সামরিক বাহিনীর কুচকাওয়াজ এবং উম্মতে মোহাম্মদীর সালাহর সাদৃশ্য

লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ আসাদ আলী ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৩, ০৭:১৫:৫১ সন্ধ্যা



সত্য, শ্বাস্বত, এবং পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা হোল দীনুল ইসলাম। মানবজাতির আদীকাল থেকেই ইসলামের যাত্রা শুরু। মানবজাতিকে যাবতীয় অন্যায়-অবিচার, অশান্তি থেকে মুক্ত কোরে একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্যই যুগে যুগে দীনুল ইসলাম, সত্য জীবনব্যবস্থা দিয়ে আল্লাহ নবী-রসুলদের পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। সর্বশেষ এসেছেন মহানবী মোহাম্মদ (দHappy। তাঁর আগমন হয়েছে সম্পূর্ণ মানবজাতির জন্য এবং তাঁর নবুওয়াতকাল কেয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী। আল কোর’আনের অন্ততঃ তিনটি আয়াতে মহান রব্বুল আলামিন তাঁর শেষ নবী প্রেরণের উদ্দেশ্য স্পষ্টভাষায় ব্যক্ত করেছেন। আল্লাহ বলেছেন- ‘আমি তাঁকে (মোহাম্মদকে) সত্যদীন এবং সঠিক পথনির্দেশ দিয়ে এই কারণে প্রেরণ করেছি যে তিনি এটাকে অন্যান্য সমস্ত দীনের উপর বিজয়ী করবেন এবং সাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ঠ’ (সুরা আল ফাতাহ: ২৮, সফ: ৯, তওবা: ৩৩)। অর্থাৎ সমস্ত পৃথিবীতে এই শেষ দীনকে প্রতিষ্ঠা করাই হল তাঁর দায়িত্ব এবং এই দায়িত্ব যতদিন না পূরণ হচ্ছে ততদিন রসুলাল্লাহর উপর আল্লাহর উপাধি ‘রহমাতুল্লিল আলামিন’ও অর্থবহ হয় না। আল্লাহর একটি অতি তাৎপর্যপূর্ণ নাম হল সোবহান যার অর্থ- নিখুঁত, ত্রুটিহীন। তাঁর প্রতিটি কাজ নিখুঁত। কাজেই তিনি তাঁর রসুলকে যে বিরাট-বিশাল দায়িত্ব দিয়ে পৃথিবীতে পাঠালেন সেই দায়িত্ব পালনের প্রক্রিয়া, কর্মপদ্ধতিও নির্দিষ্ট করে দিলেন। সেই প্রক্রিয়া হল সংগ্রাম এবং সর্বাত্মক সংগ্রাম। আর এই সর্বাত্মক সংগ্রামের জন্য যে প্রশিক্ষণ প্রয়োজন ত্রুটিহীন (সোবহান) আল্লাহ সেটাও দিয়ে দিলেন। সেই প্রশিক্ষণ হল সালাহ (নামাজ)। উম্মতে মোহাম্মদীর পাহাড়সম দায়িত্ব পালনের জন্য যে চরিত্রের, আত্মার বল প্রয়োজন সেই চরিত্র সৃষ্টির প্রশিক্ষণ হল সালাহ (নামাজ)।

সালাহর আকীদা বিকৃতি:

বর্তমানে সালাহর আকীদা বিকৃত হোয়ে গেছে। ইসলামের অন্যান্য বিষয়াবলির মতো সালাহকেও উপাসনা সর্বস্ব একটি আচার-অনুষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। প্রকৃত উম্মতে মোহাম্মদী তদানীন্তন অর্ধপৃথিবীতে যে বিপ্লব সৃষ্টি করেছিল এবং যাদের ঐক্য-শৃঙ্খলা এবং আনুগত্যের সামনে তৎকালীন বিশ্বের সুপার পাওয়ারগুলো মাথা নোয়াতে বাধ্য হয়েছিল সেই জাতির সালাহ (নামাজ) আর বর্তমানের এই মুসলিম নামধারী জাতির সালাহর (নামাজ) মাঝে রয়েছে আকাশ-পাতাল ফারাক। এই ফারাক বাহ্যত এবং অভ্যন্তরীণ উভয় দিক দিয়েই। বর্তমানের এই সালাহকারীদের কাছে দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের কোনই মূল্য নেই, কাজেই সালাহর সেই প্রকৃত আকীদা অর্থাৎ সংগ্রামী চরিত্রের মোজাহেদ তৈরির প্রশিক্ষণও তাদের কাছে অনুপস্থিত হওয়াই স্বাভাবিক। সালাহ এখন নিছক একটি আত্মিক পরিশুদ্ধি লাভের পথ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। অথচ সালাহর যে নিয়ম-কানুন, হুকুম-আহকাম রয়েছে সেগুলো দেখলেই বোঝা যাবে সালাহ ধ্যাণ বা উপাসনা নয় বরং ধ্যাণের সম্পূর্ণ বিপরীত। এর সাথে যে বিষয়টির মিল সবচেয়ে বেশি তাহলো- যে কোন দেশের সামরিকবাহিনীর কুচকাওয়াজ। শুধু আচার-অনুষ্ঠানের মিলই নয়, উদ্দেশ্য এবং প্রক্রিয়াতেও সালাহ ও সামরিক বাহিনীর কুচাকাওয়াজের যথেষ্ঠ মিল দৃশ্যমান হয়। এই মিল এতটাই প্রকট যে বর্তমানের প্রায়ান্ধ ইসলামের দৃষ্টিতেও তা ধরা পড়ে। যেমন ডিগ্রী ইসলামিক স্টাডিজের তৃতীয় পত্রের অনুশীলনের ৬ষ্ঠ প্রশ্নের ১৮ নং উত্তরে লেখা হোচ্ছে- “মসজিদ নেতৃত্ব ও নেতার আনুগত্যের শিক্ষা দেয়; মসজিদ নেতৃত্ব ও আনুগত্যের এক অনুপম শিক্ষা কেন্দ্র। মসজিদে সব মুসল্লির একই ইমামের পেছনে সারিবদ্ধভাবে উঠাবসার দৃশ্য দেখে মনে হয় তারা একজন সেনাপতির নির্দেশে কুচকাওয়াজে লিপ্ত। এখানেই নেতার প্রতি অকৃত্রিম আনুগত্য ও নেতৃত্বের বৈশিষ্টের উত্তম সবক বিদ্যমান।” এই মিল স্বাভাবিক, কারণ দু'টোরই উদ্দেশ্য এক। নিম্নে এমনই প্রধান প্রধান কিছু মিল তুলে ধরলাম-

“সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজের সাথে সালাহর মিল”

১। উদ্দেশ্য:

*সালাহর উদ্দেশ্য হোল উম্মতে মোহাম্মদীর দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের জন্য অতি প্রয়োজনীয় ঐক্য, শৃঙ্খলা এবং আনুগত্য সৃষ্টি করা।

*কুচকাওয়াজের উদ্দেশ্য হোল সামরিক বাহিনীর মধ্যে ঐক্য, শৃঙ্খলা এবং আনুগত্য সৃষ্টি করা।

২। জামাতবদ্ধ হওয়া:

*সালাহর পূর্বশর্ত হোল জামাতবদ্ধ (ঐক্যবদ্ধ) হওয়া।

*কুচকাওয়াজেরর পূর্বশর্ত হোল সামরিক বাহিনীর ঐক্যবদ্ধ হওয়া।

৩। নারী-পুরুষ উভয়ের অংশগ্রহণ:

*সালাহতে নারী-পুরুষভেদে কোন বৈষ্যম্য নেই। উভয়েরই দায়িত্ব, উদ্দেশ্য যেহেতু এক, কাজেই উদ্দেশ্য অর্জনের প্রক্রিয়াও এক হওয়ায় স্বাভাবিক। ইতিহাসে পাই, প্রকৃত উম্মতে মোহাম্মদীর যুগে নারী-পুরুষ মসজিদে গিয়ে একই সাথে সালাহ কায়েম কোরতেন এবং তাদের নেতার দিক নির্দেশানা শুনতেন।

*সামরিকবাহিনীর কুচকাওয়াজেও নারী-পুরুষের জন্য কোন ভেদাভেদ করা হয় না।

৪। ইমাম বা কমাণ্ডার আবশ্যক:

*সালাহর জন্য একজন ইমাম থাকা আবশ্যক। ঐ ইমামের হুকুমের (তকবীরের) সাথে সাথে রুকু, সেজদাহ, এতেদাহ না করলে কখনোই সালাহ কবুল হয় না। ইমামের তকবীরের সাথে সাথে রুকু সেজদাহ না হোলে সে সালাহ গৃহীত হয় না। মুসল্লিকে সর্বদায় ইমামের তকবীরের জন্য সতর্ক, তৎপর হোয়ে থাকতে হয়।

*সামরিক বাহিনীরও একজন কমাণ্ডার থাকা আবশ্যক। প্রতিটি মুহূর্তে প্রতিটি সেনাসদস্য তার নিজ নিজ কমাণ্ডারের প্রতি আনুগত্যশীল থাকে এবং তার কথায় মৃত্যুখাদে ঝাপ দিতেও সর্বদা প্রস্তুত থাকে। সালাহর মতই কুচকাওয়াজের সময় সামরিক বাহিনীর সৈনিকেরা সার্জেন্ট মেজরের আদেশের সঙ্গে সঙ্গে সকলে একত্রিতভাবে মার্চ করে, ডাইনে বামে ঘুরে, বসে, দৌড়ায়।

৫। শৃঙ্খলার গুরুত্ব:

*সালাহতে শৃঙ্খলার গুরুত্ব ব্যাপক। প্রকৃত ইসলামের যুগে সালাহ শিক্ষা নেওয়ার সময় জাতির ইমাম বা খলিফাকে চাবুক ব্যবহার করার ইতিহাস পাওয়া যায়। পূর্ণভাবে সালাহ কায়েম করতে গেলে ১০০টিরও বেশি ছোট বড় নিয়ম পদ্ধতি অর্থাৎ শৃঙ্খলা পালন করতে হয়।

*প্যারেডের অন্যতম একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হল শৃঙ্খলা। প্যারেডের প্রতিটি পর্যায়ে বিরাজ করে চূড়ান্ত শৃঙ্খলা এবং সেই শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীর জন্যও থাকে শাস্তির ব্যবস্থা।

৬। পোশাক:

*সালাহর জন্য উত্তম ও জাকজমকপূর্ণ, চাকচিক্যময় পোশাক পরিধান করার জন্য কোর’আনে তাগিদ দেওয়া হোয়েছে। কিন্তু একই রকম পোশাক পরাকে বাধ্যতামূলক করা হয় নি কারণ সালাহ যেহেতু পুরো জাতির জন্য, কাজেই পুরো জাতির জন্যই একরকম পোশাকের ব্যবস্থা করা যুক্তিসঙ্গত নয়।

*সামরিক বাহিনীর প্যারেড, কুচকাওয়াজ করার সময় তাদের পোশাক-পরিচ্ছেদ অর্থাৎ ইউনিফর্ম একই রকম, ইস্ত্রি করা পরিষ্কার এক কথায় জাকজমকপূর্ণ হওয়া বাধ্যতামূলক।

৭। ছোটখাটো শৃঙ্খলা:

*সালাহতে হাইতোলা, জামা-কাপোড় ঠিক করা, পাথরকুচি সরানো, এক পায়ে দাঁড়ানো, চোখ বন্ধ করা ইত্যাদি করা নিষেধ।

*সামরিকবাহিনীর প্যারেডেও চোখ বন্ধ করা, হাই তোলা, জামাকাপোড় ঠিক করা, ভারসাম্যহীন হোয়ে দাঁড়ানো ইত্যাদি কঠোরভাবে নিষেধ থাকে।

৮। উদ্দেশ্যহীন প্রশিক্ষণ:

* যে ব্যক্তি দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ইচ্ছুক নয় তার জন্য সালাহ কায়েম করা অর্থহীন। আল্লাহর রসুল বলেছেন- ‘ইসলাম হল একটি ঘর, এর ভিত্তি হোচ্ছে তওহীদ; ছাদ হোল জেহাদ (দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম) আর থাম (খুঁটি) হোল সালাহ। অর্থাৎ ছাদকে ধরে রাখার জন্যই যেমন খুঁটির প্রয়োজন, তেমনি জেহাদ চালিয়ে যাবার জন্যই প্রয়োজন সালাহ। কাজেই যে ব্যক্তি দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করতে ইচ্ছুক নয় তার সালাহ স্বাভাবিকভাবেই অর্থহীন।

*সামরিকবাহিনীরও যাবতীয় প্রশিক্ষণ, কুচকাওয়াজ ইত্যাদির লক্ষ্য হল যুদ্ধ। সামরিক বাহিনীর কোন সদস্য যদি যাবতীয় প্রশিক্ষণ, কুচকাওয়াজ ইত্যাদিতে নিখুঁত থাকে কিন্তু যুদ্ধে অংশ নিতে না চায় তাহলে তার ঐ প্রশিক্ষণ অর্থহীন।

৯। নির্দিষ্ট সময়:

* ৫ ওয়াক্ত সালাহর জন্য নির্দিষ্ট সময় বাঁধা থাকে। এই নির্দিষ্ট সময়েই সকলকে একত্রিত হোতে হয়।

* সামরিকবাহিনীর কুচকাওয়াজেরও নিদিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া থাকে এবং এই নির্দিষ্ট সময়েই কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়।

বিষয়: বিবিধ

১৬১৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File