রাজনৈতিক দলের সহিংসতা অপরাধ, কিন্তু সহিংসতার অনুমতিদাতা?
লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ আসাদ আলী ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৩, ০১:২৯:৩১ দুপুর
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার ও বিরোধীদল প্রথম থেকেই বিপরীত অবস্থানে রয়েছেন। নির্দলীয় সরকারের দাবিতে বিরোধীদলের অব্যাহত হরতাল, অবরোধ, গাড়ি ভাংচুর, যানবাহনে অগ্নিসংযোগের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে বিগত কয়েকটি মাস। এরই মধ্যে একশ’রও বেশি মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে এই ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড। আহত-পঙ্গুদের হিসাব করলে ছোটখাটো যুদ্ধকালীন দেশের থেকে কোন ভালো পরিস্থিতি যে বিরাজ করছে না তা সহজেই প্রমাণ পাওয়া যাবে। তফসীল ঘোষণার পর থেকেই বিরোধী জোটের ডাকা অব্যহত অবরোধ কর্মসূচিতে অস্বাভাবিক ক্ষয়ক্ষতি পোষাতে হচ্ছে দেশবাসীকে। যোগাযোগ, শিল্প, বাণিজ্য, শিক্ষাক্ষাতে ব্যাপক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে। অসাধারণ ক্ষয়ক্ষতির কবলে পড়ে দেশের ব্যবসায়ী সমাজ এখন দেউলিয়া হতে বসেছে। অপূরণীয় ক্ষতির স্বীকার দেশের এই দলনিরপেক্ষ অর্থনীতির চালকগণ এতটাই বাধা-বিঘ্নে পতিত হয়েছেন যে, তারা রাস্তায় নেমে রাজনৈতিক দলগুলোর সহিংসতার প্রতিবাদ জানাতে বাধ্য হচ্ছেন। তাদের সাম্প্রতিক দূরাবস্থা বোঝা যায় এই থেকে যে- চলমান অস্থিরতায় ক্ষতি পোষাতে পোশাক শিল্পের মালিকরা সরকারের কাছে বিশেষ প্রনোদনের সুযোগ চেয়েছেন আর এই বিশেষ সুযোগ না দিলে ব্যবসা গোটানোর সম্মানজনক পথ চেয়েছেন।
আমাদের ক্ষদ্র আয়ের এই দেশে পোশাক শিল্প হলো অর্থনীতির অন্যতম একটি স্তম্ভ। দেশের একটি বিরাট দারিদ্র্যপিড়িত এবং কর্মঠ জনসংখ্যা এই পেশার সাথে জড়িত। অথচ এমনই একটি শিল্প আজ কতটা বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে তা বোঝা যায় মালিকদের ঐ আবেদনের প্রেক্ষিতে।
নির্বাচনকেন্দ্রীক রাজনৈতিক অস্থিরতা বাংলাদেশে এটা প্রথম নয়। আজ যে দাবিতে আন্দোলন নাম দিয়ে সহিংসতা ও মানুষ হত্যা করা হচ্ছে সেই একই দাবিতে ২০০৬ সালেও তৎকালীন বিরোধীদল আওয়ামীলীগ আন্দোলন-সহিংসতা চালায়। আজ যেমন টানা অবরোধ কর্মসূচি দেওয়া হচ্ছে একইভাবে তৎকালীন সময় লাগাতার হরতালের স্বীকার হয়ে চট্টগ্রাম বন্দর দুই মাস অচল হয়ে ছিল। এভাবেই জাতির সবচেয়ে বড় সমস্যা দারিদ্র্য বিমোচনে সব সময়ই সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে থেকেছে রাজনৈতিক সহিংসতা। যে হরতাল অবরোধের কোপানলে পুড়ে দেশের স্বপ্ন-সাধনা এবং বাঙ্গালির আকাশ ছোঁয়া আকাক্সক্ষা প্রতিনিয়ত ছাই হচ্ছে সেই হরতাল-অবরোধকে দেশবাসী কোনদিনই চায় নি। কিন্তু তারা না চাইলেও রাজনীতিকরা ঠিকই সেটাকে বহাল রেখেছে। অনেক বড় বড় আইন আমাদের রাজনীতিকরা সহজেই প্রণয়ন করে ফেলেন কিন্তু যে কর্মকাণ্ডের ফলে দেশবাসীর জনজীবন হুমকির মুখে পতিত হচ্ছে, যত্রতত্র তাদের লাশ পড়ছে, অতি কষ্টে অর্জিত অর্থনীতি নিমেষেই ভেঙে পড়ছে, মানুষের মৌলিক অধিকার ক্রমাগত ক্ষুন্ন হচ্ছে সেই কর্মকাণ্ডকে বেআইনি বা অবৈধ ঘোষণা করে আইন করার মতো সাহস কারই হয় নি। হয় নি, কারণ সকলেই এই কর্মকাণ্ড করার বৈধতা চায়। তারা যখন সরকারী দলে থাকেন তখন বিরোধী দলের হরতাল-অবরোধ ইত্যাদির কঠিন সমালচনা করে থাকেন কিন্তু যখন ঐ তারাই আবার বিরোধী দলে পরিণত হন তখন এই সমালচনার কথা নিমেষেই ভুলে যান। তারাও দেখাতে শুরু করেন গণতান্ত্রিক আন্দোলন। কারণ এই অমানবিক কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দিয়ে রেখেছে গণতন্ত্র। গণতন্ত্র যে কার্যত ‘শক্তির’ মানদণ্ড দিয়ে চলে তার একটি বাস্তব উদাহরণ হলো এই শক্তি প্রদর্শনের লড়াইয়ে গণতন্ত্র কর্তৃক বৈধতা দান। এই সিস্টেম রাজনৈতিক দলগুলোকে শুধু যে আন্দোলনের নামে হরতাল-অবরোধ করার বৈধতাই দিয়েছে তাই নয়, রীতিমত এটাকে বিরোধীদলের কর্তব্য হিসেবে স্থির করে দিয়েছে। কারণ এটা ছাড়া তাদের দাবি-দাওয়া আদায়ে আর কোন রাস্তা গণতন্ত্র দিতে পারে নি। কিন্তু আশ্চর্য বিষয় হলো আমরা দেশের আপামর জনতা বরাবরের মতই এই সহিংস কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে এসেছি, এর বিরুদ্ধে চায়ের কাপে তুফান সৃষ্টি করেছি, আমাদের জ্ঞানী-গুনী বুদ্ধিজীবীগণ সংবাদপত্র-টকশোতে এটার পর্যাপ্ত ঘৃণা বিস্তার করে চলেছেন কিন্তু দু:খের বিষয় হলো- ‘যে সিস্টেম এই ঘৃণিত কর্মকাণ্ডের অনুমতি দিয়ে রেখেছে সেই সিস্টেমের বিরুদ্ধে একটি শব্দও আজ অবধি আমাদের মুখ থেকে উচ্চারিত হয় নি। আমরা এই সহজ বিষয়টি আজও অনুধাবন করতে পারি নি যে, আম গাছ হতে কাঁঠাল ফল পাওয়া যতটা অসম্ভব তেমনি প্রচলিত সিস্টেমকে বজায় রেখে এই জাতি বিনাসী সহিংস কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণ করাও তেমনিই অসম্ভব। যদি তা অনুধাবন করতে পারতাম তাহলে এটাও বুঝতে কষ্ট হতো না যে, আমাদের নিজেদের বেঁচে থাকার তাগিদেই প্রচলিত সিস্টেমকে পাল্টানোর প্রয়োজন। গ্রহণ করা প্রয়োজন এমন একটি সিস্টেম যেটা প্রকৃতপক্ষেই মানুষের ইচ্ছা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে সক্ষম। যে সিস্টেমে দেশের পরিচালকগণ মানুষের যুক্তিভিত্তিক সকল দাবি-দাওয়া পূরণ করতে বদ্ধ পরিকর এবং যে সিস্টেম অযৌক্তিক এবং অহেতুক কোন দাবি আদায়ে আন্দোলনের নামে মানুষকে সামান্য পরিমাণ কষ্ট দেওয়া বরদাস্ত করবে না।
বিষয়: রাজনীতি
৯৪১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন