যেমন রাজা তেমন তার প্রজা
লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ আসাদ আলী ৩০ অক্টোবর, ২০১৩, ০৩:১৭:০৮ দুপুর
যেমন রাজা তেমন প্রজা
মোহাম্মদ আসাদ আলী
আমাদের শত শত রাজনৈতিক সংকটের মাঝে নতুন একটি সংযোজিত ইস্যু হলো আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আসন্ন নির্বাচনকে নিয়েই বর্তমানে আমাদের রাজনৈতিক মহল ঘুরপাক খাচ্ছেন। চায়ের দোকান থেকে শুরু করে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত নির্বাচনই এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কারণ নির্বাচনই আমাদের রাজনীতিকদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। কোন দল ক্ষমতা দখল করবে আর কোন দল রাজপথ দখল করবে তা নির্ধারণ করে থাকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। কাজেই এটা যে রাজনীতিকদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ইস্যু হবে সেটাই স্বাভাবিক। রূঢ় বাস্তবতা হলো নির্বাচনে সুবিধা বলে যদি কোন কিছু থেকে থাকে তবে তা রাজনীতিকদের জন্য, আমরা যারা সাধারণ জনগণ খ্যাতিপ্রাপ্তরা আছি তাদের কাছে মোটেও কোন সুখকর বিষয় নয়।
এইসব জাতীয় নির্বাচন জাতির জন্য দুই পয়সার মূল্য বয়ে আনে না। এই যে রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত করা হয়, এই অর্থের যোগানদাতা কারা? এই রাষ্ট্রেরই ক্ষুধার্ত, হাড্ডিসার, দুর্বল, কৃষক-শ্রমিকেরা নয় কি? কিন্তু তারা কি পায় এই নির্বাচন থেকে? এই নির্বাচন নামক আনুষ্ঠানিকতা হলো কার্যতঃ তলাবিহীন ঝুড়ি যেখানে ৫ বছর পর পর জাতি অতি কষ্টে উপার্জিত অর্থ দান করে থাকে। নির্বাচনকে হেয় করা আমার উদ্দেশ্য নয়, বরং আমি বাস্তবতাকে তুলে ধরছি। রাষ্ট্রের আইন-কানুন, নিয়ম নীতিমালা প্রণয়নের জন্য জনপ্রতিনিধির প্রয়োজন আর এই জনপ্রতিনিধি বাছাই করার সিস্টেম হিসেবেই আমরা নির্বাচনকে ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু যদি দেখা যায় আমাদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সম্পর্কে নিজেরাই অবগত নন তাহলে এই নির্বাচনের কি কোন যথার্থতা থাকে?
একজন সংসদ সদস্যের কাজ হলো দেশের নীতি নির্ধারণ করা, আইন প্রণয়ন করা। দেশটা কিভাবে চলবে, কোন নীতিতে চলবে তা সংসদে বসে আলাপ আলোচনা করা, জাতিকে দিক নির্দেশনা দেওয়া। জাতির ভাল যেটা গ্রহণ করা আর মন্দ যেটা তা প্রত্যাখ্যান করা। সংসদ সদস্যরা যদি গ্রামের ব্রীজ, কালভার্ট, রাস্তাঘাট, হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স ইত্যাদির জন্য সংসদে আবেদন করেন, যুক্তি প্রস্তাব করেন, বিল উথাপন করেন, বাতিল করেন তাহলে তারা কিভাবে অন্যান্য বৃহৎ পদক্ষেপগুলো নিবেন? তাদের প্রধান যে কাজ তাহল আইন প্রণয়ন করা, যে কারণে সংসদকে বলা হয় আইনসভা। কাজেই সংসদ সদস্যদের কাজ হলো কোন আইনটা জাতির জন্য কল্যাণকর আর কোন আইনটা অকল্যাণকর তা যাচাই-বাছাই করা। যেটা কল্যাণকর সেটাকে বাস্তবায়ন করতে আপ্রাণ চেষ্টা করা, আর যেটা অকল্যাণকর যথেষ্ট পরিমাণ তথ্য, উপাত্ত আইনজীবীদের পরামর্শ ইত্যাদি নিয়ে সেই অকল্যাণের বিপক্ষে দাঁড়ানো, এবং মিডিয়ার মাধ্যমে তা প্রচার করা। কিন্তু বাস্তবতা হলো আজকের অধিকাংশ সংসদ সদস্যরা জানেনই না তাদের কাজ কি? তাই দেখা যায় যতটা না তিনি আইনবিধান নিয়ে ব্যস্ত তার থেকে বেশি ব্যস্ত থাকেন গ্রামের সেই ব্রীজ, কালভার্ট, টেন্ডার, বদলী-বাণিজ্য ইত্যাদি নিয়ে। আর জনগণও তাদের কাছে যায় দেশের কল্যাণ নয়, বরং অকল্যাণ নিয়ে। তাদের ড্রয়িং রুম আর অফিস গিজ গিজ করে এলাকার জনতার ভারে, যারা তাদের নির্বাচিত নেতার কাছে যায় বিভিন্ন তদবির, নিয়োগ, রাস্তাঘাট, সাহায্য, অন্যকে ধরাশায়ী, মামলা প্রত্যাহার ইত্যাদি নিয়ে। তারা তাদের হাজার হাজার সামাজিক এবং পারিবারিক সমস্যা নিয়ে এমপিকে ব্যতিব্যস্ত রাখে। কাজ না করে দিলে ভোট না দেওয়ার হুমকি, এমনকি এলাকায় গেলে ঠ্যাং ভাঙ্গার হুমকিও দিতে দ্বিধা বোধ করে না। একটা প্রবাদ আছে, “যেমন রাজা তেমন প্রজা”।
এই কথা অস্বীকার করা অসম্ভব যে, বর্তমানে গণতন্ত্রের নামে লেজুরবৃত্তির রাজনীতি চলমান। এর প্রভাব পড়েছে ছাত্র রাজনীতিতেও। সাধারণত দেখা যায় একজন ছাত্র কলেজ বা ভার্সিটিতে ভর্তি হবার পর ভালো সুযোগ-সুবিধার আশায় চোখ কান বুজে একটা নির্দিষ্ট দলে ভর্তি হয়। শুরু হয় লেজুরবৃত্তি, কিন্তু ঐ দলটির জাতীয় আদর্শ কি বা কোন মতাদর্শের বিশ্বাসী তা অধিকাংশ ছাত্র জানেই না বা জানার দরকার মনে করে না। লোক দেখানো মিছিল হয়, নেতা একটা জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেয় তারপর ক্যাম্পাসে ফিরে শুরু হয় খাবার পালা। এতে করে কি হয়? হল দখল করা যায়, টেন্ডারবাজী করা যায় আরও কিছু সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়। কিন্তু জাতির স্বার্থে, সুবিধাবঞ্চিতদের স্বার্থে তাদের কোন কার্যকলাপ লক্ষ্য করা যায় না। এভাবেই রাজনীতি হয়ে গেছে লেজুড়বৃত্তির। কোন রকমে একটা দলের টিকিট পেলেই হলো যেন কলাগাছ হলেও সমস্যা নেই। ফলে যারা রাজনীতিকে পরিচালনা করছেন তারা একটা বিল আনলে তার কল্যাণ কি বা অকল্যাণই বা কি তা অধিকাংশই জানেননা এবং জানার দরকারও পড়েনা। সংসদে যখন বিলটা উথাপন করা হয় তারপর সকলের সমর্থন পেয়ে স্পিকার যখন চিৎকার করে বলেন হ্যাঁ জয়যুক্ত হোয়েছে, হ্যাঁ জয়যুক্ত হোয়েছে, করুণ বাস্তবতা হচ্ছে তিনিও নিজেই জানেন না যে তিনি কিসের উপর হ্যাঁ বোললেন।
প্রচলিত সিস্টেমে একটা রেওয়াজ হয়ে গেছে- যারা বিরোধী দলে থাকে তারা সংসদে যাবে না। নবম জাতীয় সংসদের ৪০০ কার্যদিবসের মধ্যে বিরোধী দলের সাংসদরা অনুপস্থিত ছিল ৩২৩ দিন। ৮ম সংসদেও বর্তমান সরকারী দল যখন বিরোধী দলে ছিলেন তখন তারাও এরকম শত শত দিন সংসদে অনুপস্থিত ছিলেন। তাহলে যারা সংসদে গেল না, বিল উথাপন করলো না, আলোচনা পরামর্শ করলো না, তাদের সংসদ সদস্য বানিয়ে লাভটা কি? আমরা দেখি একজন সংসদ সদস্য একজন থানার ওসির কাছেও কোন দাম পায়না, যদি সে বিরোধী দলের হয়। কারণ ওসি সরকারী দলের ফরমায়েশে কাজ করে। তার কাছে সরকারী দলের একটা জেলা সভাপতির যে দাম থাকে বিরোধী দলের ১০ টা এমপিরও সে দাম থাকেনা। কারণ ঐ ওসি জানে সরকারী দলের কাছেই সবকিছু। তাহলে যে সংসদ সদস্য সংসদে যায় না, যার কোন মূল্য নেই সেই সংসদ সদস্য বানিয়ে লাভ কি? আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হলো সংসদের বাইরের জনসভায় প্রতিদ্বন্দ্বী নেতা-নেত্রীদের দেওয়া ভাষণকে নিয়ে সংসদে শুরু হয় গালাগালি। কে কত অশ্লীলভাবে গালাগালি করতে পারে, তাদের বাপ-দাদাকে কে কত ঘায়েল করতে পারে তার প্রতিযোগীতা শুরু হয়। কিন্তু জাতির দিকনির্দেশনার যে বিষয়টা তা বরাবরই আলোচনার বাইরেই থেকে যায়। কোন আইন প্রাচীন হয়ে গেছে, কোন আইন এখন একান্ত প্রয়োজন, কোন আইন বাতিল করা উচিত তার দিকে রাজনীতিকদের কোন ভ্রক্ষেপ নাই। দুই ঘণ্টার সংসদ অধিবেশনে দেড় ঘণ্টাই চলে গালাগালি, খিস্তি খেউড়। তারপর পান থেকে চুন খসলেই ওয়াক আউট। এই ওয়াক আউট কে প্রতিষ্ঠা করেছে তা বোঝা বড় দায়। নেতাদের স্বার্থবাদী মত প্রতিষ্ঠিত না হলেই তিনি সংসদ থেকে রাগ করে বের হয়ে চলে আসেন যার নাম দেওয়া হলো ওয়াক আউট। কিন্তু ন্যায় তো ন্যায়ই। জাতির কল্যাণ যেটাতে হবে তা একজনে বললেও যেমন গৃহীত হওয়া উচিত তেমনি যেটা জাতির জন্য ক্ষতিকর তা ৩০০ জনের ভেতরে ২৯৯ জনে পক্ষ নিলেও তা বর্জিত হওয়া উচিত। এমন সিস্টেমই আমাদের কাম্য। কাজেই এই তথাকথিত গণতান্ত্রিক সিস্টেমের অজ্ঞ, অথর্ব, ক্ষমতাহীন অনুসরণকারী তথাকথিত জননেতা নির্বাচনের কোন যথার্থতা আমি দেখতে পাইনা।
বিষয়: রাজনীতি
১১৮০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন