আইনের শাসনের অভাবেই যে ‘খুনি’দের জন্ম!
লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ আসাদ আলী ২৫ মার্চ, ২০১৪, ০২:৫৫:৫৫ দুপুর
সামাজিক মূল্যবোধ আর অবিচার কোন পর্যায়ে চলে গেছে তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে আরো একবার দেখিয়ে দিলো দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত একটি খবর। গত রবিবার প্রকাশিত ঐ খবরটির শিরোনাম ছিল, ‘বিচার না পেয়ে ঘাতক হয়েছি’- এটি নিজ মেয়ের উত্যক্তকারীকে খুনের দায়ে আটক একজন মধ্যবয়সী মায়ের বক্তব্য। পুলিশ ও সাংবাদিকদের সামনে আটককৃত ‘খুনি’ ঐ মা বলেন, ‘দানবের রোষানল থেকে কিশোরী কন্যাকে রক্ষা করতে পুলিশ ও প্রভাবশালীদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি। সবাই দেখছি বলে আশ্বাস দিলেও কেউই সাহায্যের হাত বাড়ায়নি। শেষটায় বাধ্য হয়ে নিজেই সব বিচারের ভার কাঁধে তুলে নিয়ে ঘাতক হতে বাধ্য হয়েছি। কারণ মা হয়ে মেয়েকে রক্ষা করতো পারব না- এ যন্ত্রণা আমাকে তাড়িত করছিল। জানি, বিচারে আমার ফাঁসি হবে। তবে এ নিয়ে আমার কোন অনুশোচনা নেই। দুঃখ শুধু একটাই, দুর্বলের পাশে কেউ থাকে না। যার ক্ষমতা ও দাপট বেশি তাকেই সবাই সমীহ করে। সে যত বড় শয়তানই হোক না কেন।’ আইনের ভাষায় তাকে ‘খুনি’ বলা হলেও সত্যিই কি তিনি ‘খুনি’ না ‘প্রতিবাদী’ তা নিয়ে কথা হচ্ছে দেশের অনলাইন যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক এবং ব্লগগুলোতে। বেশিরভাগ মানুষই ঐ ‘খুনি’ মাকে স্যালুট জানিয়ে অভিমত জানিয়ে বলছেন, প্রয়োজনে তারাও এ রকম ‘খুনি’ হতে চান।
খবরে আরো প্রকাশ, ‘যশোর সদর উপজেলার দেয়ারা ইউনিয়নের ভেকুটিয়া গ্রামের কৃষাণী খাদিজা বেগম (৪৫)। গত ১২ মার্চ নিজ বাড়িতে তিনি হাসুয়া (বড় দা) দিয়ে হত্যা করেন উত্ত্যক্তকারী একই এলাকার বাসিন্দা পাঁচ সন্তানের পিতা মফিজুর রহমান মফিকে (৪৪)। এ ঘটনায় যশোর কোতয়ালী থানায় মামলা হয়েছে। পুলিশ খাদিজাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে।
ঘটনাটি হৃদয়ঙ্গম করার জন্য পাঠকের সামনে ইত্তেফাকে প্রকাশিত খবর থেকে কিছু অংশ হুবহু এখানে তুলে ধরা হলো। ‘পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে খাদিজা বেগম বলেন, প্রচুর বিষয় বৈভব না থাকলেও সংসারে সুখ ছিল অনেক। কিন্তু মানুষরূপী দানব মফি আমার সেই সুখের সংসার তছনছ করে দিয়েছে। তার হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য পুলিশ-দারোগা, মেম্বার, পার্টির লোকের কাছে গিয়েছি। কেউ আমার সাহায্যে এগিয়ে আসেনি।
ঘটনা সম্পর্কে খাদিজা বেগম বলেন, একই ইউনিয়নের তেতুলবাড়িয়া গ্রামের মোসলেম শেখের ছেলে মফিজুর রহমান মফি। সে আমার বোনের ননদের মেয়েকে প্রথম বিয়ে করে। ঐ ঘরে তার চার মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে। বড় মেয়ে কলেজে পড়ে। তারপরও সে কোটচাঁদপুরে গিয়ে আমার বোনের মেয়ে রুনাকে উত্ত্যক্ত করত। সেখান থেকে রুনার বাবা-মা রুনাকে আমার কাছে পাঠিয়ে দেয়। আমার বাড়িতে এসেও মফি তাকে বিরক্ত করত। একটা সময় রুনা বাধ্য হয়ে মফিকে বিয়ে করে।
তিনি আরও বলেন, এখানেই শেষ নয়। এরপর মফি আমার অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া মেয়েকে উত্ত্যক্ত করা শুরু করে। আমি তাকে নানাভাবে বুঝাই যে, ও তোমার মেয়ের চেয়েও ছোট। ওকে বিরক্ত করো না। কিন্তু সে আমার কথা না শুনে সাঙ্গ-পাঙ্গদের সঙ্গে নিয়ে মাঝেমধ্যেই বাড়িতে এসে শাসাত এবং বিয়ের জন্য চাপ দিত। এ নিয়ে এলাকার লোকজনও নানা বাজে মন্তব্য করতে শুরু করে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে মফির বিরুদ্ধে থানায় জিডি করেছি, জানিয়েছি এলাকার মেম্বারকে, ধর্না দিয়েছি রাজনৈতিক নেতাদের কাছে। কিন্তু মফির বিরুদ্ধে কেউ ব্যবস্থা নেয়নি। উল্টা মফির উৎপাত আরও বেড়ে যায়। এ অবস্থায় মাসখানেক আগে মেয়েকে আমার মেজ ছেলের ( রাজমিস্ত্রী) কাছে ঢাকায় পাঠিয়ে দেই।
খাদিজা বেগম বলেন, ঘটনার দিন মাগরিবের নামাজের পর কোরআন শরীফ পড়ছিলাম। এ সময় মফি ঘরে ঢুকে আমার মেয়ে কোথায় তা জানতে চায় এবং এখনই মেয়েকে তার হাতে তুলে দিতে বলে। এ সময় কৌশল করে রান্নাঘর থেকে বেটে রাখা মরিচ এনে মফির চোখে লাগিয়ে দেই। এরপর হাসুয়া (বড় দা) দিয়ে কুপিয়ে তাকে হত্যা করি।’
অবাক করা ব্যাপার এই যে, আইনের ভাষায় আইনকে নিজের হাতে তুলে নেওয়ার অপরাধে অপরাধী হলেও ঠিকই একদল মানুষ এই ‘খুনি’কে সমর্থন করছেন এবং এই ‘খুনি’ মায়ের মত পরিস্থিতিতে পতিত হলে নিজেকে খুনিতে পরিণত করার মতামত প্রকাশে দ্বিধাবোধ করছেন না। তাই প্রশ্ন জাগে, মানুষের বিবেকবোধ যদি কোন কাজকে অপরাধ বলে না মনে করে সেটা কীভাবে বে-আইনী হতে পারে? তাহলে আরো প্রশ্ন জাগেনা যে, প্রচলিত আইন আর মানুষের বিবেকবোধের মধ্যে বিস্তর দূরত্ব রয়েছে?
প্রায়শঃই দেখা যায় বিক্ষুব্ধ মানুষ চোর-ডাকাত ধরে সাপের মত পিটিয়ে মেরে ফেলছে। একটা দুইটা নয়, বিক্ষুব্ধ মানুষের হাতে একসাথে একাধিক মানুষ হত্যার ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। আইনের শাসনকে উপেক্ষা করে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার মত এই মানসিকতা সৃষ্টি কেন হলো এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গেলে আমাদেরকে খুব বেশি খাটা-খাটুনি করার দরকার নেই। এক কথায়ই বলে দেওয়া যায়- আইনের শাসনের ব্যর্থতা থেকেই এই অবস্থার জন্ম।
মানুষ মূলত চলমান সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং সভ্যতার ক্রমবর্ধমান অবনতি ও মূল্যবোধের সংকটে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। এ অবস্থা বা ব্যবস্থায় সমাজের খারাপ মানুষগুলো ক্ষমতা ও আধিপত্যের জোরে অন্যায় করেও আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে। আইনের শাসন কিছুতেই তাদের লাগাম টেনে ধরতে পারছে না। কেননা সিস্টেমের মারপ্যাঁচে অপরাধীরাই সমাজের ক্ষমতাধর আসনগুলো দখল করে নিয়েছে। নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত মানুষগুলো সমাজের দ্বারে দ্বারে বিচার চেয়েও বিচার পাচ্ছে না। সুতরাং মরিয়া হয়ে আইনকে হাতে তুলে নেওয়া ছাড়া মানুষের আর কীইবা করার আছে? আইন হয়তো তাকে খুনি বলবে, তার নিজস্ব ধারা অনুযায়ী শাস্তি প্রদানও করবে। মানুষ তারও পরোয়া করছে না। কিন্তু আইনের যদি মানুষের মত বোধ থাকত তাহলে হয়তো আইন তাকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারত না। উপরে আলোচিত ঐ খবরটি যারা পড়েছেন তাদের অধিকাংশই এমনই মত পোষণ করছেন।
পরিহাসের বিষয় এই যে, আজকে সমাজে আইনের ভূমিকাটা দাঁড়িয়েছে তিন ঘণ্টার বাংলা সিনেমার মত। তিন ঘণ্টায় বহু মানুষ খুনোখুনি হয়ে গেল, ভিলেন ও তার সাঙ্গ-পাঙ্গরা মানুষ মেরে কেটে সাফ করে দিল। কিন্তু যেই এসে নায়ক আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে অন্যায় নির্মূল করার কাজে নামল তখনি আইনের লোক এসে হাজির। আমরা দীর্ঘদিন থেকে এমনটা দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আইনের শাসন যদি প্রতিষ্ঠিত থাকত তাহলে অপরাধীরা কিছুতেই অপরাধ করার সুযোগ পেত না। স্বাভাবিকভাবেই নিরুপায় মানুষকে নিজেদের হাতে আইন তুলে নিতে হতো না। তাই একথা বলাই যায় যে, আইন হাতে তুলে নেওয়ার পেছনে আইনের শাসনের ব্যর্থতাই দায়ী। সুতরাং ঐ মায়ের মত ‘খুনি’দেরকে শাস্তি না দিয়ে আগে একটি আইনের শাসনের উপর নির্ভর করা সমাজ তৈরি করা হোক। নতুবা এ সমাজ প্রতিনিয়ত আইন হাতে তুলে নেওয়া, আইন লঙ্ঘনকারী ‘খুনি’দের জন্ম দিয়েই যাবে।
বিষয়: বিবিধ
৯৭১ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন