুশিক্ষা
লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ আসাদ আলী ০১ এপ্রিল, ২০১৪, ০৭:৩৫:৫৬ সন্ধ্যা
পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণের উদগ্র বাসনা আমাদের সমাজে যে সমস্ত প্রথার প্রচলন ঘটিয়েছে ‘এপ্রিল ফুল’ উদযাপন তার মধ্যে অন্যতম। এই প্রথা পালন করতে গিয়ে এপ্রিলের ১ তারিখে মিথ্যা বলে কারো সাথে প্রতারণা করে তাকে নির্বোধ বানানোকে শুধু বৈধই মনে করা হয় না, বরং একে রীতিমত একটি পারঙ্গমতা ও উৎকর্ষতা মনে করা হয়। যে যত বেশি চাতুর্যপূর্ণভাবে এবং নিরঙ্কুশভাবে অন্যকে যত বেশি প্রতারিত করতে পারবে, তাকে তত অধিক প্রশংসার যোগ্য বলে মনে করা হয়। মানুষকে প্রতারিত করার এই রুচি-যাকে প্রকৃতপক্ষে ‘কুরুচি’-ই বলা উচিৎ- বিনা কারণে কত লোকের জানমালের ক্ষতি সাধন করছে তার ইয়াত্তা নেই। অনেক সময় এর পরিণতিতে বহু প্রাণনাশ পর্যন্ত হয়েছে। শুধু তাই নয়, ‘এপ্রিল ফুল’ বিষয়টির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে মোসলেমদের করুণ ও হৃদয়র্স্পশী ইতিহাস।
রানী ইসাবেলার পরিহাস- হায় এপ্রিলের বোকা!
স্পেনে মোসলেম সেনাপতি তারিক বিন যিয়াদ এর নেতৃত্বে ৭১১ খ্রিঃ এসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন হয় এবং মোসলেম সভ্যতার গোড়পত্তন হয়। রাজ্যের নাম হয় আল-আন্দালুস। যে উদ্দেশ্যে এই উম্মতে মোহাম্মদী নামক জাতিটিকে আল্লাহর রসুল সৃষ্টি করেছিলেন তা হচ্ছে সর্বাত্মক সংগ্রাম, জেহাদের মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠা করে মানবজাতির জীবনে শান্তি, শৃঙ্খলা, ন্যায়, সুবিচার ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই জাতির শাসকরা বিরাট ভূখণ্ডের শাসনক্ষমতা ও অতুল ঐশ্বর্য লাভ করে তাদের মূল উদ্দেশ্য ভুলে যায় এবং দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ত্যাগ করে ভোগ বিলাস, দুনিয়া উপভোগ, আমোদ আহ্লাদে লিপ্ত হয়। জেহাদ ত্যাগ করলেও মোসলেমরা আল্লাহর সত্যদীনের হুকুম বিধান পালন করার কারণে জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতিটি অঙ্গনে, সাহিত্য, সঙ্গীত, শিল্পকলায়, স্থাপত্যশৈলী, নব নব আবিষ্কার এক কথায় জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে এই আটশ বছরে সমৃদ্ধির চূড়ান্ত অবস্থানে পৌঁছায়। দীর্ঘ আটশ বছর অব্যাহত থাকে এই বিস্ময়কর উন্নতির ধারা। কিন্তু এরই মধ্যে ধর্মের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে জাতির মধ্যে সৃষ্টি হয় হাজারো দলাদলি, ফেরকা, মাজহাব ইত্যাদি। আস্তে আস্তে মোসলেম সম্রাজ্যে ঘুনে ধরতে শুরু করে এবং মোসলেম শাসকরাও ভোগ বিলাসে গা ভাসিয়ে নারী ও মদে আসক্ত হয়ে এসলামের সকল শিক্ষা থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। আল্লাহ এ জাতিকে সতর্ক করে বলেছেন, ‘যদি তোমরা অভিযানে (জেহাদ) বের না হও, তিনি তোমাদেরকে কঠিন শাস্তি দিবেন এবং তোমাদের উপরে অন্য জাতি চাপিয়ে দেবেন (সুরা তওবা ৩৯)। আল্লাহর সেই ঘোষণা বাস্তবায়িত হতে শুরু করল। ইউরোপসহ পৃথিবীর অন্যান্য মোসলেম দেশগুলোও ধীরে ধীরে মোসলেমদের হাত ছাড়া হয়ে খ্রিস্টানদের দখলে যেতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় আসে স্পেনের পালা। এ দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করে খ্রিস্টান জগত। তারা মেতে উঠে কুটিল ষড়যন্ত্রে। সিদ্ধান্ত নেয়, ‘স্পেনের মাটি থেকে মুসলমানদের উচ্ছেদ করতে হবে’। এ চিন্তা নিয়েই পর্তুগীজ রানী ইসাবেলা চরম মোসলেম-বিদ্বেষী পার্শ্ববর্তী খ্রিস্টান সম্রাট ফার্ডিনান্ডকে বিয়ে করে। বিয়ের পর দু’জন মিলে নেতৃত্ব দেয় মোসলেম নিধনের। মোসলেম বিরোধী দুই বৃহৎ খ্রিস্টান শক্তি সম্মিলিত শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। খ্রিস্টানদের সম্মিলিত বাহিনী হাজার হাজার নারী-পুরুষকে হত্যা করে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে উল্লাস করতে করতে ছুটে আসে রাজধানী গ্রানাডায়। টনক নড়ে মোসলেম বাহিনীর। তারা সম্মিলিত খ্রিস্টান বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। কিন্তু এরই মধ্যে হাজার হাজার মোনাফেক খ্রিস্টানদের গুপ্তচর হয়ে মোসলেম শাসনের কেন্দ্রবিন্দুগুলিতে ঠাঁই করে নিয়েছে। আরও ছিল ইহুদীদের ষড়যন্ত্র। এমনই একটি দুর্বল মুহূর্তে খ্রিস্টান বাহিনী ঘিরে ফেলে গ্রানাডার তিন দিক। এক মাত্র মহাসমুদ্রই বাকী থাকে মোসলেমদের পলায়নের পথ হিসাবে। সেদিক দিয়েও পলায়নের কোন সুযোগ রাখে না খ্রিস্টানরা। চতুর ফার্ডিন্যান্ডের নির্দেশে আশপাশের সব শস্যখামার জ্বালিয়ে দেয়া হয়। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয় শহরের খাদ্য সরবরাহের প্রধান কেন্দ্র ভেগা উপত্যকা? অচিরেই দুর্ভিক্ষ নেমে আসে শহরে। দুর্ভিক্ষ যখন প্রকট আকার ধারণ করলো তখন প্রতারক ফার্ডিন্যান্ড ঘোষণা করলো, ‘মুসলমানরা যদি শহরের প্রধান ফটক খুলে দেয় এবং যারা নিরস্ত্র অবস্থায় মসজিদে আশ্রয় নেবে এবং সমুদ্র পাড়ে রক্ষিত নৌযানগুলোতে আরোহণ করবে তাদেরকে সবরকমের নিরাপত্তা দেওয়া হবে।’ এমন বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে মোসলেমগণ ফার্ডিনান্ডের এই ঘোষণায় বিশ্বাস করল এবং জীবনরক্ষার আশা ফিরে পায়। তার সরল মনে মসজিদ ও নৌযানগুলোতে আশ্রয় গ্রহণ করে। কিন্তু প্রতিশ্র“তি ভঙ্গ করে রাজা ফার্ডিন্যান্ড তালা লাগিয়ে দেয় মসজিদগুলোতে এবং মাঝসমুদ্রে ভাসিয়ে নিয়ে যায় নৌযানগুলোকে। এরপর আগুন লাগিয়ে দেয় মসজিদগুলোর চার পাশে। ফলে অগ্নিদগ্ধ লক্ষ লক্ষ নারি পুরুষ আর নি®পাপ শিশুর আর্ত চিৎকারে ভারি হয়ে উঠে স্পেনের আকাশ বাতাস। অপরদিকে মাঝসাগরে ডুবিয়ে দেয় নৌযানগুলোকে। সেদিন প্রায় সাত লক্ষ মোসলেম দাবিদার অসহায় জনতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এর মাধ্যমেই ইতি ঘটে স্পেনের আটশ বছরের মোসলেম শাসনের। প্রকৃতপক্ষে স্পেনে যে জাতিটি খ্রিস্টান হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছিল তারা পরিচয়ে মোসলেম হলেও আল্লাহর দৃষ্টিতে তারা আর মোসলেম ছিল না। তারা ছিল আল্লাহর লা’নত ও গজবের পাত্র। কারণ এই সাত লক্ষ মানুষ মোমেন হলে তারা কোন অবস্থাতেই এমন অসহায়ভাবে মরতে পারে না, কেননা মোমেনদের রক্ষাকর্তা, বন্ধু, সহায় অর্থাৎ ওয়ালী স্বয়ং আল্লাহ। তাঁর ওয়াদা মোতাবেক মোমেনরা কখনোই কাফেরদের সঙ্গে পরাজিত হবে না, কারণ আল্লাহ মোমেনদের সঙ্গে থাকবেন। মোমেনদের পরাজয় মানে আল্লাহর পরাজয় যা অসম্ভব। সুতরাং তারা মোমেন ছিলেন না। যাহোক আল্লাহর এই প্রতিশ্র“ত গজব বাস্তবায়িত হয় ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দের ২ জানুয়ারি। গ্রানাডা দখলের পর খ্রিস্টান বাহিনী স্পেনের অনেক সমৃদ্ধ লাইব্রেরী পুড়িয়ে দেয়। তারা অসংখ্য আরবী গ্রন্থ পুড়িয়ে ফেলে। এরপর মোসলেমদের যারা বেঁচে থাকে তাদেরকে খ্রিস্টান হতে বাধ্য করা হয় অথবা নির্বাসিত করা হয়।
অনেকে বলে থাকেন গ্রানাডা গণহত্যার এ দিনটি ছিল ১ এপ্রিল। কিন্তু খ্রিস্টানদের এই ধোঁকাবাজি থেকেই ‘এপ্রিল ফুল’ নামক কুরুচিপূর্ণ প্রথার উদ্ভব, এই মতের পক্ষে তেমন কোন দলিল প্রমাণ নেই। তবে এতদুভয়ের মধ্যে একটি সম্বন্ধ সৃষ্টি হয় রানী ইসাবেলার একটি উক্তির প্রেক্ষিতে। মসজিদে অগ্নিসংযোগের পর লক্ষ লক্ষ নারী-পুরুষ-শিশু অসহায় আর্তনাদ করতে করতে জীবন্ত দগ্ধ হয়ে যখন মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারাচ্ছিল, প্রজ্জ্বলিত অগ্নিশিখায় দগ্ধ অসহায় মোসলেমদের পোড়া মাংসের গন্ধে যখন গ্রানাডার আকাশ-বাতাস ভারী করে তুলেছিল, তখন রানী ইসাবেলা হেসে বলতে লাগলো, ‘হায় এপ্রিলের বোকা! শত্র“র আশ্বাস কেউ বিশ্বাস করে?’ এই হল স্পেনের ইতিহাসের সঙ্গে এপ্রিল ফুলের যোগসূত্র।
এপ্রিল ফুলের গোড়ার কথা
ইরানের নববর্ষ ‘নওরোজ’ অনুষ্ঠানে এপ্রিল ফুলের মতই ধোঁকা দেয়া হত মানুষকে। এটা খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৬ সাল থেকে প্রচলিত। আর এটাকেই সবচেয়ে পুরাতন ইতিহাস হিসেবে ধরা হয়। তবে এই দিনে ধোঁকাবাজি ও মিথ্যাচারের যে প্রথা আজ চালু হয়েছে তা ব্যাপকতা লাভ করেছে বহু পরে।
রোমান নববর্ষ ও এপ্রিল ফুল-
এপ্রিল ফুলের এই কুপ্রথার সূচনার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সুপ্রাচীন। এপ্রিল ফুল এর সাথে সূর্য আর প্রকৃতি উপাসনার বেশ কিছু সম্পর্ক আছে। প্রাচীন ইউরোপে এপ্রিল মাসের প্রথম দিনকে বসন্তের সূচনা ধরা হত। শীতের পরে বসন্তের বহুরূপী আবির্ভাবকে মানুষ প্রকৃতির ছলনা মনে করত। সেখান থেকে মানুষ নিজেরাও এই দিনটিতে মিথ্যা বলে অন্যকে ছলনা দিতে শুরু করে। এটা খ্রিস্ট ধর্মেরও আগের কথা। তাছাড়া প্যাগানদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের একটা অংশ ছিল আজকের এপ্রিল ফুলের মতই। অনেকে আনন্দ করার জন্যই অন্যকে উপহার উপঢৌকন দেবার নামে অসার বস্তু উপহার দিয়ে ঠাট্টা করত। রোমানরা এই মাসকে তাদের দেবী ঠবহঁং এর সাথে সম্পৃক্ত মনে করে একে সম্মানিত মাস মনে করত। গ্রীক ভাষায় সৌন্দর্য ও প্রেমের দেবী ভেনাসের নাম বলা হত অ্যাফ্রোদিতি, আর সম্ভবত এই শব্দ থেকেই এপ্রিল শব্দটির উদ্ভাবন (ব্রিটেনিকা/১৫তম সংস্করণ/পৃ: ২৯২/খণ্ড: ৮)। অন্যদিকে অধিকাংশ ইউরোপ ২৫ মার্চে নববর্ষ পালন করত। ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে পোপ গ্রেগরী ঢওওও পুরানো জুলিয়ান ক্যালেন্ডারকে নতুন গ্রেগরীয়ান ক্যালেন্ডার দিয়ে প্রতিস্থাপন করার আদেশ দিলেন। এ ক্যালেন্ডারে ১ জানুয়ারীকে নববর্ষ হিসেবে গ্রহণ করা হয়। ফ্রান্স এটি গ্রহণ করল এবং নববর্ষকে ১ জানুয়ারীতে পরিবর্তন করল। কিন্তু কিছু লোক তার বিরোধিতা করে। যারা পুরনো ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ১ এপ্রিলকেই নববর্ষের ১ম দিন ধরে দিন গণনা করে আসছিল, তাদেরকে প্রতি বছর ১লা এপ্রিলে বোকা উপাধি দেয়া হতো। ১৭৫২ পর্যন্ত ইংল্যান্ডে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার গৃহীত হয় নি, অথচ সেখানেও ততদিনে এপ্রিল ফুল গৃহীত হয়ে গেছে।
পহেলা এপ্রিলে ঈসা (আ) এর সঙ্গে নিষ্ঠুরতা-
ইতিহাসের ভাষ্যমতে খ্রিস্টানদের জন্যও পহেলা এপ্রিল একটি দুঃখময় দিন হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা হয় নি। ঊনবিংশ খ্রিস্ট শতাব্দীর নামকরা এনসাইক্লোপিডিয়া ‘লারুস’ এ বলা হয়েছে যে প্রকৃতপক্ষে ইহুদি ও খ্রিস্টানদের বর্ণনামতে ১লা এপ্রিল সেই তারিখ, যেই তারিখে ইহুদি ও প্যাগান রোমানরা ‘বনী ইস্রাইলের রাজা’ বলে ঈসাকে (আ উপহাসের পাত্র বানায়। ইঞ্জিলের বর্ণনা: “যে ব্যক্তি তাঁকে (ঈসা আ বন্দী করে রেখেছিল, সে তাঁর সঙ্গে উপহাস করত, তাঁকে প্রহার করত এবং তাঁকে এভাবে জিজ্ঞাসা করত যে, ‘নবুওয়াত দ্বারা বল্ তোকে কে মেরেছে?’ এমনিভাবে বিদ্রƒপ করে সে তাঁর বিরুদ্ধে অনেক কথা বলত।” (লুকঃ ২২/৬৩-৬৫)
প্রথমে ঈসাকে (আ ইহুদিদের ধর্মীয় নেতা ও প্রধান পুরোহিতদের আদালতে পেশ করা হয়। তারপর তারা তাঁকে রোমান সম্রাটের গভর্নর পিলাতের আদালতে বিচারের উদ্দেশ্যে নিয়ে যায়। তারপর পিলাত তাঁকে পার্শ্ববর্তী প্রদেশের গভর্নর হেরোদের আদালতে পাঠিয়ে দেয়। অবশেষে হেরোদও উপর্যুপরি ঠাট্টা তামাশা শেষে পুনরায় তাঁকে বিচারের উদ্দেশ্যে পিলাতের আদালতে পাঠিয়ে দেয়। ঈসাকে (আ এক আদালত থেকে অন্য আদালতে পাঠানোর উদ্দেশ্য ছিল তাঁর সঙ্গে বিদ্রƒপ করা এবং তাঁকে কষ্ট দেওয়া, ঐতিহাসিকদের অভিমত দিনটি পহেলা এপ্রিল ছিল বলেই উপহাসকারীদের নিষ্ঠুরতা বিশেষ মাত্রা অর্জন করেছিল। তাই এপ্রিল ফুলের প্রথা মূলত একজন নবীর সঙ্গে কাফেরদের ধৃষ্টতামূলক আচরণের ইতিহাস মনে করিয়ে দেয়।
এপ্রিলের মাছ-
এই দিনে মানুষকে কেন বোকা বানানো হয় তার পেছনে আছে মাছের বাচ্চা ফোটার সম্পর্ক। শুনতে আশ্চর্য লাগছে, তাই না? কিন্তু প্রসিদ্ধ ইতিহাস সেটাই বলে। এপ্রিলের প্রথম দিবসে ফ্রান্সে প্রাচীনকাল থেকেই পয়সন দ্য আভ্রিল (ঢ়ড়রংংড়হ ফ'ধাৎরষ) নামক একটি অনুষ্ঠান পালিত হয় যার সাথে সম্পর্ক আছে মাছের। এপ্রিলের শুরুর দিকে ডিম ফুটে মাছের বাচ্চা বের হয়। এই শিশু মাছগুলোকে সহজে বোকা বানিয়ে ধরা যায়। সেজন্য তারা ১ এপ্রিল পালন করে ‘পয়সন দ্য আভ্রিল’ অর্থাৎ এপ্রিলের মাছ। ১ এপ্রিলে ফ্রান্সে বাচ্চারা অন্য বাচ্চাদের পিঠে কাগজের মাছ ঝুলিয়ে দেয় তাদের অজান্তে। যখন অন্যরা দেখে তখন চিৎকার করে বলে ওঠে ‘পয়সন দ্য আভ্রিল’। কবি চসারের ক্যান্টারবারি টেইলস (১৩৯২) বইয়ের ঞযব ঘঁহ'ং চৎরবংঃ'ং ঞধষব-এ এই দিনের কথা খুঁজে পাওয়া যায়।
তবে এনসাইক্লোপিডিয়া ‘লারুস’ এ বলা হয়েছে যে, চড়রংংড়হ শব্দটি অপর একটি ফরাসী শব্দ চড়ংরড়হ এর বিকৃত রূপ। যার অর্থ কষ্ট দেওয়া এবং শাস্তি দেওয়া। বিধায় এ প্রথাটি মূলত খ্রিস্টানদের বর্ণনামতে ঈসাকে (আ) যে কষ্ট ও শাস্তি দেওয়া হয়েছিল, তারই স্মৃতিস্বরূপ উদযাপন করা হয়ে থাকে। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ঈসার (আ সঙ্গে বিদ্রƒপ করার উদ্দেশ্যে ইহুদিদের দ্বারা প্রচলনকৃত এই প্রথাটির ধারক এখন সেই খ্রিস্টানরাই। তারা এ প্রথার প্রকৃত উৎস সম্পর্কে অবগত না হয়ে এবং কোনরূপ চিন্তা-ভাবনা না করে এটি উদযাপন করা আরম্ভ করেছে। আল্লামা তাকীউদ্দীন উসমানী এ প্রসঙ্গে এপ্রিল ফুল নামে একটি প্রবন্ধও লিখেছেন যাতে তিনি এ বিষয়ে বেশ শক্ত দলিল প্রমাণ দেখিয়েছেন।
গণমাধ্যমে এপ্রিল ফুলের ‘মর্কটক্রীড়া’-
‘এপ্রিল ফুল’ শব্দযুগল প্রথম ব্যবহার করে ইংলিশ ম্যাগাজিন উৎবপশ গধমধুরহব., ১৬৯৮ সালে। তারা এতে বলে ১ এপ্রিল ঞড়বিৎ ড়ভ খড়হফড়হ এ একদল কালো মানুষকে ধুয়ে ফরসা করা হবে! হাজার হাজার কালো বর্ণের মানুষ ফর্সা হতে নির্দিষ্ট স্থানে উপস্থিত হয় এবং বোকা বনে। তবে সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটায় ইংলিশ দৈনিক ঊাবহরহম ংঃধৎ, ১৭৪৬ এ। তারা বলে ১ এপ্রিল ওংষরহমঃড়হ এ বানরের প্যারেড অনুষ্ঠিত হবে। দলে দলে লোক সেদিন দেখতে যায় কিন্তু কিছুই দেখে না। শেষে বুঝে যে তারাই সেই বানর, তাদের বোকা বানানো হয়েছে।
বোস্টন ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের শিক্ষক জোসেফ বস্কিন এর মতে কন্সট্যানটাইনের রাজত্বকালে কিছু রাজবিদূষক (ভাড়) রোমরাজাকে বলেন যে তারা তার থেকে ভালোভাবে রাজত্ব পরিচালনা করতে পারবে। রাজা অবাক হলেন আর বিদূষক কুগেলকে একদিনের রাজত্ব দিলেন। কুগেল দিন কাটাল অদ্ভুত সব উদ্ভট কাজ করে। যদিও পরে প্রমাণিত হয় এটি এপ্রিল ফুলের একটি কৌতুক ছিল। সেই থেকে এদিনটি বাৎসরিক প্রথা হিসাবে ব্যাপকতা লাভ করে।
২০১০ সনে জর্ডানের একটি পত্রিকাও পাঠকদেরকে ‘এপ্রিলের বোকা’ বানানোর সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১০ এর ১ এপ্রিল জর্ডানের আল ঘাদ পত্রিকা প্রথম পাতায় একটি খবরে প্রকাশ করে যে, দেশের পূর্বাঞ্চলীয় মরুশহর জাফরে সসারে চেপে ভিনগ্রহের কিছু প্রাণী অবতরণ করেছে। এরা আকৃতিতে বিশাল। একেকটির উচ্চতা কম করে হলেও ১০ ফুট। পত্রিকার এ খবরে ভয় পেয়ে যায় জাফর শহরের বাসিন্দারা। ভিনগ্রহের প্রাণীগুলো হামলা করতে পারে এমন আতঙ্কে তারা শহর ছাড়তে শুরু করে। অভিভাবকেরা বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানো বন্ধ করে দেন। রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যায়। যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। শহরের ১৩ হাজার লোককে মেয়র মেলিহান নিজ তত্ত্বাবধানে অন্যত্র সরিয়ে নেন। এরপর বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য নিরাপত্তা বাহিনীকে তিনি নির্দেশ দেন। তারা খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারে, বিষয়টি পুরোপুরি ভুয়া। মরুভূমিতে ভিনগ্রহের কোনো প্রাণীর নামগন্ধ নেই। পত্রিকার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক মুসা বাহুমি এ ঘটনার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে বলেন, “ডব সবধহঃ ঃড় বহঃবৎঃধরহ, হড়ঃ ংপধৎব ঢ়বড়ঢ়ষব. আমরা মজা করতে চেয়েছিলাম, মানুষকে ভয় দেখাতে চাই নি।’
সুতরাং বোঝা গেল পাশ্চাত্যের একটি কুপ্রথা মোসলেমদের মধ্যেও ভালোভাবে বিস্তার লাভ করেছে। উপরোক্ত বিস্তারিত বিবরণের দ্বারা একটি বিষয় অন্তত সুস্পষ্ট যে, এপ্রিল ফুলের সঙ্গে মিথ্যাচার, ধোঁকা, প্রবঞ্চণা, সত্যনবীর প্রতি বিদ্রƒপ, নির্যাতন, মোসলেমদের গণহত্যা ইত্যাদি বহু বিষময় ইতিহাস জড়িত। আল্লাহ বলেছেন,
(ক) তাদের প্রতি আল্লাহর অভিসম্পাত যারা মিথ্যাবাদী। (সুরা আল-ইমরান: ৬১)।
(খ) নিশ্চয়ই আল্লাহ ধোকাবাজ, প্রতারককে পছন্দ করেন না। (সুরা আনফাল: ৫৮)
(গ) যারা বিনা অপরাধে মু’মিন পুরুষ ও মু’মিন নারীদেরকে কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে। (সুরা আহযাব: ৫৮)
(ঘ) আল্লাহর রসুল বলেছেন, ‘ধ্বংস তার জন্য যে, লোক হাসানোর জন্য কথা বলে এবং তাতে সে মিথ্যার আশ্রয় নেয়। ধ্বংস তার জন্য, ধ্বংস তার জন্য।’ (মুয়াবিয়া বিন হাইদা রা. থেকে তিরমিজি : ২৩৫, আবু দাউদ : ৪৯৯০)
(ঙ) আবদাল্লাহ ইবনে উমর (রা) থেকে বর্ণিত, রসুলাল্লাহ বলেছেন, যে ব্যক্তি কোন সম্প্রদায়ের সাথে সাদৃশ্য গ্রহণ করবে, সে তাদের মধ্যে গণ্য হবে। (সুনান আবু দাউদ-৪০৩১, মুসনাদে আহমাদঃ ২/৫, মাজমাউয যাওয়ায়েদ-১৭৯৫৯, মুসান্নাফ ইবনে আবু শাইবাহঃ ৪/২১২)
এপ্রিল ফুলের ইতিহাস যাই হোক এটা বর্জনীয় তাতে সন্দেহ নেই। কারণ মিথ্যা কখনই আনন্দের খোরাক হতে পারে না। ধর্মীয় দিক যদি বাদ দেই তবুও একজন মানুষ মিথ্যা বলে আনন্দ পেতে পারে না। আর পৃথিবীতে মনে হয় না এমন ধর্ম আছে যেখানে মিথ্যা বলাকে পাপ বলা হয়নি। সুতরাং যেই ধর্মের হন না কেন এই উৎসব (!) বর্জন করা উচিত, অন্তত নিজের মানবিকতা থেকে।
বিষয়: বিবিধ
১৪১৭ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
(ক) তাদের প্রতি আল্লাহর অভিসম্পাত যারা মিথ্যাবাদী। (সুরা আল-ইমরান: ৬১)।
(খ) নিশ্চয়ই আল্লাহ ধোকাবাজ, প্রতারককে পছন্দ করেন না। (সুরা আনফাল: ৫৮)
(গ) যারা বিনা অপরাধে মু’মিন পুরুষ ও মু’মিন নারীদেরকে কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে। (সুরা আহযাব: ৫৮)
(ঘ) আল্লাহর রসুল বলেছেন, ‘ধ্বংস তার জন্য যে, লোক হাসানোর জন্য কথা বলে এবং তাতে সে মিথ্যার আশ্রয় নেয়। ধ্বংস তার জন্য, ধ্বংস তার জন্য।’ (মুয়াবিয়া বিন হাইদা রা. থেকে তিরমিজি : ২৩৫, আবু দাউদ : ৪৯৯০)
(ঙ) আবদাল্লাহ ইবনে উমর (রা) থেকে বর্ণিত, রসুলাল্লাহ বলেছেন, যে ব্যক্তি কোন সম্প্রদায়ের সাথে সাদৃশ্য গ্রহণ করবে, সে তাদের মধ্যে গণ্য হবে। (সুনান আবু দাউদ-৪০৩১, মুসনাদে আহমাদঃ ২/৫, মাজমাউয যাওয়ায়েদ-১৭৯৫৯, মুসান্নাফ ইবনে আবু শাইবাহঃ ৪/২১২)
এপ্রিল ফুলের ইতিহাস যাই হোক এটা বর্জনীয় তাতে সন্দেহ নেই। কারণ মিথ্যা কখনই আনন্দের খোরাক হতে পারে না।
মন্তব্য করতে লগইন করুন