কবি মতিউর রহমান মল্লিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের এক মহানায়ক
লিখেছেন লিখেছেন হারানো সুর ২৪ মে, ২০১৪, ০৫:০৮:৩৩ বিকাল
সাহসের সাথে কিছু স্বপ্নজড়াও
তারপরে পথ চলে নির্ভয়
আঁধারের ভাঁজ কেটে আসবে বিজয়
সূর্যের লগ্ন সে নিশ্চয়।’
এমন সাহসী উচ্চারণে যিনি সত্যের পথে দৃঢ়ভাবে চলতে প্রেরণা জোগান এবং সাথীদের হাত ধরে সামনে যেতে শেখান তিনিই কবি মতিউর রহমান মল্লিক। বিশ্বাসী সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতে দেশে-বিদেশে এক নামেই পরিচিত তিনি। কবি হিসেবে যেমন তাঁর প্রতিষ্ঠা ও সুখ্যাতি তেমনি সফল গীতিকার, সুরকার, শিল্পী হিসেবেও তাঁর জনপ্রিয়তা ঈর্ষনীয়। তবে বিশ্বাসী জনসাগরে তিনি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের এক মহানায়ক হিসেবেই বেশি সমাদৃত। বিশ্বাসী সংস্কৃতির সমকালীন যাত্রায় সাহসী কা-ারি ছিলেন তিনি। কবি ফররুখ আহমদ, আবদুল লতিফ, আজিজুর রহমান, সিরাজুল ইসলাম, ফজল এ খোদা, সাবির আহমদ চৌধুরী, সৈয়দ শামসুল হুদা প্রমুখ গীতিকার ঐতিহ্যধারার সঙ্গীত অঙ্গনকে বেশ কয়েক ধাপ এগিয়ে দিলেও এ ক্ষেত্রে একটি স্রোত তৈরিতে সক্ষম হয়েছিলেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তারপরে মতিউর রহমান মল্লিকই হামদ-নাত ও দেশজ অনুষঙ্গ নিয়ে ঐতিহ্যবাদী গানের সবচেয়ে সফল ও সার্থক গীতিকার এ কথা সন্দেহাতীতভাবেই বলা যায়। সেইসাথে সংস্কৃতির এ ধারাকে বাংলাদেশসহ বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়া এবং জনপ্রিয় করার যে সাংগঠনিক শক্তি সেই আন্দোলনের মহানায়কও তিনি।
মুকুটবিহীন সম্রাট ও অলিয়ে কামেল হযরত খানজাহান আলীর স্মৃতিবিজড়িত বাগেরহাট। এ জেলারই বারুইপাড়া গ্রামে ১৯৫৬ সালের ১ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন কবি মতিউর রহমান মল্লিক। সংস্কৃতিবান পরিবারে অন্যতম কৃতী পুরুষ কবি মুন্সি কায়েম উদ্দিন মল্লিক তাঁর পিতা। মা আছিয়া খাতুনও মুখে মুখে ছড়াকাটা মহীয়সী মহিলা ছিলেন। কবি মল্লিকের বড় ভাই আহমেদ আলী মল্লিকও একজন বড় কবি। সবুজে ঢাকা মায়াময় পরিবেশে বেড়ে ওঠা মল্লিক নিজেকেও সবুজের সাথে মানানসই করেই গড়ে তুলেছিলেন। সাহাবী-কবি আবদুল্লাহ বিন রাওহা রা. এবং সমকালীন বিশ্বের শ্রেষ্ঠকবি আল্লামা ইকবালের কাব্যদর্শনকে বুকে ধারণ করেই বেড়ে ওঠেন তিনি। মাদরাসা ও সাধারণ শিক্ষার সমন্বয়ে সাজিয়ে নিয়েছিলেন তাঁর শিক্ষাজীবন। মুহাক্কিক আলিমগণও যেমন তার উস্তাদ তেমনি আবদুল মান্নান সৈয়দের মতো সব্যসাচী সাহিত্য ব্যক্তিত্বেরও প্রিয়ছাত্র হতে পেরেছিলেন তিনি। ব্যক্তিগত জীবনেও সে প্রভাব পুরোপুরি চোখে পড়েছে।
ফিরে দেখা
প্রথমত, ‘শোনেন সবে নবীজীর ঐ হকিকত/ কেয়সা ছিল বেলালেরই মহব্বত; উড়িয়া যায়রে জোড় কবুতর মা ফাতেমা কান্দ্যা কয়/ আজ বুঝি কারবালার আগুন লেগেছে মোর কলিজায়’ কিংবা ‘এবারের মতন ফিরে যাও আজরাইল মিনতি করিয়া কই তোমারে/ আসমান জমিন চেহারা তোমার আজাবের ডা-া হাতেতে তোমার’ ইত্যাদি গানগুলো এক সময় গজল নামে গাঁও-গেরামের ওয়াজ মাহফিলে গাওয়া হতো এবং গ্রামের সহজ সরল মানুষ বিশেষত গ্রামীণ ধর্মপ্রাণ মহিলাগণ দু’ চোখের পানি ছেড়ে হৃদয় উজাড় করে এসব গান শুনতেন। শহুরে ওয়াজ মাহফিলে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের হাম্দ-নাতগুলো গাওয়ার চর্চা থাকলেও এগুলোকেও গজল নামে আখ্যা দেয়া হতো এবং পূর্বোক্ত গানগুলোকেও গাওয়া হতো গজল হিসেবেই। তবে শিক্ষিত এলাকার মাহফিলে (শহর-গ্রাম উভয় স্থানে) আল্লামা ইকবাল, রুমী, গালিব কিংবা শেখ সা’দীর উর্দু-ফার্সি গানের পাশাপাশি আরবি গানেরও প্রচলন লক্ষ্য করা যেত। তবে যাই গাওয়া হোক না কেন তাকে অবশ্যই ‘গজল’ নামে আখ্যায়িত করা ছিল বাধ্যতামূলক। কেননা সে সময় গান মানেই অশ্লীল কিছু এবং তা মসজিদ, মাদরাসা, ওয়াজ মাহফিল কিংবা মিলাদ মাহফিলে গাওয়া নাজায়েজ মনে করা হতো। যদিও উত্তর-বাংলার লোকসঙ্গীতে ঐতিহ্য ধারার চর্চা শুরু হয়েছিল অনেক আগেই। শিল্পীসম্রাট আব্বাস উদ্দীন, আব্দুল আলীম, নীনা হামিদ, রথিন্দ্রনাথ রায়, ফেরদৌসী রহমান প্রমুখ শিল্পীর কণ্ঠে ঐতিহ্য ধারার গান উচ্চারিত হলেও অনেক মুসলিম পরিবারে তা গ্রহণযোগ্য হিসেবে দেখা যায়নি; বিশেষত ধর্মীয় মঞ্চে এগুলোকে না-জায়েজ মনে করা হতো। এমনকি কবি কাজী নজরুল ইসলামের ঐতিহ্যবাহী প্রেমময় হামদ-নাতগুলোও সর্বজনগ্রাহ্য ছিল না। এমন সঙ্কটময় সময়েও ঐতিহ্যবাহী মুসলিম পরিবারের একটি অংশ গানের এ ধারাকে বিশ্বাসের সহায়ক হিসেবে ধারণ করে। আলেম-উলামা ক্রমশ বিভিন্ন মাহফিলে আরবি-ফারসি কবিতার পাশাপাশি নজরুলের গান-কবিতাও কোটেশন হিসেবে কিংবা বক্তৃতার অলঙ্কার হিসেবে উপস্থাপন করতে থাকেন। ফলে পঞ্চাশের দশকের পর থেকেই এসব গান-কবিতা অনেক পরিবারে গ্রহণযোগ্য এবং অনেক রক্ষণশীল পরিবারেও সহনশীল হয়ে ওঠে। এমন বৈরী ও প্রতিকূল পরিবেশে সত্তর দশকের শেষ দিকে কবি মতিউর রহমান মল্লিকের নেতৃত্বে নতুন আঙ্গিকে ঐতিহ্য ধারার গানচর্চা শুরু হয়। সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠীর সাংগঠনিক অবয়বে ১৯৭৭ সাল থেকে এ ধারা নতুন রসে সঞ্জীবীত হয়ে ওঠে। মিডিয়াব্যক্তিত্ব মীর কাসেম আলী ও আবু নাসের মুহাম্মদ আবদুজ্জাহেরের মতো সংস্কৃতিমনা বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আন্তরিক পৃষ্ঠপোষকতায় এ সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী ব্যক্তিদের অন্যতম ছিলেন ড. মিয়া মুহাম্মদ আইয়ুব, জনাব সিদ্দিক জামাল, জনাব গিয়াস উদ্দিন আহমেদ, জনাব আবদুল হালিম, জনাব লোকমান হোসেন, জনাব নজরে মাওলা প্রমুখ। তাঁদের পথ ধরেই শিল্পী তফাজ্জল হোসাইন খান, আবুল কাশেম, তারিক মনোয়ার, হাসান আখতার, সাইফুল্লাহ মানছুর, সালমান আযামীসহ এক ঝাঁক প্রতিভাবান শিল্পী এ যাত্রায় সার্থক কা-ারির পরিচয় দেন। সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠী ঢাকা থেকে সংস্কৃতির এ বিশ্বাসী ধারায় যে নতুন আবহ সৃষ্টি করেছিল তা বিভিন্ন নামে এখন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে এবং উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষের হৃদয়াঙ্গনে বিশুদ্ধ বিনোদনের খোরাক হিসেবে সমাদৃত।
দ্বিতীয়ত, মতিউর রহমান মল্লিকের গান এখন বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে। বর্তমান ঐতিহ্যবাহী দেশজ অনুষঙ্গসমেত প্রচলিত ইসলামী সঙ্গীতের ভুবনে একটি জনপ্রিয় নাম মতিউর রহমান মল্লিক। তিন দশকের অধিককাল ধরে তিনি যেমন এ অঙ্গনে নতুন নতুন গান উপহার দিয়ে বিশ্বাসী শ্রোতাদের হৃদয়ে স্থায়ী আসন তৈরি করে নিয়েছেন; তেমনি সাংগঠনিক ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের মাধ্যমে এটাকে একটি আন্দোলনে রূপ দিতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। তাইতো তাঁর অসংখ্য জনপ্রিয় গান যেমন মানুষের মুখে মুখে তেমনি তাঁকে ঘিরে শতশত কবি-গীতিকার-শিল্পী আজ বিশ্বদরবারে সত্যের মশাল নিয়ে এগিয়ে যেতে পাগলপারা। মল্লিকের কয়েকটি জনপ্রিয় গানের উপমা হচ্ছেÑ
ঈমানের দাবি যদি কুরবানী হয় / সে দাবি পূরণে আমি তৈরি থাকি যেন
ওগো দয়াময় আমার প্রভু দয়াময়
ঈমানের উপমা যে অগ্নিশিখা / কাজ হলো শুধু তার জ্বলতে থাকা
তেমনি করে ওগো নিঃশেষে আমি / জ্বলে পুড়ে জীবনের দাম যেন খুঁজে পাই
ওগো দয়াময় আমার প্রভু দয়াময়।
কিংবা আল্লাহর প্রশংসায় নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন এভাবেÑ
তোমার সৃষ্টি যদি হয় এতো সুন্দর / না জানি তাহলে তুমি কতো সুন্দর
সেই কথা ভেবে ভেবে কেটে যায় লগ্ন / ভরে যায় তৃষিত এ অন্তর
না জানি তাহলে তুমি কতো সুন্দর।
অথবা মুমিন কখনো মনভাঙা হলে তিনি তাঁকে চাঙ্গা করেছেন এভাবেÑ
ভেঙে যায় সবকিছু ভাঙে না তো মুমিনের মন
দীন কায়েমের কাজে কাটে তার সকল সময়
কাটে তার প্রতিটি ক্ষণ।
কিংবা
চলো চলো চলো মুজাহিদ পথ যে এখনো বাকি
ভোল ভোল ব্যথা ভোল মুছে ফেলো ঐ আঁখি।
আসুক ক্লান্তি শত বেদনা শপথ তোমার কভু ভুল না
সময় হলে দিও আজান তাওহিদের হে প্রিয় সাকি।
‘পৃথিবী আমার আসল ঠিকানা নয় / মরণ একদিন মুছে দেবে সকল রঙিন পরিচয়;
একজন মুজাহিদ কখনো বসে থাকে না / যতই আসুক বাধা যতই আসুক বিপদ / ভেঙে পড়ে না;
মাফ করে দাও এই পাপীরে / হে দয়াময় মেহেরবান, অনুতাপের অশ্রু আমার কবুল কর মহিয়ান
প্রভৃতি ছাড়াও তাঁর অসংখ্য জনপ্রিয় গান রয়েছে।
শিশুদের গান লিখতে হলে গীতিকারকেও যে শিশু হতে হয় তার স্পষ্ট প্রমাণ দিয়েছেন তিনি। তাঁর এমন অনেক গান রয়েছে যা শিশু-কিশোরকে শুধু আদর্শ জীবন গঠনেই উজ্জীবিত করে না বরং সেগুলো দুষ্টুমিমাখা মিষ্টি বিনোদনও এনে দেয়। তাঁর গান দুষ্টুমিমাখা অভিমানী শাসনে শিশুদের মনকে সজাগ করে করে অবলীলায়।
খুব সকালে উঠলো না যে / জাগলো না ঘুম থেকে
কেউ দিও না তার কপোলে / একটুও চুম এঁকে।
মাজলো না দাঁত অলসতায় / মুখ ধুলো না কোন কথায়
লজ্জা দিও সবাই তাকে / আস্ত হুতুম ডেকে।
তবে একটা বিষয় ভীষণভাবে লক্ষণীয় যে, শিশুদের সাথে দুষ্টুমির সময়ও কিন্তু কবি মল্লিক প্রকৃতিকে ভোলেননি। এমনকি উপমা উৎপ্রেক্ষাতেও মুন্সিয়ানা বজায় রেখেছেন, তবে তা অবশ্যই শিশুদের হজমযোগ্যÑ
ডাকলো দোয়েল টুনি টোনা / জলদি ওঠো খোকন সোনা
নইলে আগে উঠবে সুরুজ /আলোর কুসুম মেখে।
কবি মতিউর রহমান মল্লিকের কলমে এক অসাধারণ বৈচিত্র্যতেজ লক্ষণীয়। মতিউর রহমান মল্লিক কবিতার শরীরে মায়ার আঁটসাঁট বাঁধন কষে নিজেকে সফল করেছেন সন্দেহাতীতভাবে। জীবনের বাস্তবতা তাঁর কবিতার উপজীব্য বিষয়। বক্তব্য উপস্থাপনে তিনি নির্মাণ করেছেন নিজস্ব ঢঙ। ফলে কবিতার ভাঁজে ভাঁজেই তাঁর অস্তিত্বের প্রকাশ অনায়াসে লক্ষণীয়। ছন্দের জাদুকরী প্রভাব যেমন পাঠককে মুগ্ধ করে তেমনি উপমা ও চিত্রকল্প নির্মাণেও তিনি স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। তাঁর কবিতায় গীতলতার স্বাভাবিক আবহ চোখে পড়লেও গান ও কবিতার ভাঁজে ভাঁজে পার্থক্যের দেয়াল খুব শক্ত। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ আবর্তিত তৃণলতা, অনবরত বৃক্ষের গান, তোমার ভাষায় তীক্ষè ছোরা, চিত্রল প্রজাপতি, নিষন্ন পাখির নীড়ে কিংবা ছড়াকাব্য রঙিন মেঘের পালকির সাথে গানের সঙ্কলন ঝংকার ও যতগান গেয়েছি’র মধ্যে পার্থক্যের প্রাচীর খুর মজবুত। কাব্যের শব্দগাঁথুনিতে গীতলতার দোলা থাকলেও তা গানের শব্দভঙ্গি থেকে পুরোপুরি ভিন্ন স্বাদের। এখানেই কবি মল্লিক এবং গীতিকার মল্লিকের এক অসাধারণ বৈচিত্র্যঘ্রাণ ভেসে আসে। কণ্ঠশিল্পী হিসেবেও অসাধারণ কৃতিত্বের অধিকারী তিনি। প্রতীতি ১ এবং প্রতীতি ২ তাঁর স্বকণ্ঠে গাওয়া অডিও অ্যালবাম। বিশ্বাসী চেতনাকে শাণিত করার প্রয়াসে নির্মিত এ অ্যালবাম দীর্ঘ দুই দশক একচ্ছত্র ভূমিকা পালন করেছে বলা যায়। গানের ভাষা, সুর-কণ্ঠ এবং প্রতীকের মোহনীয় ব্যবহার তৃষিত হৃদয়কে তৃপ্ত করে তোলে। তাঁর সঙ্গীতবলয়কে ঘিরে সচেতনভাবেই মন্তব্য করা যায়Ñ ‘মতিউর রহমান মল্লিকের গান শুধুমাত্র পবিত্রময়তার অপরূপ শোভাই নয় বরং তা যেন গানফুলের সুগন্ধি মৌ।’
সাংগঠনিক পথচলা
সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠী প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যে ধারা শুরু হয়েছিলো তা এখন বিশ্বময় ছড়িয়ে গেছে। বর্তমান বাংলাদেশে সেই প্রেরণাকে সামনে রেখে ছাত্রযুবকদের মধ্যে কেন্দ্রীয়ভাবে ‘সমন্বিত সংস্কৃতি সংসদ’ সারাদেশে ৩৫০টিরও বেশি সাহিত্য, নাট্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন নিয়ে গঠিত। এ সংগঠনগুলোতে নিয়মিত সঙ্গীতচর্চা, নাটক মঞ্চায়ন সাহিত্য সভা, লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশনা প্রভৃতির ক্ষেত্রে আশার আলো ছড়াতে সমর্থ হয়েছে। সেই সাথে সারাদেশে সংস্কৃতিকেন্দ্রসমূহ ছাড়াও বিশ্বাসী চেতনার অনেক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন এ অঙ্গনে বেশ কাজ করে যাচ্ছে। এ সকল সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন কবি মতিউর রহমান মল্লিক। এ প্রসঙ্গে মিডিয়াব্যক্তিত্ব মীর কাসেম আলী উল্লেখ করেন, ‘সাইমুম দিয়েই যাত্রা শুরু। হিমালয়ের শিখর থেকে ঝরনাধারা গড়িয়ে পড়তে পড়তে পদ্মা, মেঘনা, যমুনাসহ বহু নদ-নদী ছাড়িয়ে ছড়িয়ে দিল আবেহায়াতের ফল্গুধারা। মল্লিকের মাধ্যমে আল্লাহপাক ইসলামী সংস্কৃতির এক প্লাবন সৃষ্টি করার তৌফিক দিলেন।’
সংগঠক হওয়ার জন্য যেমন হৃদয়ের ব্যাপ্তিটা অনেক বড় থাকতে হয় তেমনি পরোপকারী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পাগলপারা হয়ে ছুটতে হয় মাঠ-ময়দানে। কবি মতিউর রহমান মল্লিক সে কাজটি যথার্থভাবেই করতে সক্ষম হয়েছিলেন। খেয়ে না খেয়ে তিনি ছুটে বেড়িয়েছেন দেশের এ-প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। ছুটে বেড়িয়েছেন দেশের বাইরেও। মানুষ হিসেবে তিনি যেমন ছিলেন সহজ সরল এবং আবেগপ্রবণ, তেমনি আদর্শের প্রচারক হিসেবে তিনি ছিলেন সংগঠনপাগল মানুষ। জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, আরাম-আয়েশ কখনো তাকে বাগে আনতে পারেনি। ইসলামী তাহজিব তমুদ্দুনের বিজয়সংগ্রামে তিনি ছিলেন জীবন উৎসর্গকৃত এক মর্দে মুমিন। কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, লেখক, নাট্যকর্মীসহ সংস্কৃতিবান মানুষদের সুসংঘবদ্ধ করতে তিনি ছুটে বেড়িয়েছেন দেশের সকল প্রান্তে। সংস্কৃতির মডেল ব্যক্তিত্ব হিসেবে গড়ে তুলতে তাদেরকে তিনি নিয়মিত দিকনির্দেশনা দিতেন। শিল্পীদের নিয়ে শিল্পীগোষ্ঠী তৈরি করতেন। পকেটের টাকা পয়সা খরচ করে, কখনো পায়ে হেঁটে, খেয়ে না খেয়ে এ লক্ষ্যে পাগলের মতো কাজ করতেন। সংস্কৃতিকর্মীদের মানোন্নয়নই যেন তার জীবনের ব্রত ছিল। জ্ঞানচর্চা এবং তা ছড়িয়ে দেয়াই ছিল জীবনের প্রধান মিশন। নিজে বড়ো হবার স্বপ্ন কখনো তাকে স্পর্শ করেনি। এ প্রসঙ্গে অনেকেরই অনেক স্মৃতি রয়েছে তাঁর সাথে। কবিবন্ধু হাসান আলীম এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘তিনি শুধু নিজেকে গড়ার জন্য প্রাণপাত করেননি- অন্যকে গড়ার জন্য শ্রম দিয়েছেন- ঘাম দিয়েছেন- রক্ত দিয়েছেন। তিনি ইচ্ছে করলে বড় সম্পাদক, বড় কবি, বড় শিল্পী, বড় অধ্যাপক হতে পারতেন- কিন্তু এ সবের কোনটিই একান্তভাবে নিজের জন্য আঁকড়ে ধরেননি।’ আর এ ধরনের মানসিকতা ছিলো না বলেই আজ মতিউর রহমান মল্লিক শুধু একটি নামই নয়; একটি প্রাণবন্ত ইতিহাস।
সংগঠক হিসেবে তিনি ছিলেন রানী মৌমাছির মতো। তিনি যেখানে যেতেন সেখানেই তাঁকে ঘিরে তৈরি হতো মৌচাক। তাঁর কথার মধ্যে যেমন জাদু ছিলো তেমনি হৃদয়ের নিখাদ ভালোবাসা সবাইকে উদ্বেলিত করে তুলতো। সারাদেশে যেন মল্লিকের অস্তিত্ব ছড়িয়ে থাকতো। দেশের প্রত্যেক প্রান্তের কবি-সাহিত্যিক সংগঠকই মনে করতেন মল্লিক ভাই তাঁকেই বেশি ভালোবাসেন। তাঁর কথা শোনার জন্য সংস্কৃতিকর্মীরা উন্মুখ হয়ে থাকতেন। তাঁর বক্তব্যে যেমন মধুরতা থাকতো তেমনি থাকতো দর্শনের গভীরতা। ধর্মদর্শন, সাহিত্যিক রস, কবিতার অনিবার্য বিষয়ের উদ্ধৃতি আর হৃদয়সাগরের গভীর আকুলতা ও প্রেম দিয়ে শ্রোতাদের মুগ্ধ করে রাখতেন তিনি। মুনসী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহর চেতনা, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর পা-িত্য, ফররুখ আহমদের ঐতিহ্যঘেরা মননশীল কাব্যভুবন, কাজী নজরুল ইসলামের শিকল ভাঙার গান, সৈয়দ আলী আহসানের কাব্যভাষণ এবং বিশ্বাসের দৃঢ়কোমল অস্তিত্ব তাঁকে অসাধারণ বাগ্মীতে পরিণত করেছিল। আদর্শগতভাবে কেউ তাকে অপছন্দ করলেও তাঁর বাগ্মিতা এবং আন্তরিকতাকে শ্রদ্ধা না করে উপায় ছিল না।
রাজধানীতে বসবাস করলেও বাংলাদেশের প্রতিটি প্রান্ত ছিল তাঁর কাছে একান্ত আপন। রাজধানীর চাকচিক্যময়তার চেয়ে তিনি গ্রামের কাদামাটি আর মেঠোপথকেই বেশি পছন্দ করতেন। তাইতো তার পক্ষেই বাংলাদেশের প্রত্যেক প্রান্ত চষে বেড়ানো সম্ভব হয়েছিল। সফরের একটি অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বিশিষ্ট সাহিত্য ও সংস্কৃতিসেবী মুহাম্মদ আমিনুল ইসলাম বলেন, মল্লিক ভাইয়ের সাথে একবার সফরে গেলাম রামপাল। প্রচ- বৃষ্টি। প্রোগ্রামস্থলে পৌঁছতে রাত হয়ে গেল। তাও আবার ঘুটঘুটে অন্ধকার। কাঁচা রাস্তা। হাঁটু পরিমাণ কাদা। কিছুই দেখা যায় না। আমাদেরকে প্রোগ্রামস্থলে যেতেই হবে। মল্লিক ভাইয়ের রাস্তাঘাট চেনা ছিল। তিনি আমাকে বললেন, আপনি শুধু আমার শার্ট ধরে রাখবেন। আর আমার সাথে সাথে পা বাড়াতে থাকবেন। এভাবে এক মাইলেরও বেশি রাস্তা হেঁটে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছলাম।’
যিনি যে কাজকে মিশন হিসেবে নিয়েছেন তার শয়নে-স্বপনে-জাগরণে, সুখে-দুঃখে এমনকি রোগসজ্জাতেও তিনি সেই স্বপ্ন এবং সেই কল্পনায় ভাসতে থাকেন; কবি মতিউর রহমান মল্লিক এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। জীবনের শুরু থেকে যে স্বপ্ন নিয়ে পথ চলেছেন, জীবনসায়াহ্নে এসেও হাসপতালের বিছানায় জটিল রোগের অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যেও বিশ্বাসী সংস্কৃতির অগ্রযাত্রার ভাবনায় মগ্ন তিনি। দু’টি কিডনিই যার অচল, প্যানক্রিয়ায় যিনি ব্যাপক কষ্টভোগ করছেন; জীবনের এমন সঙ্কটময় মুহূর্তেও তিনি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের খোঁজ খবর নিয়েছেন বিভাগীয় প্রতিনিধিগণকে হাসপাতালে ডেকে।
২০০৯ সালের ১০ আগস্ট মল্লিক ভাইকে দেখতে যাবো বলে মোবাইলে জানালাম। পরক্ষণেই মল্লিকভাই কলব্যাক করে বললেন, তুমি ঐ তারিখেই আসছো তো? আমি হ্যাঁ বলতেই তিনি বললেন- ঠিক আছে এসো, মিস করো না যেন। কথামতো ১০ আগস্ট ’০৯ সোমবার ইবনে সিনা হাসপাতালে গেলাম মল্লিক ভাইকে দেখতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই খুলনা, বরিশাল, সিলেট, চট্টগ্রাম ও ঢাকাসহ বিভাগীয় সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিগণ হাজির হলেন। হাসপাতালের বিছানায় বসে যথারীতি প্রোগ্রাম শুরু করলেন মল্লিক ভাই। তখন বুঝলাম এ বৈঠক পূর্বপরিকল্পিত। জিজ্ঞেস করলাম, মল্লিক ভাই আমাকে তো বৈঠকের খবর দেননি! স্বভাবসুলভ মৃদু হেসে তিনি বললেন, ‘আরে ধুত্তোরি, রাখো তো, তুমি ড. এবং ভার্সিটির প্রফেসর, তোমাকে খবর দিয়ে আনা যায়? একটা ইয়ে আছে না? তুমি এদিন আসবে তাই ডেট করেছি।’ আমার চোখের কোনা ভিজে গেল অজান্তেই।
দীর্ঘ সময় ধরে তিনি আমাদের সাথে কথা বললেন এবং সবার হাতে বিভিন্ন পরিকল্পনা ধরিয়ে দিলেন। এক ফাঁকে আমার মিসেস (নাজমা আখন্দ) এর সাথে মল্লিক ভাইয়ের কথা বলিয়ে দিলাম মোবাইলে। তিনি মল্লিক ভাইকে নানা বলে ডাকেন। মোবাইলে কথা বলার সময় মনে হলো তিনি পুরোপুরি সুস্থ মানুষ। এক পর্যায়ে তার নাতনীকে তিনি বললেন, এখন আমি খুব ভালো আছি নানী, মনে হচ্ছে মাঠে গিয়ে ফুটবল খেলতে পারব। বেশ রসিকতাও করলেন। মনেই হলো না তিনি হাসপাতালের বিছানায়। সবাইকে যাতায়াতের খরচটা বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। আমি আপত্তি করায় তিনি স্বভাবসুলভ বললেন, দুই ঘণ্টা ধরে কথা বলে শরীরটা খারাপ লাগছে, এখন চেতাইও না। আমি ভয়ে আর কোনো কথা বলার সাহস পাইনি। ইনিই আমাদের মল্লিক ভাই। যার হৃদয়-সাগর ভালোবাসা আর আদরে পরিপূর্ণ ছিল।
ব্যক্তিগতভাবে সাহিত্য-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নেতৃত্বের উপমা তৈরিতে তিনি যেমন সফল ছিলেন তেমনি সে বিষয়টি যেন দায়িত্বশীলগণ ভুলে না যায় এ জন্য এ বিষয়ে বিভিন্ন প্রবন্ধ-নিবন্ধও লিখে গেছেন। ‘সাহিত্য-সাংস্কৃতিক আন্দোলন : দায়িত্বশীলদের ভূমিকা’ শীর্ষক প্রবন্ধটি সংস্কতিকর্মী এবং সংগঠকদের পথ চলার জন্য মাইলফলক। সাহিত্য সংস্কৃতির ধারণা, ব্যক্তিগত দায়িত্ব, সাংগঠনিক দায়িত্বসহ বিভিন্ন পর্যায়কে ভাগভাগ করে তিনি খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে গাইডলাইন দিয়ে গেছেন।
পরিশেষে বলা যায়, মতিউর রহমান মল্লিক নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। সারাদেশে তৈরি হওয়া তার স্বপ্নের সংগঠনগুলো আজও সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে দক্ষতা ও যোগ্যতার ক্ষেত্রে ঘাটতি থাকলেও যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাব ও নিজেদের আস্থাহীনতা যেমন পেছনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে তেমনি অর্থনৈতিক সঙ্কট, আলাদা নাট্যমঞ্চ সঙ্কট, তথ্যসন্ত্রাসে বিভ্রান্তি হওয়া, আন্তর্জাতিক চক্রান্ত, রক্ষণশীল ইসলামপন্থীদের বাধা, আধুনিক প্রযুক্তির অজ্ঞানতা, সর্বোপরি সংস্কৃতির সঠিক মডেল না পেয়ে এ অভিযানে বিজয়ের টার্গেট না হয়ে আত্মরক্ষামূলক অবস্থান নেয়া হয়েছে। এসব সীমাবদ্ধতার ফলে এ প্রয়াস সাধারণ জনগণের মাঝে কাক্সিক্ষত আবেদন সৃষ্টিতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সংস্কৃতির সঠিক ধারণা উপস্থাপন করে দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহে সাংস্কৃতিক পৃষ্ঠপোষকতার জন্য প্রতিষ্ঠিত সংস্কৃতিকেন্দ্রসমূহকে আরো সহযোগিতা প্রদান এবং প্রয়োজনীয় অঞ্চলে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে উন্নতমানের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা দরকার। বিভাগীয় শহর ছাড়াও দেশের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রসমূহে নিজস্ব বলয়ে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান গড়তে উৎসাহিত করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে রাজধানী ছাড়াও রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, বগুড়াসহ বিভিন্ন অঞ্চলে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা জরুরি। বিভাগীয় শহর ছাড়াও দেশের বিভাগীয় অঞ্চল থেকে প্রকাশিত সাহিত্যের সকল কাগজই অর্থনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা বিশেষত বিজ্ঞাপন সঙ্কটে সঠিকভাবে প্রকাশিত হতে পারছে না। তাই এ বিষয়ে আরো চিন্তা করা প্রয়োজন। ইসলামী আদর্শে বিশ্বাসীদেরকে নিজস্ব আকিদার ভিত্তিতে আলাদা প্লাটফর্ম গড়ে তোলা দরকার। অতিসত্বর সংস্কৃতির মাপকাঠি তৈরি করে আস্থা ও দৃঢ় মনোবল নিয়ে সমমনা সংগঠনসমূহের সমন্বয় গড়ে তুলে বিজয় নেশায় নতুন উদ্দীপনাসহকারে কাজে নামতে হবে। সেইসাথে ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকে সাংস্কৃতিক প্লাটফর্ম তৈরির তত্ত্বাবধানসহ গুরুত্ব তুলে ধরে বক্তব্য আরো বাড়ানো দরকার। মিডিয়ার ক্ষেত্রে আরো বেশি আন্তরিক হওয়া জরুরি। বিশ্বাসী চেতনায় উজ্জীবিত সকল প্রকার স্বার্থান্ধতা ও ছোটখাটো মতপার্থক্য ভুলে সরাসরি আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের সফল উপায় বের করতে হবে। তবেই আত্মার বিকাশ ও নতুন উদ্যমে জাগরণ তৈরি করা সম্ভব। এ প্রেক্ষাপটে সুষ্ঠু পরিকল্পনার ভিত্তিতে জ্ঞানচর্চা আরো বৃদ্ধি করে যোগ্যতার ভিত্তিতে জনশক্তিকে কাজে লাগিয়ে মজবুত সাংস্কৃতিক সংগঠন ও বুদ্ধিজীবী মিডিয়া ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলতে পারলেই সামনের পথ আরো পরিষ্কার হবে। মল্লিকের রেখে যাওয়া স্বপ্ন বাস্তবায়নের মাধ্যমে লাল-সবুজের এ প্রাণের বাংলাদেশকে সত্যিকারের শান্তিময় জনপদে পরিণত করার জন্য আজ প্রয়োজন মল্লিকদর্শনের সঠিক প্রয়োগ। বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলে প্রত্যেক সংস্কৃতিকর্মী মল্লিকের মতো বটবৃক্ষ না হোক অন্তত ছোটখাটো কোন ছায়াদার বৃক্ষ হিসেবে দাঁড়িয়ে গেলেও সাংস্কৃতিক জগতের অন্ধকার দ্রুত অপসারিত হবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদের সবাইকে কবুল করুন; আমিন।
বিষয়: বিবিধ
১৬৫৫ বার পঠিত, ১৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
কবি মল্লিক মানেই কবিতার রং তুলি
দিলাম:https://www.youtube.com/watch?v=STB7-tFImEo
মন্তব্য করতে লগইন করুন