বিলুপ্তির পথে মায়ের ভাষা (কাউকে আঘাত করা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়)
লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ আসাদ আলী ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪, ০৬:৪৯:০৬ সন্ধ্যা
গত কয়েকদিন যাবৎ মহান ভাষা দিবস একুশে ফেব্র“য়ারি উপলক্ষে আলোচনা, টকশোতে (Talk Show),বক্তৃতায়, সেমিনারে, পত্র-পত্রিকায় যেভাবে দেখা যাচ্ছে সবাই বাংলা ভাষাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসেন, সবাই তাদের সেই ভালোবাসা নানা ভঙ্গিমায় প্রকাশ কোরছেন। সবাই মনে হচ্ছে ভাষার জন্য পাগল, উৎসর্গিতপ্রাণ। বর্ণমালা খচিত পোশাক পরে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে আবেগতাড়িত বক্তব্য দিচ্ছেন বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যক ও কবিরা। তারা বাংলা ভাষার সমৃদ্ধ শব্দ ভাণ্ডার, সমৃদ্ধ বর্ণমালা, অপ্রতিদ্বন্দ্বী উচ্চারণরীতি, ফনেটিক্স () ইত্যাদির চুলচেরা বিশ্লেষণ কোরে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ কোরে দেন যে, বাংলা ভাষা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষা। এই প্রসঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কিছু অনুভূতি আজ পাঠকদের সঙ্গে ভাগাভাগি কোরি। আমি মনে কোরি বেশ কয়েকটি দিক থেকে বিচার কোরলে বাংলা ভাষার সঙ্গে পৃথিবীর অন্য কোন ভাষার তুলনা চলে না। তবে ভাবের গভীরতা ও বি¯তৃতির দিক থেকে আরবী ভাষা অদ্বিতীয়। কোর’আনে একটি কথা আছে, আল্লাহ বলেন- তোমরা এমন কথা কেন বলো যা তোমরা নিজেরা করো না। আল্লাহর কাছে রাগ হয় (সুরা সফ ২-৩)। আল্লাহর রসুল বলেন- যে কথায় বলে এক, আর কাজে করে আরেক সে মোনাফেক। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তো আমরা মোনাফেক হোয়ে গেছি অনেক আগেই, ভাষার ব্যাপারেও আমরা যা বোলছি তা কোরি না। আজকে যারা বাংলা ভাষাকে নিয়ে গদগদ করেন তাদের প্রতি আমি প্রশ্ন রাখতে চাই, ১৯৫২ সালের আগে এ দেশের যতজন মানুষ ইংরেজিতে কথা বোলত, যতটুকু ইংরেজি বোলত, ইংরেজি গান শুনতো, হিন্দীতে কথা বোলত, হিন্দী গান শুনতো, আজকে ষাট বছর পরে তার অনুপাত বেড়েছে না কমেছে? বাড়লে কতটুকু বেড়েছে? তখন দেশে ক’টি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল-কলেজ ছিলো, আর এখন কয়টা? তখন সারা বাংলাদেশে দু’চারটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ছিলো কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে। অনেকে হয়তো আমাকে কাঠমোল্লাদের মতো ইংরেজী বিদ্বেষী ভাবতে পারেন, কিন্তু সেটা মনে কোরলে কঠিন ভুল হবে। আমি ইংরেজি ভাষার একজন ভক্তজন, ইংরেজি আমার খুব প্রিয় একটি ভাষা। তবে আমি ইংরেজ এবং ইংরেজির অন্ধ অনুরাগী নই। ইংরেজির প্রতি আমাদের এই জাতির এত যে ভালোবাসা, এত শ্রদ্ধা অথচ মুখে বলি আ-মরি বাংলা ভাষা। আমাদের কোর্ট-কাছারিতে, অফিস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সর্বত্র চলে ইংরেজি প্রীতি, ইংরেজির জয়োগান। আমাদের ছেলেমেয়েদেরকে পড়াই ইংরেজি মিডিয়াম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, তারা যখন ইংরেজি রাইম বলে, ইংরেজি কথা বলে তখন সেটা অন্যদের কাছে বোলতে খুব গর্ব বোধ করি। আমরা প্রতিটি বাক্যে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার কোরি, যে শব্দগুলির যথোপযুক্ত প্রতিশব্দ বাংলাতে আছে সেগুলিও ইংরেজিতে বোলতে আমরা সাচ্ছন্দ বোধ কোরি। এই জগাখিঁচুড়ি ভাষাটিকে জনপ্রিয় কোরে তোলার জন্য বেশ কিছু রেডিও স্টেশনও কোমর বেঁধে নেমেছে যারা পারতপক্ষে বাংলা শব্দ বোলতে চান না, যতটুকুও বা বলেন সেটা ইংরেজি উচ্চারণ নকল কোরে বোলতে চেষ্টা করেন। হঠাৎ কোরে কেউ বুঝতেও পারবেন না যে তারা বাংলা বোলছেন না ইংরেজি বোলছেন। যারা এভাবে নিজেদের মাতৃভাষাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন তারা কবি আব্দুল হাকিমের সেই দু’টি লাইন আবারও পড়ে নিতে পারেন- যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী, সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি। দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়। নিজ দেশ তেয়াগী কেন বিদেশ ন যায়॥ আমাদের এত ইংরেজি প্রীতি কেন? কারণ খুব সোজা, ইংরেজরা আজকের পৃথিবীর প্রভু। প্রভুদের ভাষা না জানলে ভালো কোরে গোলামি করা যায় না, তাই আমাদের ইংরেজি দরকার। অথচ এটা বাস্তব যে, ইংরেজি ভাষা অনেক দিক থেকেই অন্যান্য অনেক ভাষা থেকে দুর্বল এবং কয়েক শ বছর আগেও এটি পৃথিবীতে উল্লেখযোগ্য কোন ভাষা ছিলো না। ভাষাবিদরা ইংরেজিকে বোলে থাকে . কারণ এই ভাষার প্রায় প্রতিটি শব্দই অন্যান্য ভাষা থেকে ধার করা। মাইগ্রেশন পিরিয়ডে অর্থাৎ ৪০০-৭০০ খ্রিস্টাব্দ এই সময়টিতে জার্মানদের দ্বারা ইংল্যান্ড বারবার আক্রান্ত হয় এবং সেখানে জার্মানদের বসতি গড়ে ওঠে। তাদের মাধ্যমে পশ্চিম জার্মানির কিছু আঞ্চলিক ভাষা প্রাচীন ইংরেজি ভাষার () রূপ পরিগ্রহ করে। পরিবর্তীতে রেনেসাঁর সময় বিশেষ কোরে জার্মান, ডাচ, ফ্রেঞ্চ, ল্যাটিন, প্রাচীন গ্রীক ভাষা থেকে প্রচুর পরিমাণে শব্দ এসে ইংরেজি ভাষাকে প্রভাবিত কোরেছে, এরপর থেকেই আধুনিক ইংরেজি ভাষার আবির্ভাব ঘটে পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে। সুতরাং ইংরেজি ভাষার ইতিহাস খুঁজতে গেলে টেনেটুনে দেড় হাজার বছরের পেছনে যাওয়া যায় না। অথচ বাংলা ভাষার উদ্ভব যে সংস্কৃতি থেকে সেই ভাষার ইতিহাস ও ঐতিহ্য বলা যায় প্রাগৈতিহাসিক আমল থেকে। সর্বপ্রথম ধর্মগ্রন্থ বেদও আল্লাহ নাজেল কোরেছেন সংস্কৃত ভাষায়। অর্থাৎ সংস্কৃতি ভাষার উদ্ভব নিশ্চয়ই আরও বহু আগে। বাংলা ভাষার বর্ণমালা ইংরেজি ভাষার দ্বিগুণ। আর ইংরেজিতে যে ছাব্বিশটি বর্ণ রোয়েছে সেগুলির সবই নেওয়া হোয়েছে ছাব্বিশ বর্ণবিশিষ্ট ফ্রেঞ্চ বর্ণমালার অনুকরণে। বাংলা ভাষার উচ্চারণরীতি এমন সমৃদ্ধ যে এমন কোন ভাষা নেই যা বাঙালিরা সহজেই আয়ত্ব কোরতে পারে না। বাঙালিরা যে কোন দেশে গিয়ে কিছুদিন থাকলেই তাদের ভাষা শিখে আসে, ইংরেজি, জার্মান, চায়ানিজ, কোরিয়ান, জাপানিজ, ডাচ কোন ভাষাই তাদের শিখতে কষ্ট হয় না, এটা বাংলা বর্ণমালা ও উচ্চারণরীতির শ্রেষ্ঠত্বের অন্যতম দিক। পক্ষান্তরে তিনশ বছর এদেশে বসবাস কোরে ব্রিটিশরা বাংলাকে বানিয়েছে বেঙ্গালি, ঢাকাকে বানিয়েছে ডেককা, হিন্দুস্তানকে বানিয়েছে ইন্ডিয়া, কোলকাতাকে বানিয়েছে খ্যালকাটা ইত্যাদি। আজও ইউরোপে ইংরেজির তুলনায় ফ্রেঞ্চ, ল্যাটিন অনেক অভিজাত ভাষা হিসাবে স্বীকৃত। তবে যে দেশগুলি ব্রিটিশদের উপনিবেশ হোয়েছিল সেই দেশগুলির কিছু মানুষ আজও ইংরেজি ভাষা শুনলেই প্রভুভক্তিতে আপ্লুত হোয়ে যায়। অনেক দেশই তাদের মাতৃভাষাকে ইংরেজি ভাষার আগ্রাসন থেকে রক্ষা করার জন্য নিজেদের দেশে ইংরেজি নিষিদ্ধ কোরে রেখেছে, অনেক দেশে একে দাপ্তরিক ভাষার স্বীকৃতি দেয় নি, বহু দেশের স্কুল কলেজে ইংরেজি শেখানোও হয় না। ইংরেজরা যখন আল্লাহর দেওয়া শাস্তিসরূপ মোসলেম নামধারী জাতিটির উপর চেপে বোসল, তখন তাদের ভাষাটাও আমাদের মাঝে আসলো। আমরা প্রভুর ভাষা হিসেবে ইংরেজি শিখতে বাধ্য হোলাম, নয়তো আমাদের পেটে ভাত জুটতো না, সেনাবাহিনীতে চাকরি জুটতো না, রেলস্টেশনে চাকরি জুটতো না, অফিসের পিয়ন কেরাণীর চাকরিও আমরা কোরতে পারবো না। আজ আমরা ভৌগোলিক ভাবে স্বাধীন, কিন্তু রাজনৈতিকভাবে পরাধীন। আজও আমরা পাশ্চাত্যের গোলামই রোয়ে গেছি, তাদেরকেই প্রভু বোলে মেনে চোলছি। একুশে ফেব্র“য়ারি দিনটিও ইংরেজি পঞ্জিকা মোতাবেক আমরা হিসাব কোরি, ঐ দিন বাংলা সন কত ছিলো, কত তারিখ ছিলো সেই তথ্যটুকুও আমাদের স্কুল কলেজে শেখানো হয় না। আজকে ইউরোপ-আমেরিকায় যেতে পারলেই আমরা নিজেদেরকে ধন্য মনে কোরি। সেখানে আমরা যাই অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য। বিশ্বময় প্রভুত্ব করার কারণে আমাদের নিজেদের দেশের, নিজেদের জাতির ইতিহাসও আমাদেরকে ইংরেজি ভাষায় পড়তে হয়, জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতিটি অঙ্গণে ইংরেজি না জানা থাকে প্রবেশাধিকারই থাকে না। এভাবেই দুর্বল ইংরেজি ভাষা আজকে দুনিয়াতে শক্তিশালী হোয়ে গেছে। ইংরেজি শেখানোর জন্য হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ প্রতিষ্ঠান খোলা হোয়েছে। কোটি কোটি লোক ইংরেজি ভাষায় কথা বলে, কোটি কোটি লোক ইংরেজি ভাষায় গান গায়। তাদের ভাষার সাম্রাজ্য আজ দুনিয়াজোড়া। এর পেছনের মূল কারণ হোল, জাতির শ্রেষ্ঠত্বের সাথে সাথে সেই জাতির ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ পায়। কাজেই শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে, আর মাতৃভাষা দিবস পালন কোরে বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। বেঁচে থাকলেও তা হবে দপ্তরবিহীন মন্ত্রীদের মতো। কার্যত ধীরে ধীরে এই ভাষা মানুষের মুখ থেকে হারিয়ে যাবে। পৃথিবীর বহু উপজাতির ভাষা ছিলো এক কালে দুনিয়ার সেরা ভাষা, কিন্তু এখন সেগুলো বিলুপ্তির পথে। এসলাম ছাড়া পৃথিবীর প্রতিটি ধর্মগ্রন্থের ভাষাই আজ মৃত ভাষায় পরিণত হোয়েছে, সেসব ভাষায় কেউ আর আজ কথা বলে না। ভাষার আশ্রয় হোচ্ছে মানুষের মুখ। মানুষের মুখে যে ভাষা প্রচলিত থাকে না, সে ভাষা কেতাবকে আশ্রয় কোরে বেশিদিন জীবনধারণ কোরতে পারে না। কাজেই মুখে এক কথা আর কাজে আরেকটা না কোরে আসুন ঐক্যবদ্ধ হোন, এক্যবদ্ধভাবে নিজের কৃষ্টি, নিজের সংস্কৃতি ধারণ করুন, নিজের একটি ভিত্তির উপর দাঁড়ান। পৃথিবীর বুকে নেতৃত্ব দেওয়ার চেষ্টা করুন, ইংরেজরা যেমন বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ার কারণে আজ প্রভুর আসনে আসীন, আপনারাও চারিদিকে ছড়িয়ে পড়–ন। নিজেরা ষোল কোটি বাঙালি নিজেদের মধ্যকার সব বিবাদ বিসম্বাদ মিটিয়ে ঐক্যবদ্ধ হোন, তাহোলে নিজেরা পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠত্ব পাবেন, আর তখন আপনাদের মাধ্যমেই বাংলাভাষার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে, ভাষারও অনেক উন্নতি হবে, সকল জাতির মানুষ বাংলা শিখবে, শিখতে বাধ্য হবে। আপনার মায়ের ভাষা আর বিলুপ্ত হবে না। নয়তো দিবস পালন করাই সার হবে।
বিষয়: বিবিধ
১৩১৪ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ইংরেজি মিডিয়াম এর আগ্রাসনের পিছনে আছে আমাদের হিনমন্যতা। গ্লোবালাইজেশন এর প্রভাব অতটা নয়। ইউরোপের দেশগুলি আমাদের চাইতে অনেক বেশি এগিয়ে কিন্তু তারা তাদের নিজস্বভাষাকে ইংরেজির জন্য ভুলে যাচ্ছেনা।
মন্তব্য করতে লগইন করুন