কন্যা সন্তানের উপস্থিতিতে সক্ষম ভাইবোনের উত্তরাধিকার প্রচলিত অবিচার ও সঠিক ইসলাম

লিখেছেন লিখেছেন সৈয়দ জিল্লুর রহমান ২৪ অক্টোবর, ২০১৩, ১০:৪২:০৮ সকাল



بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيْمِ

কন্যা সন্তানের উপস্থিতিতে সক্ষম ভাইবোনের উত্তরাধিকার

প্রচলিত অবিচার ও সঠিক ইসলাম

উত্তরাধিকারী আত্মীয়গণের মধ্যে কিছু আত্মীয়ের উত্তরাধিকার শর্তহীন ও প্রশ্নাতীত। যেমন ছেলে-মেয়ে, পিতা-মাতা ও স্বামী-স্ত্রী। এ তিন ধরণের মোট ছয় প্রকার লোকের মধ্যে কোন একজন মারা গেলে বাকী আত্মীয়গণ সর্বাবস্থায় উত্তরাধিকারী গণ্য হন। আবার কিছু সংখ্যক আত্মীয় এমন আছেন, যাদের উত্তরাধিকার শর্তহীন নয় এবং যাদের উত্তরাধিকার নিয়ে চিন্তাশীল মনিষীদের মধ্যে ভিন্নমত ও বিতর্ক রয়েছে। কন্যা সন্তানের উপস্থিতিতে ভাইবোনদেরকে উত্তরাধিকারী গণ্য করে হিস্সা প্রদান করা এমন একটি বিতর্কিত বিষয়।

মৃতের সন্তানদের মধ্যে যদি এক বা একাধিক কন্যা সন্তান থাকে এবং তাদের সাথে মৃতের ভাইবোনও বর্তমান থাকেন, তাহলে এ এতিম কন্যাদের পাশাপাশি শক্ত-সামর্থ ভ্রাতা-ভঙ্গিগণ উত্তরাধিকারী গণ্য হবেন কি না, তা নিয়ে মনিষীদের মধ্যে মতবিরোধ ও বিতর্ক রয়েছে। হজরত উমার রা, ইবনু মাসঊদ রা. ও আবু মুসা আশআরী রা. সহ একদল ছাহাবায়ে কেরাম ও বিরাট সংখ্যক ফুকাহাগণ কন্যাদেরকে নির্দিষ্ট হারে হিস্সা দেয়ার পরে অবশিষ্ট অংশ ভাইবোনদেরকে প্রদান করার পে মত প্রকাশ করে থাকেন। তারা তাদের মতের সমর্থনে নিম্নোক্ত প্রমাণাদি পেশ করেন:

ক. তাদের বিবেচনায়, মেয়েরা হল এমন উত্তরাধিকারী যাদের জন্য নির্ধারিত হিস্সা রয়েছে। যাকে ইলমুল ফারাইজে বলা হয় ‘যবীল ফুরূজ’। কারণ, তারা বলেন, মেয়ে একজন হলে সে অর্ধেক সম্পদ পায়, একাধিক হলে পায় দু’তৃতীয়াংশ। যেমন আল্লাহ তা’লা বলেন:

فَإِنْ كُنَّ نِسَاءً فَوْقَ اثْنَتَيْنِ فَلَهُنَّ ثُلُثَا مَا تَرَكَ وَإِنْ كَانَتْ وَاحِدَةً فَلَهَا النِّصْفُ

‘‘সুতরাং তারা যদি দু’য়ের অধিক কন্যা সন্তান হয়, তাহলে তারা পাবে দু’তৃতীয়াংশ যা কিছু সে রেখে যাবে তা থেকে। আর যদি সে একজন নারী হয়, তাহলে সে পাবে অর্ধেক।” (সূরা নিসা-১১)। তারা বলেন, আল্লাহর নির্ধারিত হিস্সার পরে বাকী অর্ধেক বা এক তৃতীয়াংশ মেয়েরা পেতে পারে না। সুতরাং বাকী সম্পদ লাভ করবেন এমন উত্তরাধিকারীগণ যাদের জন্য নির্ধারিত কোন হিস্সা নেই বরং তারা অবশিষ্ট সম্পদ লাভ করেন। এ ধরণের উত্তরাধিকারীদেরকে মাওলা (আছাবা) বলা হয়। আর ভাই-বোন হলেন সে আছাবা, যারা বাকী সম্পদ লাভ করবেন। কারণ হাদীছ শরীফে এসেছে:

عَنْ اِبْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ الله عَنْهُمَا قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اِقْسِمُوْا الْمَالَ بَيْنَ اَهْلِ الْفَرَائِضِ عَلَى كِتَابِ اللهِ فَمَا تَرَكَتِ الْفَرَائِضُ فَلاَوْلَى رَجُلٍ ذَكَرٍ .

হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছা. বলেছেন: ‘তোমরা উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সম্পদ বন্টন কর আল্লাহর কিতাব মোতাবেক। যে সম্পদ অবশিষ্ট থেকে যাবে, তা পাবে ঘনিষ্ঠতর পুরুষ লোক।’ (মুসলিম, আবু দাউদ, ইবনু মাজাহ, মুসনাদু আহমাদ)১। তাছাড়া অন্য হাদীছে এসেছে:

عَنْ جَابِرٍ بْنِ عَبْدِ اللهِ قَالَ جَاءَتْ اِمْرَأَةُ سَعْدِ بْنِ الرَّبِيْعِ بِاِبْنَتَيْهَا مِنْ سَعْدٍ إلَى رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَتْ يَا رَسُوْلَ اللهِ هَاتَانِ اِبْنَتَا سَعْدِ بْنِ الرَّبِيْعِ قُتِلَ أَبُوْهُمَا مَعَك يَوْمَ اُحُدٍ شَهِيْدًا وَاَنَّ عَمَّهُمَا أَخَذَ مَالَهُمَا ‏ فَلَمْ يَدَعْ لَهُمَا مَالاً وَلاَ تُنْكَحَانِ إلاَّ وَلَهُمَا مَالٌ قَالَ يَقْضِيْ اللهُ فِيْ ذَلِكَ فَنَزَلَتْ آيَةُ الْمِيْرَاثِ فَبَعَثَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اِلَى عَمِّهِمَا فَقَالَ اِعْطِ اِبْنَتَىْ سَعْدٍ اَلثُلُثَيْنِ وَاِعْطِ أُمَّهُمَا الثُّمُنَ وَمَا بَقِيَ فَهُوَ لَكَ

হজরত জাবির রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ ছা. এর কাছে সা’দ বিন রাবী’য় রা. এর স্ত্রী তার দু’জন মেয়েকে নিয়ে এসে বললেন: ‘হে আল্লাহর রাসূল, সা’দ বিন রাবী’য় রা. আপনার সাথে উহুদ যুদ্ধে গিয়েছিলেন। সে যুদ্ধে তিনি শহীদ হন। এই তার দু'মেয়ে। তাদের সম্পদ তাদের চাচা নিয়ে গেছে; তাদের জন্য কিছুই বাকী রাখেনি। সম্পদ না থাকার কারণে তাদের বিয়েও দেয়া যাবে না।’ রাসূলুল্লাহ ছা. বললেন: ‘আল্লাহ এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দিবেন।’ এর পরেই উত্তরাধিকার সংক্রান্ত আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়। তখন রাসূলুল্লাহ ছা. তাদের চাচার কাছে খবর পাঠিয়ে বললেন: ‘সা’দের দু’মেয়েকে দু’তৃতীয়াংশ দিয়ে দাও এবং তাদের মাতাকে এক অষ্টমাংশ প্রদান কর। আর যা কিছু অবশিষ্ট থাকবে, তা তুমি পাবে।’ (তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, আল মুসতাদরাক, আবু দাউদ)২। এ হাদীছে মেয়েদেরকে নির্ধারিত হিস্সা দেয়ার পরে অবশিষ্ট অংশ রাসূলুল্লাহ ছা. ভাইকে দিয়েছেন যা প্রমাণ করে যে, কন্যা সন্তানের সাথে ভ্রাতাগণও অবশিষ্ট হিস্সা পান।

খ. কন্যাদের সাথে বোনেরাও হিস্সা পায় বলে ছাহাবায়ে কেরামের একাংশ ও অধিকাংশ ফুকাহাদের যে মতামত রয়েছে, তার স্বপে কি যুক্তি ও দলীল রয়েছে তা সুনির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। তবে একটি দলীল হল নিম্নোক্ত হাদীছ। বর্ণিত হয়েছে:

عَنْ اَبُوْقَيْسٍ قَالَ سَمِعْتُ هُذَيْلَ بْنَ شُرَحْبِيْلَ يَقُوْلُ سُئِلَ اَبُوْ مُوْسَى عَنْ اِبْنَةٍ وَاِبْنَةِ اِبْنٍ وَاُخْتٍ فَقَالَ لِلاِبْنَةِ اَلنِّصْفُ وَلِلأُخْتِ اَلنِّصْفُ وَائْتِ اِبْنَ مَسْعُوْدٍ فَسَيُتَابِعُنِىْ فَسُئِلَ اِبْنُ مَسْعُوْدٍ وَاُخْبِرَ بِقَوْلِ اَبِىْ مُوْسَى فَقَالَ لَقَدْ ضَلَلْتُ اِذَنْ وَمَا اَنَا مِنَ الْمُهْتَدِيْنَ أَقْضِيْ فِيْهَا بِمَا قَضَى النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِلاِبْنَةِ اَلنِّصْفُ وَلِاِبْنَةِ اْلاِبْنِ اَلسُّدُسُ تَكْمِلَةَ الثُّلُثَيْنِ وَمَا بَقِيَ فَلِلأُخْتِ فَأَتَيْنَا اَباَمُوْسَيْ فَاَخْبَرْنَاهُ بِقَوْلِ اِبْنِ مَسْعُوْدٍ فَقَالَ لاَ تَسْأَلُوْنِيْ مَا دَامَ هَذَا الْحَبْرُ فِيْكُمْ

‘হজরত আবু কায়েস রাহ. বলেন: আমি হুযাইল বিন শুরাহবীল রাহ. কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, হজরত আবু মূসা আশআরী রা. কে জিজ্ঞাসা করা হল যে, যদি একজন মেয়ে, একজন ছেলের তরফের নাতিন ও একজন বোন থাকে, তাহলে কে কত হিস্সা করে পাবে? তখন তিনি বললেন: ‘মেয়ে অর্ধাংশ পাবে আর বাকীটুকু পাবে বোন। তুমি আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ এর কাছে গিয়ে দেখতে পার, তিনিও আমার অনুসরণ করবেন।’ হজরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রা. কে জিজ্ঞাসা করলে এবং আবু মুসা রা. এর মতামতের কথা জানালে তিনি বললেন: ‘আমি সঠিক পথের দিশা না পেলে পথভ্রষ্ট হয়ে যেতাম। আমি এমন রায় দেব, যে রকম রায় দিয়েছিলেন রাসূলুল্লাহ ছা.। মেয়ে অর্ধাংশ পাবে, নাতিন পাবে এক ষষ্টাংশ যাতে করে দু’জনের হিস্সা মোট দু’তৃতীয়াংশ হয়। আর বাকীটুকু পাবে বোন।’ আমরা হজরত আবু মূসা আশআরী রা. এর কাছে ফেরত গিয়ে তার কাছে ইবনু মাসউদ রা. এর রায়ের কথা জানালে তিনি বললেন, ‘এ পন্ডিত যতদিন আছে, ততদিন আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা কর না।’ (বুখারী, তিরমিযী, আবু দাউদ, ইবনু মাজাহ, আল মুসতাদরাক, মুসনাদু আহমাদ)৩। তাদের আরেকটি দলীল ফারাইজের গ্রন্থাবলীর সুত্রে জানা যায়। সে দলীলটি হল, রাসূলুল্লাহ ছা. এর কথিত হাদীছ। যেমন বর্ণিত হয়েছে: اِجْعَلُوا الْاَخَوَاتِ مَعَ الْبَنَاتِ عَصَبَةً ‘তোমরা মেয়েদের সাথে বোনদেরকে আছাবা বানাও।’ (সিরাজী, আল বাহরুর রায়ীক, তাবয়ীনুল হাকায়িক, মাজমাউল আনহর ফী শারহে মুলতাকাল আবহর, আল মাওসূআতুল ফেকহিয়্যাহ আল কুয়েতিয়্যাহ, ফেকহুস সুন্নাহ)৪। উপরোক্ত বিষয়গুলোকে বিশ্লেষণ করে ফুকাহা ও ফারাইজবিদগণ আছাবা (মাওলা) উত্তরাধিকারীগণকে তিনভাগে বিভক্ত করেছেন। ১. ‘আছাবা বিনাফসিহী’, ২. ‘আছাবা বিগায়রিহী’ এবং ৩. ‘আছাবা মা’আ গায়রিহী’। ব্যাখ্যা করে তারা বলেন যে, সকল পুরুষ উত্তরাধিকারীগণ হলেন ‘আছাবা বিনাফসিহী’, যারা স্বনির্ভর অবশিষ্টাংশভোগী আছাবা। পান্তরে কন্যা ও বোনের মত নারী উত্তরাধিকারীগণ, যাদের জন্য নির্ধারিত হিস্সা আল্লাহ বলে দিয়েছেন বলে তারা মনে কেরন, তারা তাদের ভাইদের সাথে যৌথভাবে উত্তরাধিকারী হলে সে ভাইদের কল্যাণে তারা বোনেরাও আছাবায় পরিণত হন। এ রকম পরনির্ভরশীল আছাবাদেরকে বলা হয় ‘আছাবা বিগায়রিহী’। আর কন্যা সন্তানদের সাথে যদি মৃতের এক বা একাধিক বোন উত্তরাধিকারী জড় হন, তবে কন্যাগণ যবীল ফুরূজ ঠিকই থাকবেন, কিন্তু বোনেরা আছাবায় পরিণত হয়ে অবশিষ্ট সম্পদ লাভ করবেন। এ ধরণের আছাবা হওয়াকে তারা ‘আছাবা মা’আ গায়রিহী’ বলে অভিহিত করে থাকেন।

গ. ফুকাহাগণ আরো বলেন: ‘সূরা নিসার ১৭৬ নং আয়াত পাঠ কালে মনে হতে পারে যে, সন্তানের উপস্থিতিতে ভাই অথবা বোনেরা উত্তরাধিকারী নন। কিন্তু এ ধারণা ঠিক নয়। কারণ আয়াতে বলা হয়েছে:

اِنِ امْرُؤٌ هَلَكَ لَيْسَ لَهُ وَلَدٌ وَلَهُ اُخْتٌ فَلَهَا نِصْفُ مَا تَرَكَ وَهُوَ يَرِثُهَآ اِنْ لَمْ يَكُن لَهَا وَلَدٌ

‘‘যদি কোন নি:সন্তান লোক মারা যায় এবং তার একজন বোন থাকে, তবে সে বোন মৃত ব্যক্তি যা কিছু ছেড়ে যাবে তার অর্ধেক পাবে - এবং সে ব্যক্তিও তার বোনের (যদি মারা যায়) উত্তরাধিকারী হবে, যদি তার (মৃত বোনের) কোন সন্তান না থাকে।’’ প্রকৃতপে এ আয়াতে সকল সন্তানের কথা বলা হয়নি, বরং পুত্র-সন্তানের কথা বলা হয়েছে। কারণ এ আয়াতে ব্যবহৃত ‘ওলাদ’ শব্দের অর্থ হল পুত্র-সন্তান। আর এ রকম অর্থ গ্রহন না করলে উপরে বর্ণিত হাদীছ গুলোর সাথে এ আয়াতের সংঘর্ষ দেখা দেয়, সমম্বয় করা যায় না।’ পান্তরে হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস, আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের রা. সহ কিছু সংখ্যক ছাহাবায়ে কেরাম ও অন্য একদল ফুকাহার মতে সন্তান পুত্র হোক অথবা কন্যা – কোন ধরণের সন্তানের উপস্থিতিতে ভাইবোন কোন উত্তরাধিকারী বলে বিবেচিত হবেন না। যেমন বর্ণিত আছে:

عَنْ عَطَاءَ اَنَّ اِبْنَ عَبَّاسٍ كاَنَ يَقُوْلُ اَلْمِيْرَاثُ لِلْوَلَدِ فَاِنْتَزَعَ اللهُ تَعَالَي مِنْهُ لِلزَّوْجِ وَالْوَالِدِ

হজরত আতা রাহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: ইবনে আব্বাস বলতেন: ‘মালের হকদার হলো সন্তানগণ। সেখান থেকে আল্লাহ পিতা-মাতা ও স্বামী-স্ত্রীদের জন্য কিছু সম্পদ ছিনিয়ে নিয়েছেন।’ (মুছান্নাফু আব্দির রাজ্জাক)৫। তিনি ‘আছাবা বিনাফসিহী’, ‘আছাবা বিগায়রিহী’ অথবা ‘আছাবা মা’আ গায়রিহী’- প্রভৃতি পরিভাষার সমর্থনে কোন বক্তব্য দেন নি। তাছাড়া তিনি ‘ওলাদ’ শব্দ দ্বারা ‘পুত্র ও কন্যা সন্তান’ বলে ব্যাখ্যা করেন। আমরা প্রথম দলের চাইতে হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. প্রমুখদের মতামতকে অধিক যুক্তিসঙ্গত ও সমর্থনযোগ্য বলে মনে করি। আমাদের নিম্নোক্ত আলোচনায় প্রমাণীত হবে যে, কন্যা সন্তানের উপস্থিতিতে ভাইবোন কোন প্রকার উত্তরাধিকারী নন।

কন্যা সন্তানদেরকে ‘যবীল ফুরূজ’ বিবেচনা করা সংক্রান্ত তাদের প্রথম দাবী নিম্নোক্ত কারণে সঠিক নয়। (১). মেয়েরা ছেলেদের মত মাওলা (আছাবা) হতে পারে বলে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন কুরআন মজীদে সুস্পষ্টভাবে ঘোষনা করেছেন। আল্লাহ বলেন: وَلِكُلٍّ جَعَلْنَا مَوَالِيَ مِمَّا تَرَكَ الْوَالِدَانِ وَاْلاَقْرَبُوْنَ “আর পিতামাতাও আত্মীয় স্বজনেরা যা কিছু ছেড়ে যাবেন তাতে (পুরুষ ও নারীর) প্রত্যেককে আমরা মাওলা বানিয়েছি।” (সূরা নিসা-৩৩)। এ আয়াতে বর্ণিত ‘মাওলা’ শব্দের অর্থ হল অবশিষ্টাংশভোগী উত্তরাধিকারী, যাকে অনেকেই ‘আছাবা’ নাম দিয়ে থাকেন। হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. কাতাদা রাহ. মুজাহিদ রাহ. ইবনু যায়েদ রাহ. সহ বড় বড় তাফসীরকারকদের এ ব্যাপারে ঐক্যমত্য দেখা যায়। (দেখুন তাফসীরে তাবারী, বাগাবী, ফাতহুল কাদীর, জালালাইন প্রভৃতি)। আর কন্যা সন্তানের উপস্থিতিতে অপর কেউ মাওলা হওয়ার অধিকারী নন। যেমন সন্তানের পরে সর্বাধিক শক্তিশালী মাওলা হলেন পিতা। এ কারণে পিতার উপস্থিতিতে ভাইবোনউত্তরাধিকারী হতে পারেন না। কিন্তু সে পিতাও কন্যা সন্তানের উপস্থিতিতে মাওলা হওয়ার অধিকারী নন।বরং তখন তিনি নির্ধারিত হিস্সাদার ‘যবীল ফুরূজ’ হিসাবে এক ষষ্টাংশ পাবেন। আল্লাহ বলেন:

وَلاَبَوَيْهِ لِكُلِّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا السُّدُسُ مِمَّا تَرَكَ اِن كَانَ لَهُ وَلَدٌ

“আর পিতামাতার প্রত্যেকে মৃত ব্যক্তি যা কিছু ছেড়ে যাবে তাতে এক ষষ্টাংশ করে পাবেন, যদি মৃতের কোন সন্তান থাকে।” (সূরা নিসা-১২)। পিতার পরে সর্বাধিক শক্তিশালী মাওলা হলেন ভাই। কন্যা সন্তানের উপস্থিতিতে সে ভাই কোন বৈধ উত্তরাধিকারী নন। আল্লাহ তা’আলা বলেন: وَهُوَ يَرِثُهَآ اِنْ لَمْ يَكُن لَهَا وَلَدٌ ‘‘এবং সে ভাইও তার মৃত বোনের উত্তরাধিকারী হবে, যদি তার (মৃত বোনের) কোন সন্তান না থাকে।” (সূরা নিসা- ১৭৬)। কারণ মেয়েরা নিজেরা মাওলা হওয়ার কারণে অপরাপর মাওলাদেরকে তারা দূরে সরিয়ে দেয়। তবে কথা হল এই যে, একজন কন্যা সন্তান একজন পুত্র সন্তানের সমান শক্তিশালী মাওলা নন। বরং দু’জন কন্যা সন্তান একত্রে একজন পুত্র সন্তানের সমান। আর একজন কন্যা সন্তান একজন পুত্র সন্তানের অর্ধেক হিস্সার অধিকারী। এ কারণেই আল্লাহ বলেছেন: لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ اْلأُنْثَيَيْنِ ‘‘প্রত্যেক পুত্র সন্তান দু’জন কন্যা সন্তানের সমান হিস্সা পাবে।” (সূরা নিসা-১১)। আল্লাহ আরোও বলেন: وَاِنْ كَانَتْ وَاحِدَةً فَلَهَا النِّصْفُ ‘‘ছেলেমেয়েদের মধ্যে যদি একজন মাত্র মেয়ে হয়, তাহলে সে পাবে অর্ধেক।” উহার অর্থ হবে وَاِنْ كَانَتْ وَاحِدَةً فَلَهَا نِصْفُ حَظِّ الذَّكَرِ অর্থাৎ ছেলেমেয়েদের মধ্যে যদি একজন মাত্র মেয়ে হয়, তাহলে সে পাবে- একজন ছেলে থাকলে সে যতটুকু পেত- তার অর্ধেক। আর দু’য়ের অধিক কন্যা সন্তান হলে তারা পাবে দু’তৃতীয়াংশ ঠিকই, কিন্তু বাকী এক তৃতীয়াংশ পাবেন পিতামাতা, যা আয়াতেই উল্লেখ আছে। উহা দ্বারা প্রকৃতপে নির্ধারিত হিস্সা বুঝায় না। তাছাড়া কন্যাগণ যদি নির্ধারিত হিস্সা ভোগ করে, তাহলে পুত্রগণও কন্যাদের সমান নির্ধারিত হিস্সা ভোগ করতে হবে। কারণ আল্লাহ বলে দিয়েছেন যে, ‘‘প্রত্যেক পুত্র সন্তান দু’জন কন্যা সন্তানের সমান হিস্সা পাবে।” দু’জন কন্যা সন্তানের অতিরিক্ত কোন হিস্সা পুত্রকে দেয়া হয়নি। আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা জরুরী, তা হল: لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ اْلأُنْثَيَيْنِ আয়াতাংশ দ্বারা মূলনীতি বর্ণণা করা হয়েছে এবং فَإِنْ كُنَّ نِسَاءً فَوْقَ اثْنَتَيْنِ فَلَهُنَّ ثُلُثَا مَا تَرَكَ আয়াতাংশ দ্বারা পূর্বের আয়াতাংশের ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এ কারণে ব্যাখ্যা অংশের শুরুতে فَ বর্ণটি প্রয়োগ করা হয়েছে, যাকে ব্যাখ্যাদানকারী বর্ণ বা اَلْفَاءُ لِلتَّفْسِيْرِ বলা হয়। সুতরাং আয়াতের এ অংশ দিয়ে নতুন কোন মূলনীতি নির্ধারিত হবে না বরং পূর্বের আয়াতাংশের বিশ্লেষণ ও তাফসীর হবে। এ কারণেই ব্যাখ্যা অংশে দু’জন কন্যার হিস্সার কথা বলা হয়নি। কারণ ‘‘প্রত্যেক পুত্র সন্তান দু’জন কন্যা সন্তানের সমান হিস্সা পাবে”- বলার মাধ্যমে দু’জন কন্যার হিস্সার কথা বর্ণিত হয়েছে। আর আইনের আলোচনাকালে সর্বাবস্থায় মূলনীতি ব্যাখ্যার চাইতে শক্তিশালী অবস্থানে থাকে। ব্যাখ্যা অংশ দিয়ে মূলনীতিকে পরিবর্তন করা যায় না। (২). হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. বর্ণিত হাদীছের সঠিক অনুবাদ হবে - ‘তোমরা উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সম্পদ বন্টন কর আল্লাহর কিতাব মোতাবেক। যে সম্পদ অবশিষ্ট থেকে যাবে, তা পাবে সর্বাধিক হকদার পুরুষ লোক।’ কারণ ‘আওলা’ শব্দের অর্থ হল সর্বাধিক হকদার, ‘ঘনিষ্ঠতর’ নয়। আর সর্বাধিক হকদার পুরুষ লোক হল পুত্র-সন্তান। দূরবর্তী পুরুষ মাওলা বা আছাবাগণ কখনোই সর্বাধিক হকদার নন। তাছাড়া এ হাদীছটি ‘খবরে ওয়াহিদ’ (একমাত্র বর্ণণাকারী কর্তৃক বর্ণিত) হওয়ার কারণে এবং স্বয়ং বর্ণণাকারী ছাহাবী ভিন্ন মতামত ব্যক্ত করার কারণে উহা আমল করার উপযোগী নয়। কারণ স্বয়ং আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. তার নিজের বর্ণিত হাদীছখানা থাকা সত্বেও কন্যাদেরকে অবশিষ্টাংশভোগী মাওলা (আছাবা) উত্তরাধিকারী বলে মনে করেন। (৩). কুরআনে মূলত অবশিষ্ট অংশের কথা বলা হয়েছে। আর হজরত জাবির রা. এবং হুযাইল বিন শুরাহবীল রাহ. বর্ণিত হাদীছগুলো সহ যেসব হাদীছে রাসূলুল্লাহ ছা. মেয়েদের সাথে ভাইবোনদেরকে অংশ দিয়েছেন বলে বর্ণিত হয়েছে, তা উহুদ যুদ্ধের পরের ঘটনা। তখনও ভাইবোনদের হিস্সা বর্ণনা করে কালালা সংক্রান্ত সূরা নিসার ১৭৬ নং আয়াত অবতীর্ণ হয়নি। তখন তো রাসূলুল্লাহ ছা. শুধু ভাইবোনকে নয় বরং মুক্তিদাতা মুনিব ও মুক্তিপ্রাপ্ত ক্রীতদাসকেও দিয়েছেন। যেমন বর্ণিত আছে:

عَنْ اِبْنِ عَبَّاسٍ اَنَّ مَوْلًي لِحَمْزَةَ تُوُفِّيَ فَتَرَكَ اِبْنَتَهُ وَاِبْنَةََ حَمْزَةَ فَاَعْطَي النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اِبْنَتَهُ النِّصْفَ وَلِاِبْنَةِ حَمْزَةَ النِّصْفَ

‘হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: ‘হামজা রা. এর একজন মুক্তিপ্রাপ্ত ক্রীতদাস ছিল। সে তার একমাত্র মেয়ে ও মুনিব-হামজা রা. এর মেয়েকে রেখে মারা গেলে রাসূলুল্লাহ ছা. তার পরিত্যক্ত সম্পদের অর্ধেক তার মেয়েকে দেন ও বাকী অর্ধেক দেন হামজা রা. এর মেয়েকে।’ (সুনানু দার কুথনী)৬। আর এ কথা সর্বজন বিদিত যে, হজরত হামজা রা. উহুদ যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন। তার কোন পুত্র সন্তান ছিল না; ফাতেমা নামীয় তার একজন মাত্র কন্যা ছিলেন। এজন্য তিনি একজন ক্রীতদাসকে পালকপুত্র হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। সূরা নিসার ১৭৬ নং আয়াত নাযিলের পূর্বে রাসূলুল্লাহ ছা. সে ফাতেমাসহ অনেককেই উত্তরাধিকারের সম্পদে হিস্সা দিয়েছিলেন। কিন্তু সূরা নিসার ১৭৬ নং আয়াত নাযিলের পরে তিনি ভাইবোনসহ কোন আছাবাকে কিছুই দেন নি। কারণ এ আয়াত সবশেষে নাযিল হয়েছিল। যেমন বর্ণিত আছে:

عَنِ الْبَرَاءِ قَالَ آخِرُ آيَةٍ أُنْزِلَتْ مِنَ الْقُرْآنِ يَسْتَفْتُوْنَكَ قُلِ اللهُ يُفْتِيْكُمْ فِيْ الْكَلاَلَةِ

হজরত বারা রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: ‘সর্বশেষ কুরআনের যে আয়াত নাযিল হয় তা হল- يَسْتَفْتُوْنَكَ قُلِ اللهُ يُفْتِيْكُمْ فِيْ الْكَلاَلَةِ - অর্থাৎ সূরা নিসার এই ১৭৬ নং আয়াত।’ (মুসলিম, বুখারী)৭। আর সর্বশেষ বিধানের মাধ্যমে মহানবী ছা. এর পূর্বে দেয়া সকল নির্দেশনা রহিত হয়ে গিয়েছে।

ঘ. (১). হজরত হুযাইল বিন শুরাহবীল রাহ. বর্ণিত হাদীছে মহানবী ছা. এর আমলের বিবরণ রয়েছে বটে কিন্তু মৌখিক কোন নির্দেশনা নেই। উহা সর্বশেষ নাযিলকৃত আয়াত দ্বারা রহিত হয়েছে। তাছাড়া অপর একটি হাদীছ থেকে জানা যায় যে, কন্যা সন্তানের উপস্থিতিতে ভাইবোন অথবা ভ্রাতষ্পুত্রগণ উত্তরাধিকারী নন। যেমন বর্ণিত হয়েছে:

عَنْ عَامِرِ بْنِ سَعْدِ بْنِ اَبِيْ وَقَاصٍ عَنْ اَبِيْهِ قَالَ مَرِضْتُ بِمَكَّةَ مَرَضًا اَشْفَيْتُ مِنْهُ عَليَ الْمَوْتِ فَاتَانِي النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَعُوْدُنِي فَقُلْتُ يَا رَسُوْلَ اللهِ اِنَّ لِيْ مَالاً كَثِيْرًا وَلَيْسَ يَرِثُنِيْ اِلاَّ اِبْنَتِيْ اَفَاَتَصَدَّقُ بِثُلُثَيْ مَالِيْ فَقَالَ لاَ قُلْتُ فَالشَّطْرُ قَالَ لاَ قُلْتُ فَالثُّلُثُِ قَالَ الثُّلُثُِ كَثِيْرٌ اِنْ تَرَكْتَ وَلَدَكَ أَغْنِيَاءَ خَيْرٌ مِنْ اَنْ تَتْرُكَهُمْ عَالَّةً يَتَكَفَّفُوْنَ النَّاسَ

‘হজরত আমির বিন সা’দ বিন আবী ওকাছ রাহ. থেকে বর্ণিত, তিনি তার পিতা থেকে বর্ণণা করেন। তিনি বলেন: ‘আমি মক্কায় এমন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লাম যে আমি মরে যাব বলে আশংকা করছিলাম। রাসূলুল্লাহ ছা. আমাকে দেখতে আসলেন। আমি তাঁকে জিঙ্গাসা করলাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল, আমার অনেক সম্পদ রয়েছে। আর একজন মাত্র কন্যা ছাড়া আমার অপর কেন উত্তরাধিকারী নেই; আমি কি দু’তৃতীয়াংশ সম্পদ দান করতে পারি ? তিনি বললেন: ‘না’, আমি বললাম, তাহলে অর্ধেক ? তিনি বললেন: ‘না’, আমি বললাম, তাহলে এক তৃতীয়াংশ, তিনি বললেন: ‘এক তৃতীয়াংশই তো বেশী। তোমার সন্তানকে সম্পদশালী রেখে যাওয়া অধিক উত্তম তাদেরকে এমন অভাবগ্রস্থ রেখে যাওয়ার চেয়ে যে তারা অন্যের কাছে হাত পেতে বেড়াবে।’ (বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, ইবনু মাজাহ, তিরমিযী, নাসায়ি, মুসনাদু আহমাদ, মুয়াত্তা মালিক)৮। উল্লেখ্য যে, যখন হজরত সা’দ বিন আবী ওকাছ রা. এ মন্তব্য করেন, তখন তার ভাইবোন, ভ্রাতষ্পুত্রগণ এবং অন্যান্য পুরুষ আছাবাগণ জীবিত ছিলেন। কথিত আছাবাগণ কন্যা সন্তানের উপস্থিতিতে উত্তরাধিকারী গণ্য হলে রাসূলুল্লাহ ছা. তখন নিশ্চয়ই বলতেন: ‘কেন তোমার তো ভাইবোন, ভ্রতষ্পুত্রগণ এবং অন্যান্য পুরুষ আছাবাগণ রয়েছেন?’ কারণ রাসূলুল্লাহ ছা. এর নিজ কুরাইশ গোত্রের এ লোকেরা তার পূর্বপরিচিত ছিলেন। ‘আমির’ নামে তার এক ভাই ছিলেন। যেমন বর্ণিত আছে:

وَهُوَ عَامِرٌ بْنُ أَبِيْ وَقَاصٍ وَاِسْمُ أَبِيْ وَقَاصٍ مَالِكٌ أَسْلَمَ بَعْدَ عَشَرَةِ رِجَالٍ وَهُوَ مِنْ مُهَاجِرَةِ الْحَبْشَةِ وَلَمْ يُهَاجِرْ إِلَيْهَا أَخُوْهُ سَعْدٌ.

তিনি হলেন আমির বিন আবী ওকাছ রা.। আর আবু ওকাছের নাম ছিল মালিক। তিনি দশজন পুরুষলোক ইসলাম গ্রহণের পরে ইসলাম গ্রহণ করেন। আবিসিনিয়ায় হিজরাতকারী লোকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন তিনি কিন্তু তার ভাই হজরত সা’দ ওখানে হিজরাত করেন নি। (উসদুল গাবাহ)৯। এ ছাহাবী উমার রা. এর খেলাফতকালে সিরিয়ায় ইন্তেকাল করেন। যেমন উল্লেখ আছে:

وَقَالَ الْبَلَاذُرِيْ هَاجَرَ عَامِرٌ اَلْهِجْرَةَ الثَّانِيَةِ إِلَى الْحَبْشَةِ وَقَدِمَ مَعَ جَعْفَرَ وَمَاتَ بِالشَّامِ فِيْ خِلَافَةِ عُمَرَ.

আর আল্লামা বালাজুরী রাহ. বলেন: ‘আমির’ দ্বিতীয় দলের সাথে আবিসিনিয়ায় হিজরাত করেন এবং ‘জা’ফর’ রা. এর সাথে (মদীনায়) প্রত্যাবর্তন করেন। আর উমার রা. এর খেলাফতকালে সিরিয়ায় ইন্তেকাল করেন। (আল ইছাবা ফী তাময়ীযিছ ছাহাবা)১০।

হজরত সা’দ রা. এর ‘আতেকা’ নাম্নি একজন বোন ছিলেন বলে জানা যায়। যেমন বর্ণিত আছে:

حَدَّثَتْنِيْ عَاتِكَةُ بِنْتُ أَبِيْ وَقَاصٍ أُخْتُ سَعْدٍ قَالَتْ جِئْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَمَّا دَخَلَ مَكَّةَ فِيْ ثَمَانِ نِسْوَةٍ وَمَعِيَ اِبْنَايَ فَقُلْتُ هَذَانِ اِبْنَا عَمِّكَ وَاِبْنَا خَالَتِكَ فَأَخَذَ أَحَدَهُمَا عَمْرَو بْنَ عُتْبَةِ بْنِ نَوْفَلَ وَكَانَ اَصْغَرَهُمَا فَوَضَعَهُ فِيْ حِجْرِهِ

সা’দ রা. এর বোন ‘আতেকা’ বিনতু আবী ওকাছ রা. হাদীছ বর্ণণা করেন। তিনি বলেন: ‘রাসূলুল্লাহ ছা. মক্কায় প্রবেশের পরে আমি আটজন নারীর সঙ্গে তার কাছে আমার দু’জন পুত্রকে নিয়ে এসে বললাম, এ দু’জন আপনার চাচার দু’পুত্র আর আপনার দু’খালাত ভাই। তখন তিনি তাদের একজন আমর বিন উতবা বিন নাওফালকে ধরে তার কোলে বসালেন। আর সে ছিল দু’জনের মধ্যে কনিষ্ঠ।’ (আল ইছাবা ফী তাময়ীযিছ ছাহাবা)১১।

নাফে’ বিন উতবা নামের তার একজন ভ্রাতস্পুত্রও ছিলেন। যেমন বর্ণিত আছে:

نَافِعٌ بْنُ عُتْبَةَ بْنِ أَبِيْ وَقَاصٍ اَلزُّهْرِيْ وَهُوَ اِبْنُ أَخِيْ سَعْدِ بْنِ أَبِيْ وَقَاصٍ وَهُوَ أَخُوْ هَاشِمٍ الْمِرْقَالِ لَهُ صُحْبَةٌ وَأَبُوْهُ عُتْبَةُ هُوَ الَّذِيْ كَسَرَ رُبَاعِيَّةَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَوْمَ أُحُدٍ وَمَاتَ عُتْبَةُ كَافِرًا قَبْلَ فَتْحِ مَكَّةَ وَأَوْصَى إِلَى أَخِيْهِ سَعْدٍ ثُمَّ أَسْلَمَ نَافِعٌ يَوْمَ فَتْحِ مَكَّةَ .

যুহরী উপগোত্রের নাফে’ বিন উতবা বিন আবী ওকাছ রা.। তিনি সা’দ বিন আবী ওকাছ রা. এর ভ্রাতষ্পুত্র ছিলেন। তিনি হাশিম আল মিরকালের ভাই ছিলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ ছা. এর সান্যিদ্ধ লাভে ধন্য ছিলেন। উহুদ যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ ছা. এর সামনের চার দাত ভাঙ্ঘার অপকর্মকারী উতবা ছিল তার পিতা। আর উতবা মক্কা বিজয়ের পূর্বে তার ভাই সা’দ রা. এর নিকট ওছিয়াত করে মৃত্যু বরণ করে। অত:পর এই নাফে’ রা. মক্কা বিজয়ের দিন ইসলাম গ্রহণ করেন। (উসদুল গাবাহ)১২।

হযরত সা’দ বিন আবী ওকাছ রা. এর আরেকজন ভ্রাতস্পুত্র ছিলেন হাশিম নামে। যেমন বর্ণিত আছে:

حَّدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ عُمَرَ قَالَ : وَ أَمَّا هَاشِمُ الْأَعْوَرُ فَإِنَّهُ اِبْنُ عُتْبَةَ بْنِ أَبِيْ وَقَاصٍ : أَسْلَمَ يَوْمَ فَتْحِ مَكَّةَ وَ كَانَ أَعْوَرَ فُقِئَتْ عَيْنُهُ يَوْمَ الْيَرْمُوْكِ وَ هُوَ اِبْنُ أَخِيْ سَعْدِ بْنِ أَبِيْ وَقَاصٍ شَهِدَ صِفِّيْنَ مَعَ عَلِيِّ بْنِ أَبِيْ طَالِبٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ وَ كَانَ يَوْمَئِذٍ عَلَى الرَّجَّالَةِ

‘মুহাম্মাদ বিন উমার রাহ. বলেন: এক চোখ অন্ধ হাশিম ছিলেন উতবা বিন আবী ওকাছ এর পুত্র। তিনি মক্কা বিজয়ের দিন ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন এক চোখ কানা; ইয়ারমোকের যুদ্ধে তার একটি চোখ নষ্ট হয়ে যায়। তিনি ছিলেন সা’দ বিন আবী ওকাছ রা. এর ভ্রতষ্পুত্র। তিনি আলী বিন আবী তালিব রা. এর সাথে ছিফ্ফীনের যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে শাহাদাত বরণ করেন। সেদিন তিনি পদাতিক বাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন। (আল মুসতাদাক)১৩।

অপর একটি বর্ণণা মোতাবেক জানা যায় যে, হজরত আব্দুর রহমান বিন আওফ রা. তাঁর গোত্রের অন্তর্ভূক্ত তাঁর জ্ঞাতি ভাই ছিলেন। যেমন বর্ণিত হয়েছে:

عَنْ عُرْوَةَ فِيْمَنْ شَهِدَ بَدْرًا مَعَ رَسُوْلِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنْ بَنِىْ زُهْرَةَ بْنِ كِلاَبِ بْنِ مُرَّةَ : عَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنُ عَوْفِ بْنِ عَبْدِ عَوْفِ بْنِ الْحَارِثِ بْنِ زُهْرَةَ وَسَعْدُ بْنُ أَبِىْ وَقَّاصِ بْنِ وَهْبِ بْنِ عَبْدِ مَنَافِ بْنِ زُهْرَةَ.

হজরত উরওয়া রাহ. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: ‘বনী যুহরা বিন কেলাব বিন মুররা’- গোত্রের অন্তর্ভূক্ত যারা রাসূলুল্লাহ ছা. এর সঙ্গে বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন, তারা হলেন- আব্দুর রহমান বিন আওফ বিন আব্দে আওফ বিন হারিছ বিন যুহরা রা. এবং সা’দ বিন আবী ওকাছ বিন ওহাব বিন আব্দে মনাফ বিন যুহরা রা.। (বায়হাকী কুবরা)১৪। এ বর্ণণা থেকে জানা যায় যে, হজরত আব্দুর রহমান বিন আওফ রা. হজরত সা’দ বিন আবী ওকাছ রা. এর জ্ঞাতি ভাই ছিলেন। তাঁর দাদার দাদা যিনি ছিলেন তার নাম ছিল যুহরা এবং আব্দুর রহমান বিন আওফ রা. এর দাদার দাদাও ছিলেন একই যুহরা। যদি আছাবাদের কোন হিস্সা থাকত, তাহলে এ আব্দুর রহমান বিন আওফ রা. আছাবা হিসাবে উত্তরাধিকার পেতেন। তখন হজরত সা’দ বিন আবী ওকাছ রা. একথা বলতেন না যে, وَلَيْسَ يَرِثُنِيْ اِلاَّ اِبْنَتِيْ “আর একজন মাত্র কন্যা ছাড়া আমার অপর কেউ উত্তরাধিকারী হওয়ার নেই”, আর তিনি বললেও রাসূলুল্লাহ ছা. প্রতিবাদ করতেন। কিন্তু বাস্তবে কেউই একথাটি বলেন নি।

আর সিরাজীর উল্লেখিত اِجْعَلُوا الْاَخَوَاتِ مَعَ الْبَنَاتِ عَصَبَةً ‘তোমরা মেয়েদের সাথে বোনদেরকে আছাবা বানাও’- বক্তব্যটি হাদীছের নামে একটি জালিয়াতি। মহানবী ছা. কখনোই এরকম কোনকিছু বলেন নি। এ কারণে কথিত এ হাদীছের বর্ণণাকারী ছাহাবী ও সনদের কোন বিবরণ কেউ জানে না। (দেখুন: রাদ্দুল মুহ্তার, হাশিয়াতু ইবনি আবিদীন)১৫। (২). স্বয়ং রাসূলুল্লাহ ছা. একজন কন্যাকে উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পূর্ণ সম্পদ দান করে নজির স্থাপন করেছেন। আর ইমাম নাসায়ী এ নজীরকে আমলে নিয়ে তাঁর কিতাবে শিরোনাম দিয়েছেন ‘মীরাসুল ইবনাতিল ওয়াহিদাতিল মুনফারিদাহ’ বা ‘শুধুমাত্র একজর কন্যার উত্তরাধিকার’ বলে। যেমন বর্ণিত হয়েছে:

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ بُرَيْدَةَ عَنْ أَبِيْهِ بُرَيْدَةَ أَنَّ امْرَأَةً أَتَتْ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَتْ كُنْتُ تَصَدَّقْتُ عَلَى أُمِّى بِوَلِيْدَةٍ وَإِنَّهَا مَاتَتْ وَتَرَكَتْ تِلْكَ الْوَلِيْدَةَ. قَالَ قَدْ وَجَبَ أَجْرُكِ وَرَجَعَتْ إِلَيْكِ فِى الْمِيْرَاثِ .

হজরত আব্দুল্লাহ বিন বুরাইদাহ রাহ. তাঁর পিতা বুরাইদা রা. থেকে বর্ণণা করে বলেন যে, এক মহিলা রাসূলুল্লাহ ছা. এর নিকটে আগমন করে বললেন: ‘আমি আমার মাতাকে একজন ক্রীতদাসী দান করেছিলাম। আর তিনি ঐ দাসীকে রেখে ইন্তেকাল করেছেন।’ রাসূলুল্লাহ ছা. বললেন: ‘তোমার ছওয়াব পাওয়া হয়ে গেছে আর উত্তরাধিকার সূত্রে সে ক্রীতদাসী তোমার কাছে ফেরত চলে এসেছে।’ (আবু দাঊদ, মুসলিম, মুসনাদু আহমাদ, মুসতাদরাক, ইবনু আবী শায়বা, বায়হাকী কুবরা, নাসায়ী কুবরা)১৬। কেউ কেউ হয়ত এ মর্মে প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারেন যে, সে ক্রীতদাসী তার অনুদানকৃত ছিল। কিন্তু সে যুক্তি এ কারণে টিকবে না যে, স্বত্ব ত্যাগ করে দান করলে ও দানের সম্পদ হস্তান্তরিত হলে, তা অনুদান গ্রহণকারীর পূর্ণ মালিকানাধীন নিজস্ব সম্পদ বলে গণ্য হয়। দাতার তাতে কোন অধিকার থাকে না। এ কারণে রাসূলুল্লাহ ছা. বলেছেন: وَرَجَعَتْ إِلَيْكِ فِى الْمِيْرَاثِ ‘আর উত্তরাধিকার সূত্রে সে ক্রীতদাসী তোমার কাছে ফেরত চলে এসেছে।’ অর্থাৎ উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পূর্ণ সম্পদ একজন কন্যা সন্তান পেতে পারে। আর তখন রাসূলুল্লাহ ছা. কথিত আছাবাদেরকে অস্বীকার করে একজন কন্যাকে সম্পূর্ণ সম্পদ দিয়ে দিলেন। (৩). তৎকালিন আরব সমাজে প্রচলিত ও জনপ্রিয় ‘আছাবা’ প্রথাকে উৎখাত করে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন উত্তরাধিকারে নারীকে হিস্সা দিয়েছিলেন। সমস্তরের পুরুষ উত্তরাধিকারীর সাথে মিলিত হলে নারী ‘আছাবা বিগায়রিহী’ হবে, অন্যথায় আছাবা হতে পারবে না; আর কন্যার সাথে মিলিত হলে বোন ‘আছাবা মা’আ গায়রিহী’ হবে- এসব কথা একান্তই কিছু মনিষীর ব্যক্তিগত অনুমান- আল্লাহ প্রদত্ত নয়, রাসূলুল্লাহ ছা. বর্ণিতও নয়। বরং আছাবাগিরীর বিরোদ্ধে রাসূহুল্লাহ ছা. কঠোর মন্তব্য করেছেন। যেমন বর্ণিত আছে:

عَنْ جُبَيْرِ بْنِ مُطْعِمٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَيْسَ مِنَّا مَنْ دَعَي اِلَي عَصَبِيَّةٍ وَلَيْسَ مِنَّا مَنْ قَاتَلَ عَلَي عَصَبِيَّةٍ وَلَيْسَ مِنَّا مَنْ مَاتَ عَلَي عَصَبِيَّةٍ

হজরত যুবায়ের বিন মুত্ইম রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ ছা. বলেছেন: ‘যে আছবিয়্যাতের দিকে আহবান করে সে আমার উম্মাতের মধ্যে শামিল নয়। আর যে আছবিয়্যাতের কারণে যুদ্ধ করে, সে আমার উম্মাতের মধ্যে শামিল নয় এবং যে আছবিয়্যাতের জন্য নিহত হয় সেও আমার উম্মাতের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত নয়।’ (আবু দাউদ, বাগাবী- শারহুস সুন্নাহ)১৭। এ কারণে আমরা এ আছাবা পরিভাষা ও উহার শ্রেণীবিন্যাসের সাথে একমত নই। প্রকৃতপে কিছু ভুল ব্যাখ্যা ও নকল হাদীছের ভিত্তিতে এ শ্রেণীবিন্যাসের থিওরী গড়ে উঠেছে বলে আমরা মনে করি। (৪). কন্যাদেরকে মাওলা উত্তরাধিকারী মেনে নিয়ে অবশিষ্ট সম্পদ দেয়ার স্বপে মতামত না দিয়ে তাদেরকে নির্ধারিত হারে -একজনের জন্য অর্ধেক ও একাধিকের জন্য দু’তৃতীয়াংশ হিসাবে- হিস্সা দিলে হিসাবে গরমিল দেখা দেয়। যাকে ইলমুল ফারাইজে ‘আওল’ বলা হয়। যে আওলের কারণে কুরআনের ফারাইজ সংক্রান্ত সকল নির্দেশনা লঙ্ঘনের ঝুঁকি সৃষ্টি হয়। যা আমরা সমস্যা নং- ৩ এবং সমস্যা নং- ৬ এ দেখিয়েছি। কিন্তু হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. এর মতবাদের আলোকে কন্যাদেরকে অনির্ধারিত অবশিষ্টাংভোগী মাওলা গণ্য করে হিস্সা দিলে হিসাবে কোন গরমিল হবে না। যাও আমরা সমস্যা নং- ৪ এবং সমস্যা নং- ৭ এ দেখিয়েছি।

ঙ. সূরা নিসার ১৭৬ নং আয়াতই প্রকৃতপে আছাবা সংক্রান্ত থিওরীর ত্র”টি নির্দেকশ। এ আয়াতে ‘ওলাদ’ বলতে শুধুমাত্র ‘পুত্র-সন্তান’ বুঝায়- এমন দাবী একটি হাস্যকর দাবী। কারণ রাসূলুল্লাহ ছা. এমন কথা বলে যান নি, এমন কি কোন ছাহাবীই এমন ধরণের ব্যাখ্যাও করেন নি। অর্থাৎ এ রকম ব্যাখ্যার স্বপে কোন দলীল নেই। আরবী অভিধান, ভাষার ব্যবহার ও কুরআনে ব্যবহৃত ওলাদ শব্দের ব্যাখ্যা গুলোকে বিবেচনা করলে একথা দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ওলাদ অর্থ হল সন্তান। গাণিতিক বিশ্লেষণেও প্রমাণীত হয় যে, কন্যা সন্তানের উপস্থিতিতে ভাইবোন কোন হিস্সার অধিকারী নন। এ সমাধান ‘ওলাদ’ শব্দের অর্থ বুঝতেও সাহায্য করে। যেমন নিম্নোক্ত সমস্যার সমাধানে দেখুন:

সমস্যা নং- ১১. যদি কোন নারী তার স্বামী, ভাই ও একজন কন্যা সন্তান রেখে মৃত্যু বরণ করে, তাহলে তার সমাধান। [ফকীহদের মতানুসারে] :

সমাধান: ফকীহদের মতে তখন স্বামী পাবে ১/৪ অংশ, কন্যার সংখ্যা একজন হলে, তাদের মতানুসারে, সে পায় ১/২ অংশ। কারণ তারা কন্যাদেরকে যবীল ফুরূজ বলে বিবেচনা করেন। আর ভাই পাবে অবশিষ্ট ১/৪ অংশ। কারণ তারা ভাইকে ‘আছাবা’ গণ্য করে অবশিষ্ট অংশের অধিকারী বলে দাবী করেন এবং কন্যা সন্তানের সাথে সেও আছাবা হিসাবে হিস্সাদার বলে মনে করেন। এ কারণে ভাই একজন হোক অথবা একাধিক, কন্যা সন্তানের সাথে সে বা তারা অবশিষ্ট হিস্সা পাবে বলে তারা ঘোষনা করেন। এ হিসাবে ভাই একজন অথবা একাধিক হলে তারা অবশিষ্ট ১/৪ অংশ পাবে। মনে করি মোট সম্পদের পরিমাণ ৬,০০,০০০ টাকা। তাদের মতে তখন স্বামী পাবে ১,৫০,০০০ টাকা, কন্যা পাবে ৩,০০,০০০ টাকা এবং ভাই পাবে অবশিষ্ট ১,৫০,০০০ টাকা।

কিন্তু তাদের এ সমাধান সঠিক ও যুক্তিভিত্তিক নয়। যদি কন্যা সন্তানকে ‘ওলাদ’ বলে স্বীকার করা হয়, তাহলে স্বামীকে এক চতুর্থাংশ দেয়া সঠিক আছে কিন্তু ভাইকে কোন হিস্সা দেয়া সঠিক নয়। কারণ আল্লাহ তা’আলা বলেছেন: وَهُوَ يَرِثُهَآ اِنْ لَمْ يَكُنْ لَّهَا وَلَدٌ ‘‘এবং সে ভাইও তার মৃত বোনের উত্তরাধিকারী হবে, যদি তার (মৃত বোনের) কোন ‘ওলাদ’ (সন্তান) না থাকে।” (সূরা নিসা- ১৭৬)। যেহেতু কন্যাকে ‘ওলাদ’ বা সন্তান বলে স্বীকার করা হয়েছে, সুতরাং সে ‘ওলাদ’ বা সন্তানের উপস্থিতিতে ভাই কিছুই পেতে পারে না। আর যদি কন্যা সন্তানকে ‘ওলাদ’ বলে স্বীকার করা না হয়, তাহলে স্বামীকে মোট সম্পদের অর্ধেক হিস্সা দিতে হবে। কারণ আল্লাহ বলেছেন:

وَلَكُمْ نِصْفُ مَا تَرَكَ اَزْوَاجُكُمْ اِنْ لَمْ يَكُنْ لَهُنَّ وَلَدٌ فَاِنْ كَانَ لَهُنَّ وَلَدٌ فَلَكُمُ الرُّبُعُ مِمَّا تَرَكْنَ

“তোমাদের জন্য অর্ধাংশ বরাদ্দ থাকবে যা কিছু তোমাদের স্ত্রীগণ রেখে মারা যাবে তাতে, যদি তাদের কোন ‘ওলাদ’ (সন্তান) না থাকে। তবে যদি তাদের কোন ‘ওলাদ’ (সন্তান) থাকে, তাহলে তোমরা এক চতুর্থাংশ পাবে যা কিছু তারা ছেড়ে যাবে তাতে।” (সূরা নিসা -১২)। এ আয়াতে বলা হয়েছে যে, ‘ওলাদ’ বা সন্তান না থাকলে স্বামী পাবে সম্পদের অর্ধেক। কন্যা সন্তানকে যদি ‘ওলাদ’ বলে স্বীকার করা না হয়, তাহেল স্বামীকে অর্ধেক দিতে হবে। তা কুরআনের নির্দেশ। তখন স্বামী পাবে অর্ধেক আর কন্যা সন্তান তো তাদের মতানুসারে একজন হলে অর্ধেক পায়, সুতরাং বাকী অর্ধেক কন্যা নেবে। ভাইর জন্য কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।

প্রকৃত পে উপরোক্ত মাসআলার সঠিক সমাধান নিম্নরূপ:

সমস্যা নং- ১২. যদি কোন নারী তার স্বামী, ভাই ও একজন কন্যা সন্তান রেখে মৃত্যু বরণ করে, তাহলে তার সমাধান। [হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. এর মতানুসারে] :

সমাধান: উপরোক্ত মাস্আলার ক্ষেত্রে হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. এর মতানুসারে সমাধান করলে এভাবে করতে হবে: সন্তান থাকলে স্বামী এক চতুর্থাংশ পান, তাই তাকে ১/৪ অংশ দেয়া হবে। কন্যার সংখ্যা একজন হলে, সে পায় অবশিষ্ট অংশের ১/২ অংশ। তাই তাকে অবশিষ্ট হিস্সার ১/২ অংশ দেয়া হবে। কারণ কন্যা সন্তানও মাওলা (আছাবা) বলে পরিগণিত। আর ভাই কোন ধরণের সন্তানের উপস্থিতিতে হিস্সাদার নন। এজন্য তিনি কিছুই পাবেন না। সেজন্য অবশিষ্ট বেঁচে যাওয়া সম্পদ স্বামী ও কন্যা পুনর্বার রদ্দ আকারে পাবে। এ হিসাবে টাকার অংকে স্বামী পাবে ২,৪০,০০০ টাকা। আর কন্যা পাবে ৩,৬০,০০০ টাকা। মোটকথা কন্যা সন্তানকে ‘ওলাদ’ মানলে ভাই কিছুই পায় না। আর কে না জানে যে, কন্যা সন্তানও ‘ওলাদ’ বা ‘আওলাদের’ অন্তর্ভুক্ত। প্রকৃতপে ‘ওলাদ’ বা সন্তান বলতে কাকে বুঝায় তা স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা ব্যাখ্যা করে বলেছেন। আল্লাহ বলেন: يُوْصِيْكُمُ اللهُ فِيْ اَوْلاَدِكُمْ لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ اْلأُنْثَيَيْنِ “তোমাদের সন্তানদের ব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশনা হল এই যে, একজন পুত্র, দুইজন কন্যার সমান হিস্সা পাবে।” (সূরা নিসা-১১)। এখানে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন কৌশলে বলে দিলেন যে, ‘ওলাদ’ বা ‘আওলাদ’ হল ‘ছেলে মেয়ের মিলিত রূপ’। এখন কেউ যদি ‘ওলাদ’ বলতে ‘ইবিন’ বা পুত্র সন্তান বলে দাবী করতে চান, তাহলে তা তার ব্যক্তিগত মতামত ও ভিত্তিহীন দাবী বলে পরিগণিত হবে। কুরআন হাদীছের সমর্থন সে মতের অনুকুলে থাকবে না। সুতরাং তাদের এ রকম দাবী কুরআনের এ আয়াত নাকচ করে দেয়। যে আয়াতের মাধ্যমে ভাইবোনের উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়, সে আয়াতই কন্যা সন্তানের উপস্থিতিতে ভাইবোনের উত্তরাধিকার অস্বীকার করে।

চ. ভাইবোনদের উত্তরাধিকার শর্তহীন নয়। অন্য কথায়- ভ্রাতাভগ্নিগণ স্বয়ংসম্পূর্ণ কোন উত্তরাধিকারী নন। তাদের উত্তরাধিকারী হওয়ার শর্তটিও আবার এমন নয় যে, ‘যবীল ফুরূজ’ উত্তরাধিকারীগণ তাদের নির্ধারিত হিস্সা নেয়ার পরে যা কিছু অবশিষ্ট থাকবে সে অবশিষ্টাংশ ভ্রাতাভগ্নিগণ পাবেন’। বরং শর্তটি হল: ‘যদি কোন সন্তান বর্তমান না থাকে, তাহলেই কেবল ভ্রাতাভগ্নিগণ উত্তরাধিকারী হবেন’। এ শর্তটির মানে হল- উত্তরাধিকারী বিবেচিত হওয়ার পূর্বশর্ত হল মৃতের কোন সন্তান না থাকা। সুতরাং কন্যা সন্তানের বর্তমানে ভ্রাতাভগ্নিগণ ইসলাম সম্মত কোন বৈধ- উত্তরাধিকারী বিবেচিত হবেন না।

তথ্যসূত্র:

১. মুসলিম-৪২২৮, বাবু আলহিকুল ফারাইজা বিআহলিহা; আবু দাউদ-২৯০০, বাবুন ফী মীরাছিল আছাবা; ইবনু মাজাহ-২৭৪০, বাবু মীরাছিল আছাবা; মুসনাদু আহমাদ-২৮৬০, পৃ-৫৩, ভ-৫।

২. তিরমিযী-২০৯২ কিতাবুল ফারাইজ; ইবনু মাজাহ-২৭২০ কিতাবুল ফারাইজ; আল মুসতাদরাক-৭৯৫৪, কিতাবুল ফারাইজ; আবু দাউদ-২৮৯৩, বাবু মা জাআ ফী মীরাছিছ ছুলব।

৩. বুখারী-৬৩৫৫, কিতাবুল ফারাইজ বাবু মীরাছী ইবনাতি ইবনিন মাআ ইবনাতিন; তিরমিযী- ২০৯৩ কিতাবুল ফারাইজ, বাবু মীরাছী ইবনাতিল ইবনি মাআ ইবনাতিছ ছুলব; আবু দাউদ- ২৮৯২, বাবু মা জাআ ফী মীরাছিছ ছুলব; ইবনু মাজাহ -২৭২১, কিতাবুল ফারাইজ; আল মুসতাদরাক-৭৯৫৮, কিতাবুল ফারাইজ; মুসনাদু আহমাদ-৩৬৯১, পৃ-২১৮, ভ-৬।

৪. সিরাজী-৩১ (কানপুর প্রেস, লক্ষৌ); আলবাহরুও রায়ীক পৃ-৫৬৬, ভ-৮; তাবয়ীনুল হাকায়িক বাবুল খুলয়ি র্প-২৩৬, ভ-৬; মাজমাউল আনহর ফী শারহে মুলতাকাল আবহর পৃ-৫০৬, ভ-৮; আল মাওসূআতুল ফেকহিয়্যাহ আল কুয়েতিয়্যাহ পৃ-৮০, ভ-৩; ফেকহুস সুন্নাহ-৬১৯, ভ-৩।

৫. মুছান্নাফু আব্দির রাজ্জাক - ১৯০৩০, কিতাবুল ফারাইজ।

৬. সুনানু দার কুথনী-৫১, কিতাবুল ফারাইজ ওয়াস সিয়ার ও গাইরু যালিক।

৭. মুসলিম-৪২৩৭, বাবু আখিরু আয়াতিন উনযিলাত; বুখারী-৪৩৭৭, কিতাবুত তাফসীর।

৮. বুখারী-৬৩৫২, বাবু মীরালি বানাত; মুসলিম- ৪২৯৬, বাবুল ওয়াছিয়্যাতি বিছ ছুলুছ; আবু দাউদ-২৮৬৬, বাবু মা জাআ ফী মালা ইয়াজুযু; ইবনু মাজাহ-২৭০৮, বাবুল ওয়াছিয়্যাতি বিছ ছুলুছ; তিরমিযী-২১১৬, আল ওয়াছিয়্যাতু বিছ ছুলুছ; নাসায়ি-৩৬৩২, পৃ-৫৫৩, ভ-৬; মুসনাদু আহমাদ-১৪৪০, পৃ-৫০, ভ-৩; মুয়াত্তা মালিক-২৮২৪, আল ওয়াছিয়্যাতু ফিছ ছুলুছ।

৯. উসদুল গাবাহ, পৃ-৫৬৫, ভ-১ উসদুল গাবাহ, পৃ-৫৬৫, ভ-১।

১০. আল ইছাবা ফী তাময়ীযিছ ছাহাবা পৃ-৫৯৮, ভ-৩।

১১. আল ইছাবা ফী তাময়ীযিছ ছাহাবা পৃ-৬৮, ভ-৫।

১২. উসদুল গাবাহ, পৃ-১০৫৮, ভ-১।

১৩. আল মুসতাদাকু আলাছ ছাহীহাইন হা. নং-৫৬৯৩, পৃ-৪৪৭, ভ-৩।

১৪. বায়হাকী কুবরা-১৩৪৭০, বাবু ই’তায়িল ফাইয়ি আলাদ দিওয়ান ।

১৫. রাদ্দুল মুহ্তার, ফাছলুন ফিল আছাবাত পৃ-৪১২, ভ-২৯; হাশিয়াতু ইবনি আবিদীন, পৃ-৭৭৬, ভ-৬।

১৬. আবু দাঊদ-২৮৭৯, বাবু মা জাআ ফির রাজুলি ইয়াহাবু; মুসলিম-২৭৫৩, বাবু কাজায়িছ ছিয়ামি আনিল মায়্যিত; মুসনাদু আহমাদ-২৩০৩২, পৃ-১৪০, ভ-৩৮; মুসতাদরাক-৮০১৮, কিতাবুল ফারাইজ; ইবনু আবী শায়বা-২১৩৯৬, ফির রাজুলি ইয়াতাছাদ্দাকু; বায়হাকী কুবরা-৭৪২৪, বাবু মান কালা ইয়াজুযুল ইবতিবাউ; নাসায়ী কুবরা-৬৩১৭, মীরাছুল ইবনাতিল ওয়াহিদাতিল মুনফারিদাহ।

১৭. আবু দাউদ-৫১২৩, বাবুন ফিল আছাবিয়্যাহ; বাগাবী- শারহুস সুন্নাহ, পৃ-৩৪০, ভ-৬।

বিষয়: বিবিধ

১৩২১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File