ভারতীয় ইতিহাসে মোহাম্মদ বিন কাসেম
লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ আসাদ আলী ২৭ মার্চ, ২০১৪, ০৭:২৮:৩৬ সন্ধ্যা
মোহাম্মদ বিন কাসেম। ভারতীয় ইতিহাস, বিশেষ করে মোসলেম শাসনের ইতিহাসের সাথে নামটি ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। ইসলামের প্রাথমিক যুগে এই তরুণ যুবকই এই উপমহাদেশে ইসলামের ঝাণ্ডা হাতে হাজির হয়েছিলেন। অন্ধকারে আচ্ছন্ন এবং বর্ণ-বৈষম্যের নির্মম কষাঘাতে জর্জরিত মানুষকে দেখিয়েছিলেন আশার আলো, শিখিয়েছিলেন কীভাবে মানুষকে ভালোবাসতে হয়, কীভাবে জাতি-ধর্ম-বর্ণের উর্ধে উঠে মানবতার কল্যাণে কাজ করতে হয়। এটা ঠিক যে, তৎকালীন সিন্ধু ও মুলতানের অধিবাসীরা মোহাম্মদ বিন কাসেমের আগমনকে তাৎক্ষণিকভাবে মেনে নেয় নি, কিন্তু পরবর্তীতে তাদের ভুল ভেঙ্গে যায়। তারা বুঝতে সক্ষম হয় যে, আসলে মোসলেমরা সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য আসে নি, তারা এসেছে মানবতার মুক্তিদূত হিসেবে; অন্যায়-অবিচার, বৈষম্যহীন একটি সমাজ উপহার দেওয়াই হলো মোসলেমদের উদ্দেশ্য। আর তাই ইতিহাসের নজীরবিহিন ঘটনা সেদিন পৃথিবীবাসী প্রত্যক্ষ করেছে। অন্যায়ভাবে যখন মোহাম্মদ বিন কাসেমকে হত্যা করা হয় তখন কাসেমের অধীনস্থ সেনাবাহিনীর সাথে সাথে এই উপমহাদেশের বিজিত অঞ্চলের মানুষগুলোও অশ্র“ বিসর্জন দেয়। ভিনদেশি কোন সেনাপতির মৃত্যুতে বিজিত অঞ্চলের অধিবাসীর অশ্র“ বিসর্জন দেওয়ার ইতিহাস আর কোথাও পাওয়া যায় না। ক্ষনজন্মা এই বীরের বিশেষ বিশেষ কিছু ঘটনাপ্রবাহ নিয়েই মূলতঃ এই প্রবন্ধ।
জন্ম পরিচয়: ইতিহাসখ্যাত বীর মোহাম্মদ বিন কাসেম ৬৯৫ খ্রিস্টাব্দের ৩১ ডিসেম্বর তায়েফে জন্মগ্রহণ করেন। তায়েফের থাকিফ গোত্রভুক্ত মোহাম্মদ বিন কাসিমের বাবার নাম কাসিম বিন ইউসুফ। অল্প বয়সেই মুহাম্মদ বিন কাসিম বাবাকে হারান। এ সময় উমাইয়া শাসক চাচা আল হাজ্জাজ বিন ইউসুফ আল থাকিফ কাসিমকে সমর এবং প্রশাসনিক বিষয়ে শিক্ষা দেন। অতঃপর বিন কাসেম তাঁর চাচাতো বোন জুবাইদাকে বিয়ে করেন। খুব অল্প বয়সে চাচা হাজ্জাজের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি পারস্যের শাসক নিযুক্ত হন।
সিন্ধু অভিযানের প্রেক্ষাপট: ভারতীয় উপমহাদেশের সাথে আরবদের যোগাযোগ বহুদিনের। প্রধানত ব্যবসার মাধ্যমেই এই যোগাযোগ স্থাপিত হয়; আরব বণিকরা ভারতীয় উপমহাদেশের উপকূলবর্তী বন্দরসমূহে আগমন কোরে এই দেশের পণ্যদ্রব্য আরবদেশে এবং পরে মধ্য-এশিয়া, উত্তর আফ্রিকা এবং এমনকি ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রেরণ করতো। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে আরব দেশে ইসলাম প্রচারিত হয়; আরবের মুসলমানরাও পূর্বপুরুষদের চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী ব্যবসা বাণিজ্যে তৎপর হোয়ে উঠেন। তারাও ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে এবং চীন-সাম্রাজ্যের সঙ্গে ব্যবসা চালাতেন। তখন ছিল আরবীয় ব্যবসা বাণিজ্যের স্বর্ণযুগ। একবার বাণিজ্য উপলক্ষে জাজিরাতুল ইয়াকুত এ গিয়ে কতিপয় আরবীয় বণিক মৃত্যুবরণ করেন। দেশীয় রাজা তখন পরলোকগত বণিকদের স্ত্রী-পুত্রদেরকে স্বদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন এবং সঙ্গে উমাইয়া সাম্রাজ্যের ইরাক প্রদেশের ভাইসরয় হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফের জন্য প্রচুর উপঢৌকন প্রেরণ করেন। কথিত আছে যে, আটটি জাহাজ-ভর্তি উপঢৌকন হাজ্জাজের নিকট প্রেরিত হয়। আরব দেশের পথে প্রতিকূল বাতাসে তাদের জাহাজগুলো সিন্ধু দেশের দেবল নামক বন্দরে নীত হয়। সেখানে জলদস্যুরা তাদের জাহাজ লুন্ঠন করে এবং হাজ্জাজের নিকট প্রেরিত উপঢৌকন কেড়ে নেয় এবং পরলোকগত বণিকদের বিধবা স্ত্রী ও আত্মীয় পরিজনদেরকে বন্দী করে। খবর পেয়ে হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফ সিন্ধুরাজ দাহিরের নিকট ক্ষতিপূরণ দাবি করে চিঠি লেখেন, কিন্তু তিনি দাহিরের নিকট থেকে কোন সদুত্তর পান নি। হাজ্জ্বাজ-বিন ইউসুফ ক্রুদ্ধ হয়ে সিন্ধরাজ দাহিরের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সংকল্প করেন। এভাবেই মূলত সিন্ধুদেশে মোসলেম আক্রমণের পথ রচিত হয়।
মোহাম্মদ বিন কাসেমের আক্রমণ: মোহাম্মদ-বিন কাসেমের অভিযানের প্রস্তুতির জন্য হাজ্জাজ বিন ইউসুফ বাছাই করে অতি দক্ষ সৈন্য নিযুক্ত করেন এবং মোহাম্মদ বিন কাসিমকে ৬,০০০ ঘোড়সওয়ার ও ৩,০০০ উটের ব্যবস্থা করেন। মোহাম্মদ বিন কাসেম এই বিরাট সৈন্যবাহিনী সমভিব্যাহারে শিরাজ ও কামরানের পথ ধরে দেবলের পথে অগ্রসর হন। পথে তিনি আরও সৈন্য সংগ্রহ কোরে নিজের শক্তি বৃদ্ধি করেন। অবশেষে ৭১১ খ্রিস্টাব্দে মোহাম্মদ বিন কাসেম দেবলে উপস্থিত হোলেন। এই বিরাট সৈন্যবাহিনী পাঠিয়েও হাজ্জাজ-বিন ইউসুফ সন্তুষ্ট ছিলেন না, তিনি সমুদ্রপথে দুর্গ অবরোধ করার যন্ত্রপাতিও পাঠালেন। দুর্গ অবরোধের জন্য বিরাট আকারের মনজানিক (বড় বড় পাথর নিক্ষেপকারী যন্ত্রবিশেষ) পাঠালেন। শখ কোরে এই যন্ত্রের নাম দেওয়া হোয়েছিল আল আদ বা কনে এবং এই যন্ত্র চালাতে ৫০০ জন লোকের দরকার হতো। দেবলে এসেও মোহাম্মদ বিন কাসিম এমন অনেক দেশি সৈন্য সংগহ করেন যারা দেশের শাসনকর্তার প্রতি বিরূপ ভাবাপন্ন ছিল। এই সব সৈন্য পরে সিন্ধুবিজয়ে বিশেষ সাহায্য করে। দেবলের দুর্গ পাথরের দ্বারা তৈরি ছিল এবং অবরুদ্ধ সৈন্যরা আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হোয়ে প্রাণপণে যুদ্ধ করে। মোহাম্মদ বিন কাসিমও দুর্গ দখলের জন্য সর্বপ্রকার প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন। তিনি চারিদেকে পরিখা খনন করে সৈন্য মোতায়েন করলেন। প্রথমেই মোসলেমরা দেবলের মন্দিরের চূড়াস্থ নিশান নামিয়ে ফেলেন, যাতে অবরুদ্ধ হিন্দু সৈন্যদের মনোবল ভেঙে পড়ে। ফলে ঘোরতর যুদ্ধ হয় এবং যুদ্ধে মোসলেমরা বিপুলভাবে জয়ী হয়। অতঃপর মোহাম্মদ বিন কাসিম মুসলমানদের থাকার জন্য স্থান নির্বাচন কোরে একখানি মসজিদ তৈয়ার করেন এবং দুর্গের শাসন পরিচালনার জন্য এক হাজার সৈন্য মোতায়েন করেন। এদিকে দেবলের পতনে সিন্ধরাজ দাহির বিশেষ বিচলিত হলেন না। তিনি মনে করলেন সামান্য বাণিজ্য-বন্দর পতনের ফলে তার বিশাল রাজত্বের বিশেষ ক্ষতি হবে না। তিনি সুযাগমতো মোসলেমদের সঙ্গে শক্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হতে থাকলেন। অন্যদিকে মোহাম্মদ বিন কাসেম নীরুন যাত্রা করলেন। নীরুনের অধিবাসীরা মোসলেমদের নিকট সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ কোরল। অতঃপর মোহাম্মদ বিন কাসেম প্রায় বিনা কষ্টে সেহওয়ান জয় করলেন।
মোসলেম সেনাপতির এইরূপ অপ্রত্যাশিত বারংবার বিজয়ে সিন্ধুরাজ দাহির বিচলিত হয়ে পড়লেন এবং রাওয়ার নামক স্থানে গিয়ে নিজ সেনাবাহিনী সাজিয়ে আক্রমণকারীদের মোকাবেলা করতে কৃতসঙ্কল্প হলেন। সিন্ধুরাজ এখানে তার সমস্ত শক্তি নিয়োগ করলেন এবং বিপুল হস্তীবাহিনীসহ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন। মুসলমান বাহিনীও প্রস্তুত হলো, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কয়েক মাসের জন্য যুদ্ধ বন্ধ ছিল, কারণ ইতোমধ্যে অধিকাংশ মোসলেম সৈন্য স্ক্যার্ভি রোগে আক্রান্ত হয় এবং তাদের ঘোড়াগুলোও পীড়িত হয়ে পড়ে। কিন্তু হাজ্জাজ বিন ইউসুফের অত্যন্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থার ফলে মোসলেম সৈন্যরা প্রত্যাশিত অপ্রত্যাশিত সকল প্রকার দুর্ভোগের হাত থেকে রক্ষা পায়। হাজ্জাজ শুধু সৈন্য সাহায্য পাঠিয়েই ক্ষান্ত ছিলেন না, তিনি এমন জিনিসও পাঠালেন যার ব্যবহারের ফলে স্ক্যার্ভি রোগ প্রশমিত হয়। তিনি অতি অধিক পরিমাণে জমানো সিরকা পাঠান; সিরকা পাঠানোর পদ্ধতিও ছিল অভিনব। জমানো সিরকায় তুলা ভিজিয়ে শুকিয়ে ফেলা হয়। বার বার একই প্রক্রিয়ার সাহায্যে তুলায় এত অধিক পরিমাণে সিরকা মাখানো হয় যাতে ঐ তুলায় আর বেশি সিরকা না ধরে। পরে ঐ শুকনা তুলা সিন্ধুদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সিরকা মিশ্রিত তুলা পানিতে ডুবিয়ে সিরকা বের করে নেওয়া হতো। প্রচুর পরিমাণ সিরকা পাওয়ায় মোসলেমরা স্ক্যার্ভি রোগের সাথে পাল্লা দিতে সমর্থ হয়। এইবার মোহাম্মদ বিন কাসিম রাওয়ার আক্রমণ করার সংকল্প করেন এবং নদী পার হবার জন্য নৌকার পুল তৈরি করার আদেশ দেন। সম্পূর্ণ পস্তুতির পর ৭১২ সালের জুন মাসে তারা নদী অতিক্রম করে দাহিরের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দুই দিকেই সৈন্যরা বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে, কিন্তু আরব সেনাপতির বিশেষ পারদর্শিতা এবং আরব ধনুর্বিদদের শ্রেষ্ঠত্বের কাছে দাহিরের সৈন্যরা পরাজয় বরণ কোরতে বাধ্য হয়। দাহির যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুবরণ করে; নেতার মৃত্যুতে হিন্দু সৈন্যদের মনোবল ভেঙ্গে পড়ে এবং তারা যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যাগ করে। ফলে মোসলেম বাহিনী চূড়ান্তভাবে সিন্ধু জয় কোরে নেয়। এরপর মোহাম্মদ বিন কাসিম প্রায় বিনা যুেিদ্ধ ব্রাহ্মণাবাদ অধিকার করেন।
অতঃপর মোহাম্মদ বিন কাসিম দাহিরের রাজধানী আরড় অভিমুখে যাত্রা করেন। সেখানে দাহিরের এক ছেলে দুর্গ রক্ষায় নিযুক্ত ছিল। কিছুদিন অবরুদ্ধ থাকার পর আরড় দুর্গ আত্মসমর্পণ করে। পরে মোহাম্মদ বিন কাসিম মুলতান আক্রমণ করেন। মুলতান শহর অত্যন্ত সুরক্ষিত ছিল, সেখানে প্রবেশের পথ বের করা মোসলেমদের জন্য প্রায় অসম্ভব ছিল। কিন্তু শত্র“পক্ষের একজন দলত্যাগী স্বতপ্রবৃত্ত হোয়ে মোসলেমদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসে। একটি ছোট নদী হতে মুলতান শহরে পানি সরবরাহ করা হতো। উক্ত দলত্যাগী লোকটির সহায়তায় মোসলেমরা নদীর সন্ধান পান এবং তারা ঐ নদীর গতি পরিবর্তন করে দেন। পানির অভাবে মুলতান বেশিদিন টিকতে পারল না, তারা আরবদের নিকট আত্মসমর্পণ করে। এভাবেই মোহাম্মদ বিন কাসিম অতি স্বল্প সময়ে সিন্ধুদেশে স্বীয় প্রাধান্য বিস্তার করতে সক্ষম হন।
সিন্ধুদেশে আরব শাসনব্যবস্থা: সিন্ধু অধিকারের পর মোহাম্মদ বিন কাসেম সেখানে অতি চমৎকার এবং আশাতীত শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর (রা একটি নিয়ম প্রণয়ন করেছিলেন যে, বিজিত দেশে আরবরা কোনো সম্পত্তি অধিকার করতে পারবে না। মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধুদেশে এই নিয়মটি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন। আরবরা শুধু সামরিক বিভাগেই নিযুক্ত ছিলেন, বেসামরিক বিভাগসমূহ দেশিয় লোকেরাই সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করতো। তাদের মধ্যে শুধু অল্প পরিমাণ লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল; কিন্তু বলতে গেলে তাদের হাতেই দেশের শাসনভার বজায় ছিল। মোহাম্মদ বিন কাসেম অধিকৃত অঞ্চলের অধিবাসীগণকে আহলে কিতাব হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন এবং তাদেরকে জিম্মির মর্যাদা দান করেছিলেন (ত্র্যান এ্যাডভান্সড্ হিস্টরি অব ইন্ডিয়া, পৃঃ ১৮৩২)। তাছাড়া তিনি হিন্দুদের উপাসনালয়ের নিরাপত্তাসহ অন্যান্য দায়-দায়িত্বও নেন যা তৎকালীন সময়ে বিজিত অধিবাসীদের কল্পনারও বাইরে ছিল (এস, এম, ইকরামঃ হিস্টরি অব মোসলেম সিভিলাইজেশন ইন ইন্ডিয়া এ্যান্ড পাকিস্তান, পৃঃ ৯)। মোহাম্মদ বিন কাসেম ব্রাহ্মণদেরকেও যথাযোগ্য গুরুত্ব দিয়েছেন। হিন্দু সমাজে অনেক পূর্ব থেকেই ব্রাহ্মণরা বিশেষ বিশেষ সুযোগ সুবিধা ভোগ করে আসতো। তিনিও ব্রাহ্মণদের ঐসকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করার ব্যবস্থা করে দেন। এমনকি যেসব ব্রাহ্মণ পালিয়ে গিয়েছিল তাদেরকে ধরে এনে স্ব স্ব পদে বহাল করেন। দাহিরের সময় তারা যে শতকরা ৩ ভাগ রাজস্ব ভোগ করতে পারতো, মোহাম্মদ বিন কাসেমও তাদের সেই সুবিধা ভোগ করার অধিকার দেন (এলিয়ট ও ডউসনঃ হিস্টরি অব ইন্ডিয়া এ্যাজ বাই ইট্স অউন হিস্টরিয়ানস, ১ম খণ্ড, পৃঃ ১৮৩)। তিনি স্থানীয় লোকদের মধ্য থেকে কর আদায় করার দায়িত্ব দিতেন স্থানীয় লোকদেরকেই। এর ফলে সাধারণ মানুষ অনেকটা বিদেশি আরবদের সম্পর্কে আশ্বস্ত হতেন এবং তাদের সম্পর্কে ভয় দূরীভূত হতো। এভাবেই এক সময় মোহাম্মদ বিন কাসেমের শাসনব্যবস্থা স্থানীয় জনসাধারণের কাছে জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য ছিল। তিনি রাজা দাহিরের চেয়ে অনেক বেশি সাধারণ মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন। এই ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ পাওয়া যায় ইতিহাসে, যখন মোহাম্মদ বিন কাসেমের মৃত্যুর পর সিন্ধুবাসীরা তাঁর জন্য অশ্র“ বিসর্জন করেছিল (এলিয়ট ও ডউসন: হিস্টরি অব ইন্ডিয়া এ্যাজ বাই ইট্স অউন হিস্টরিয়ানস, ১ম খণ্ড, পৃঃ ১২৪)।
মোহাম্মদ বিন কাসেমের নির্মম মৃত্যু: মোহাম্মদ বিন কাসিমের মৃত্যু সম্পর্কে বিতর্কমূলক তথ্যাদি পাওয়া যায়। কথিত আছে যে, দাহিরের মৃত্যুর পর তার দুই মেয়ে খলিফার নিকট অভিযোগ করে যে, বন্দী করার পর মোহাম্মদ বিন কাসেম তাদের শ্লীলতাহানি করেন। এতে খলিফা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে আদেশ দেন যে, মোহাম্মদ বিন কাসেমকে যেন কাঁচা চামড়ার থলিতে ভরে খলিফার নিকট পাঠানো হয়। নির্দেশ শুনে মোহাম্মদ বিন কাসেম খলিফার আদেশ শিরোধার্য করে নিজেই কাঁচা চামড়ার থলিতে ঢুকে পড়েন। বলা বাহুল্য, ২/১ দিনের মধ্যেই তিনি মারা যান। চামড়ার থলি খলিফার নিকট পৌছিলে মোহাম্মদ বিন কাসেমের মৃতদেহ বের হয়ে পড়ে। দাহিরের মেয়েদেরও ঘটনাস্থলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পিতৃহন্তার অবস্থা দেখে তারা অত্যন্ত সুখী হয়, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই বলে যে, তারা আগে মোহাম্মদ বিন কাসেমের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করেছিল সবই মিথ্যা (মীর মাসুম- এর চাচনামার অনুসরণে ইশ্বরীপ্রসাদঃ এ শর্ট হিস্টরি অব দি মোসলেম রুল ইন ইন্ডিয়া, পৃঃ ৩৫-৩৬)।
অনেকে মনে করেন, উপরিউক্ত গল্পটি নিছক বানানো। সিন্ধুবিজয়ী মোহাম্মদ বিন কাসেমের শেষ জীবন অত্যন্ত বেদনাদায়ক সন্দেহ নেই, কিন্তু তাদের মতে এর কারণ দামেস্কে উমাইয়া খলিফার পরিবর্তন এবং হাজ্জাজ বিন ইউসুফের বংশের প্রতি নতুন খলিফার নিষ্ঠুর নীতির ফল। খলিফা ওয়ালিদের সময় হাজ্জাজের প্রবল প্রতিপত্তি ছিল এবং ঐ সময়ে মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধুদেশ বিজয়ে বের হন। কিন্তু পরবর্তী খলিফা সোলামান হাজ্জাজের ঘোরতর শত্র“ ছিলেন। ইতোমধ্যে হাজ্জাজের মৃত্যু হয়, কিন্তু খলিফার রোষ পড়ে হাজ্জাজের বংশের উপর। এরই আবশ্যম্ভাবী পরিণতি হয় মোহাম্মদ বিন কাসেমের অপসারণ। খলিফা নব-বিজিত সিন্ধুদেশে নতুন শাসনকর্তা নিযুক্ত করে পাঠালেন। মোহাম্মদ বিন কাসেম স্বদেশে ফিরে গেলে তাকে এমন এক পদস্থ কর্মচারীর হাতে সোপর্দ করা হয়, যিনি মোহাম্মদ বিন কাসেমকে ইরাকের কোন এক কারাগারে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেন।
তবে ঘটনা যাই হোক সত্য এই যে, মোহাম্মদ বিন কাসেম যখন উক্ত নির্দেশ শুনলেন তখন তিনি জানতেন যে, খলিফার নির্দেশটি ভুল ছিল অথবা খলিফা তাঁর প্রতি যুলুম কোরতে চাচ্ছেন। কিন্তু এই যুক্তিতে খলিফার হুকুমের আনুগত্য করা থেকে বিরত হন নি। কারণ, খলিফা বা এমামের নির্দেশ পালন না কোরে কেউ নিজেকে মোসলেম দাবি কোরতে পারে না, এটা মোসলেম জাতির চেইন অব কমান্ড। এই চেইন অব কমান্ড ভেঙে গেলে জাতির যে করুণ পরিণতি হবে তা তিনি ভালোভাবেই উপলব্ধি কোরেছিলেন। বস্তুত তিনি ইচ্ছা কোরলেই খলিফার নির্দেশ অমান্য কোরতে পারতেন। তাঁর অধীনস্ত সৈন্যবাহিনী তাঁর পক্ষ হোয়ে খলিফার বিরুদ্ধে যুদ্ধ কোরতেও দ্বিধা কোরত না। কিন্তু এতে জাতির যে অসামান্য ক্ষতি হোত তা বিবেচনা কোরেই তিনি স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে বরণ কোরে নেন।
বিষয়: বিবিধ
৩৮১১ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মুহাম্মদ বি কাসিম সম্পর্কে রাজা দাহিরের কন্যা সংক্রান্ত গল্পটি সম্পুর্ন বানোয়াট। এটি একই সঙ্গে খলিফা ও মুহাম্মদ বিন কাসিম উভয়কে অবমাননার উদ্দেশ্যে বানান হয়েছে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন