আদম থেকে বনি আদম, পর্ব ০১ (একটি গবেষণাধর্মী আলোচনা) যেভাবে পূর্ববর্তী দ্বীনগুলোর বিকৃতি এসেছে
লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ আসাদ আলী ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৩, ০৮:০০:৪৮ রাত
মানবতার মুক্তির জন্য, মানুষের সার্বিক কল্যাণ সাধনের জন্য এবং মানুষকে অন্যায়-অশান্তি, রক্তপাতহীন সমাজ উপহার দেবার জন্য আল্লাহ যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রসুল পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। মানবজাতি ইতিহাস পর্যালোচনা কোরলে এটা স্পষ্ট হয় যে, পৃথিবীর প্রতিটি জনপদে নির্দিষ্ট কিছু সময় পর পর আল্লাহ তাঁর প্রেরিত পাঠিয়েছেন। কোন জাতি নবী-রসুলদের আনিত জীবনপথকে সত্য জ্ঞান কোরে গ্রহণ কোরেছে আবার কোন জাতি নবী-রসুলদের প্রত্যাখ্যান কোরেছে, নির্যাতন কোরেছে এমনকি হত্যা পর্যন্ত কোরেছে। যারা প্রত্যাখ্যান কোরেছে তাদেরকে সংশোধনের জন্য আল্লাহ আবারো নতুন নবী পাঠিয়েছেন। একজন নবী একটা জনসম্প্রদায়ে বা জাতিতে যখন প্রেরিত হোয়েছেন তখন তাঁকে সম্মুখীন হোতে হোয়েছে তাঁর পূর্ববর্ত্তী নবীর বিকৃত ব্যবস্থার অনুসারীদের। পূর্ববর্ত্তী দীনকে বিকৃত করা না হোলে হয়তো তখন তাকে পাঠানোর প্রয়োজনই হতো না। এই দীনগুলি কেমন কোরে বিকৃত হোয়েছে সে সম্বন্ধে একটা ধারণার প্রয়োজন। যখন কোন একজন নবী তাঁর কাজে সফল হোয়েছেন অর্থাৎ তাঁর আনা জীবনব্যবস্থা তাঁর সম্প্রদায় বা জাতি গ্রহণ কোরেছে, প্রতিষ্ঠা কোরেছে, তখন তার ফলে সে জাতিতে শান্তি, ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হোয়েছে। সে সমাজ থেকে যাবতীয় অন্যায়-অশান্তি, রক্তপাত নির্মূল হোয়ে গেছে। অতঃপর তিনি পৃথিবী থেকে বিদায়ের পর শয়তানের প্ররোচনায় মানুষ ঐ ব্যবস্থা বিকৃত কোরতে শুরু কোরেছে। এই বিকৃতিগুলোকে শ্রেণী বিন্যাস কোরলে প্রধান প্রধানগুলো হলো-
-ক) নবীর ব্যক্তিত্বে, চরিত্রের মাধুর্যে মুগ্ধ, তাঁর অলৌকিক শক্তিতে অভিভূত তাঁর জাতি, উম্মাহ তাকে অশেষ ভক্তিশ্রদ্ধা কোরেছে। তাদের মধ্যে অনেকে তাকে প্রাণ ভরে ভালও বেসেছে। তাঁর ওফাতের পর ক্রমে ক্রমে এই ভক্তি শ্রদ্ধা ভালবাসা তাকে আরও উপরের আসনে বসাতে চেয়েছে। এটা একটা স্বাভাবিক মানবিক বৃত্তি- যে যাকে যত ভালবাসে, শ্রদ্ধা করে সে তাকে তত বড় কোরে দেখতে চায়, দেখাতে চায়। যদিও রসুল তাঁর জীবিতকালে নিঃসন্দেহে বার বার পরিষ্কার কোরে বোলে গেছেন যে আমি তোমাদের মতই মানুষ, শুধু আমাকে পাঠানো হোয়েছে তোমাদের জন্য জীবন-বিধান দিয়ে, কিছু অলৌকিক শক্তি দিয়ে। কাজেই আমি যা, অর্থাৎ রসুল, এর বেশি আমাকে অন্য কিছু মনে কোরোনা, কোরলে মহা অন্যায় হবে। কিন্তু অতি ভক্তি আর শয়তানের প্ররোচনায় যতই দিন গেছে ততই তাদের নবীকে উপরের দিকে ওঠাতে ওঠাতে শেষ পর্যন্ত কোন নবীকে আল্লাহর ছেলে, কোন নবীকে একেবারে আল্লাহর আসনেই বসিয়েছে।
খ) নবীরা চোলে যাবার পর তাঁর জাতি, উম্মাহ, তাদের জীবন ব্যবস্থাটাকে নিয়ে অতি বিশ্লেষণ কোরতে শুরু কোরেছে। যে কোন জিনিসেরই অতি বিশ্লেষণ সে জিনিসটাকে নষ্ট, ধ্বংস কোরে দেয়। তাদের বেলাতেও তার ব্যতিক্রম হয় নি। অতি বিশ্লেষণের ফলে বিভিন্ন রকমের মতামত গড়ে উঠেছে, সেই মতামতের অনুসারী জুটেছে, জাতি নানা মতে বিভক্ত হোয়ে গেছে। তারপর অবশ্যম্ভাবীরূপে সেই বিভক্ত অর্থাৎ মযহাব ও ফেরকাগুলির মধ্যে সংঘাত ও ফলে ধ্বংস হোয়ে গেছে।
গ) এই অতি বিশ্লেষণের অবশ্যম্ভাবী ফল আরও হোয়েছে। তার একটা হলো জীবন-বিধানের আদেশ-নিষেধগুলির গুরুত্বের ওলট-পালট হোয়ে যাওয়া- অর্থাৎ কোন্টা অতি প্রয়োজনীয়, কোনটা তার চেয়ে কম প্রয়োজনীয়, কোনটা বিশেষ প্রয়োজনীয় নয়, এগুলির উল্টা-পাল্টা কোরে ফেলা- যদিও সবগুলিই জীবন-ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত। এক কথায় অগ্রাধিকার (চৎরড়ৎরঃু) কোনটা আগে কোনটা পরে। অতি বিশ্লেষণের ফলে জীবন-ব্যবস্থাগুলির যে সব অনুশাসন অতি গুরুত্বপূর্ণ ছিলো, যার উপর সমগ্র ব্যবস্থাটার জীবন-মরণ নির্ভর কোরত সেগুলোকে অপ্রয়োজনীয় স্থলে নামিয়ে দিয়ে অতি অপ্রয়োজনীয় নির্দেশগুলিকে মহা গুরুত্ব দিয়ে তাই নিয়ে বাড়াবাড়ি করা হোয়েছে।
ঘ) অতি বিশ্লেষণের আরও এক আত্মঘাতী ফল এই হোয়েছে ঐ জীবন-ব্যবস্থাগুলি যা জাতির সর্বস্তরের মানুষের জন্য এসেছিলো তার ব্যাখ্যা, ইত্যাদি করার অধিকার একটি বিশেষ শ্রেণীর হাতে সীমাবদ্ধ হোয়ে পড়েছে। স্বভাবতঃই, কারণ যে আদেশ নিষেধগুলি জাতির সবার জন্যই অবতীর্ণ হোয়েছে তা সবারই বোধগম্য ছিলো- কিন্তু ওগুলিকে বিশ্লেষণ, অতি-বিশ্লেষণ কোরে জন সাধারণের বোঝার বাইরে নিয়ে যাওয়া হোয়েছে- ফলে ঐ বিশ্লেষণ নিয়ে ঘাটাঘাটি করায় ব্যস্ত ঐ শ্রেণীটির মধ্যে তা আবদ্ধ হোয়ে পড়েছে এবং পরবর্ত্তীতে জীবন-বিধানের সব রকম ব্যাপারে তাদের মতামত হোয়ে দাঁড়িয়েছে চূড়ান্ত। এই হলো পুরোহিত শ্রেণী এবং এমনি কোরেই প্রতি জীবন-বিধান, প্রতি ধর্মে এরা নিজেরা নিজেদের সৃষ্টি কোরেছেন এবং জীবন-বিধানের মুল লক্ষ্যই বিনষ্ট হোয়ে গেছে। জাতির জনসাধারণ অতি প্রয়োজনীয় উদ্দেশ্য ভুলে যেয়ে পুরোহিতদের কাছে প্রক্রিয়ার ছোট খাট ব্যাপারগুলি সম্বন্ধে বিধান (ফতোয়া) জানতে চেয়েছে আর পুরোহিতরা অতি উৎসাহে নতুন নতুন দুর্বোধ্য বিধান তৈরী কোরেছেন আর তা তাদের দিয়েছেন।
ঙ) আরেক রকমের বিকৃতি এসেছে কায়েমী স্বার্থের (ঠবংঃবফ ওহঃবৎবংঃ) কারণে। প্রথমে নতুন প্রেরিতের ধর্মকে মেনে নিলেও পরে তারা দেখেছে যে তা তাদের কায়েমী স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর হোয়ে দাঁড়াচ্ছে তখন তারা ছলে-বলে, বিধান বিশ্লেষণকারীদের (মুফতি) হাত কোরে ঐ স্বার্থ বিরোধী নির্দেশগুলির পরিবর্ত্তন কোরেছে। ক্রমশঃ সমস্ত জীবন-ব্যবস্থার মুল উদ্দেশ্যই ভুলে যেয়ে ওর খুঁটিনাটি ব্যাপারগুলি পালন করাই একমাত্র কর্ত্তব্য হোয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রতিটি জীবন ব্যবস্থা ঐসবগুলি কারণের একত্রিত, সম্মিলিত প্রভাবে সম্পূর্ণভাবে বিকৃত হোয়ে গেছে। স্রষ্টা দিয়েছেন মানুষকে একটা প্রাণবন্ত, বেগবান (উুহধসরপ) জীবন ধর্ম। শয়তানের প্ররোচনায় সেটাকে একটা উদ্দেশ্য-বিহীন, স্থবির, প্রাণহীন, অনুষ্ঠান সর্বস্ব ব্যাপারে পরিণত কোরেছে। ফলে আবার মানুষ অনিবার্যভাবে সেই অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার আর রক্তারক্তির মধ্যে পতিত হোয়েছে। সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু আল্লাহ আবার তার রসুল পাঠিয়েছেন মানুষকে সত্য, ন্যায় পথে ফিরিয়ে আনতে।
উপরোক্ত বিকৃতিগুলি ছাড়াও আরও একটি বিশেষ কারণ হোয়েছে নতুন নবী পাঠানোর। সেটা হলো মানুষ জাতির বিবর্ত্তন। এক নবী থেকে তার পরবর্ত্তী নবী পর্যন্ত যে সময় অতীত হোয়েছে, সেই সময়ে মানুষ জ্ঞানে-বিজ্ঞানে কিছুটা এগিয়ে গেছে। পারিপার্শ্বিকতায় খানিকটা প্রভেদ এসেছে, নতুন সমস্যাও দেখা দিয়েছে। কাজেই পরবর্ত্তী রসুল যে ব্যবস্থা নিয়ে এসেছেন তাতে স্বাভাবিকভাবেই পুর্বের ব্যবস্থা থেকে কিছু ভিন্নতা থেকেছেই, যদিও মৌলিক সত্য, আল্লাহর একত্ব ও সার্বভৌমত্ব, দীনুল কাইয়্যেমা, সনাতন ধর্ম, সেরাতুল মোস্তাকীম একই থেকেছে। বিভিন্নতাগুলি শুধুমাত্র কম প্রয়োজনীয় ব্যাপারগুলোয়, যেগুলি স্থান এবং কালের প্রভাবাধীন।
বিষয়: বিবিধ
১৬৪৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন