সূরা ফাতিহা – আমরা যা শিখিনি পর্ব ২
লিখেছেন লিখেছেন হারানো সুর ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০৯:৪৬:৪১ সকাল
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
গত পোস্টের মাধ্যমে আমরা বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম এবং সূরা ফাতিহা এর প্রথম আয়াতটির অর্থ ও তাৎপর্য জেনেছি ৷ আজ আমরা পরবর্তী দুটি আয়াত الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ এবং مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ এর অর্থ ও তাৎপর্য জানব ৷
الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
যিনি নিতান্ত মেহেরবান ও দয়ালু
এই আয়াতে আল্লাহ ﷻ আমাদেরকে তিনি কেমন প্রভু, তার এক বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। মাত্র দুটি শব্দের মধ্যে কী ব্যাপক পরিমাণের তথ্য আছে দেখুন।
প্রথমত, রাহমা-ন এবং রাহি-ম: এই দুটো শব্দই এসেছে রাহমা থেকে, যার অর্থ: দয়া। আরবিতে রাহমা শব্দটির আরেকটি অর্থ ‘মায়ের গর্ভ।’ মায়ের গর্ভে শিশু নিরাপদে, নিশ্চিতে থাকে। মায়ের গর্ভ শিশুর জীবনের সব মৌলিক চাহিদার ব্যবস্থা করে দেয়, শিশুকে আঘাত থেকে রক্ষা করে, শিশুর বেড়ে উঠার জন্য সব ব্যবস্থা করে দেয়। শিশুর জন্য সকল দয়ার উৎস হচ্ছে তার মায়ের গর্ভ।
এখন রাহমান এবং রাহিম দুটো শব্দই এসেছে রাহমাহ থেকে, কিন্তু যেহেতু শব্দ দুটোর গঠন দুই ধরনের, তাই তাদের অর্থ দুই ধরণের দয়ার—
আররাহমা-ন
রাহমা-ন এর শেষে যে একটা টান আছে: ‘আন’, তা প্রচণ্ডতা নির্দেশ করে। রাহমান হচ্ছে পরম দয়ালু, অকল্পনীয় দয়ালু। আল্লাহ ﷻ তার একটি গুণ ‘আর-রাহমা-ন’ দিয়ে আমাদেরকে বলেছেন যে, তিনি পরম দয়ালু, তাঁর দয়ার কথা আমরা কখনও কল্পনা করতে পারব না। একজন মা যেমন তার শিশুর জন্য সবরকম মৌলিক চাহিদা পূরণ করে, সবরকম বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করে, আল্লাহ ﷻ তার থেকেও বেশি দয়ার সাথে তাঁর সকল সৃষ্টিকে পালন করেন, রক্ষা করেন, তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করেন। আল্লাহ ﷻ তাঁর অসীম দয়া দিয়ে প্রকৃতিতে হাজারো ব্যবস্থা করে রেখেছেন পৃথিবীর সবধরনের প্রাণীর মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য। মানুষ হাজার বছর ধরে নানা ভাবে প্রকৃতির এই ব্যবস্থাগুলো ধ্বংস করেছে, চরম দূষণ করেছে, অবাধে গাছ, পশুপাখি নিধন করেছে। কিন্তু তারপরেও কোটি কোটি প্রাণী প্রতিদিন খাবারের সন্ধানে বের হয় এবং ঠিকই খাবার খেয়ে ঘরে ফিরে। শুধু ইউরোপেই প্রতি বছর ৩০০ মিলিয়ন গবাদি পশু এবং ৮ বিলিয়ন মুরগি খাবার জন্য হত্যা করা হয়। তারপরেও আমাদের গবাদি পশু, হাস-মুরগির কোনো অভাব হয় না, কারণ আল্লাহ ﷻ পরম দয়ালু।
দ্বিতীয়ত, রাহমা-ন শব্দটির গঠন এমন যে, এটি কোনো কিছু এই মুহূর্তে হচ্ছে—তা নির্দেশ করে। যেমন আপনি যদি বলেন: “মুহম্মদ একজন উদার মানুষ”, তার মানে এই না যে মুহম্মদ এই মুহূর্তে কোনো উদার কাজ করছে, বা কাউকে কিছু দান করছে। কিন্তু রাহমা-ন শব্দটির গঠন এমন যে, তা নির্দেশ করে এই মুহূর্তে আল্লাহ ﷻ অকল্পনীয় দয়ালু। তিনি আপনাকে, আমাকে, আমাদের পরিবারকে, সমাজকে, আমাদের দেশকে, আমাদের ছোট গ্রহটাকে, আমাদের ছায়াপথের ১০০ কোটি তারা এবং কোটি কোটি গ্রহকে, পুরো মহাবিশ্বের ১০০ কোটি ছায়াপথকে এবং তাদের প্রত্যেকটির ভিতরে কোটি কোটি তারা এবং গ্রহকে এবং তাদের মধ্যে থাকা অসংখ্য প্রাণী জগতকে এই মুহূর্তে, একই সময়ে, একই সাথে দয়া করছেন।
তৃতীয়ত, রাহমা-ন শব্দটির গঠন এমন যে, এটি একটি অস্থায়ী ব্যাপার নির্দেশ করে। একই ধরণের কিছু শব্দ হল জাওআ’-ন (جوعان) যার অর্থ প্রচণ্ড খুধায় কাতর, আ’তশা-ন (عطشان) প্রচণ্ড পিপাসার্ত। এই ধরণের শব্দগুলোর প্রতিটি একটি অস্থায়ী ধারণা নির্দেশ করে, যা পরিবর্তন হতে পারে। যেমন, খাবার খুধাকে দূর করে দেয়, পানি পিপাসাকে দূর করে দেয়। ঠিক একইভাবে আমরা যদি আল্লাহ্র ﷻ কথা না শুনি, তাহলে আল্লাহ ﷻ তাঁর রহমতকে আমাদের উপর থেকে তুলে নিতে পারেন। আল্লাহ্র ﷻ রহমত যে অস্থায়ী, তা রাহমা-ন শব্দটির গঠন নির্দেশ করে।
আররাহি-ম
রাহি-ম এর শেষে যে একটা টান আছে: ‘ইম’ −সেটা ‘সবসময় হচ্ছে’ এমন কিছু নির্দেশ করে। আল্লাহ ﷻ যে সবসময় দয়ালু, তাঁর দয়া যে কখনও শেষ হবে না, তা রাহি-ম এর শেষে ‘ইম’ টান দিয়ে নির্দেশ করা হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, রাহি-ম এর অর্থ এই নয় যে, তিনি সবার প্রতি সবসময় দয়ালু। এমন হতে পারে: তিনি এই মুহূর্তে কাউকে তাঁর দয়া দেবার প্রয়োজন মনে করছেন না, কারণ সে তাঁর ﷻ দেওয়া সীমাকে লঙ্ঘন করেছে। এছাড়াও আল্লাহ ﷻ যদি সবসময় সবার প্রতি অসীম দয়ালু থাকতেন, তাহলে আর জাহান্নাম থাকত না, বা কেউ জাহান্নামী হতো না। সুতরাং আল্লাহ ﷻ রাহি-ম শুধু তাদেরই প্রতি, যারা তাঁর কথা শোনে।
এই দুটি শব্দ আররাহমা-ন এবং আররাহি-ম দিয়ে আল্লাহ ﷻ আমাদেরকে তাঁর দয়ার সম্পর্কে একটি সম্পূর্ণ ধারণা দিয়েছেন। সুতরাং এই আয়াতের একটি উপযুক্ত অনুবাদ হবেঃ
তিনি এই মুহূর্তে অকল্পনীয় দয়ালু এবং তিনি নিরন্তর দয়ালু।
এখন আল্লাহ ﷻ যদি অকল্পনীয় এবং নিরন্তর দয়ালু হন, তাহলে কি আমরা যা খুশি তাই করে পার পেয়ে যাব? কারন তাঁর দয়ার তো কোনো শেষ নেই? উত্তর হচ্ছে:
مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ
যিনি বিচার দিনের মালিক
আল্লাহ ﷻ এখানে খুব অল্প কিছু শব্দ ব্যবহার করে আমাদেরকে বলে দিয়েছেন যে, যদিও তাঁর করুণা অসীম কিন্তু তারপরেও আমাদেরকে আমাদের কাজের বিচার দিতে হবে এবং বিচারক হবেন স্বয়ং আল্লাহ ﷻ এবং কেউ আমাদেরকে সেদিন তাঁর বিচার থেকে রক্ষা করতে পারবে না এবং কেউ কোনো কাজে আসবে না। কারণ আল্লাহ ﷻ বিচার দিনের মালিক।
আরবি মালিক শব্দটির দুটো উচ্চারন রয়েছে, মালিক এবং মা-লিক। মালিক অর্থ রাজা। মা-লিক অর্থ অধিপতি। এখানে আল্লাহ ﷻ লম্বা মা-লিক ব্যবহার করেছেন যার অর্থ আল্লাহ ﷻ বিচার দিনের একমাত্র অধিপতি। এই দিন তিনি ছাড়া আর কারও কোনো ক্ষমতা থাকবে না। তিনি হবেন সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। যেমন একজন রাজার হয়তো অনেক বড় রাজত্ব আছে এবং প্রতিটি প্রজা তার হুকুম শুনে। কিন্তু একজন প্রজা তার বাড়ির ভিতরে তার আসবাব পত্রের সাথে কি করবে, সেটা পুরোপুরি তার ব্যাপার। এখানে রাজার কিছুই বলার নেই। প্রজা হচ্ছে তার আসবাবপত্রের মা-লিক, সে যা খুশি তাই করতে পারে তার আসবাবপত্র নিয়ে। একই ভাবে আল্লাহ হচ্ছেন বিচার দিনের মা-লিক, সেদিন সব ক্ষমতা থাকবে তাঁর। কেউ তাঁর ক্ষমতার সাথে ভাগ বসাতে পারবে না।
এখন কেন বিচার ‘দিনের’ অধিপতি? কেন বিচারের অধিপতি নয়? আমরা যখন বলি – ওই বাড়িটা আমার, তার মানে সাধারণত দাঁড়ায় ওই বাড়ির ভেতরে যা কিছু আছে তার সবই আমার। এমনটা নয় যে বাড়িটা আমার, কিন্তু বাড়ির ভেতরে সব আসবাবপত্র অন্য কারো। একইভাবে আল্লাহ ﷻ যখন বলেন তিনি বিচার দিনের মালিক, তার অর্থ বিচার দিনে যা কিছু হবে, তার সব কিছুর একমাত্র অধিপতি তিনি। বিচার দিন একটা লম্বা সময় এবং সে দিনে অনেকগুলো ঘটনা ঘটবে, যার সবকিছুরই একমাত্র অধিপতি তিনি। তিনি হবেন একমাত্র জজ। তিনি নিজে প্রত্যেকের বিচার করবেন, কোনো উকিল ধরার সুযোগ থাকবে না।
আরবিতে ইয়াওম يَوْم এর বেশ কিছু অর্থ হয় – দিন, যুগ, পর্যায়, লম্বা সময়। যদিও সাধারণত ‘ইয়াওমি দ্দিন’ সবসময় ‘বিচার দিন’ অনুবাদ করা হয়, কিন্তু আমরা যদি ইয়াওমের অন্য অর্থগুলো দেখি তাহলে এটা ‘বিচার পর্যায়’ অনুবাদ করা যেতে পারে। বিচার দিন যে আমাদের একটি দিনের সমান নয় বরং একটা লম্বা পর্যায়, তা ইয়াওমের বাকি অর্থগুলো ইঙ্গিত করে।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য ব্যপার হল, কেন আল্লাহ ﷻ এর আগের আয়াতে তাঁর দয়ার কথা বলার পর এই আয়াতে শাস্তির কথা না বলে বিচারের কথা বললেন। এর কারন হচ্ছে, কিয়ামতের দিন দুই ধরণের মানুষ থাকবে – যারা আল্লাহ্র ﷻ রহমত পেয়ে জান্নাতে যাবে, আর যারা ন্যায় বিচার পেয়ে জাহান্নামে যাবে। জাহান্নাম কোনো শাস্তি নয়, সেটি ন্যায় বিচার। আল্লাহ ﷻ কাউকে শাস্তি দেন না, তিনি ন্যায় বিচার করেন। যারা জান্নাত পায়, তারা আল্লাহ্র অসীম অনুগ্রহের জন্য জান্নাত পায়, ন্যায় বিচারের জন্য নয়। সত্যিই যদি আল্লাহ ﷻ আমাদের ভালো কাজগুলোর ন্যায় বিচার করতেন, তাহলে আমাদের সর্বনাশ হয়ে যেত। তখন আপনার আমার একটা নামাযও সঠিক নামায হতো না, কারন আমরা নামাযে দাঁড়িয়ে এমন কিছু নাই যা ভাবি না। আমাদের একটা রোজাও রোজা হতো না, কারন আমরা রোজা রেখে মিথ্যা কথা বলি, হিন্দি সিরিয়াল দেখি, সুদ খাই, উল্টো পাল্টা জিনিসের দিকে তাকাই, আজে বাজে কথা শুনি ইত্যাদি। আমাদের যাকাত কোনো যাকাত হতো না, কারন আমাদের অনেকের যাকাত হচ্ছে লোক দেখানো একটা ব্যপার, যেখানে আমরা আমাদের মোট সম্পত্তির হিসাব যত কম করে করা যায় তা করে, তার ২.৫% যাদেরকে দিলে লোকমুখে অনেক নাম হবে, তাদেরকেই বেশি করে দেই। আমাদের বিরাট সৌভাগ্য যে আল্লাহ ﷻ আমাদের কিছু ভালো কাজকে ১০ গুণ, কিছু ভালো কাজকে ১০০ গুণ, ১০০০ গুণ করে হিসাব করবেন। তা না হলে কেউ কোনোদিন জান্নাত পেত না।
এখন এই আয়াতটির শব্দগুলোর অর্থকে যদি ঠিকভাবে তুলে ধরি, তাহলে এর অর্থ দাঁড়ায়-
বিচার দিনের/পর্যায়ের একমাত্র অধিপতি।
আমরা এই তিনটি আয়াতে আল্লাহ্র সম্পর্কে একটি সম্পূর্ণ ধারণা পেলাম। এখন আমরা জানি আমাদের প্রভু কে। সুতরাং আমাদের এখন বলা উচিৎ -
إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ
আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদত করি এবং শুধুমাত্র তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি
পরবর্তী পোস্টে এই আয়াতটির বিস্তারিত আলোচনা করা হবে ৷ আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক জ্ঞান অর্জনের তওফিক দান করুন (আমীন)৷
বিষয়: বিবিধ
১৪৬৩ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন