পড়, তোমার প্রভুর নামে

লিখেছেন লিখেছেন হারানো সুর ২৭ মে, ২০১৪, ১২:৪২:১৬ দুপুর

বিশ্বস্রষ্টা মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ফিরিশতা জিবরাঈলের মাধ্যমে সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ যে বাণীটি দিয়ে প্রেরণ করেছিলেন তা ছিল, ‘ইক্বরা’ অর্থাত্ পড়ো। আমরা ছোটবেলায় শুনতাম পড়ালেখা করে যে গাড়ি-ঘোড়ায় চড়ে সে। আর দুষ্ট ছেলেরা ফাঁকি দেয়ার জন্য বলত, পড়ালেখা করে যে, গাড়ি চাপা পড়ে সে। আসলে কথাটি যদিও আজ আর শিক্ষিত মানুষের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। আজ শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবাই গাড়ি দৌড়ায়। তাতে আমাদের মনঃক্ষুণ্ন হওয়ার কোনোই কারণ নেই। আমরা পড়াশোনা করব গাড়িতে চড়ার জন্যই নয়. বরং বড় অনেক বড় মানুষের মতো মানুষ হওয়ার জন্য। আমাদের আশরাফুল মাখলুকাত কেন বলা হয় জানেন? সে এক মজার কাহিনী। আদমকে (আ.) সৃষ্টির পরপরই এক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল। একদিকে সব ফেরেশতা, অপরদিকে আদম (আ.) একা। আল্লাহ ছিলেন সেখানের বিচারক। বিষয়বস্তু ছিল জ্ঞান। আমাদের পিতা আদম (আ.) সেই প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়েছিলেন বলেই তো আমরা আশরাফুল মাখলুকাত। জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব বোঝানোর জন্যই তো বুজুর্গদের উক্তি প্রসিদ্ধ আছে, দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত বিদ্যা অর্জন কর। তাহলে এর আগে বা পরে কি জ্ঞানার্জন থেকে বাদ দেয়া যাবে?মুসলমানের প্রাচীন ইতিহাস অনুসন্ধান করলে পাওয়া যায়, ইলম ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতে তাদের ছিল ব্যাপক দখল-দারিত্ব।

জোশেফহেলের মন্তব্য হলো : Cordova Shone like lighthouse on the darkness of Europe অর্থাত্ আমি সেই সময়ের কথা বলছি, যখন ইউরোপে খ্রিস্টানদের সবচেয়ে বড় লাইব্রেরিটি ছিল রাণী ইসাবেলার, যাতে বইয়ের সংখ্যা ছিল মাত্র ২০১টি। অন্যদিকে তত্কালীন ফাতেমীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী কায়রোতে মুসলমানদের পাঠাগারে জমা হয়েছিল ১০ লাখ বই’। এছাড়াও কাগজ, ঘড়ি, বারুদ, মানচিত্র, ইউরোপ থেকে ভারতের রাস্তা এমনকি আমেরিকার আবিষ্কারক মুসলমানরাই। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, আজকে তারাই বিশ্বে সবচেয়ে পশ্চাত্পদ জাতি। কারণ এক সময় পৃথিবীর শিক্ষক হলেও এখন তারাই সবচেয়ে কম লেখাপড়া করে। অথচ রাসুল সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, জ্ঞান হচ্ছে মুসলমানের হারানো সম্পদ।

সুতরাং বড় হতে হলে এ বিশ্বটাকে আবারও জয় করতে চাইলে অ-নে-ক বে-শি পড়ালেখা করতে হবে। মুসলিম ছাড়াও বিশ্বে যারাই বড় হয়েছেন তারাই প্রচণ্ড পড়াশোনা করেই বড় হয়েছেন। যিনি দরিদ্রতার কারণে ঘড়ি বিক্রি করে দিয়ে দিনে আধপেট খেয়ে সারাদিন লাইব্রেরিতে পড়ে থাকতেন আর পৃথিবীকে পরিমাপ করতেন, তিনি পরে রূপকথাকেও ছাড়িয়ে গিয়ে জগদ্বিখ্যাত নেপোলিয়ান হয়েছিলেন। হেলেন কিলার, বার্নারড’শ, শেক্সপিয়র প্রমুখের দৃষ্টান্ত আজ ইতিহাসে বিরল। ডা. মুহাম্মাদ ইকবাল, কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, স্যার সলিমুল্লাহ, শেরে বাংলা, সোহরাওয়ার্দী প্রমুখ মুসলিম মনীষীর নজির আজ পৃথিবীতে কল্পনাতীত। একজন মহান ব্যক্তির মহান কথা। তিনি যখন অসহায়ভাবে রাশিয়ার এক রেল স্টেশনে মারা যান তখন তার ওভারকোটের পকেটে পাওয়া যায় মূল্যবান এক বই ‘দ্য সেইং অফ প্রোফেট মুহাম্মদ’। সেই নোবেল বিজয়ী লিও টলস্টয়কে বলা হয়েছিল জাতীয় উন্নয়নের জন্য আপনি যুব সমাজের প্রতি কিছু বলুন। তিনি বলেছিলেন আমার তিনটি পরামর্শ আছে। ১. পড়। ২. পড়। ৩. আর পড়। এটি যেন মহান আল্লাহর সেই প্রথম বাণী ‘পড় তোমার প্রভুর নামে’-এর প্রতিফলন।

প্রতিভা : জন্মগত না কি সাধনালব্ধবিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলেন, অনেক সময় আমার মনে হয় আল্লাহ বোধহয় কিছু মানুষকে জন্মগতভাবেই প্রতিভা দিয়েছেন। সুতরাং আমাদের চেষ্টা করলেও খুব একটা লাভ হবে না। এতে করে নিজেদের অজান্তেই এক ধরনের নিষ্ক্রিয়তা জেঁকে বসে, আত্মোন্নয়নের গতি হয়ে যায় শ্লথ। তবে আমার ধারণা কিছু উজ্জ্বল ও ব্যতিক্রম বাদ দিলে সাধারণভাবে সব মানুষের প্রতিভাই আল্লাহ প্রদত্তভাবে সমান। অতঃপর সাধনার কম-বেশির কারণে প্রতিভার স্ফুরণের ক্ষেত্রে হ্রাসবৃদ্ধি ঘটে। আমরা অনেকেই বলি ‘আমার কোনো যোগ্যতা নেই’, আমার মনে হয় ইসলামের দৃষ্টিতে আমাদের এটা বলার কোনোই সুযোগ নেই। কারণ ইরশাদ হয়েছে, নিশ্চয়ই আমি পৃথিবীতে আমার খলিফা (মানুষকে) প্রেরণ করব। আর খলিফা গোটা পৃথিবীর জন্য। তাহলে সহজেই অনুমেয় যে, জন্মগতভাবেই আল্লাহ কত বড় দায়িত্ব দিয়ে আমাদের প্রেরণ করেছেন। এত বড় দুনিয়ার দায়িত্ব যাদের দিলেন তাদের ব্যাপারে এটা কীভাবে ধারণা করা যায়, তাদের কম যোগ্যতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। তাই যারা নিজের যোগ্যতাহীনতা বা স্বল্পতার অভিযোগ করে, আমার মনে হয় তারা প্রকারান্তরে আল্লাহকেই অভিযুক্ত করেন। কেননা তিনিই তো তাদের সৃষ্টি করেছেন এবং সর্বজ্ঞ হিসাবেই এই বিশাল দায়িত্ব আমাদের দান করেছেন।

আমাদের মুসলিম মহামনীষীদের মধ্যে এমন হাজারও নজির পাওয়া যায়, যারা নিজেদের বিশ্বের দরবারে এক নামে পরিচিত হয়েও সারারাত কাটিয়ে দেন পড়াশোনা। জীবনের শেষ মুহূর্তটুকুও জ্ঞান অর্জন থেকে গাফেল ছিলেন না হাদিস শাস্ত্রের উজ্জ্বল নক্ষত্র ইমামু মুসলিম ইবনে হাজ্জাজ কুশাইরি (রহ.)। একটি হাদিস অনুসন্ধান ও গবেষণার মধ্য দিয়েই রাতব্যাপী অধ্যয়ন করতে করতে শেষ রাতের দিকে ইন্তেকাল করেন। আধুনিককালের শ্রেষ্ঠতম মনীষী ইমামুল আসর শাইখুল হাদিস আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরীর (রহ.) ইন্তেকালের আগ মুহূর্তে মুমূর্ষু অবস্থায়ও কিতাব অধ্যয়নে গভীরভাবে নিমগ্ন ছিলেন। ইন্তেকালের পর তার তিনদিকে টেবিলের ওপর বেশ কয়েকটি কিতাব খোলা ছিল। এভাবেই আমাদের বুজুর্গাদের দ্বীন নিজেদের সবকিছু উত্সর্গ করে দিয়ে ইলম তলবের জন্য ওঠেপড়ে লেগে ছিলেন এবং আজীবন এর ওপরই বলবত্ ছিলেন। আর এর বদৌলতেই ইলমের কিঞ্চিত লাভ করতে পেরেছিলেন, যা তাদের ইহলৌকিক ও পরলৌকিক উভয়জগতের জন্য যথেষ্ট হয়ে গিয়েছিল। আসলে এটাই রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী—‘যখন তুমি জ্ঞানার্জনের জন্য নিজের সর্বস্ব উত্সর্গ করবে, তখন ইলম কিঞ্চিতই দিবে, আর এই কিঞ্চিতই তোমার জন্য যথেষ্ট হবে’ এর প্রকৃত মর্ম। এতকিছুর পরও কি আমাদের হারানো চেতনা ফিরে আসবে না, আমাদের বোধ কি জাগ্রত হবে না?

বিষয়: বিবিধ

১০৯২ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

227014
২৭ মে ২০১৪ বিকাল ০৪:৩৫
সন্ধাতারা লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ খুব ভালো লাগলো
227052
২৭ মে ২০১৪ বিকাল ০৫:৫৫
পুস্পিতা লিখেছেন : মুসলমানদের ভিতর লেখাপড়া কমে গিয়েছে।
227808
২৯ মে ২০১৪ সকাল ০৯:২৬
বাজলবী লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ ভালো লাগলো

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File