ভোটের অধিকার নয়, বাঁচার অধিকার চাই
লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ আসাদ আলী ০৫ ডিসেম্বর, ২০১৩, ০৩:০৬:২৬ দুপুর
অবরোধের জালে আটকা পড়েছে দেশ। তফসীল ঘোষণার পর থেকেই চলছে অবরোধ। নামে অবরোধ হলেও কার্যত সহিংসতার মাপকাঠিতে তা হরতালকেও ছাড়িয়ে গেছে অনেক আগেই। চরম নৈরাজ্য বিরাজ করছে দেশে। ধসে পড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সার্বিক অর্থনীতি। ন্যুব্জ হতে বসেছে জাতির মেরুদণ্ড শিক্ষাও। ধস নেমেছে তিলে তিলে অর্জিত বিভিন্ন খাতের সাফল্য। টানা সহিংসতার কবলে পড়ে ১০ বছর পিছিয়ে পড়েছে রেল। একই অবস্থা বিরাজ করছে গণপরিবহনেও। নৈরাজ্যের শিকার হয়ে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে সম্ভাবনাময় পোশাক খাত। এমনভাবেই জাতির বর্তমান যখন ধ্বংসের কিনারে দণ্ডায়মান, তখন ভবিষ্যৎকেও অন্ধকারাচ্ছন্ন করে দেবার পায়তারা চলছে। রাজনৈতিক সহিংসতায় ব্যবহৃত হচ্ছে শিশু-কিশোররা। হাতে চাপাতি, বোমা, রামদা তুলে দিয়ে অপরাধপ্রবণ করে তোলা হচ্ছে দেশের আগামী প্রজন্মকে। বিভিন্ন সহিংস ঘটনার কারণে ইতোমধ্যেই ঢাকা প্রায় সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। নিত্য প্রয়োজনীয় কাঁচামালের হাহাকার পড়েছে। দেশের ব্যবসায়ী সমাজ বর্তমানে দেউলিয়া আর যারা এখনও দেউলিয়া হয় নি তারাও দেউলিয়া হবার পথে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার আগুন এখন এক জেলা থেকে আরেক জেলা, এক থানা থেকে আরেক থানা, এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে। বিভাগীয় শহর, জেলা শহর এবং প্রত্যন্ত গ্রাম্য হাটবাজারে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে। পরিস্থিতি জাতিগত দাঙ্গার চেয়ে কোন অংশে কম নয়। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী অনাকাক্সিক্ষত এই পরিবেশের মোকাবেলা করতে গিয়ে প্রতি পদে পদে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। স্বজন হারানোর মর্মপীড়া ও হৃদয়বিদারী আকুতিতে বাংলার আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠছে।
গত ১১ মাসে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছে ৩৫০ জনেরও অধিক মানুষ যাদের মাঝে শিশু, বৃদ্ধ, মহিলা কেউই বাদ যায় নি। বাংলাদেশের মত ছোট্ট এই দেশটির জন্য এই হিসাব মোটেও স্বাভাবিক নয়। সেই সাথে এটা আরো অস্বাভাবিক যে, গত সাত দিনেই প্রাণ হারিয়েছে প্রায় ৫০ জনেরও অধিক সাধারণ মানুষ আর আহতদের সংখ্যা হাজারের ঘরে। এই সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের রক্তের দাম, প্রাণের দাম যে আমাদের রাজনীতিকরা কিভাবে দেবেন তার কোন ভাষা আমি খুঁজে পাই না। গণতন্ত্রের এই জীবন-মরণ খেলা এদেশে নতুন নয়। গত বাইশ বছরে আমাদের রাজনীতিকদের এই নগ্ন খেলায় প্রাণ হারিয়েছে ২৫০০ এরও অধিক জনতা। এই প্রতিটি মৃত্যু হলো এক একটি পরিবারের মৃত্যু, তাদের আশা-আকাক্সক্ষা, স্বপ্নের মৃত্যু। পুরো জাতিই আজ শোক সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। নিরাশার অন্ধকারে নিমজ্জিত তাদের জীবন।
প্রিয় মাতৃভূমির অবস্থা যখন এই তখন জাতির সম্মুখে সরকারের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। শহরে শহরে গ্রামে গ্রামে যে অস্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ করছে, যে প্রাণঘাতি কর্মকাণ্ড প্রকাশ্যে করা হচ্ছে সেগুলোকে দমন করার দায়িত্ব ছিল সরকারের। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এমন একটি নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির মধ্যেও সরকার ব্যস্ত রয়েছে নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে। তারা মনোনয়ন বিক্রি করছেন, বাছাই করছেন, গ্রহণ করছেন অপরদিকে বিরোধী জোট সাধারণ মানুষকে নৃশংসভাবে পুড়িয়ে মারছে। সরকারের কাছে সাধারণ মানুষের জীবনের চেয়ে, তাদের নিরাপত্তা বিধানের চেয়ে, তাদের বাঁচানোর চেয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান যেন অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে। যে দেশে মানুষের জীবন-সম্পদ রক্ষার অধিকার ভূলুণ্ঠিত, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার মত মৌলিক অধিকার হুমকির মুখে সেই দেশের সরকার ব্যস্ত রয়েছে জনগণের ভোটাধিকার নিয়ে। তারা তাদের ক্ষুদ্রস্বার্থের বেড়াজাল ভেদ করে একটু বাইরে চোখ রাখলেই দেখতে পেতেন যে, জনতা ভোট চায় না, নির্বাচন তাদের আবশ্যক নয়, তারা চায় সুষ্ঠুভাবে বাঁচতে, সময়মত পরীক্ষা দিতে, স্বাভাবিকভাবে নিজেদের রুটি-রুজির কর্ম করে খেতে, নিরাপদে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পৌঁছাতে। এটা নিশ্চিত করার জন্যই তারা সরকার নির্বাচন করেছে। সরকারের কাজ হলো তাদের এই অধিকার বাস্তবায়ন করা, নির্বাচন করা নয়। নির্বাচন আমরা গত ২২ বছর যাবৎ করেই আসছি কিন্তু এর দ্বারা আমাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয় নি, হবার সম্ভাবনাও নেই। বরং এই নির্বাচনই আজ জাতিকে অচল-স্থবির, পঙ্গু করে ফেলছে। যারা উঠতে বসতে নির্বাচন, গণতন্ত্র, সংবিধানের বুলি আউড়িয়ে থাকেন তাদের সেই গালভরা বুলি দেশের মানুষকে আগুনে পোড়ানো থেকে বাঁচাতে পারছে না। কাজেই ওগুলোর কোন অপরিহার্যতা আমাদের কাছে নেই। আমাদের দরকার নিরাপত্তা, শান্তি। যে আমাদের শান্তি দেবে, নিরাপত্তা দেবে আমরা তাকেই চাই। আমরা ভোটের অধিকার চাই না, আমরা বাঁচার অধিকার চাই।
বিষয়: রাজনীতি
১০৪৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন