ভালোবাসা বন্দী হয় যেখানে
লিখেছেন লিখেছেন হারানো সুর ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪, ০৮:০৪:৪৯ রাত
প্যারিসের যে নদীর পাড়ে বসে কপোতাক্ষ নদ কবিতাটি লিখেছিলেন মাইকেল মধূসূদন দত্ত সেই নদীর নাম শীন। প্যারিসের বুক চিড়ে শেষ বিকেলের আলোয় ঝলমল করছে শীন। স্থানীয় বাংলাদেশীর তাই এই শীন নদীকে কপোতাক্ষ নদী বলে থাকেন। যেখানে মাইকেল মধূসূদন দত্ত বসে বৈকালিক সময় কাটাতে কাটাতে কবিতাটি লিখেছিলেন সেই জায়গাটি চিহ্নিত করে রেখেছে ফরাসিরা।
এই নিয়ে প্যারিসে আমার ৭ম যাত্রা। এবার একটি অদ্ভুত জিনিস দেখলাম। শীন নদীর উপরের একটি ব্রিজ যার আক্ষরিক নাম হচ্ছে বাটোবিস এবং মানুষ বলে লাভ লক ব্রিজ! এই ব্রিজের বৈশিষ্ট হচ্ছে পুরো ব্রিজের দুপাশের রেলিংয়ে হাজার হাজার তালা মারা! মানুষের এক অদ্ভুত বিশ্বাস এখানে প্রেমিক-প্রেমিকা বা নতুন বিবহিত দম্পত্তিরা তাদের ভালোবাসার অমরত্ব চেয়ে মনে মনে উইশ করে এখানে তালা দিয়ে লক করে যায়! একজোড়া কপোত-কাপোতীকে দেখলাম বেশ আগ্রহ নিয়ে বিভিন্ন তালা দেখছে। নিজের পরিচয় দিয়ে আলাপ জমালাম। ইটালিয়ানরা ইংলিশে আমাদের দেশের চেয়েও দুর্বল। মোটামোটি আকারে ইঙ্গিতে আর ভাঙ্গা ইংলিশে জানলাম অ্যান্তিনিও আর রোজী এসেছে ইটালির নেপোলি থেকে। আটবছরের প্রেমের সফল পরিনতি ঘটবে আগামী মাসে। তাই তারা তাদের ভালোবাসার অমরত্বের দাবি নিয়ে এসেছে এখানে!
রোজী হাসতে হাসতে বলে, অ্যান্তেনিও তার জীবনের সবচেয়ে আকর্ষনীয় পুরুষ হিসাবে যুগ যুগ ধরে বেচে থাকবে এটাই তার আকাঙ্খা। এশিয়ার থাইল্যান্ডে, ইটালির ভ্যানিসে সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এমনটি চালু থাকলেও এটি মূলত ভালোবাসা আর বিশ্বাসের প্রতীক হিসাবে ২০০০ সালে মিলেনিয়াম বছরে শুরু হয় প্যারিসের শীন নদীর উপরে। প্রত্যেক বছর নতুন হাজার হাজার তালা এখানে মারা হয়। এইসব তালায় নিজেদের নাম খোদাই করে রাখা হয়, কেউবা লিখে রাখে রং-তুলি দিয়ে।কেউ কেউ প্যাডতালার বাইরেও সাইকেলের তালাও দিয়ে লক করে গেছে। সাথে থাকা প্যারিসের বন্ধু জুবের ভাই বললেন, এদের প্রেম মনে হয় বেশী জোড়ালো, এইজন্য সাইকেলের মোটা তালা।
নানা রঙ্গের হাজার হাজার তালার ভীড়ে চোখে পড়লো ছোট ছোট ভালোবাসার কোটেশন। যেমন – লিজা, ইউ আর মাই ফেভারিট রিজন টু লুজ মাই স্লিপ! আরেক জায়গায় লিখা – ইউ আর দ্যা বি’স নিস… তবে বেশীরভাগ লেখা ফ্রেঞ্চ বা অন্যান্য ভাষায়। যা বুঝার উপায় নেই। কেউ কেউ নিজেদের নাম জোড়া করে লিখেছে যেমন – র্যা চেল + ড্যানিয়েল। একজন সত্তোরোর্ধ্ব বয়স্ক লোক প্রায় অনেকক্ষন ধরে দাড়িয়ে দাড়িয়ে বিভিন্ন তালায় লেখাগুলো পড়ছেন। পরিচয় দিয়ে জিজ্ঝেস করলাম, কি দেখছেন? হেসে বললেন, তালায় বিভিন্ন লেখা পড়তে ভালো লাগে। ৬ বছর হয় স্ত্রী মারা গেছেন। আগে স্ত্রীসহ আসতেন বিকালে হাটতে হাটতে। এখানে এসে ভালোবাসাময় একটি বিকাল পার করতেন দুজনে মিলে। স্ত্রী মারা যাওয়ার পরও সেই স্মৃতি হাতড়ে এখানে আসেন সপ্তাহে একদিন। বিভিন্ন তালার লেখাগুলো দেখতে ভালো লাগে। আমি বললাম এগুলোতো নতুন বছর আসলে লোকাল অথরিটি কেটে ফেলে দেয়, তাহলে লাভ কি হলো? লোকটি হেসে বললো, এটা ভালোবাসা আর বিশ্বাসের বহি:প্রকাশ মাত্র! কিন্তু এখানে এসে আপনি যে স্মৃতি গেথে গেলেন সেটা কেটে ফেলার সাধ্য কার আছে।
বিষয়: বিবিধ
১৩৮৯ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন