আমার খুব প্রিয় একটি কবিতা 'উমর ফারুক' শেয়ার করলাম আশাকরি ভাল লাগবে

লিখেছেন লিখেছেন সায়েম খান ০৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪, ০২:১২:২৩ দুপুর

উমরফারুক

- কাজী নজরুল ইসলাম

তিমির রাত্রি - 'এশা'র আযান শুনি দূর মসজিদে।

প্রিয়-হারা কার কান্নার মতো এ-বুকে আসিয়ে বিঁধে!

       আমির-উল-মুমেনিন,

তোমার স্মৃতি যে আযানের ধ্বনি জানে না মুয়াজ্জিন।

তকবির শুনি, শয্যা ছাড়িয়া চকিতে উঠিয়া বসি,

বাতায়নে চাই-উঠিয়াছে কি-রে গগনে মরুর শশী?

ও-আযান, ও কি পাপিয়ার ডাক, ও কি চকোরীর গান?

মুয়াজ্জিনের কন্ঠে ও কি ও তোমারি সে আহ্ববান?

       আবার লুটায়ে পড়ি।

'সেদিন গিয়াছে' - শিয়রের কাছে কহিছে কালের ঘড়ি।

উমর! ফারুক! আখেরি নবীর ওগো দক্ষিণ-বাহু!

আহ্বান নয় - রূপ ধরে এস - গ্রাসে অন্ধতা-রাহু!

ইসলাম-রবি, জ্যোতি তার আজ দিনে দিনে বিমলিন!

সত্যের আলো  নিভিয়া-জ্বলিছে জোনাকির আলো ক্ষীণ।

শুধু অঙ্গুলি-হেলনে শাসন করিতে এ জগতের

দিয়াছিলে ফেলি মুহম্মদের চরণে যে-শমশের

ফিরদৌস ছাড়ি নেমে এস তুমি সেই শমশের ধরি

আর একবার লোহিত-সাগরে লালে-লাল হয়ে মরি!

ইসলাম - সে তো পরশ-মানিক তাকে কে পেয়েছে খুঁজি?

পরশে তাহার সোনা হল যারা তাদেরেই মোরা বুঝি।

আজ বুঝি - কেন বলিয়াছিলেন শেষ পয়গম্বর-

'মোরপরে যদি নবী হত কেউ, হত সে এক উমর।'

অর্ধ পৃথিবী করেছ শাসন ধুলার তখতে বসি

খেজুরপাতার প্রাসাদ তোমার বারে বারে গেছে খসি

সাইমুম-ঝড়ে। পড়েছে কুটির, তুমি পড়নি ক' নুয়ে,

ঊর্ধ্বের যারা - পড়ছে তাহারা, তুমি ছিলে খাড়া ভূঁয়ে।

শত প্রলোভন বিলাস বাসনা ঐশ্বর্যের মদ

করেছে সালাম দূর হতে সব ছুঁইতে পারেনি পদ।

সবারে ঊর্ধ্বে তুলিয়া ধরিয়া তুমি ছিলে সব নিচে,

বুকে করে সবে বেড়া করি পার, আপনি রহিলে পিছে।

       হেরি পশ্চাতে চাহি-

তুমি চলিয়াছ রৌদ্রদগ্ধ দূর মরুপথ বাহি

জেরুজালেমের কিল্লা যথায় আছে অবরোধ করি

বীর মুসলিম সেনাদল তব বহু দিন মাস ধরি।

দুর্গের দ্বার খুলিবে তাহারা বলেছে শত্রু শেষে-

উমর যদি গো সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করে এসে!

হায় রে, আধেক ধরার মালিক আমির-উল-মুমেনিন

শুনে সে খবর একাকী উষ্ট্রে চলেছে বিরামহীন

সাহারা পারায়ে! ঝুলিতে দু খানা শুকনো 'খবুজ' রুটি

একটি  মশকে একটুকু পানি খোর্মা দু তিন মুঠি।

প্রহরীবিহীন সম্রাট চলে একা পথে উটে চড়ি

চলেছে একটি মাত্র ভৃত্য উষ্ট্রের রশি ধরি!

মরুর সূর্য ঊর্ধ্ব আকাশে আগুন বৃষ্টি করে,

সে আগুন-তাতে খই সম ফোটে বালুকা মরুর পরে।

কিছুদূর যেতে উঠ হতে নামি কহিলে ভৃত্যে, 'ভাই

পেরেশান বড় হয়েছ চলিয়া! এইবার আমি যাই

উষ্ট্রের রশি ধরিয়া অগ্রে, তুমি উঠে বস উটে,

তপ্ত বালুতে চলি যে চরণে রক্ত উঠেছে ফুটে।'

       ...ভৃত্য দস্ত চুমি

কাঁদিয়া কহিল, 'উমর! কেমনে এ আদেশ কর তুমি?

উষ্ট্রের পিঠে আরাম করিয়া গোলাম রহিবে বসি

আর হেঁটে যাবে খলিফা উমর ধরি সে উটের রশি?'

       খলিফা হাসিয়া বলে,

'তুমি জিতে গিয়ে বড় হতে চাও, ভাই রে, এমনি ছলে।

রোজ-কিয়ামতে আল্লাহ যে দিন কহিবে, 'উমর! ওরে

করেনি খলিফা, মুসলিম-জাঁহা তোর সুখ তরে তোরে।'

কি দিব জওয়াব, কি করিয়া মুখ দেখাব রসুলে ভাই।

আমি তোমাদের প্রতিনিধি শুধু, মোর অধিকার নাই।

আরাম সুখের, -মানুষ হইয়া নিতে মানুষের সেবা।

ইসলাম বলে, সকলে সমান, কে বড় ক্ষুদ্র কেবা।

ভৃত্য চড়িল উটের পৃষ্ঠে উমর ধরিল রশি,

মানুষে স্বর্গে তুলিয়া ধরিয়া ধুলায় নামিল শশী।

জানি না, সেদিন আকাশে পুষ্প বৃষ্টি হইল কিনা,

কি গান গাহিল মানুষে সেদিন বন্দী' বিশ্ববীণা।

জানি না, সেদিন ফেরেশতা তব করেছে কি না স্তব-

অনাগত কাল গেয়েছিল শুধু, 'জয় জয়  হে মানব।'

তুমি নির্ভীক, এক খোদা ছাড়া করনি ক' কারে ভয়,

সত্যব্রত তোমায় তাইতে সবে উদ্ধত কয়।

মানুষ হইয়া মানুষের পূজা মানুষেরি অপমান,

তাই মহাবীর খালদেরে তুমি পাঠাইলে ফরমান,

সিপাহ-সালারে ইঙ্গিতে তব করিলে মামুলি সেনা,

বিশ্ব-বিজয়ী বীরেরে শাসিতে এতটুকু টলিলে না।

মানব-প্রেমিক! আজিকে তোমারে স্মরি,

মনে পড়ে তব মহত্ত্ব-কথা - সেদিন সে বিভাবরী

নগর-ভ্রমণে বাহিরিয়া তুমি দেখিতে পাইলে দূরে

মায়েরে ঘিরিয়া ক্ষুদাতুর দুটি শিশু সকরুণ সুরে

কাঁদিতেছে আর দুখিনী মাতা ছেলেরে ভুলাতে হায়,

উনানে শূন্য হাঁড়ি চড়াইয়া কাঁদিয়া অকুলে চায়।

শুনিয়া সকল - কাঁদিতে কাঁদিতে ছুটে গেলে মদিনাতে

বায়তুল-মাল হইতে লইয়া ঘৃত আটা নিজ হাতে,

বলিলে, 'এসব চাপাইয়া দাও আমার পিঠের 'পরে,

আমি লয়ে যাব বহিয়া এ-সব দুখিনী মায়ের ঘরে'।

কত লোক আসি আপনি চাহিল বহিতে তোমার বোঝা,

বলিলে, 'বন্ধু, আমার এ ভার আমিই বহিব সোজা!

রোজ-কিয়ামতে কে বহিবে বল আমার পাপের ভার?

মম অপরাধে ক্ষুধায় শিশুরা কাঁদিয়াছে, আজি তার

প্রায়শ্চিত্ত করিব আপনি' - চলিলে নিশীথ রাতে

পৃষ্ঠে বহিয়া খাদ্যের বোঝা দুখিনীর আঙিনাতে!

       এত যে কোমল প্রাণ,

করুণার বশে তবু গো ন্যায়ের করনি ক' অপমান!

মদ্যপানের অপরাধে প্রিয় পুত্রেরে নিজ করে

মেরেছ দোররা, মরেছে পুত্রে তোমার চোখের পরে!

ক্ষমা চাহিয়াছে পুত্র, বলেছ পাষাণে বক্ষ বাঁধি-

'অপরাধ করে তোরি মতো স্বরে কাঁদিয়াছে অপরাধী।'

       আবু শাহমার গোরে

কাঁদিতে যাইয়া ফিরিয়া আসি গো তোমারে সালাম করে।

খাস দরবার ভরিয়া গিয়াছে হাজার দেশের লোকে,

'কোথায় খলিফা' কেবলি প্রশ্ন ভাসে উৎসুক চোখে,

একটি মাত্র পিরান কাচিয়া শুকায়নি তাহা বলে,

রৌদ্রে ধরিয়া বসিয়া আছে গো খলিফা আঙিনা-তলে।

হে খলিফাতুল-মুসলেমিন! হে চীরধারী সম্রাট!

অপমান তব করিব না আজ করিয়া  নান্দী পাঠ,

মানুষেরে তুমি বলেছ বন্ধু, বলিয়াছ ভাই, তাই

তোমারে এমন চোখের পানিতে স্মরি গো সর্বদাই।

(সংক্ষেপিত)।

বিষয়: সাহিত্য

১৬১৮ বার পঠিত, ৩০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

173707
০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ দুপুর ০২:১৯
বুড়া মিয়া লিখেছেন : ভালো লাগলো
০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ দুপুর ০৩:১৩
127203
সায়েম খান লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ।
173712
০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ দুপুর ০২:২৩
আলোর আভা লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ ।
০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ দুপুর ০৩:৩৩
127204
সায়েম খান লিখেছেন : ধন্যবাদ, আমার প্রিয় কবিতাটি পড়ার জন্য।
173721
০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ দুপুর ০২:৫১
পবিত্র লিখেছেন : শেয়ার করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। Good Luck Good Luck Good Luck
০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সকাল ০৯:৪৩
127470
সায়েম খান লিখেছেন : আপনাকেও ধন্যবাদ।
173737
০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ বিকাল ০৪:৩১
সুমন আখন্দ লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ ভালো লাগলো
০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সকাল ০৯:৪৫
127473
সায়েম খান লিখেছেন : লাগতেই হবে এযে আমাদের জাতীয় কবির অনবদ্য সৃষ্টি।
173739
০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ বিকাল ০৪:৩৩
ফেরারী মন লিখেছেন : ও-আযান, ও কি পাপিয়ার ডাক, ও কি চকোরীর গান?
মুয়াজ্জিনের কন্ঠে ও কি ও তোমারি সে আহ্ববান?
আবার লুটায়ে পড়ি।

আহ!! দিলে চোট লাগিলো Praying
০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সকাল ০৯:৪৮
127477
সায়েম খান লিখেছেন : কবিতাটি হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করার জন্য ধন্যবাদ।
173758
০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ বিকাল ০৫:১১
ভিশু লিখেছেন : ভেরি গুড শেয়ার!
Thumbs Up Thumbs Up Thumbs Up
Rose Rose Rose
Good Luck Good Luck Good Luck
০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সকাল ১০:০৪
127485
সায়েম খান লিখেছেন : ভেরিগুড কমেন্টস ...
173766
০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ বিকাল ০৫:১৫
ডক্টর সালেহ মতীন লিখেছেন : কবিতাটি পড়লেই আমি আবেগাপ্লূত হয়ে পড়ি। এরকম চরিত্র গঠন করতে হে আল্লাহ আমাদের তাওফিক দাও। ধন্যবাদ পোস্টের জন্য্
০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ দুপুর ০২:১৮
127522
সায়েম খান লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ, আপনার মতো আমিও কবিতাটি পড়লে আবেগে চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনা।
173767
০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ বিকাল ০৫:১৫
প্রবাসী আব্দুল্লাহ শাহীন লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ
০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ দুপুর ০২:১৯
127523
সায়েম খান লিখেছেন : আপনাকেও ধন্যবাদ।
173802
০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ বিকাল ০৫:৫৮
egypt12 লিখেছেন : উনিই আমাদের প্রানের কবি...আল্লাহ উনাকে যোগ্য সম্মান দিন আর অপারগতা ক্ষমা করুন
০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ দুপুর ০২:২০
127524
সায়েম খান লিখেছেন : আমিন ...
১০
173837
০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:১৩
আলোকিত ভোর লিখেছেন : ধন্যবাদ Rose
০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ দুপুর ০২:২১
127525
সায়েম খান লিখেছেন : আপনাকেও ধন্যবাদ।
১১
173951
০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ রাত ১০:১৫
আওণ রাহ'বার লিখেছেন : কবি নজরুল এর কবিতা আলহামদুলিল্লাহ ।
আল্লাহ কবিকে জান্নাত দান করুন। আমীন
০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:৫৯
127595
সায়েম খান লিখেছেন : আমিন...।
১২
173957
০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ রাত ১০:২৮
আহমদ মুসা লিখেছেন : অর্ধ পৃথিবী করেছ শাসন ধুলার তখতে বসি
খেজুরপাতার প্রাসাদ তোমার বারে বারে গেছে খসি

মাধ্যমিক লেভেলে পড়াবস্থায় জাতীয় কবির এই পঙ্খতিটির ব্যাখ্যা চেয়ে প্রশ্ন এসেছিল পরীক্ষায়। হয়তো তেমন ভালবে উত্তর লিখতে পারিনি তখন। ইস! যদি এই পরীক্ষাটি আবার দিতে পারতাম!
০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:২৫
127608
সায়েম খান লিখেছেন : হুম! তখন হয়তো কথাগুলোর মর্মার্থ ততটা বুঝতেন না, কিন্তু এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন ...?
১৩
174201
০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ দুপুর ০৩:৩২
ফাতিমা মারিয়াম লিখেছেন : আমার প্রিয় কবিতাটি শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ Rose Rose Rose
০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ রাত ০৮:১৩
127612
সায়েম খান লিখেছেন : এটা আপনারও প্রিয় কবিতা? জেনে খুশি হলাম।
১৪
174440
০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ রাত ০২:২৫
বৃত্তের বাইরে লিখেছেন : খুব ভালো লাগলো আপনার শেয়ার করা কবিতা। ধন্যবাদ আপনাকে Good Luck Rose
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:২২
129856
সায়েম খান লিখেছেন : ধন্যবাদ আপনাকেও ...
১৫
174925
০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সকাল ১১:৩৮
আলমগীর মুহাম্মদ সিরাজ লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:২২
129857
সায়েম খান লিখেছেন : আপনাকেও ধন্যবাদ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File