নবী-রসুলদের মো'জেজা এবং আল কোর'আন (পর্ব: ০১)
লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ আসাদ আলী ০২ জানুয়ারি, ২০১৪, ০৭:৫৭:৪১ সন্ধ্যা
আদম (আ থেকে মোহাম্মদ (দ পর্যন্ত মানবজাতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে যা পাওয়া যায় তা সংক্ষেপে এই যে- ‘আল্লাহ যুগে যুগে তাঁর নবী-রসুল পাঠিয়ে মানবজাতিকে সত্য দীন দিয়েছেন। যারা সেই দীন অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করেছে তারা তার ফলসরূপ ফাসাদ-সাফাকুদ্দিমাহীন সমাজে শান্তি-সমৃদ্ধিতে বসবাস করতে পেরেছে, আর যারা তাঁর পাঠানো দীনকে গ্রহণ করা থেকে বিরত থেকেছে তারা বিকৃত দীনের অনুসরণের ফলে অন্যায়-অবিচার এবং অশান্তিতে পতিত হয়েছে। এই অন্যায়-অশান্তিপূর্ণ সমাজে শান্তি স্থাপনের জন্য আল্লাহ আবার নতুন নবী পাঠিয়েছেন। নতুন নবীকে যাতে মানুষ স্রষ্টা প্রেরিত হিসেবে নিশ্চিত হোতে পারে সেই জন্য তাকে অলৌকিক কাজ করার ক্ষমতাও দিয়েছেন যা ইতিহাসে নবী-রসুলদের মো'জেজা হিসেবে পরিচিত। তবে শেষ রসুল পর্যন্ত যতগুলো মো'জেজা নবী-রসুলরা দেখিয়েছেন সে সবগুলোই ছিলো যার যার স্থান-কাল-পাত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। নবী যতদিন জীবিত থেকেছেন তাঁর মো'জেজাও ততদিনই ছিল, তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নেবার পর আর সে মো'জেজা দেখা যায় নি।’
তবে মহান রব্বুল আলামিন এই ইতিহাসের খাতায় দাড়ি টানেন আজ থেকে চৌদ্দশ’ বছর আগে শেষ নবী মোহাম্মদকে (দ পাঠানোর মধ্য দিয়ে। আজ থেকে চৌদ্দশ’ বছর আগে মানুষ জাতির জীবনে ও ইতিহাসে এমন এক মহাবিপ্লব ঘটে গেলো যে তদানিন্তন পৃথিবীকে তো বদলিয়ে দিয়েছিলোই- শুধু তাই নয়, যা মানুষ জাতির বাকি সম্পূর্ণ ভবিষ্যতকেও নিয়ন্ত্রণ কোরবে। এক দিক দিয়ে এ ঘটনা নতুন কিছু নয়। কারণ যুগে যুগে, একের পর এক প্রেরিতদেরই আরেকজন এলেন স্রষ্টার বাণী আর জীবন-বিধান নিয়ে। কিন্তু আরেক দিক দিয়ে এবারের এই আগমনে রইলো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যতিক্রম। প্রধান প্রধান ব্যতিক্রমগুলি হচ্ছে-
(ক) এর আগের জীবন-বিধান, দীনগুলি এসেছে নির্দিষ্ট, সীমিত মানব সমাজের জন্য। সনাতন ধর্ম, দীনুল কাইয়্যেমা অর্থাৎ একেশ্বরবাদ ভিত্তি হিসাবে থেকে অন্যান্য আইন নিয়ম ইত্যাদি এসেছে স্থান, কাল ও পাত্রের সমস্যা ও চাহিদা অনুযায়ী। এবারেরটা এলো সমস্ত মানব জাতির জন্য। স্রষ্টা লক্ষ্য রাখলেন এতে যেন এমন কোন আইন, কানুন, নির্দেশ না থাকে যা স্থান, কাল বা পাত্রের প্রভাবাধীন হয়। অর্থাৎ এবারের বিধান এলো সম্পূর্ণভাবে সার্বজনীন।
(খ) এটা এলো মানুষের জন্য শেষ জীবন-বিধান হিসাবে, অর্থাৎ এরপর আল্লাহর কাছ থেকে আর কোন জীবনব্যবস্থা আসবে না। এখানেও স্রষ্টা লক্ষ্য রাখলেন যে, এতে এমন কোন আইন, নির্দেশ না থাকে যা সময়ের পরিবর্ত্তনের ফলে অকেজো হয়ে যায়- অর্থাৎ শুধু যা শাশ্বত।
(গ) এর আগের প্রতিটি জীবন-বিধানের ধর্মগ্রন্থ মানুষ তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য বিকৃত করে ফেলেছিল। স্রষ্টা জানতেন তার এই শেষ বইও মানুষ বিকৃত করে ফেলবে। তাই এবার একে বিকৃতি থেকে রক্ষা করার ভার নিলেন নিজে।
ঘ) যার মাধ্যমে আল্লাহ তার এই শেষ জীবনব্যবস্থা পাঠালেন তাকে তিনি তৈরী করলেন সমস্ত মানব জাতির আদর্শ করে। এবং যেহেতু তাকে মানুষ জাতির আদর্শ কোরে তৈরী করলেন কাজেই তাকে করতে হলো একেবারে নিখুঁত করে, যেমন নিখুঁত কোরে স্রষ্টা আর কাউকে তৈরী করেন নি। কোন মানুষকে তো নয়ই, এমন কি তাঁর অন্য কোন নবী রসুলকেও নয়।
সব নবীর বেলা যা হোয়েছে এই শেষ জনের (দ বেলায়ও তার ব্যতিক্রম হলো না। প্রচণ্ড প্রতিরোধ গড়ে উঠলো প্রচলিত ধর্মের হর্ত্তাকর্ত্তাদের দিয়ে। প্রশ্ন উঠলো, ইনি যে সত্যই নবী, আল্লাহর প্রেরিত তার প্রমাণ কি, চিহ্ন কি? আল্লাহ জানেন এ প্রশ্ন উঠবে, তার প্রতিটি নবীর সময় উঠেছে, এবং তিনিও প্রতিটি নবীকেই চিহ্ন অর্থাৎ মো’জেজা দিয়ে শক্তিশালী করেছেন। এখানে একটা কথা বোলে নেই। কোর’আনে কোথাও মো’জেজা শব্দটি নেই। মো’জেজা অর্থাৎ অলৌকিক শব্দের জায়গায় আল্লাহ ব্যবহার করেছেন আয়াত শব্দটি অর্থাৎ চিহ্ন। অর্থ ঐ একই, অর্থাৎ একটি বিশেষ ব্যাপার বা জিনিষ যে সত্য তার চিহ্ন। এই অর্থে আল্লাহ তার কোর’আনের শ্লোকগুলিকে আয়াত বোলে বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ এই শ্লোকগুলি স্রষ্টার, তার প্রেরিতের সত্যতার চিহ্ন, প্রমাণ। তিনি না থাকলে এবং যার মুখ দিয়ে ঐ আয়াতগুরি উচ্চারিত হোচ্ছে তিনি প্রেরিত না হোলে ঐ শ্লোকগুলি কোথা থেকে এলো? এই অর্থে আরো বহু জিনিসকে আল্লাহ তাঁর অস্তিত্বের, একত্বের সত্যতার চিহ্ন হিসাবে বর্ণনা কোরেছেন। যেমন প্রাকৃতিক নিয়ম, গ্রহ-নক্ষত্রের, দিন-রাত্রির বিবর্ত্তন, ইত্যাদিও সবই স্রষ্টার অসীম ক্ষমতার চিহ্ন, যেমন চিহ্ন অর্থাৎ আয়াত হলো নবীদের অলৌকিক, মো’জেজার শক্তি, ঈসার (আ মরাকে প্রাণ দেয়ার মুসার (আ সমদ্রকে দু’ভাগ কোরে দেয়ার শক্তি ও অন্যান্য নবীদের মো’জেজা। এই যে শেষ প্রেরিতকে (দ আল্লাহ পাঠালেন, একে যে আয়াত অর্থাৎ মো’জেজা দেয়া হলো তা তার পূর্ববর্ত্তী নবীদের জন্য দেয়া মো’জেজা থেকে অন্য রকম হতে হলো। কারণ পূর্ববর্ত্তী নবীদের দায়িত্ব ছিলো যার যার জাতির মধ্যে সীমিত, আর এর (দ দায়িত্ব হলো সমগ্র মানব জাতির নয় শুধু- মানব জাতির বাকি আয়ুষ্কালেরও।
স্রষ্টা তার জীবনব্যবস্থা দিয়ে যত প্রেরিত (নবী রসুল) এই পৃথিবীতে প্রেরণ কোরেছেন তার প্রত্যেককে মো’জেজা বা অসাধারণ, আপাতঃ অসম্ভব অর্থাৎ অলৌকিক কাজ করার শক্তি দিয়েছেন। যেহেতু তিনি তার প্রত্যেক প্রেরিতকে এই শক্তি দিয়েছেন তাতে বোঝা যায় এটার একটা বিশেষ গুরুত্ব আছে। এই মো’জেজাগুলি বিভিন্ন প্রেরিত, রসুলদের বিভিন্ন ধরনের হোয়েছে। যে সমাজে যে ধরনের মানুষ, পারিপার্শ্বিকতা, যে ধরনের অভিযোগ কোন নবীর উপর দেয়া হোয়েছে, মো’জেজার শক্তিগুলির ধরন সেইগুলির উপর নির্ভর করেছে। এ ছাড়াও যে বিশেষ সমাজে বা জাতিতে একজন রসুল প্রেরিত হয়েছেন সে জাতির বা সমাজের কতখানি বিবর্ত্তন ভিত্তিক অগ্রগতি হোয়েছে তার উপর নির্ভর করছে সেই নবীকে কোন ধরনের মো’জেজার শক্তি দেয়া হবে তা। বহু পুরোন রসুলদের কাকে কী ধরনের মো’জেজা শক্তি দেয়া হয়েছিল তার কোন নির্ভরযোগ্য তথ্য আমরা পাই না। কিন্তু তুলনামূলকভাবে আধুনিক নবীদের মো’জেজার যে নির্ভুল তথ্য পাই তাতে দেখা যায় মুসাকে (আ মুখোমুখি হতে হয়েছিল মিশরের যাদুকরদের। এর কারণ আছে। তখন মিশর পৃথিবীর প্রচণ্ড শক্তিধর রাজত্বগুলির একটি। শাসনকর্ত্তা ফেরাও সর্বময় কর্ত্তা। দেবতা ‘রা’ এবং সময়ান্তরে ‘আমন’ দেবের পুরোহিতরাই স্থির করতেন ধর্মীয় এবং জাতীয় সব কাজকর্ম। এই পুরোহিতরা পূর্ববর্ত্তী ব্যাবিলনীয় যাদুবিদ্যা, যে সম্বন্ধে স্বয়ং আল্লাহ কোর’আনে উল্লেখ কোরেছেন তা ভালো ভাবে রপ্ত কোরে নিয়েছিলেন এবং সেই যাদুবিদ্যার জোরে জনসাধারণকে অভিভূত কোরে রেখেছিলেন। কাজেই মুসা (আ আল্লাহর আদেশে ফেরাও এর দরবারে যেয়ে যখন বোললেন- আমাকে পাঠানো হোয়েছে আপনার কাছে এই কথা বোলতে যে, “আমি পৃথিবীর সমস্ত জাতিসমূহের প্রভুর প্রেরিত। প্রভুর ব্যাপারে আমার সত্য ছাড়া আর কিছু বলা সম্ভব নয়। সেই প্রভুর কাছ থেকে আমি পরিষ্কার নির্দশন নিয়ে এসেছি, আপনাকে এই বোলতে যে আপনি বনি-ইসরাইলীদের আমার সঙ্গে (মিশর থেকে) চলে যেতে দিন”, তখন ফেরাও তাকে সেই পুরানো কথাই বোললেন- অর্থাৎ (হে মুসা) আপনার কথার সত্যতার প্রমাণ কি? যদি কোন নিদর্শন (আয়াত) এনে থাকেন তবে তা দেখান। নিজেকে নবী প্রমাণ কোরতে মুসাকে (আ মুখোমুখী হতে হলো মিশরের পুরোহিত শ্রেণীর শ্রেষ্ঠ যাদুকরদের। তার হাতের লাঠি সাপ হোয়ে যাদুকরদের সব সাপ খেয়ে ফেলা ছাড়াও পরে বন্যা, ফড়িং, পোকা, ব্যাঙ ও নদীর পানি রক্তে পরিণত করার মো’জেজা দেখাতে হয়েছিল তা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম যাদুকরের পক্ষেও অসম্ভব।
তারপর মো’জেজা নিয়ে এলেন ঈসা (আ। তিনি এলেন ফেরাও এর মত কোন শক্তিশালী রাজার মুখোমুখি হোতে নয়। বনী ইসরাইল জাতি যদিও তখন মুসার (আ মাধ্যমে দেয়া জীবন পথই অনুসরণ করে চলছিল, কিন্তু পূর্বতন জীবন বিধানগুলির মতো ওটাও আত্মা বা উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলে, ছোটখাট বিষয়ের অতি বিশ্লেষণ নিয়ে বর্ত্তমানে আমাদের মত বিরামহীন তর্ক-বিতর্ক ইত্যাদিতে ব্যস্ত ছিল। তাদের পুরোহিত অর্থাৎ রাব্বাই, সাদ্দুসাই এবং ধর্ম সম্বন্ধে পণ্ডিতগণ ধর্মের অবিশ্রান্ত চুলচেরা বিচার করতে করতে এমন অবস্থায় এসে পড়ছিলেন যে সেই জীবন পথের আসল উদ্দেশ্যই হারিয়ে গিয়েছিল, আজকের ইসলাম নামের ধর্মের মত। শাস্তি হিসাবে আল্লাহ ইতিমধ্যেই মুসার (আ অনুসারীদের ইউরোপের রোমানদের পদানত দাসে পরিণত করে দিয়েছিলেন, যেমন এই মুসলিম বলে পরিচিত জাতিটাকেও আল্লাহ একই কারণে ইউরোপের বিভিন্ন জাতির ক্রীতদাসে পর্যবসিত করে দিয়েছিলেন। যাই হোক, ঈসাকে (আ পাঠানো হলো ঐ পথভ্রষ্ট বনি ইসরাইলীদের পথে আনতে। নিজেকে আল্লাহর নবী বোলে প্রমাণ কোরতে তাকে যে সব মো’জেজা দেখাতে হোয়েছিলো তাতে কিন্তু যাদুকরদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয় নি। তার মো’জেজা হলো শিশু অবস্থায় দোলনা থেকে কথা বলা, জন্মান্ধকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দেয়া, মরাকে জীবন দান, শুধু পাঁচটি রুটি ও দু’টি মাত্র মাছ দিয়ে পাঁচ হাজার লোককে পেট ভরে খাওয়ানো ইত্যাদি। এসব কিছু ছিল ইহুদীদের কাছে প্রমাণ করতে যে তিনি সাধারণ লোক নন, তিনি স্রষ্টার প্রেরিত। কিন্তু এসব চোখের সামনে দেখেও তার নিজের জাতি ইহুদীরা বিশেষ করে তাদের পুরোহিত রাব্বাই, সাদ্দুসাইরা তাদের প্রভু ও শাসনকর্ত্তা রোমানদের কাছে নালিশ কোরে তাকে প্রাণদণ্ড দেওয়ালো। যদিও সে প্রানদণ্ড কার্যকরী করার আগেই আল্লাহ তাকে স্বশরীরে অন্য জগতে উঠিয়ে নিলেন এবং তার যে শিষ্য বিশ্বাসঘাতকতা কোরে ঈসাকে (আ ধরিয়ে দিয়েছিলো তার চেহারা ঠিক ঈসার (আ মত কোরে দিলেন এবং রোমান এবং ইহুদী পুরোহিতরা ঈসা (আ মনে কোরে তাকে ক্রুশে উঠিয়ে হত্যা করলো।
বিষয়: বিবিধ
১৮৪৭ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন