কন্যা সন্তানের অধিকার ও প্রাপ্য
লিখেছেন লিখেছেন সৈয়দ জিল্লুর রহমান ১৯ অক্টোবর, ২০১৩, ০১:০৯:১৫ দুপুর
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيْمِ
কন্যা সন্তানের অধিকার ও প্রাপ্য
কন্যা সন্তান পুত্র সন্তানের মতই পিতামাতার বংশধারার রক্ষক। আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন কন্যার গর্ভজাত সন্তানের মাধ্যমে আমাদের প্রিয় নবী ছা. এর বংশধারা রক্ষা করেছেন। মৃতের সবচেয়ে অগ্রগণ্য উত্তরাধিকারী হলেন তার ছেলেমেয়ে ও নাতিপুতি। কন্যার অবস্থা পাঁচটি। প্রথমত: মৃতের একমাত্র সন্তান হিসাবে যদি একজন মাত্র কন্যা থাকে ও অন্য কোন উত্তরাধিকারী না থাকে, তাহলে সে কন্যা অন্য অংশীদার না থাকার কারণে সম্পূর্ণ সম্পদ লাভ করবে। দ্বিতীয়ত: অন্য উত্তরাধিকারীদের সাথে মৃতের একমাত্র সন্তান হিসাবে যদি একজন কন্যা সন্তান বর্তমান থাকে, তাহলে অন্য উত্তরাধিকারীদেরকে তাদের নির্ধারিত হিস্সা দেয়ার পরে যা কিছু অবশিষ্ট থাকবে, সে অবশিষ্ট অংশের অর্ধাংশ উক্ত কন্যা সন্তান লাভ করবে। তৃতীয়ত: মৃতের যদি একাধিক কন্যা থাকে ও অন্য কোন উত্তরাধিকারী না থাকেন, তাহলে কন্যাগণ মৃতের সমস্ত সম্পদ লাভ করবে। যেমন কোন ছেলে থাকলে সে সমস্ত সম্পদ লাভ করে। চতুর্থত: অন্য উত্তরাধিকারীর সাথে একাধিক কন্যা সন্তান বর্তমান থাকলে, তারা অন্য অংশীদারদেরকে তাদের জন্য নির্ধারিত হিস্সা দেয়ার পরে যা কিছু অবশিষ্ট থাকবে তার সবটুকু লাভ করবে। আর পঞ্চমত: যদি মৃতের সন্তান কয়েকজন ছেলেমেয়ে হয় এবং অপর কোন উত্তরাধিকারী না থাকে, তাহলে সমগ্র সম্পদ তাদের মধ্যে বণ্টিত হবে। সেক্ষেত্রে لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ اْلأُنْثَيَيْنِ - একজন পুরুষ দু’জন নারীর সমান হিস্সা পাবে। আর অন্য উত্তরাধিকারী থাকলে সে উত্তরাধিকারীগণ তাদের নির্ধারিত হিস্সা নেয়ার পরে যা কিছু অবশিষ্ট থাকবে, মৃতের সন্তানগণ সে অবশিষ্ট সম্পদ লাভ করবে।
আলোচনা ও পর্যালোচনা:
প্রথমত: কন্যা একমাত্র উত্তরাধিকারী: মানুষ তার জীবন কালে সন্তান সন্ততি হাসিল করে ও সম্পদ অর্জন করে। কিন্তু মানুষের কাছে সর্বদাই সম্পদের চেয়ে সন্তানের মূল্য সর্বাধিক। এজন্য সন্তানের কল্যান চিন্তা করে মানুষ সম্পদ খরচ করতে কুন্ঠিত হয় না। সন্তান যদি পুত্র হয়, তাহলে সে পুত্রের মাধ্যমে মানুষ তার বংশধারা রক্ষা করে। প্রাক ইসলামী যুগে মানুষ কন্যা সন্তানের ব্যাপারে একটু কম আগ্রহী ছিল। এজন্য তখন কন্যা সন্তানগণ সম্পদে অংশীদারিত্ব পেত না। আর সংগত কারণেই পুত্র না থাকলে মানুষ সম্পদ রেখে যেতে চাইত না। কিন্তু ইসলাম এসে মানুষের সে ধারণা পাল্টে দিল। হজরত সা’দ বিন আবু ওকাস রা. এর প্রশ্নের উত্তরে রাসূলুল্লাহ ছা. এরশাদ করলেন: اِنْ تَرَكْتَ وَلَدَكَ أَغْنِيَاءَ خَيْرٌ مِنْ اَنْ تَتْرُكَهُمْ عَالَّةً يَتَكَفَّفُوْنَ النَّاسَ ‘তোমার সন্তানকে সম্পদশালী রেখে যাওয়া অধিক উত্তম তাদেরকে এমন অভাবগ্রস্থ রেখে যাওয়ার চেয়ে যে তারা অন্যের কাছে হাত পেতে বেড়াবে।’ (বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, ইবনু মাজাহ, তিরমিযী, নাসায়ি, মুসনাদু আহমাদ, মুয়াত্তা মালিক)১। তাই ঈমানদারগণ তাদের ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সন্তানদের জন্য সম্পদ রেখে মৃত্যু বরণ করতে চান। এজন্য মানুষ মৃত্যুরপূর্বক্ষণ পর্যন্ত হালাল সম্পদ উপার্জনের চেষ্টা অব্যাহত রাখে। অপরদিকে জন্ম লগ্ন থেকেই সন্তানগণ তাদের পিতামাতার অর্থনৈতিক দায়িত্বশীলতার অধীনে থেকে প্রতিপালিত হয়ে থাকে। সন্তানের অর্থনৈতিক দায়িত্বশীল হলেন তাদের পিতামাতা। পিতামাতা মৃত্যু বরণ করলে সে সন্তানেরা যাতে অর্থনৈতিক দূরাবস্থার মধ্যে পতিত না হয়, সে জন্য আল্লাহ তা’আলা মৃত পিতামাতার সম্পদ সন্তানদের জন্য বরাদ্ধ দিয়েছেন। সন্তান ছেলে হোক অথবা মেয়ে হোক, তার প্রতিপালনের দায়িত্ব পিতামাতার। আর সে কারণেই পিতামাতা মারা গেলে সম্পদের উত্তরাধিকারও সে ছেলেমেয়েদেরই প্রাপ্য। তাদের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ভিত্তিও পিতামাতা থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদের উপর নির্ভর করে। এ কারণে সন্তানদের জন্য কোন অংশ উল্লেখ না করেই আল্লাহ তা’আলা ঘোষনা করেছেন:
يُوصِيْكُمُ اللهُ فِيْ أَوْلَادِكُمْ لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الْأُنْثَيَيْنِ
“তোমাদের সন্তানদের ব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশনা হল- একজন পুরুষ দু’জন নারীর সমান হিস্সা পাবে।” (সূরা নিসা-১১)। এখানে আয়াতের প্রথমাংশের দিকে তাকালে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, সমস্ত সম্পদ সন্তানদের জন্য। সেখানে শুধু ছেলে সন্তানদের জন্য একথা বলা হয়নি। বরং বলা হয়েছে যে, সন্তানদের পরস্পরের মধ্যে সম্পদের বন্টন পদ্ধতি হবে- ‘একজন পুরুষ দু’জন নারীর সমান হিস্সা পাবে’ -এ সূত্র মতে। ‘সিয়াকে কালাম’ বা বক্তব্যের ধরণ দেখে বুঝা যায় যে, ‘একজন পুরুষ দু’জন নারীর সমান হিস্সা হিসাবে’ সন্তানেরা সমস্ত সম্পদ পাবে। আর এ সূত্র মতে একজন মাত্র পুত্র থাকলে সে সম্পূর্ণ সম্পদের মালিক হবে আবার শুধুমাত্র একজন কন্যা থাকলে সেও সম্পূর্ণ সম্পদের মালিকানা লাভ করবে। কেননা উত্তরাধিকারী না থাকার কারণে সম্পদ বন্টনের প্রয়োজন নেই। একাধিক বৈধ ও যোগ্য উত্তরাধিকারী বর্তমান থাকলেই কেবল সম্পদ বন্টনের প্রয়োজন। যদি কোন লোক মারা যায় তার একজন অমুসলিম পুত্র ও একজন মুসলিম কন্যা রেখে, তখন সে কন্যা একা সমস্ত সম্পদের মালিকানা হাসিল করবে। অমুসলিম হওয়ার কারণে ছেলে কিছুই পাবে না। কারণ রাসূলুল্লাহ ছা. বলেছেন: لاَ يَرِثُ الْمُسْلِمُ الْكَافِرَ وَلاَ يَرِثُ الْكاَفِرُ الْمُسْلِمَ ‘কোন মুসলিম তার কোন অমুসলিম আত্মীয়ের উত্তরাধিকারী হবে না এবং কোন অমুসলিম তার কোন মুসলিম আত্মীয়ের উত্তরাধিকারী হবে না।’ (মুসলিম, বুখারী, তিরমিযী, আবু দাউদ, ইবনু মাজাহ)২। আবার যদি কোন লোক তার একজন মেয়ে ও একজন ভাই রেখে মারা যায়, তাহলেও মেয়েটি সমস্ত সম্পদ একা লাভ করবে; ভাই কিছুই পাবে না। কারণ আল্লাহ তা’আলা বলেছেন: وَهُوَ يَرِثُهَآ إِنْ لَمْ يَكُنْ لَهَا وَلَدٌ “এবং ভাই তার মৃত বোনের উত্তরাধিকারী হবে, তবে শর্ত হল বোনটি নি:সন্তান হতে হবে।” (সূরা নিসা-১৭৬)। এ আয়াতে সন্তান না থাকা ভাইর উত্তরাধিকারী হওয়ার জন্য শর্ত করা হয়েছে। আর আল্লাহ নিজে সন্তানের ব্যাখ্যা দিয়েছেন নিম্নোক্ত ভাষায় - يُوصِيْكُمُ اللهُ فِيْ أَوْلَادِكُمْ لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الْأُنْثَيَيْنِ “তোমাদের সন্তানদের ব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশনা হল- একজন পুরুষ দু’জন নারীর সমান হিস্সা পাবে।” এ আয়াতে সন্তানের আওতায় ছেলে ও মেয়ের কথা বলে আল্লাহ বুঝিয়ে দিলেন যে, সন্তান বলতে ছেলে ও মেয়ে উভয়কেই বুঝায়।
একমাত্র উত্তরাধিকারী একজন মাত্র কন্যাসন্তান হলে তার হিস্সা সমগ্র সম্পদ না আংশিক সম্পদ, তা নিয়ে ছাহাবায়ে কেরামের মধ্যে কিছুটা মতবিরোধ লক্ষ্য করা যায়। হজরত উমার, আলী, উসমান, আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস, আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ রা. সহ অধিকাংশ ছাহাবায়ে কেরামের মতে একমাত্র উত্তরাধিকারী একজন মাত্র কন্যা হলে সে সমস্ত সম্পদ লাভ করবে। কিন্তু হজরত যায়েদ বিন ছাবিত রা. সহ কিছু উলামায়ে কেরামের মতে একমাত্র কন্যাসন্তান অর্ধেক সম্পদ লাভ করবে। আর বাকী অর্ধেক লাভ করবে রাষ্ট্রীয় তহবিল বা ‘বাইতুল মাল’। বাইতুল মাল না থাকলে কিংবা কোন অমুসলিম দেশে মৃত্যু বরণ করলে কি হবে, তা অবশ্য তারা বলেন নি। তাদের দলীল - আল্লাহ তা’আলা বলেন: وَاِنْ كَانَتْ وَاحِدَةً فَلَهَا النِّصْفُ “আর যদি সে (কন্যা) একজন হয়, তাহলে সে পাবে অর্ধেক।” এ আয়াতে একজন মেয়ে হলে তার হিস্সা ‘অর্ধেক’ বলা হয়েছে। বাকী অর্ধেক বাইতুল মাল কেন পাবে, কোন্ দলীলের ভিত্তিতে পাবে, এ ব্যাপারে তাদের বক্তব্য হল: বাকী অর্ধেকের দাবীদার না থাকায় তা বাইতুল মালে জমা হবে যা সব মুসলমানের সম্পদ হিসাবে সবাই উপকৃত হবে।
প্রথম দলের মতে আয়াতে অর্ধেকের কথা বলা হলেও এখানে তা প্রযোজ্য হবে না। বরং অপর কোন দাবীদার না থাকায় ‘রদ্দ’ বা পুন:বণ্টণ করতে হবে সে মেয়ের অনুকুলে। বাইতুল মাল পাবে না। কারণ রাসূলুল্লাহ ছা. বলেছেন:
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ قَالَ أَنَا أَوْلَى بِالْمُؤْمِنِيْنَ مِنْ أَنْفُسِهِمْ فَمَنْ مَاتَ وَعَلَيْهِ دَيْنٌ وَلَمْ يَتْرُكْ وَفَاءً فَعَلَيْنَا قَضَاؤُهُ وَمَنْ تَرَكَ مَالاً فَلِوَرَثَتِهِ হজরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত। তিনি নাবী ছা. থেকে বর্ণণা করেন। তিনি বলেছন: ‘আমি মুমিনদের নিজেদের চেয়েও অধিক হকদার। কেউ ঋণ রেখে মারা গেলে এবং তা পরিশোধের কোন ব্যবস্থা না থাকলে, তা পরিশোধের দায়িত্ব আমার আর যে ব্যক্তি সম্পদ রেখে মারা যাবে, তার সে সম্পদ তার উত্তরাধিকারীগণ পাবেন।’ (বুখারী, মুসলিম, নাসায়ী, আবু দাউদ, ইবনু মাজাহ, মুসনাদু আহমাদ, ইবনু হিব্বান)৩। এ হাদীছের মাধ্যমে জানা যায় যে, ‘সম্পদ’ উত্তরাধিকারীগণ পাবে; রাসূলুল্লাহ ছা. কিংবা বাইতুল মাল নয়। কিন্তু সম্পদ না থাকলে ঋণ পরিশোধের দায়িত্ব ইসলামী সরকারের, যা বাইতুল মাল থেকে পরিশোধিত হবে। রাসূহুল্লাহ ছা. এর অপর একটি হাদীছ থেকেও জানা যায় যে, সমস্ত সম্পদ একমাত্র মেয়ে পাবে, বাইতুল মাল নয়। যেমন বর্ণিত আছে:
عَنْ عَامِرِ بْنِ سَعْدِ بْنِ اَبِيْ وَقَاصٍ عَنْ اَبِيْهِ قَالَ مَرِضْتُ بِمَكَّةَ مَرَضًا اَشْفَيْتُ مِنْهُ عَليَ الْمَوْتِ فَاتَانِي النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَعُوْدُنِي فَقُلْتُ يَا رَسُوْلَ اللهِ اِنَّ لِيْ مَالاً كَثِيْرًا وَلَيْسَ يَرِثُنِيْ اِلاَّ اِبْنَتِيْ اَفَاَتَصَدَّقُ بِثُلُثَيْ مَالِيْ فَقَالَ لاَ قُلْتُ فَالشَّطْرُ قَالَ لاَ قُلْتُ فَالثُّلُثُِ قَالَ الثُّلُثُِ كَثِيْرٌ اِنْ تَرَكْتَ وَلَدَكَ أَغْنِيَاءَ خَيْرٌ مِنْ اَنْ تَتْرُكَهُمْ عَالَّةً يَتَكَفَّفُوْنَ النَّاسَ
‘হজরত আমির বিন সা’দ বিন আবু ওকাছ রাহ. থেকে বর্ণিত, তিনি তার পিতা থেকে বর্ণণা করেন। তিনি বলেন: ‘আমি মক্কায় এমন অসুস্থ হয়ে পড়লাম যে আমি মৃত্যুর আশংকা করছিলাম। রাসূলুল্লাহ ছা. আমাকে দেখতে আসলেন। আমি তাঁকে জিঙ্গাসা করলাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল, আমার অনেক সম্পদ রয়েছে। আর একজন মাত্র কন্যা ছাড়া আমার অপর কেন উত্তরাধিকারী নেই; আমি কি দু’তৃতীয়াংশ সম্পদ দান করতে পারি ? তিনি বললেন: ‘না’, আমি বললাম, তাহলে অর্ধেক ? তিনি বললেন: ‘না’, আমি বললাম, তাহলে এক তৃতীয়াংশ, তিনি বললেন: ‘এক তৃতীয়াংশই তো বেশী। তোমার সন্তানকে সম্পদশালী রেখে যাওয়া অধিক উত্তম তাদেরকে এমন অভাবগ্রস্থ রেখে যাওয়ার চেয়ে যে তারা অন্যের কাছে হাত পেতে বেড়াবে।’ (বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, ইবনু মাজাহ, তিরমিযী, নাসায়ি, মুসনাদু আহমাদ, মুয়াত্তা মালিক)৪। এ হাদীছ থেকে জানা যায় যে, একমাত্র মেয়ে সমস্ত সম্পদ লাভ করবে; বাইতুল মালে কিছুই যাবে না। কারণ বাইতুল মাল প্রাপ্য হলে রাসূলুল্লাহ ছা. অবশ্যই তা উল্লেখ করতেন। তিনি উহা উল্লেখ না করে বরং বুঝাতে চাইলেন যে, তোমার একমাত্র কন্যা সম্পদশালী হলে তা তোমার জন্য অধিক কল্যানকর হবে।
দ্বিতীয়ত: অন্য উত্তরাধিকারীর সাথে একমাত্র কন্যার অবস্থা: অন্য উত্তরাধিকারীর সাথে যদি একজন কন্যা সন্তান অংশীদার হয় এবং মৃত ব্যক্তির কোন পুত্র সন্তান না থাকে, তবে অন্য উত্তরাধিকারীদেরকে সর্বাগ্রে হিস্সা দিতে হবে। তাদেরকে হিস্সা দেয়ার পরে যা কিছু অবশিষ্ট থাকবে, কন্যাটি সে অবশিষ্ট সম্পদের অর্ধেক পাবে এবং বাকী অর্ধেক সেই কন্যাসহ সকল উত্তরাধিকারীর মধ্যে পুন:বন্টন হবে। ছেলে-মেয়েরা আসলে মাওলার অন্তর্ভুক্ত অনির্ধারিত হিস্সাদার উত্তরাধিকারী। তারা সব সময় অবশিষ্টাংশ পায়। কিন্তু কন্যা মাওলা হলেও সে পূর্ণ মাওলা নয়, বরং অর্ধেক মাওলা। পুত্র হল পূর্ণ মাওলা। এজন্য অবশিষ্টাংশের সম্পূর্ণ অংশ ছেলে পায়। আর ছেলের প্রাপ্য হিস্সার অর্ধেক পায় মেয়ে। মেয়ে অর্ধেক মাওলা হলেও সে অন্য মাওলাদেরকে অনির্ধারিত হিস্সা পাবার সুযোগ বাতিল করে দেয়। সেজন্য একজন মেয়ের উপস্থিতিতে মৃতের পিতা মাওলা বলে বিবেচিত হবেন না। ছেলে থাকলে পিতা যেমন ‘যবিল ফুরূজ’ বলে গণ্য হয়ে নির্ধারিত হিস্সা লাভ করেন, এক বা একাধিত মেয়ে থাকার কারণেও পিতা ‘যবিল ফুরূজ’ বলে গণ্য হয়ে নির্ধারিত হিস্সা লাভ করবেন। এ কারণেই আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন:
وَلِأَبَوَيْهِ لِكُلِّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا السُّدُسُ مِمَّا تَرَكَ إِنْ كَانَ لَهُ وَلَدٌ
“আর পিতামাতার প্রত্যেকে মৃত ব্যক্তি যা কিছু ছেড়ে যাবে, তা থেকে এক ষষ্টাংশ করে পাবেন যদি মৃতের কোন সন্তান বর্তমান থাকে।” (সূরা নিসা-১১)। এ আয়াত থেকে জানা গেল যে, ছেলে হোক মেয়ে হোক, একজন হোক অথবা একাধিক হোক - কোন সন্তান থাকলে পিতা এক ষষ্টাংশের বেশী পাবেন না। একজন মেয়ে যে অবশিষ্ট সম্পদের অর্ধেক পায়, তার দলীল হল- এ আয়াত। আল্লাহ তা’আলা বলেন: وَإِنْ كَانَتْ وَاحِدَةً فَلَهَا النِّصْفُ “আর যদি সে (কন্যা) একজন হয়, তাহলে সে পাবে অর্ধেক।” (সূরা নিসা-১১)। কিসের অর্ধেক? মোট সম্পদের অর্ধেক? অবশিষ্ট সম্পদের অর্ধেক? না একজন পুত্রের হিস্সার অর্ধেক? এ প্রশ্নের উত্তর আল্লাহ পরিষ্কার করে বলেন নি। আয়াতের আগের অংশে আল্লাহ তা’আলা বলেন: لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ اْلأُنْثَيَيْنِ ‘‘একজন পুত্রের হিস্সা হল দু’জন কন্যার হিস্সার সমান।” দু’জন কন্যার হিস্সার সমান যদি একজন পুত্রের হিস্সা হয়, তাহলে একজন কন্যার হিস্সা হবে একজন পুত্রের হিস্সার অর্ধেক। যদি ব্যাখ্যা গুলোকে এ ভাবে সাজানো যায় যে, ছেলে-মেয়ে মিশ্রিতভাবে থাকুক আর না থাকুক সর্বাবস্থায় একজন ছেলে দু’জন মেয়ের সমান হিস্সা পাবে। বিপরীতপক্ষে একজন মেয়ে হলে সে সর্বাবস্থায় একজন ছেলের হিস্সার অর্ধেক পাবে; তাহলে আয়াতের দু’অংশের মধ্যে সামঞ্জস্য প্রতিষ্ঠিত হয়। আর ঐশীবাণীর ইঙ্গিত বা ‘ইশারাতুন্ নাছ’ ও তাই বলে। একজন ছেলে যদি দু’জন মেয়ের সমান হিস্সা পায়, তাহলে একজন মেয়ে পাবে একজন ছেলের হিস্সার অর্ধেক। এভাবে ধরলে যা দাড়ায় তা হল: وَاِنْ كَانَتْ وَاحِدَةً فَلَهَا نِصْفُ حَظِّ الذَّكَرِ ছেলেমেয়েদের মধ্যে যদি একজন মাত্র কন্যা হয়, তাহলে সে পাবে- একজন পুত্র থাকলে সে যতটুকু পেত- তার অর্ধেক। ছেলে মোট সম্পদ পাবার হলে সে পাবে মোট সম্পদের অর্ধেক; বাকী অর্ধেক পাবে রদ্দের কারণে যেমন আমরা প্রথম অবস্থায় দেখেছি। আর ছেলে অবশিষ্ট সম্পদ পাবার হলে, সে পাবে সেই অবশিষ্ট সম্পদের অর্ধেক। এ জন্য আয়াতের ব্যাখ্যা হবে وَاِنْ كَانَتْ وَاحِدَةً فَلَهَا النِّصْفُ اَيْ فَلَهَا نِصْفُ حَظِّ الذَّكَرِ । সমীকরণ বা ‘বয়ঁধঃরড়হ’ এর মাধ্যমেও বিষয়টি প্রমাণ করা যায়। যেমন নীচের ‘সমীকরণটির’ দিকে লক্ষ্য করুন:
১ জন পুত্র = ২ জন কন্যা
অথবা ২ জন কন্যা = ১ জন পুত্র
অথবা ১ জন কন্যা = ১/২ জন পুত্র ।
কারো কারো মতে কন্যা সন্তান নিছক নির্ধারিত হিস্সার অধিকারী যবীল ফুরূজের অন্তর্ভুক্ত একজন উত্তরাধিকারী। তাদের মতে কন্যা সন্তান একজন হলে মোট সম্পদের অর্ধেক পায়, একাধিক হলে দু’তৃতীয়াংশ পায় এবং তাদের সাথে ছেলে সন্তানও থাকলে একজন পুরুষ দু’জন নারীর সমান হিস্সা হিসাবে অতিরিক্ত অংশে অংশীদার হয়। তাদের মতে মেয়ে একজন হোক অথবা একাধিক, সর্বদাই যবীল ফুরূজ বলে বিবেচিত হবে। তারা মনে করেন যে, নারী মাওলা হতে পারে না। সমস্তরের বা নীচের স্তরের পুরুষ ভাইর উপস্থিতির কারণে বোন মাওলা হতে পারবে। এ কারণে তারা মনে করেন যে, মিশ্রিত আকারে থাকলে একজন পুরুষ দু’জন নারীর সমান হিস্সা পায়; কিন্তু সন্তান শুধু নারী হলে তারা যবীল ফুরূজ বলে গণ্য হন। সেজন্য তারা নারীকে মাওলা বা আছাবা গণ্য করতে ‘মিশ্রিত অবস্থায় থাকার’ শর্ত আরোপ করেন। তারা তাদের মতের সমর্থনে কুরআনের এ আয়াতে করীমাকে পেশ করেন, যেখানে আল্লাহ বলেন:
يُوصِيْكُمُ اللهُ فِيْ أَوْلَادِكُمْ لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الْأُنْثَيَيْنِ فَإِنْ كُنَّ نِسَاءً فَوْقَ اثْنَتَيْنِ فَلَهُنَّ ثُلُثَا مَا تَرَكَ وَإِنْ كَانَتْ وَاحِدَةً فَلَهَا النِّصْفُ
‘‘তোমাদের সন্তানদের ব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশনা হল- একজন পুরুষ দু’জন নারীর সমান হিস্সা পাবে। সুতরাং যদি তারা দু’এর অধিক কন্যা সন্তান হয়, তবে তারা দু’তৃতীয়াংশ পাবে সে যা কিছু ছেড়ে যাবে, তা থেকে। আর যদি একজন হয়, তবে সে মোট সম্পদের অর্ধেক পাবে।” (সূরা নিসা-১১)। আয়াতের মধ্যে ‘মোট সম্পদের’ কথাটি না থাকলেও তারা তা যোগ করে অনুবাদ করেন। তাদের এ মতের স্বপক্ষে আরো যুক্তি হল হজরত ইবনু আব্বাস রা. বর্ণিত হাদীছ। রাসূলুল্লাহ ছা. এরশাদ করেন:
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اِقْسِمُوا الْمَالَ بَيْنَ أَهْلِ الْفَرَائِضِ عَلَى كِتَابِ اللهِ فَمَا تَرَكَتْ الْفَرَائِضُ فَلِأَوْلَى رَجُلٍ ذَكَرٍ
হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছা. বলেছেন: ‘যবীল ফুরূজদের মধ্যে কুরআনে বর্ণিত হিস্সা অনুসারে সম্পদ বণ্টন কর। এ বণ্টণের পরে যে সম্পদ অবশিষ্ট থাকবে তা সর্বাধিক হকদার পুরুষ লোকদের জন্য।’ (মুসলিম, মুসনাদু আহমাদ, ইবনু মাজাহ, তাবারাণী আল মু’জামুল কাবীর, মুছান্নাফু আব্দির রাজ্জাক)৫।
পক্ষান্তরে খোদ হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. এর মতবাদ বিশ্লেষণ করলে ভিন্ন আরেক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। তার মতে মেয়ে ও বোনেরা মাওলার অন্তর্ভুক্ত। এজন্য তারা তাদের সমস্তরের ছেলে ও ভাইদের সাথে একত্রে থাকলেও মাওলা একা থাকলেও মাওলা বলে বিবেচিত হবে। এ কারণে তিনি নিম্নোক্ত ক্ষেত্রে অন্যদের সাথে ভিন্নমত পোষণ করেন। (১). তিনি পিতামাতা ও স্বামী-স্ত্রীর সাথে মেয়ে কিংবা বোনেরা উত্তরাধিকারী হলে তাদেরকে অবশিষ্টাংশ দেয়ার পক্ষপাতি। আর (২). যদি কোন লোক শুধু কন্যা সন্তান রেখে মারা যান এবং তার এক বা একাধিক বোন জীবিত থাকে, তাহলে তিনি বোনকে কিছুই দেয়ার পক্ষপাতি নন। তার মতের সমর্থনে তিনি দলীল পেশ করেন: ১. আল্লাহ তা’আলা বলেন:
وَلِكُلٍّ جَعَلْنَا مَوَالِيَ مِمَّا تَرَكَ الْوَالِدَانِ وَالْأَقْرَبُوْنَ
“আর আমরা পুরুষ নারীর প্রত্যেককে পিতামাতা ও আত্মীয় স্বজনেরা যা কিছু রেখে যাবে তাতে মাওলা বানিয়েছি।” (সূরা নিসা-৩৩)। ২. আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন:
يَسْتَفْتُوْنَكَ قُلِ اللهُ يُفْتِيْكُمْ فِي الْكَلَالَةِ إِنِ امْرُؤٌ هَلَكَ لَيْسَ لَهُ وَلَدٌ وَلَهُ أُخْتٌ فَلَهَا نِصْفُ مَا تَرَكَ وَهُوَ يَرِثُهَا إِنْ لَمْ يَكُنْ لَهَا وَلَدٌ
“হে নবী, তোমার কাছে তারা ফতোয়া জিজ্ঞাসা করে। তুমি বলে দাও যে, আল্ল¬াহ ‘কালালার’ ব্যাপারে ফতোয়া দিচ্ছেন: যদি কোন নি:সন্তান লোক মারা যায় আর তার একজন বোন থাকে, তবে সে বোন অর্ধেক পাবে মৃত ব্যক্তি যা কিছু ছেড়ে যাবে, তা থেকে। - এবং সে ব্যাক্তিও তার মৃত বোনের উত্তরাধিকারী হবে তবে শর্ত হল সে (মৃত বোন) নি:সন্তান হতে হবে।” (সূরা নিসা-১৭৬)। এ আয়াতের মাধ্যমে কন্যা সন্তান থাকলেও ভাইবোনকে বঞ্চিত করা হয়েছে। ৩. মেয়ে ও বোনদেরকে মাওলা উত্তরাধিকারী মেনে নিয়ে অবশিষ্ট সম্পদ দেয়ার স্বপক্ষে মতামত না দিলে হিসাবে গরমিল দেখা দেয়। যাকে ইলমুল ফারাইজে ‘আওল’ বলা হয়। যে আওলের কারণে কুরআনের সকল নির্দেশনা লঙ্ঘনের ঝুঁকি সৃষ্টি হয়। এ কারণে প্রায় সকল ফারাইজ বিশারদগণ আওল মেনে নিলেও হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. কোনমতেই আওলকে মেনে নেন নি। তিনি তার এ মতে এত শক্ত ভুমিকা নিয়েছিলেন যে, তিনি এ দাবীর উপরে শপথ করে বলেন:
قَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ : وَايْمُ اللهِ لَوْ قَدَّمَ مَنْ قَدَّمَ اللهُ وَأَخَّرَ مَنْ أَخَّرَ اللهُ مَا عَالَتْ فَرِيضَةٌ
আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. বলেন: ‘আর আল্লাহর শপথ, তিনি যদি তাদেরকে অগ্রাধিকার দিতেন, যাদেরকে আল্লাহ অগ্রাধিকার দিয়েছেন এবং ওদেরকে পশ্চাতে রাখতেন, যাদেরকে আল্লাহ পশ্চাতে রেখেছেন, তবে কোন উত্তরাধিবারেই আওল সৃষ্টি হত না।’ (বায়হাকী কুবরা, জামেউল আহাদীছ)৬। হিসাবে গরমিল দেখা দেয়ার উদাহরণ নিম্নরূপ:-
সমস্যা নং- ৩. যদি কোন নারী তার স্বামী, পিতামাতা ও একজন কন্যা সন্তান রেখে মৃত্যু বরণ করে, তাহলে তার সমাধানে ‘আওল’ সৃষ্টি হবে। [ফকীহদের মতানুসারে] :
সমাধান: ফকীহদের মতে তখন স্বামী পাবে ১/৪ অংশ, পিতা পাবেন ১/৬ অংশ, মাতা পাবেন ১/৬ অংশ এবং কন্যা পাবে ১/২ অংশ। ভগ্নাংশের হরের মধ্যে ৪, ৬ ও ২ থাকায় ল.সা.গু হবে ১২। সুতরাং মোট সম্পদকে ১২ ভাগ করে বণ্টন করতে হবে। সেক্ষেত্রে স্বামী পাবে ৩/১২, পিতা পাবেন ২/১২, মাতা পাবেন ২/১২ এবং কন্যা পাবে ৬/১২। তাতে যোগফল দাড়াবে (৩/১২ + ২/১২ + ২/১২ + ৬/১২) = ১৩/১২। তখন দেখা যাবে যে সম্পদ ১২ অংশ করা হয়েছে কিন্তু প্রাপ্য হিস্সা হল ১৩ অংশ। তারা বলেন, গত্যন্তর না থাকায় সম্পদকে ১২ এর স্থলে ১৩ অংশ করতে হবে এবং ১২ অংশের হিসাবেই সবাইকে দিতে হবে। যেমন মনে করুন সম্পদ হল মোট ৬,০০,০০০ টাকা। কুরআনের বিধান অনুসারে মৃতের সন্তান থাকলে স্বামী এক চতুর্থাংশ এবং পিতামাতার প্রত্যেকে এক ষষ্টাংশ করে পাওয়ার স্পষ্ট বিধান রয়েছে। কিন্তু একজন মেয়ে থাকলে সে মোট সম্পদের অর্ধাংশ পাবে বলে তারা মনে করেন। এ হিসাবে স্বামী ১,৫০,০০০ টাকা, পিতা ১,০০,০০০ টাকা ও মাতা ১,০০,০০০ টাকা পাওয়ার কথা থাকলেও ফকীহগণ হিসাবের গরমিল হওয়ার কারণে সবাইকে একটু একটু করে কম দেয়ার কথা বলেন। কারণ তাদের সম্পদের ১ অংশের স্থলে অংশ ১৩/১২ ভাগ হয়ে গরমিল হতে দেখা যায়। সেজন্য তারা উপরোক্ত মাসআলায় স্বামীকে ১,৩৮,৪৬১.৫৪ টাকা পিতাকে ৯২,৩০৭.৬৯ টাকা মাতাকে ৯২,৩০৭.৬৯ টাকা ও মেয়েকে ২,৭৬,৯২৩.০৮ টাকা দিয়ে সমাধান করেন। অথচ তাদের নিজেদের সূত্রমতে মেয়েকে ৩,০০,০০০ টাকা দেয়ার কথা।
কিন্তু হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. এর মতবাদের আলোকে অংশ ভাগ করলে হিসাবে গরমিল হবে না। তাঁর মতবাদের আলোকে উপরোক্ত মাসআলাটির সমাধান নীচের উদাহরণে দেখুন:-
সমস্যা নং- ৪. যদি কোন নারী তার স্বামী, পিতামাতা ও একজন কন্যা সন্তান রেখে মৃত্যু বরণ করে, তাহলে তার সমাধানে হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. এর মতানুসারে ‘আওল’ সৃষ্টি হবে না :
সমাধান: হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. এর মতে তখন স্বামী পাবে ১/৪ অংশ, পিতা পাবেন ১/৬ অংশ, মাতা পাবেন ১/৬ অংশ এবং কন্যা পাবে অবশিষ্ট সম্পদের ১/২ অংশ। এর পরে যা কিছু অবশিষ্ট থাকবে, তা সবার মধ্যে পুন:বণ্টন করতে হবে। ভগ্নাংশের হরের মধ্যে ৪, ৬ ও ২ থাকায় ল.সা.গুহবে ১২। সুতরাং মোট সম্পদকে ১২ ভাগ করে বণ্টন করতে হবে। সেক্ষেত্রে স্বামী পাবে ৩/১২, পিতা পাবেন ২/১২, মাতা পাবেন ২/১২ এবং কন্যা পাবে ২.৫/১২। তাতে যোগফল দাড়াবে (৩/১২ + ২/১২ + ২/১২ + ২.৫/১২) = ৯.৫/১২। তখন দ্বিতীয়বার ল.সা.গু. কে ২ দিয়ে গুণ করে ২৪ করতে হবে। তাতে যোগফল দাড়াবে (৬/২৪ + ৪/২৪ + ৪/২৪ + ৫/২৪) = ১৯/২৪। অর্থাৎ সে ২৪ অংশের মধ্যে স্বামী পাবে ৬, পিতা পাবেন ৪, মাতা পাবেন ৪ এবং কন্যা পাবে ৫। তখন দেখা যাবে যে সম্পদকে ২৪ অংশ করা হয়েছে কিন্তু প্রাপ্য হিস্সা হল ১৯ অংশ। সুতরাং পুন:বণ্টণের সূত্র মোতাবেক সম্পদকে ২৪ এর স্থলে ১৯ অংশ করতে হবে। যেমন মনে করুন সম্পদ হল মোট ৬,০০,০০০ টাকা। কুরআনের বিধান অনুসারে মৃতের সন্তান থাকলে স্বামী এক চতুর্থাংশ এবং পিতামাতার প্রত্যেকে এক ষষ্টাংশ করে পাওয়ার স্পষ্ট বিধান রয়েছে। আর একমাত্র মেয়ে অবশিষ্ট সম্পদের অর্ধাংশ পাবে বলে তিনি মনে করেন। এ হিসাবে স্বামী ১,৫০,০০০ টাকা, পিতা ১,০০,০০০ টাকা ও মাতা ১,০০,০০০ টাকা এবং কন্যা অবশিষ্ট অংশের অর্ধেক {৬,০০,০০০ - (১,৫০,০০০ + ১,০০,০০০ + ১,০০,০০০)}= ২,৫০,০০০ ২ = ১,২৫,০০০ টাকা পাওয়ার কথা থাকলেও পুন:বণ্টণের কারণে সবাইকে আনুপাতিক হরে অতিরিক্ত দিতে হবে। তাতে স্বামী মোট ১,৮৯,৪৭৩.৬৮ টাকা মাতা ১,২৬,৩১৫.৭৯ টাকা পিতা ১,২৬,৩১৫.৭৯ টাকা ও মেয়ে ১,৫৭,৮৯৪.৭৪ টাকা পেলন। তাতে হিসাবের গরমিল দেখা দেয়ার কোন কারণ নেই। প্রথমে ল.সা.গু হবে ১২, পরে উহাকে তাছহীহ করতে হয়েছে ২৪ দিয়ে। আর সম্পদ অতিরিক্ত থেকে যাওয়ার কারণে পুনর্বার তা এ উত্তরাধিকারীদের মধ্যে পুনর্বার বণ্টিত হয়েছে। তাতে ভগ্নাংশের হর পরিবর্তিত হয়ে ১৯ হয়েছে, যা রদ্দের সূত্র অনুসারে হয়েছে। আর সম্পদের ১ অংশের স্থলে ভগ্নায়শের যোগফলও ১৯/১৯ = ১ হয়েছে।
এখানে আরেকটি বিষয় খেয়াল করার মত- তা এই যে, ফকীহদের মতানুসারে হিস্সা দিলে একজন মেয়েকে এত পরিমাণ সম্পদ দেয়া হয়, যা মেয়ের স্থলে ছেলে হলে সে ছেলেও পেত না। কারণ স্বামী, মাতা ও পিতার সাথে একজন ছেলে থাকলে সে সর্বোচ্চ ৫/১২ অংশ পাবে, ৬,০০,০০০ টাকার সম্পদে তা টাকার অংকে ২,৫০,০০০ টাকা। অথচ তাদের হিসাবে একজন মেয়ে পায় ২,৭৬,৯২৩.০৮ (৩ নং উদাহরণ দেখুন) যা স্বাভাবিক বোধশক্তিতে গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ একজন পুত্রের চাইতে একজন কন্যা কোন অবস্থাতেই বেশী পেতে পারে না। নীচের ছকে স্বামী, মাতা ও পিতার সাথে একজন পুত্রের অবস্থান ও হিস্সা দেখানো হল।
সমস্যা নং- ৫. যদি কোন নারী তার স্বামী, পিতামাতা ও একজন পুত্র সন্তান রেখে মৃত্যু বরণ করেন, তাহলে তার সমাধান: [ঐক্যমত্য অনুসারে] :
সমাধান: তখন স্বামী পাবে ১/৪ অংশ, পিতা পাবেন ১/৬ অংশ, মাতা পাবেন ১/৬ অংশ এবং পুত্র পাবে অবশিষ্ট অংশ। ভগ্নাংশের হরের মধ্যে ৪ ও ৬ থাকায় ল.সা.গু হবে ১২। সুতরাং মোট সম্পদকে ১২ ভাগ করে বণ্টন করতে হবে। সেক্ষেত্রে স্বামী পাবে ৩/১২, পিতা পাবেন ২/১২, মাতা পাবেন ২/১২ এবং পুত্র পাবে অবশিষ্ট ৫/১২। তাতে যোগফল দাড়াবে (৩/১২ + ২/১২ + ২/১২ + ৫/১২) = ১২/১২। যেমন মনে করুন সম্পদ হল মোট ৬,০০,০০০ টাকা। কুরআনের বিধান অনুসারে মৃতের সন্তান থাকলে স্বামী এক চতুর্থাংশ এবং পিতামাতার প্রত্যেকে এক ষষ্টাংশ করে পাওয়ার স্পষ্ট বিধান রয়েছে। আর একজন পুত্র থাকলে সে মাওলা বা আছাবা হিসাবে অবশিষ্টাংশ পাবে। এ হিসাবে স্বামী ১,৫০,০০০ টাকা, পিতা ১,০০,০০০ টাকা ও মাতা ১,০০,০০০ টাকা ও পুত্র অবশিষ্ট ২,৫০,০০০ টাকা পাবে। এ সমাধানে কারো কোন ভিন্নমত নেই। সকল ছাহাবী ও উলামাগণ এ ক্ষেত্রে একমত।
এ বিষয়টি বিবেচনায় রেখে একথা দৃঢ়তার সাথে বলা যায় যে, হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. এর মতটিই সঠিক। কারণ ছেলে থাকলে সে যতটুকু পাবে, তার স্থলে মেয়ে থাকলে সে মেয়ে কখনোই এর চেয়ে বেশী পেতে পারে না।
তৃতীয়ত: শুধুমাত্র একাধিক কন্যাসন্তান উত্তরাধিকারী হলে, তাদের অবস্থা:
যদি মৃতের উত্তরাধিকারী কয়েকজন কন্যা সন্তানই হন এবং আপর কোন উত্তরাধিকারী না থাকেন, তাহলে সে কন্যাসন্তানগুলো মৃতের সকল সম্পদের মালিকানা লাভ করবে। কারণ আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন: لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الْأُنْثَيَيْنِ –“একজন ছেলে পাবে দু’জন মেয়ের সমান হিস্সা” এ কথাটুকুকে উল্টিয়ে চিন্তা করলে পাওয়া যায় যে, দু’জন মেয়ে পাবে একজন ছেলের সমান হিস্সা। একজন ছেলে যেহেতু অন্য উত্তরাধিকারী না থাকলে সমস্ত সম্পদের হকদার হয়, ঠিক তেমনি অন্য উত্তরাধিকারী না থাকলে দু’জন মেয়েও সমস্ত সম্পদের হকদার হবে। আল্লাহ তা’আলা আরোও এরশাদ করেন: وَلِكُلٍّ جَعَلْنَا مَوَالِيَ مِمَّا تَرَكَ الْوَالِدَانِ وَالْاَقْرَبُوْنَ আমরা পুরুষ নারীর প্রত্যেককে পিতামাতা ও আত্মীয় স্বজনেরা যা কিছু রেখে যাবেন তাতে মাওলা বানিয়েছি।” (সূরা নিসা, আয়াত-৩৩)। এ আয়াতে যেহেতু নারীকেও আল্লাহ মাওলা বা আছাবার মর্যাদা দিয়েছেন, সে জন্য একাধিক মেয়েও আছাবা হয়ে সমস্ত সম্পদের মালিকানা হাসিল করবে।
কন্যা সন্তান নিছক যবীল ফুরূজের অন্তর্ভুক্ত উত্তরাধিকারী বলে যারা মনে করেন, তারা দু’জন কন্যার হিস্সার ব্যাপারেও ভিন্ন মত পোষণ করেন। তাদের মতে কন্যা সন্তান একজন হলে মোট সম্পদের অর্ধেক পায়, একাধিক হলে দু’তৃতীয়াংশ পায় এবং তাদের সাথে ছেলে সন্তানও থাকলে একজন পুরুষ দু’জন নারীর সমান হিস্সা হিসাবে অতিরিক্ত অংশে অংশীদার হয়। একাধিক কন্যা সন্তান যে দু’তৃতীয়াংশ পায়, তার প্রমাণ হিসাবে তারা সূরা নিসার ১২ নং আয়াতকে পেশ করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন: فَإِنْ كُنَّ نِسَاءً فَوْقَ اثْنَتَيْنِ فَلَهُنَّ ثُلُثَا مَا تَرَكَ “সুতরাং যদি তারা দু’এর অধিক কন্যা সন্তান হয়, তবে তারা দু’তৃতীয়াংশ পাবে সে যা কিছু ছেড়ে যাবে, তা থেকে।” তাদের বক্তব্য হল এই যে, যদিও আয়াতে দু’জন কন্যা সন্তানের কথা বলা হয়নি কিন্তু হাদীছ থেকে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ ছা. হজরত সা’দ বিন রাবীয়’ রা. এর দু’জন মেয়েকে মোট সম্পদের দু’তৃতীয়াংশ দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাছাড়া দু’জন বোনের হিস্সার ক্ষেত্রেও কুরআনে দু’তৃতীয়াংশের কথা বলা হয়েছে। তাদের দ্বিতীয় দলীল হল: হজরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রা. বর্ণিত হাদীছ। তাকে একজন মেয়ে, একজন ছেলের তরফের নাতিন ও একজন বোনের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন:
أَقْضِيْ فِيْهَا بِمَا قَضَى النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِلاِبْنَةِ النِّصْفُ وَلاِبْنَةِ اْلاِبْنِ السُّدُسُ تَكْمِلَةَ الثُّلُثَيْنِ وَمَا بَقِيَ فَلِلأُخْتِ فَأَتَيْنَا اَبَاموْسَيْ فَاَخْبَرْناَهُ بِقَوْلِ اِبْنِ مَسْعُوْدٍ فَقَالَ لاَ تَسْأَلُوْنِيْ مَا دَامَ هَذَا الْحَبْرُ فِيْكُمْ
‘আমি এমন রায় দেব যে রকম রায় দিয়েছিলেন রাসূলুল্লাহ ছা.। মেয়ে অর্ধাংশ পাবে, নাতিন পাবে এক ষষ্টাংশ যাতে করে দু’জনের সম্মিলিত হিস্সা দু’তৃতীয়াংশ হয়। আর বাকীটুকু পাবে বোন। আমরা হজরত আবু মূসা আশআরী রা. এর কাছে ফেরত গিয়ে তার কাছে ইবনে মাসউদ রা. এর রায়ের কথা জানালে তিনি বললেন, ‘এ ‘পন্ডিত’ যতদিন আছে, ততদিন আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা কর না।’ (বুখারী, তিরমিযী, আবু দাউদ, ইবনু মাজাহ, আল মুসতাদরাক, মুসনাদু আহমাদ)৭। এ হাদীছ থেকে জানা যায় যে, কন্যা সন্তানেরা সর্বোচ্চ দু’তৃতীয়াংশ সম্পদ পেতে পারে, তার বেশী নয়। কারণ বলা হয়েছে- ‘দু’তৃতীয়াংশ পূর্ণ করার জন্য’ অর্থাৎ তাদের হিস্সা সর্বোচ্চ দু’তৃতীয়াংশ। তাদের তৃতীয় দলীল হল: হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. বর্নীত হাদীছ। রাসূলুল্লাহ ছা. বলেছেন: عَنْ اِبْنِ عَبَّاسٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَلْحِقُوا الْفَرَائِضَ بِأَهْلِهَا فَمَا بَقِيَ فَهُوَ لأَوْلَى رَجُلٍ ذَكَرٍ ‘হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ছা. বলেছেন: সম্পদ হকদারদেরকে দিয়ে দাও। পরে যা অবশিষ্ট থাকবে তা সর্বাধিক হকদার পুরুষ লোক পাবে।’ (বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী)৮। এ হাদীছ থেকে জানা যায় যে, আছাবা হওয়ার অধিকার শুধু পুরুষের। তাই মেয়েরা দু’তৃতীয়াংশ নেয়ার পরে বাকী এক তৃতীয়াংশ লাভ করবে পুরুষ আছাবাগণ। যেমন ভাই, ভাতিজা, চাচা, চাচাত ভাই প্রভৃতি পুরুষ আছাবাগণের মধ্যে সর্বাধিক ঘনিষ্ঠ পুরুষ আত্মীয়গণ। এ দলীল প্রমাণের ভিত্তিতে জামহুর ছাহাবায়ে এজাম ও উলামায়ে কেরাম মনে করেন যে, কন্যা সন্তান যবীল ফুরূজের অন্তর্গত উত্তরাধিকারী। আর এ কারণেই তাদের হিস্সা ফিক্্রড্ বা নির্ধারিত। একজন হলে অর্ধেক ও একাধিক হলে দৃ’তৃতীয়াংশ। কোন পুরুষ আছাবা বর্তমান থাকলে মেয়ে ও বোনেরা কোন অবস্থাতেই দু’তৃতীয়াংশের বেশী পেতে পারে না।
পক্ষান্তরে হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. এর মতবাদ বিশ্লেষণ করলে জানা যায় যে, মেয়ে ও বোনেরা মাওলার অন্তর্ভুক্ত। এজন্য তারা তাদের সমস্তরের ছেলে ও ভাইদের সাথে একত্রে থাকলেও মাওলা একা থাকলেও মাওলা বলে বিবেচিত হবেন। এ কারণে তারা মোট সম্পদ লাভ করতে পারেন। এ মতবাদের স্বপক্ষে দলীল হল নিম্নরূপ:-
১. আল্লাহ তা’আলা ঘোষনা করেছেন: لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الْأُنْثَيَيْنِ “একজন পুত্র সন্তানের হিস্সা হবে দু’জন কন্যা সন্তানের হিস্সার সমান।” এ আয়াতাংশ থেকে জানা যায় যে, একজন ছেলে ঠিক ততটুকু পাবে, দু’জন মেয়ে যতটুকু পাবে। এখন দু’জন মেয়ে সমস্ত সম্পদ লাভ করতে না পারলে একজন ছেলেও কোন ভাবেই সমস্ত সম্পদের অধিকারী হতে পারবে না। এখানে এ কথা বলার কোন সুযোগ নেই যে ছেলে মেয়ে মিশ্রিত অবস্থায় থাকলে এ হুকুম প্রযোজ্য হবে, অন্যথায় নয়। কারণ মিশ্রিত অবস্থায় থাকার কোন শর্ত কুরআনের আয়াতে বর্তমান নেই।
২. আল্লাহ তা’আলা ঘোষনা করেছেন: وَلِكُلٍّ جَعَلْنَا مَوَالِيَ مِمَّا تَرَكَ الْوَالِدَانِ وَالْأَقْرَبُونَ “আর আমরা পুরুষ নারীর প্রত্যেককে পিতামাতা ও আত্মীয় স্বজনেরা যা কিছু রেখে যাবেন তাতে মাওলা বানিয়েছি।” (সূরা নিসা-৩৩)। এ আয়াতে মাওলা অর্থই হল আছাবা, যা হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা, কাতাদা রাহ. মুজাহিদ রাহ. ইবনে যায়েদ রাহ. এর কৃত তাফসীর ও মহানবীর হাদীছের মাধ্যমে জানা যায়। আর মেয়েরা আছাবা হলে তারা সমস্ত সম্পদই পাবে।
. পুরুষ মাওলা বা আছাবাগণ কন্যা সন্তানের উপস্থিতিতে আছাবা বলে পরিগণিত নন। তখন তারা হয়ত যবীল ফুরূজ হবেন অথবা বঞ্চিত থাকবেন। যেমন আল্লাহ বলেন: وَلِأَبَوَيْهِ لِكُلِّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا السُّدُسُ مِمَّا تَرَكَ إِنْ كَانَ لَهُ وَلَدٌ
“আর মৃতের পিতামাতার প্রত্যেকে মৃত ব্যক্তি যা কিছু রেখে যাবেন তাতে এক ষষ্টাংশ করে পাবেন যদি তার কোন সন্তান থাকে।” (সূরা নিসা-১১)। এ আয়াতের মাধ্যমে জানা গেল যে, কন্যা সন্তান থাকলে পিতার মত সর্বাধিক শক্তিশালী আছাবাও ‘যবীল ফুরূজ’ বলে পরিগণিত হবেন এবং এক ষষ্টাংশ নির্ধারিত হিস্সা লাভ করবেন। তখন তিনি মাওলা বা আছাবা হিসাবে পরিগণিত হয়ে এক ষষ্টাংশের অতিরিক্ত পাবেন না। পিতার পরে দ্বিতীয় শক্তিশালী আছাবা হলেন ভাই। কন্যা সন্তানের উপস্থিতিতে সে ভাই কোন হিস্সাই পাবেন না। কারণ আল্লাহ পরিষ্কারভাবে নির্দেশ দেন: وَهُوَ يَرِثُهَا إِنْ لَمْ يَكُنْ لَهَا وَلَدٌ “আর ভাই বোনের মৃত্যুতে উত্তরাধিকারী হবেন, তবে শর্ত হল যদি সে মৃত বোনের কোন সন্তান না থাকে।” (সূরা নিসা-১৭৬)। এ আয়াতে ভাইয়ের হিস্সা পাওয়ার জন্য মৃতকে নি:সন্তান হওয়ার শর্ত রাখা হয়েছে। আর কন্যাও তো সন্তান বটে। কন্যা সন্তানের কারণে, এ আয়াতের বিধান মোতাবেক, ভাইসহ সকল পুরুষ আছাবাগণ বঞ্চিত থাকবেন। কারণ আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন দূর্বল অসহায় কন্যা সন্তানদেরকে বাদ রেখে সবল কর্মক্ষম আছাবাদেরকে কোন হিস্সা দিতে অনুমতি দেন নি। কন্যা সন্তান নিজে মাওলা হওয়ার কারণেই অপরাপর সকল আছাদেরকে দূরে তাড়িয়ে দিয়েছে।
৪. সূরা নিসার ১৭৬ নং আয়াতটি ইলমুল ফারাইজ সংক্রান্ত সর্বশেষ নাযিলকৃত আয়াত হওয়ার কারণে এ আয়াতের মাধ্যমে আগেকার সকল হুকুমের উপরে এ আয়াতের বিধান প্রাধান্য পেয়েছে। হজরত সা’দ বিন রাবীয়’ রা. সংক্রান্ত হাদীছ সহ কিছু হাদীছে কন্যাদেরকে নির্ধারিত হিস্সা দিয়ে বাকী সম্পদ ভাইদেরকে রাসূলুল্লাহ ছা. দিয়েছেন বলে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে, সর্বশেষ নাযিলকৃত এ আয়াতের মাধ্যমে উহার কার্যকারিতা মানসূখ হয়ে গিয়েছে। কারণ হজরত বারা বিন আযিব রা. বলেন: عَنِ الْبَرَاءِ قَالَ آخِرُ آيَةٍ أُنْزِلَتْ مِنَ الْقُرْآنِ يَسْتَفْتُوْنَكَ قُلِ اللهُ يُفْتِيْكُمْ فِيْ الْكَلاَلَةِ হজরত বারা রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: ‘সর্বশেষ কুরআনের যে আয়াত নাযিল হয় তা হল- يَسْتَفْتُوْنَكَ قُلِ اللهُ يُفْتِيْكُمْ فِيْ الْكَلاَلَةِ - অর্থাৎ সূরা নিসার এই ১৭৬ নং আয়াত।’ (মুসলিম, বুখারী)৯।
৫. فَإِنْ كُنَّ نِسَاءً فَوْقَ اثْنَتَيْنِ فَلَهُنَّ ثُلُثَا مَا تَرَكَ “সুতরাং যদি তারা দু’এর অধিক কন্যা সন্তান হয়, তবে তারা দু’তৃতীয়াংশ পাবে সে যা কিছু ছেড়ে যাবে, তা থেকে” -এ আয়াতাংশ দ্বারা মেয়েদের হিস্সা দু’তৃতীয়াংশ নির্ধারিত হয় না। কারণ এ আয়াতাংশের পরেই একই আয়াতে বাকী এক তৃতীয়াংশের মালিকানা পিতামাতার প্রাপ্য বলে আল্লাহ ঘোষনা করে বলেন: وَلِأَبَوَيْهِ لِكُلِّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا السُّدُسُ مِمَّا تَرَكَ إِنْ كَانَ لَهُ وَلَدٌ “আর তার পিতামাতার প্রত্যেকে সে মৃত ব্যক্তি যা কিছু রেখে যাবে তাতে এক ষষ্টাংশ করে পাবেন যদি তার কোন সন্তান থাকে।” (সূরা নিসা-১১)। আয়াতের এ দু’অংশের বিধান থেকে বুঝা যায় যে, পিতামাতা এক ষষ্টাংশ করে মোট এক তৃতীয়াংশ পাবেন আর সন্তান পুত্র হোক কন্যা হোক তারা পাবে বাকী দু’তৃতীয়াংশ। এখানে কন্যাদের অবস্থান কি তা বুঝতে হলে لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الْأُنْثَيَيْنِ “একজন পুত্র সন্তানের হিস্সা হবে দু’জন কন্যা সন্তানের হিস্সার সমান”-আয়াতাংশ এবং وَلِكُلٍّ جَعَلْنَا مَوَالِيَ مِمَّا تَرَكَ الْوَالِدَانِ وَالْأَقْرَبُونَ “আর আমরা পুরুষ নারীর প্রত্যেককে পিতামাতা ও আত্মীয় স্বজনেরা যা কিছু রেখে যাবেন তাতে মাওলা বানিয়েছি”- আয়াতাংশের বিধানকে সামনে রেখে বিবেচনা করতে হবে। এখানে স্মরণ রাখতে হবে যে, আল্লাহ তা’আলা কন্যাদেরকে প্রথমে শুধু হিস্সাদার ঘোষনা করেন, অনেক পরে ঘোষনা করেন যে, পুরুষ নারীর সবাইকে মাওলা বানিয়েছি। আর দশম হিজরী সনে বিদায় হজ্জের প্রাক্ষালে সন্তানদের উপস্থিতিতে ভাইবোন পাবে না বলে নির্দেশনা দান করেন। আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা জরুরী মনে করছি, তা হল: لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الْأُنْثَيَيْنِ আয়াতাংশ দ্বারা মূলনীতি বর্ণণা করা হয়েছে এবং فَإِنْ كُنَّ نِسَاءً فَوْقَ اثْنَتَيْنِ فَلَهُنَّ ثُلُثَا مَا تَرَكَ আয়াতাংশ দ্বারা পূর্বের অংশের ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এ কারণে ব্যাখ্যা অংশের শুরুতে فَ বর্ণটি প্রয়োগ করা হয়েছে, যাকে ব্যাখ্যাদানকারী বর্ণ বা اَلْفَاءُ لِلتَّفْسِيْرِ বলা হয়। সুতরাং আয়াতের এ অংশ দিয়ে নতুন কোন মূলনীতি নির্ধারিত হবে না বরং পূর্বের আয়াতাংশের বিশ্লেষণ ও তাফসীর হবে।
৬. হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. বর্নীত হাদীছে করীমায় রাসূলুল্লাহ ছা. বলেছেন: أَلْحِقُوا الْفَرَائِضَ بِأَهْلِهَا فَمَا بَقِيَ فَهُوَ ِلأَوْلَى رَجُلٍ ذَكَرٍ ‘তোমরা উত্তরাধিকারী লোকদেরকে তাদের হিস্সা দিয়ে দাও। যা অবশিষ্ট থাকবে, তা পাবে সর্বাধিক হকদার পুরুষ লোক।’ (বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী) ১০। এ হাদীছে করীমায় ‘সর্বাধিক হকদার পুরুষলোক’ বলতে আছাবাদেরকে বুঝায় না; উহা দ্বারা পুত্র সন্তান বুঝায়। কারণ পুত্রের চেয়ে অধিক হকদার কোন পুরুষ আত্মীয় নেই। দূরবর্তী পুরুষ আছাবাগণ কখনোই ‘সর্বাধিক হকদার পুরুষলোক’ হতে পারেন না। তাছাড়া ইসলামে ‘আছাবাগিরী’ নেই বলে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ ছা. ঘোষণা করেছেন।
৭. কুরআনের মোকাবেলায় হাদীছের দলীল গ্রহন যোগ্য নয়। তাছাড়া হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. বর্ণিত হাদীছখানা ‘খবরে ওয়াহিদ’ ও ‘মুজতারাব’ বলে চিহ্নিত। আর হজরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রা. বর্ণিত হাদীছখানা দ্বারা তার নিজের ফতোয়া প্রমাণীত হয়। ‘দু’তৃতীয়াংশ পূর্ণ করার জন্য’ বাক্যটি কখনোই রাসূলুল্লাহ ছা. এর নয়। হজরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রা. এমন দাবীও করেন নি। তিনি শুধু বলেছেন: ‘আমি এমন রায় দিব যার মত রায় রাসূলুল্লাহ ছা. দিয়েছিলেন।’ উহা দ্বারা রাসূলুল্লাহ ছা. এর আমল প্রমানীত হয়, ‘বক্তব্য’ প্রমাণীত হয় না। এ কারণে দু’জন মেয়ে ও কয়েকজন নাতি-নাতিনের ক্ষেত্রে হজরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রা. এর ফতোয়া হল: দু’জন মেয়ে মোট সম্পদের দু’তুতীয়াংশ পাবে। আর বাকী এক তৃতীয়াংশ পাবে নাতি। নাতিন কিছুই পাবে না। কারণ মেয়েরা দু’তৃতীয়াংশের অধিক সম্পদ পায় না। যেমন বর্ণিত হয়েছে: عَنْ إِبْرَاهِيْمَ : فِيْ رَجُلٍ تَرَكَ اِبْنَتَيْهِ وَبَنِيْ اِبْنِهِ رِجَالاً وَنِسَاءً : فَلاِبْنَتَيْهِ الثُّلُثَانِ ، وَمَا بَقِيَ فَلِلذُّكُوْرِ دُوْنَ الْإِنَاثِ ، وَكَانَ عَبْدُ اللهِ لاَ يَزِيْدُ الْأَخَوَاتِ وَالْبَنَاتِ عَلَى الثُّلُثَيْنِ ، وَكَانَ عَلِيٌّ وَزَيْدٌ يُشَرِّكُوْنَ فِيْمَا بَيْنَهُمْ ، فَمَا بَقِيَ {لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الْأُنْثَيَيْن}. হজরত ইবরাহীম রাহ. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: কোন লোক যদি দু’জন মেয়ে ও ছেলের তরফের কয়েকজন নাতি-নাতিন রেখে মারা যায়, তবে তার দু’মেয়ে পাবে দু’তৃতীয়াংশ আর যা কিছু বাকী থাকবে, তা পাবে নাতিগণ; নাতিনেরা কিছুই পাবে না। আর আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রা. মেয়ে ও বোনদেরকে দু’তুতীয়াংশের বেশী কিছুই দিতেন না। আর হজরত আলী ও যায়েদ রা. নাতি-নাতিন উভয়কে পরস্পরের শরীক রাখতেন। সুতরাং তারা যা কিছু বাকী থাকত, তাতে ‘এক পুরুষ দুই নারীর সমান হিস্সা পাবে- এ নীতিমালা অনুসারে প্রদান করতেন। (ইবনু আবী শাইবা) ১১।
কিন্তু উলামাগণ হজরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রা. এর ফতোয়া গ্রহন না করে নাতির সাথে নাতিনকেও সম্পদে হিস্সা দেয়ার পক্ষে ফতোয়া দেন। আরেকটি বিষয় আলোচনার দাবী রাখে। তা হল: সে নাতিন আপন নাতিন ছিলেন না পালক -পুত্রের তরফের নাতিন ছিলেন, তা নিশ্চিত নয়। কারণ মক্কা-মদীনা সহ সমগ্র আরব উপত্যকায় পালক-পুত্রদেরকে ‘পুত্র’ ও তাদের সন্তানদেরকে ‘নাতি-নাতিন’ বলার প্রচলন ছিল। এজন্য এ হাদীছ দ্বারা সন্দেহাতীতভাবে কিছুই প্রমাণীত হয় না।
৮. কন্যাদেরকে আছাবা স্বীকার না করলে এমন উত্তরাধিকারীদেরকে হিস্সা দিতে হয়, কন্যাদের উপস্থিতিতে যাদের কোন হিস্সা নেই বলে কুরআনের সুস্পষ্ট ঘোষনা রয়েছে। যেমন কোন লোক তার ১০ জন মেয়ে ও একজন ভাই অথবা বোন রেখে মৃত্যু বরণ করল। এ অবস্থায় ফকীহগণের মতামত হল ১০ জন মেয়ে পাবে ২/৩ অংশ আর একজন ভাই অথবা বোন একাই পাবে ১/৩ অংশ। অথচ কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন বলেন: إِنِ امْرُؤٌ هَلَكَ لَيْسَ لَهُ وَلَدٌ وَلَهُ أُخْتٌ فَلَهَا نِصْفُ مَا تَرَكَ وَهُوَ يَرِثُهَا إِنْ لَمْ يَكُنْ لَهَا وَلَدٌ “যদি কোন লোক মারা যায় নি:সন্তান অবস্থায় আর তার কোন বোন থাকে, তাহলে সে বোন মৃত ব্যক্তি যা কিছু রেখে যাবে তার অর্ধেক পাবে। আবার বোন মারা গেলে তার ভাই হিস্সা পাবে, তবে শর্ত হল সে বোনকে নি:সন্তান হতে হবে।” (সূরা নিসা-১৭৬)। এ আয়াতের শিক্ষা অনুসারে মৃতের সন্তান থাকলে ভাই বা বোন কোন হিস্সা পেতে পারে না। সে সন্তান পুত্র হোক অথবা কন্যা, তাতে নির্দেশের কোন তারতম্য হবে না। বর্নীত আছে যে, জনৈক ব্যক্তি হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. এর কাছে এ ব্যাপারে ফতোয়া চাইলে তিনি বললেন: ‘বোন কিছুই পাবে না।’ প্রশ্নকারী বললেন এ অবস্থায় হজরত উমার রা. তো বোনকে হিস্সা দেন। তখন তিনি রেগে গিয়ে বললেন: أَنْتُمْ أَعْلَمُ أَمِ اللهُ ‘তোমরা বেশী জান না আল্লাহ বেশী জানেন।’ (আল মুসতাদরাক, বায়হাকী কুবরা, মুছান্নাফু আব্দির রায্যাক) ১২।
৯. পুরুষের জন্য মাওলা বা আছাবা হওয়ার অধিকার সীমিত করে দেয়া কুরআনের হুকুমের সুস্পষ্ট খেলাফ। কারণ কুরআনের আয়াতে- لِلرِّجَالِ نَصِيبٌ مِمَّا تَرَكَ الْوَالِدَانِ وَالْأَقْرَبُونَ وَلِلنِّسَاءِ نَصِيبٌ مِمَّا تَرَكَ الْوَالِدَانِ وَالْأَقْرَبُونَ مِمَّا قَلَّ مِنْهُ أَوْ كَثُرَ نَصِيبًا مَفْرُوضًا - বলে কম হোক বেশী হোক সকল ‘সম্পদ ও অধিকার’ (اَلْأَمْوَالُ وَالْحُقُوْقُ) -এ পুরুষের যেমন অধিকার স্বীকার করা হয়েছে নারীর অধিকারও তেমনি স্বীকার করা হয়েছে। মাওলা বা আছাবা হওয়ার অধিকারে নারীকে শামিল না করলে এ আয়াতে বর্ণিত বিধানের সরাসরি লঙ্ঘন বলে বিবেচিত হবে।
চতুর্থত: অন্য উত্তরাধিকারীর সাথে একাধিক কন্যা সন্তানের অবস্থা:
যদি মৃতের কন্যা সন্তানদের সাথে অন্য নির্ধারিত হিস্সাদার উত্তরাধিকারী বা ‘যবীল ফুরূজ’ বর্তমান থাকেন, তাহলে তাদেরকে হিস্সা দেয়ার পরে যে সম্পদ অবশিষ্ট থাকবে, তা মৃতের কন্যাগণ লাভ করবে। কন্যাদের সাথে যারা হিস্সা পাবেন তারা মৃতের খুবই ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। যেমন মৃতের পিতা, মাতা, দাদা দাদী, নানা, নানী, স্বামী ও স্ত্রী। এ আত্মীয়দেরকে হিস্সা দেয়ার পরে যা কিছু অবশিষ্ট থাকবে, কন্যাগণ তার সবটুকু লাভ করবে। কারণ কন্যাগণ মাওলা বা আছাবাদের অন্তর্ভুক্ত। আর আছাবাগণ সর্বদা অবশিষ্টাংশ লাভ করেন।
কিন্তু জামহুর উলামায়ে কেরামের মতে তারা যবীল ফুরূজদের অন্তর্ভুক্ত হিস্সাদার, যা আগেই বলা হয়েছে। তাদের মতে কন্যা একজন হলে মোট সম্পদের অর্ধেক ও একাধিক হলে মোট সম্পদের দু’তৃতীয়াংশ তাদের জন্য নির্ধারিত। কিন্তু তাদের মতানুসারে হিস্সা ভাগ করলে হিসাবে গরমিল দেখা দেয়। একজন মেয়ের বেলায় যেমন গরমিল দেখা দেয়, একাধিক মেয়ের বেলায়ও ঠিক তেমনি গরমিল দেখা দেয়। আর এ গরমিল থেকেই বুঝা যায় যে, এ সমাধানটি বিশুদ্ধ নয়, উহাতে ত্র“টি রয়েছে। একাধিক মেয়ের বেলায় গরমিলের চিত্র নীচের ছকে দেখুন:-
সমস্যা নং- ৬. যদি কোন নারী তার স্বামী, পিতামাতা ও দু’জন কন্যা সন্তান রেখে মৃত্যু বরণ করে, তাহলে ফকীহদের মতানুসারে তার সমাধান ও ‘আওল’ সৃষ্টির উদাহরণ :
সমাধান: ফকীহদের মতে তখন স্বামী পাবে ১/৪ অংশ, পিতা পাবেন ১/৬ অংশ, মাতা পাবেন ১/৬ অংশ এবং দু’জন কন্যা পাবে ২/৩ অংশ। ভগ্নাংশের হরের মধ্যে ৪, ৬ ও ৩ থাকায় ল.সা.গু হবে ১২। সুতরাং মোট সম্পদকে ১২ ভাগ করে বণ্টন করতে হবে। সেক্ষেত্রে স্বামী পাবে ৩/১২, পিতা পাবেন ২/১২, মাতা পাবেন ২/১২ এবং দু’কন্যা পাবে ৮/১২। তাতে যোগফল দাড়াবে (৩/১২ + ২/১২ + ২/১২ + ৮/১২) = ১৫/১২। তখন দেখা যাবে যে সম্পদ ১২ অংশ করা হয়েছে কিন্তু প্রাপ্য হিস্সা হল ১৫ অংশ। গত্যন্তর না থাকায় সম্পদকে ১২ এর স্থলে ১৫ অংশ করতে হবে এবং ১২ অংশের হিসাবেই সবাইকে দিতে হবে বলে তারা ফতোয়া দেন। যেমন মনে করুন সম্পদ হল মোট ৬,০০,০০০ টাকা। কুরআনের বিধান অনুসারে মৃতের সন্তান থাকলে স্বামী এক চতুর্থাংশ এবং পিতামাতার প্রত্যেকে এক ষষ্টাংশ করে পাওয়ার স্পষ্ট হুকুম রয়েছে। কিন্তু দু’জন মেয়ে থাকলে তারা মোট সম্পদের দু’তৃতীয়াংশ পাবে বলে ফকীহগণ মনে করেন। এ হিসাবে স্বামী ১,৫০,০০০ টাকা, পিতা ১,০০,০০০ টাকা ও মাতা ১,০০,০০০ টাকা এবং দু’জন কন্যা ৪,০০,০০০ টাকা পাওয়ার কথা থাকলেও ফকীহগণ হিসাবের গরমিল হওয়ার অজুহাতে সবাইকে একটু একটু করে কম দেয়ার কথা বলেন। কারণ তাদের সম্পদের ১ (পূর্ণ) অংশের স্থলে অংশ ১৫/১২ ভাগ হয়ে গরমিল হতে দেখা যায়। সেজন্য তারা উপরোক্ত মাসআলায় স্বামীকে ১,২০,০০০ টাকা পিতাকে ৮০,০০০ টাকা মাতাকে ৮০,০০০ টাকা ও মেয়েকে ৩,২০,০০০ টাকা দিয়ে সমাধান করেন। অথচ তাদের নিজেদের সূত্রমতে মেয়েদেরকে ৪,০০,০০০ টাকা দেয়ার কথা।
কিন্তু হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. এর মতবাদের আলোকে অংশ ভাগ করলে হিসাবে গরমিল হবে না। তাঁর মতবাদের আলোকে উপরোক্ত মাসআলাটির সমাধান নীচের উদাহরণে দেখুন:-
সমস্যা নং- ৭. যদি কোন নারী তার স্বামী, পিতামাতা ও দু’জন কন্যা সন্তান রেখে মৃত্যু বরণ করে, তাহলে হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. এর মতানুসারে তার সমাধানে ‘আওল’ সৃষ্টি হবে না :
সমাধান: হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. এর মতে তখন স্বামী পাবে ১/৪ অংশ, পিতা পাবেন ১/৬ অংশ, মাতা পাবেন ১/৬ অংশ এবং দু’জন কন্যা পাবে অবশিষ্ট সম্পদ। ভগ্নাংশের হরের মধ্যে ৪ ও ৬ থাকায় ল.সা.গু হবে ১২। সুতরাং মোট সম্পদকে ১২ ভাগ করে বণ্টন করতে হবে। সেক্ষেত্রে স্বামী পাবে ৩/১২, পিতা পাবেন ২/১২, মাতা পাবেন ২/১২ এবং কন্যাগণ পাবে অবশিষ্ট ৫/১২। তাতে যোগফল দাড়াবে (৩/১২ + ২/১২ + ২/১২ + ৫/১২) = ১২/১২। যেমন মনে করুন সম্পদ হল মোট ৬,০০,০০০ টাকা। কুরআনের বিধান অনুসারে মৃতের সন্তান থাকলে স্বামী এক চতুর্থাংশ এবং পিতামাতার প্রত্যেকে এক ষষ্টাংশ করে পাওয়ার স্পষ্ট বিধান রয়েছে। আর দু’জন মেয়ে অবশিষ্ট সম্পদ পাবে বলে তিনি মনে করেন। এ হিসাবে স্বামী ১,৫০,০০০ টাকা, পিতা ১,০০,০০০ টাকা ও মাতা ১,০০,০০০ টাকা এবং কন্যাগণ অবশিষ্ট ২,৫০,০০০ টাকা পেলন। তাতে হিসাবের গরমিল দেখা দেয়ার কোন কারণ নেই।
সুতরাং দেখা গেল যে, ফকীহদের মতানুসারে কন্যাদেরকে নির্ধারিত হিস্সা দিতে গেলে আওলের এ উপস্থিতি ত্র“টিপূর্ণ সিদ্ধান্তের প্রমাণ। অথচ তারা একাধিক মেয়েকে যত হিস্সা দেন, মেয়েদের স্থলে এক বা একাধিক ছেলে থাকলে তাদেরকে ততটুকু দিতে রাজী নন। আর কুরআনের সুস্পষ্ট শিক্ষা হল এই যে, মেয়েরা কোন অবস্থাতেই ছেলের চাইতে বেশী পেতে পারে না। নীচের ছকে উপরের ছকের আত্মীয়দের উপস্থিতিতে মেয়েদের স্থলে ছেলের হিস্সা দেখানো হল।
সমস্যা নং- ৮. যদি কোন নারী তার স্বামী, পিতামাতা ও এক বা একাধিক পুত্র সন্তান রেখে মৃত্যু বরণ করেন, তাহলে তার সমাধান: [ঐক্যমত্য অনুসারে] :
সমাধান: তখন স্বামী পাবে ১/৪ অংশ, পিতা পাবেন ১/৬ অংশ, মাতা পাবেন ১/৬ অংশ এবং এক বা একাধিক পুত্র পাবে অবশিষ্ট অংশ। ভগ্নাংশের হরের মধ্যে ৪ ও ৬ থাকায় ল.সা.গু হবে ১২। সুতরাং মোট সম্পদকে ১২ ভাগ করে বণ্টন করতে হবে। সেক্ষেত্রে স্বামী পাবে ৩/১২, পিতা পাবেন ২/১২, মাতা পাবেন ২/১২ এবং এক বা একাধিক পুত্র পাবে অবশিষ্ট ৫/১২। তাতে যোগফল দাড়াবে (৩/১২ + ২/১২ + ২/১২ + ৫/১২) = ১২/১২। যেমন মনে করুন সম্পদ হল মোট ৬,০০,০০০ টাকা। কুরআনের বিধান অনুসারে মৃতের সন্তান থাকলে স্বামী এক চতুর্থাংশ এবং পিতামাতার প্রত্যেকে এক ষষ্টাংশ করে পাওয়ার স্পষ্ট বিধান রয়েছে। আর এক বা একাধিক পুত্র থাকলে তারা মাওলা বা আছাবা হিসাবে অবশিষ্টাংশ পাবে। এ হিসাবে স্বামী ১,৫০,০০০ টাকা, পিতা ১,০০,০০০ টাকা ও মাতা ১,০০,০০০ টাকা ও এক বা একাধিক পুত্র অবশিষ্ট ২,৫০,০০০ টাকা পাবে। এ সমাধানে কারো কোন ভিন্নমত নেই। সকল ছাহাবী ও উলামাগণ এ ক্ষেত্রে একমত।
সুতরাং প্রমাণীত হল যে, মেয়েদেরকে মাওলা গণ্য করে হিস্সাদান করাই কুরআনের সঠিক শিক্ষার উপর প্রতিষ্ঠিত।
পঞ্চমত: ছেলে মেয়ে মিলিত ভাবে থাকলে তাদের অবস্থা:
ছেলে মেয়ে মিলিতভাবে থাকলে, তারা সর্বদা অবশিষ্ট অংশ লাভ করেন। আর অন্য অংশীদার না থাকলে তারা মোট সম্পদ লাভ করেন। তখন তাদের মধ্যে সম্পদ বন্টনের মূলনীতি হয় لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الْأُنْثَيَيْنِ “একজন পুরুষ দু’জন নারীর সমান হিস্সা পাবে।” এ পঞ্চম অবস্থাটাই শুধু মতবিরোধ বিহীন। সকল ছাহাবী ও উলামায়ে কেরামের সকলে একই মত প্রকাশ করেন।
তুলনামূলক আলোচনা:
আসুন এবার যুক্তির বিচারে আলোচনা করে দেখি কোন্ দলের ব্যাখ্যা অধিক যুক্তি সংগত ও কুরআন হাদীছের চেতনার সাথে অধিক সংগতিপূর্ণ।
ক. হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. এর সমাধান গ্রহন করলে হিসাবের কোন গরমিল দেখা দেয় না। শুধু একজন কন্যা হলে তার অংশ মোট সম্পদের ১/২ অংশের স্থলে অবশিষ্ট সম্পদের ১/২ অংশে দাড়ায় আর একাধিক কন্যার বেলায় তাদের অংশ মোট সম্পদের ২/৩ অংশের স্থলে অবশিষ্ট সম্পদে পরিবর্তিত হয়। কুরআনে বর্ণিত আয়াতের দিকে গভীর দৃষ্টি দিয়ে অনুধাবন করার চেষ্টা করলে বুঝা যায় যে, এটাই যথার্থ ও সঠিক। কারণ উপরোক্ত অবস্থায় মেয়েদের স্থলে যদি ছেলে হত, তাহলে ছেলেও সেই অবশিষ্ট ৫/১২ অংশই পেত টাকার অংকে যা ২,৫০,০০০ টাকা। আর এ কথাটা স্বত:সিদ্ধ যে, মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে বেশী পেতে পারে না। আশ্চর্য জনক কথা হল এই যে, একজন ছেলে যেখানে ২,৫০,০০০ টাকা পায়, সেখানে ছেলের স্থলে একজন মেয়ে হলে সে কেমন করে ২,৭৬,৯২৩.০৮ টাকা পাবে? (৩ নং সমস্যা মোতাবেক) কিংবা একাধিক মেয়ে হলে তারা ৩,২০,০০০ টাকা পাবে? (৬ নং সমস্যা মোতাবেক) অথচ আওলের প্রবক্তাগণ তাই বলেছেন।
খ. আওল হওয়াই প্রমাণ করে অংকে কোথাও ভুল হয়েছে। অংক ও গণিত শাস্ত্রের স্রষ্টা হলেন আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন। তিনি তো কোন ভুল করতে পারেন না। আর তিনি বলেছেন: مَا تَرَى فِي خَلْقِ الرَّحْمَنِ مِنْ تَفَاوُتٍ “তুমি রাহমানের সৃষ্টিতে কোন খুঁত দেখতে পাবে না।” (সূরা আল্ মুল্ক - ৩)। নিশ্চয়ই কুরআনের ব্যাখ্যা গ্রহন ও ভগ্নাংশের হিসাবে ফকীহদের ভুল হয়েছে। কিন্তু হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. এর হিসাবে গরমিল বা কোন ভুল নেই।
গ. হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. এর পেশ করা সূরা নিসার ৩৩ নং আয়াতের দলীলের বিপরীতে ফকীহদের কাছে সন্তোষজনক কোন জবাব নেই।
ঘ. আছাবা সংক্রান্ত হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. বর্ণিত হাদীছখানা একটি বিচ্ছিন্ন হাদীছ বা খবরে ওয়াহিদ। তাছাড়া তিনি নিজে বর্ণণাকারী হওয়া সত্বেও এ হাদীছের বাইরে গিয়ে যখন মত প্রকাশ করলেন, তাতে এ হাদীছখানার ব্যাপারে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। উপরন্তু ইমাম তাহাবী রাহ. এ হাদীছখানাকে ‘মুজতারাব’ বা ‘জটিলতা সৃষ্টিকারী’ বলে অভিহিত করেছেন।
ঙ. একাধিক কন্যাসন্তানকে মোট সম্পদের দু’তৃতীয়াংশ দেয়ার ব্যাখ্যাটি সূরা নিসার ১১ নং আয়াতের প্রথমাংশের মর্মার্থের স্পষ্ট বিরোধী। কারণ একজন ছেলে যদি সম্পূর্ণ সম্পদ পায়, তাহলে দু’জন মেয়েও তো সম্পূর্ণ সম্পদ পাওয়ার কথা। আবার এর বিপরীত অর্থে- আলোচ্য অংকে দু’জন মেয়ে ঠিক ততটুকু পাবে, তাদের স্থলে একজন ছেলে হলে সে যতটুকু পেত। দু’জন মেয়েরাও তো একজন ছেলের সমান হিস্সার অতিরিক্ত পেতে পারে না। এ বিষয়টি নিশ্চিত করলে কোন আওল হবে না।
চ. মেয়েরা মাওলা হতে পারে না- এ মতটি আয়াতের প্রথমাংশের বিরোধী। আয়াতাংশের মর্ম অনুসারে দু’জন মেয়ে যতটুকু সম্পদ পায় ও অধিকার ভোগ করে একজন ছেলে ঠিক ততটুকু পাবে, এর চেয়ে বিন্দু পরিমান বেশী পেতে পরে না।
ছ. ছেলেমেয়েরা মিশ্রিত অবস্থায় থাকলে ‘একজন ছেলে দু’জন মেয়ের সমান হিস্সা পাবে’ অন্যথায় নয় - ফকীহদের এ দাবী কুরআন সমর্থিত নয়। আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন ‘মিশ্রিত অবস্থায়’ থাকার কোন শর্ত আরোপ করেন নি। কোন দলীল ব্যাতীত আয়াতের সাধারণ বা ‘আম’ হুকুমকে স্পেশাল বা ‘খাছ’ করা অর্থাৎ শর্তহীন হুকুমকে শর্তযুক্ত করা কোনভাবেই জায়েয নয়।
উপরোক্ত যুক্তি সমূহকে বিবেচনায় রেখে আয়াতে করীমার দু’অংশের মর্মার্থকে ব্যাখ্যা করলে যা দাড়ায়, তা হল:
يُوصِيكُمُ اللَّهُ فِي أَوْلَادِكُمْ لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الْأُنْثَيَيْنِ فَإِنْ كُنَّ نِسَاءً فَوْقَ اثْنَتَيْنِ فَلَهُنَّ ثُلُثَا مَا تَرَكَ (وَالثُلُثُ اْلاَخِيْرُ لِلوَالِدَيْنِ) وَإِنْ كَانَتْ وَاحِدَةً فَلَهَا النِّصْفُ اَىْ نِصْفُ حَظِّ الذَّكَرِ وَلِأَبَوَيْهِ لِكُلِّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا السُّدُسُ مِمَّا تَرَكَ إِنْ كَانَ لَهُ وَلَدٌ اَىْ لِاَبَوَيْهِ الثُّلُثُ
“সন্তানদের ব্যাপারে আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশনা দিচ্ছেন: ‘একজন পুরুষ দু’জন নারীর সমান হিস্সা পাবে। সুতরাং যদি তারা দু’এর অধিক কন্যা সন্তান হয়, তবে তারা মৃত লোক যা কিছু ছেড়ে যাবে তার দু’তৃতীয়াংশ পাবে (বাকী এক তৃতীয়াংশ পিতামাতার জন্য থাকবে); আর যদি একজন হয়, তবে সে পাবে অর্ধেক অর্থাৎ ছেলের হিস্সার অর্ধেক। আর সন্তান থাকলে পিতামাতার প্রত্যেকে এক ষষ্টাংশ করে পাবে অর্থাৎ মোট এক তৃতীয়াংশ পাবে।” এ ব্যাখ্যা গ্রহন করলে মেয়ে একজন হলে অবশিষ্ট অংশের অর্ধেক, একাধিক হলে কিংবা ছেলেমেয়ে মিলিতভাবে থাকলে অবশিষ্ট অংশ লাভ করবে।
এবার পিতামাতার সাথে একজন মেয়ের হিস্সা নীচের ছকে দেখুন:-
সমস্যা নং - ৯. যদি কোন নারী কিংবা পুরুষ তার পিতামাতা ও একজন কন্যা সন্তান রেখে মৃত্যু বরণ করেন, তাহলে তার সমাধান হবে নিম্নরূপ:
সমাধান: কুরআন মোতাবেক কোন সন্তান থাকলে পিতামাতার প্রত্যেকে পান এক ষষ্টাংশ করে। এ হিসাবে পিতা পাবেন ১/৬ অংশ, মাতা পাবেন ১/৬ অংশ এবং একজন কন্যা সন্তান অর্ধেক মাওলা হওয়ার কারণে সে পাবে অবশিষ্টাংশের অর্ধেক। পিতামাতার অংশের পরে অবশিষ্ট থাকে {১ - (১/৬ + ১/৬)}= {১ - ২/৬} = ৪/৬ অংশ যা ছেলে থাকলে পেত। তার অর্ধেক মেয়েকে দেয়া হল, আর তা হল ৪/৬ ২ = ২/৬ অংশ। বাকী থেকে যায় = (৪/৬ - ২/৬ ) = ২/৬ অংশ, যার কোন হকদার নেই, তাই রদ্দ বা পুন:বণ্টণ হল। রদ্দের নিয়ম অনুসারে সম্পদকে ছয় ভাগ না করে চার ভাগ করা হল। যে চার ভাগের মধ্যে পিতা ১ অংশ, মাতা ১ অংশ ও মেয়ে ২ অংশ পাবে। মনে করি মোট সম্পদ হল ৬,০০,০০০ টাকা। তার মধ্যে পিতা পাবেন ১,৫০,০০০/- টাকা, মাতা পাবেন ১,৫০,০০০/- টাকা ও কন্যা পাবে ৩,০০,০০০/- টাকা। তাতে দেখা গেল যে, মেয়ে মোট সম্পদের অর্ধেকই পেয়েছে। এখানে পিতাকে মাওলা বানিয়ে অতিরিক্ত অংশ দেয়া হয়নি, কারণ কুরআন দ্বারা উহা স্বীকৃত নয়। অপরদিকে পিতামাতার হিস্সাও সমান হয়েছে, যা আয়াতের বর্ণিত হিস্সার সমতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কারণ সন্তান থাকলে পিতামাতার হিস্সা সমান করে আল্লাহ বিধান দিয়েছেন।
এবার দু’জন বা তার চেয়ে অধিক মেয়ের হিস্সা নীচের ছকে দেখুন:-
সমস্যা নং - ১০. যদি কোন নারী কিংবা পুরুষ তার পিতামাতা ও দু’ বা ততোধিক কন্যা সন্তান রেখে মৃত্যু বরণ করে, তাহলে তার সমাধান হবে নিম্নরূপ:
সমাধান: কুরআন মোতাবেক কোন সন্তান থাকলে পিতামাতার প্রত্যেকে পান এক ষষ্টাংশ করে। এ হিসাবে পিতা পাবেন ১/৬ অংশ, মাতা পাবেন ১/৬ অংশ এবং কন্যাগণ মাওলা হওয়ার কারণে পাবে অবশিষ্টাংশ। পিতামাতার অংশের পরে অবশিষ্ট থাকে {১ - (১/৬ + ১/৬)}= {১ - ২/৬} = ৪/৬ অংশ। মোট সম্পদকে ছয়ভাগ করে সে ছয় ভাগের মধ্যে পিতা ১ অংশ, মাতা ১ অংশ ও মেয়েরা অবশিষ্ট ৪ অংশ পাবে। মনে করি মোট সম্পদ হল ৬,০০,০০০ টাকা। তার মধ্যে পিতা পাবেন ১,০০,০০০/- টাকা, মাতা পাবেন ১,০০,০০০/- টাকা ও কন্যাগণ পাবে ৪,০০,০০০/- টাকা। তাতে দেখা যাচ্ছে যে, কন্যাগণ মোট সম্পদের দু’তৃতীয়াংশ ও পিতামাতা যৌথভাবে এক তৃতীয়াংশ পেয়েছেন।
ছেলেমেয়েরা যে অবশিষ্ট অংশ পায় তার প্রমাণ: ছেলেমেয়েরা পিতামাতার প্রকৃত উত্তরাধিকারী। তাদের জন্য কোন হিস্সা নির্দিষ্ট নেই। যে সম্পদ তাদের পিতামাতা অর্জন করে ছিলেন তা প্রকৃত পক্ষে তাদের জন্যই অর্জন করে ছিলেন। অন্য হকদারগণ তাতে যবীল ফুরূজ হিসাবে নির্ধারিত অল্প কিছু হিস্সা পাবেন ও বাকীটুকু সন্তানদের জন্য থাকবে। এ বক্তব্য নীচের দলীলগুলো দ্বারা প্রমানীত হবে:
ক. আল্লাহ বলেন: وَإِنِّيْ خِفْتُ الْمَوَالِيَ مِنْ وَرَائِيْ وَكَانَتِ امْرَأَتِيْ عَاقِرًا فَهَبْ لِيْ مِنْ لَدُنْكَ وَلِيًّا يَرِثُنِيْ وَيَرِثُ مِنْ آَلِ يَعْقُوْبَ وَاجْعَلْهُ رَبِّ رَضِيًّا “আর আমার পরে কে আমার উত্তরসূরী হবে তা নিয়ে আমি শংকিত আছি এবং-(কারণ) আমার স্ত্রী হল বন্ধ্যা। সুতরাং হে আল্লাহ, তুমি আমাকে একজন ‘ওলী’- সন্তান দান কর; যে আমার ও ‘ইয়াকুব বংশের’ (প্রকৃত) উত্তরাধিকারী হবে। আর হে প্রভু, তাকে তোমার সন্তুষ্টি হাসিলের উপযোগী বানাও। (সূরা মরিয়াম-৫-৬)।
খ. কুরআনে দু’জন মেয়ের হিস্সা না বলে দু’জনের অধিক মেয়ের হিস্সা বলার দ্বারাই প্রমাণীত হয় যে, মেয়ের সংখ্যা দু’জন হলে এবং কোন ছেলে না থাকলে তারা অবশিষ্ট সম্পদ পাবে যেমন একজন ছেলে থাকলে পেত। আল্লাহ দু’জন মেয়ের হিস্সার কথা এ কারণে স্পষ্ট করে বলেন নি কারণ لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الْأُنْثَيَيْنِ বলার সাথে সাথে দু’জন মেয়ের হিস্সার কথা বর্ণিত হয়েছে।
গ. এ ব্যাখ্যা সঠিক হওয়ার সবচেয়ে বড় প্রমাণ আওল না হওয়া। অন্য ব্যাখ্যা মোতাবেক হিস্সা দিলে অংক মিলে না; কারণ সূত্রে ভুল। আর আলোচ্য সূত্র সঠিক হওয়ার কারণে কন্যাগণকে মাওলা গণ্য করে অবশিষ্ট সম্পদ দিতে রাজী হলে আওল হয় না বরং অংক মিলে যায়।
ঘ. আল্লাহ যখন বললেন ‘একজন ছেলের হিস্সা দু’জন মেয়ের হিস্সার সমান’, তখন একথা স্বাভাবিকভাবেই আসে যে, তাহলে একজন মেয়ের হিস্সা হবে একজন ছেলের হিস্সার অর্থেক। আর এ কথাটাই আল্লাহ বলেছেন: وَإِنْ كَانَتْ وَاحِدَةً فَلَهَا النِّصْفُ ‘‘মেয়ে একজন হলে সে পাবে অর্ধেক” এই বলে। যুক্তি অন্তত তাই বলে।
ঙ. যদি মেয়ের সংখ্যা দু’জনের অধিক হয়, তাহলে তারা দু’তৃতীয়াংশ পায় বলে কুরআনে যে কথা বলা হয়েছে সে কথার সাথে এ কথাও যুক্তভাবে বলা আছে যে, পিতামাতার পত্যেকে এক ষষ্টাংশ করে পাবেন। আল্লাহ বলেন:
فَإِنْ كُنَّ نِسَاءً فَوْقَ اثْنَتَيْنِ فَلَهُنَّ ثُلُثَا مَا تَرَكَ وَإِنْ كَانَتْ وَاحِدَةً فَلَهَا النِّصْفُ وَلِأَبَوَيْهِ لِكُلِّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا السُّدُسُ مِمَّا تَرَكَ إِنْ كَانَ لَهُ وَلَدٌ “সুতরাং যদি তারা দু’এর অধিক কন্যা সন্তান হয়, তবে তারা দু’তৃতীয়াংশ পাবে সে যা কিছু ছেড়ে যাবে, তা থেকে। আর যদি একজন হয়, তবে সে পাবে অর্ধেক এবং তার পিতামাতার প্রত্যেকে এক ষষ্টাংশ করে পাবেন যদি তার কোন সন্তান থাকে।” (সূরা নিসা-১১)। এখানে লক্ষ্য করুন- ‘পিতামাতার প্রত্যেকে এক ষষ্টাংশ করে পাবেন’ এ কথাটির আগে সংযুক্ত পদ বা ‘হরফে আত্ফ’ ব্যবহার করা হয়েছে। এর মাধ্যমে আগের নির্দেশের ধারাবাহিকতা বুঝা যায়। অর্থাৎ মেয়েদের হিস্সার সাথে পিতামাতার হিস্সা সংযুক্ত। এখন দু’জনের অধিক মেয়ে যদি দু’তৃতীয়াংশ পায় আর বাকী এক তৃতীয়াংশ পিতামাতা পান তাহলে ২/৩ + ১/৩ = ১ সূত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এখন যদি দু’জনের অধিক মেয়ের স্থলে এক বা একাধিক ছেলে থাকে, তাহলে তারা কতটুকু পায়? উত্তর হল তখন এক বা একাধিক ছেলে পাবে দু’তৃতীয়াংশ আর এক তৃতীয়াংশ পাবেন পিতামাতা। তাহলে কি দাড়াল? পিতামাতার হিস্সা সর্বাবস্থায় এক তৃতীয়াংশ আর বাকী দু’তৃতীয়াংশ এক বা একাধিক ছেলে থাকলে সে পাবে অথবা একাধিক মেয়ে থাকলে তারা লাভ করবে।
চ. হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. বলেন: اَلْمِيْرَاثُ لِلْوَلَدِ فَاِنْتَزَعَ اللهُ تَعَالَي مِنْهُ لِلزَّوْجِ وَالْوَالِدِ ‘সম্পদ মূলে সন্তানের জন্য ছিল। আল্লাহ সেখান থেকে পিতামাতা ও স্বামী-স্ত্রীকে ছিনিয়ে নিয়ে হিস্সা দিয়েছেন।’ (মুছান্নাফু আব্দির রাজ্জাক) ১৩। তার এ বক্তব্য ‘সম্পদে সন্তানের হক বেশী’ এ দাবীকে সত্যায়িত করে। আয়াতের প্রথম অংশে আল্লাহ তা’আলা সন্তানদের ব্যাপারে মৌলিক নীতিমালা জারী করেছেন। আর পরবর্তী অংশে উদাহরণ দিয়েছেন। তিনি বললেন সম্পদ বন্টণে একজন পুরুষ সন্তানের হিস্সা দু’জন নারী সন্তানের সমান। এ কথা থেকে জানা গেল যে, ছেলেমেয়ে দু’রকম সন্তান যদি একসাথে থাকেন, তাহলে একজন ছেলে দু’জন মেয়ের সমান হিস্সা পাবে। কিন্তু যদি কোন মেয়ে না থাকে শুধু ছেলে থাকে তাহলে সেই ছেলের হিস্সা কত, তা বলেন নি। প্রচ্ছন্নভাবে এটা ধারণা করা যায় যে, ছেলে তো সম্পূর্ণ সম্পদ পাবে। কিন্তু নিছক ধারণার ভিত্তিতে কোন কিছু প্রমাণ করা যায় না। কেউ কেউ বলেন শুধুমাত্র একজন ছেলে হলে তার হিস্সা কত তা প্রমাণীত হয় একজন মেয়ের হিস্সা দেখে। একমাত্র সন্তান যদি একজন মেয়ে হয় তাহলে তার হিস্সা হল মোট সম্পদের অর্ধেক। সুতরাং একমাত্র সন্তান যদি একজন ছেলে হয় তাহলে তার হিস্সা হবে মোট সম্পদের অর্ধেকের দ্বিগুণ অর্থাৎ সম্পূর্ণ সম্পদ। কারণ আল্লাহ বলেছেন ‘একজন পুরুষ দু’জন নারীর সমান হিস্সা পাবে’। এখানে মিশ্রিত অবস্থা ছাড়া বিচ্ছিন্ন অবস্থায় শুধু মেয়ের অবস্থা দিয়ে শুধু ছেলের অবস্থা প্রমাণ করা হল। সুতরাং যুক্তি অনুসারে এদাবীটা এ সাথে প্রমাণীত হয়ে যায় যে, মিশ্রিত অবস্থা ছাড়া একমাত্র সন্তান একজন ছেলে যদি সম্পূর্ণ সম্পদ পেতে পারে, তাহলে মিশ্রিত অবস্থা ছাড়া একমাত্র সন্তান দু’জন মেয়েও সম্পূর্ণ সম্পদ পাবে। আমরা আয়াতে করীমার প্রথম অংশ দিয়ে প্রমাণ করলাম যে, একমাত্র সন্তান দু’জন মেয়ে হলে তারা সম্পূর্ণ সম্পদের হকদার। এবারে আসুন আলোচনা করি যে, অন্য যবীল ফুরূজ থাকলে একমাত্র সন্তান ছেলে কতটুকু পায়। এর উত্তর হাদীছ শরীফ থেকে জানা যায়। বর্ণিত আছে: عَنْ اِبْنِ عَبَّاسٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَلْحِقُوا الْفَرَائِضَ بِأَهْلِهَا فَمَا بَقِيَ فَهُوَ لأَوْلَى رَجُلٍ ذَكَرٍ ‘হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ছা. বলেছেন: সম্পদ হকদারদেরকে দিয়ে দাও। পরে যা অবশিষ্ট থাকবে তা সর্বাধিক হকদার পুরুষ লোক পাবে।’ (বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী) ১৪। এ হাদীছ থেকে জানা গেল যে, অন্যান্য যবীল ফুরূজ নিজেদের হিস্সা নেয়ার পরে যা কিছু অবশিষ্ট থাকবে তা পাবে মৃতের একমাত্র ছেলে। কারণ সর্বোৎকৃষ্ট পুরুষ লোক ছেলে ছাড়া অন্য কেউ নয়। এ ব্যাখ্যা থেকে একথাও প্রমাণীত হল যে, মেয়ে যদি দু’জন হয়, তাহলে তারা একজন ছেলের সমান হিস্সা পাবে আর যদি মেয়ে একজন হয়, তাহলে সে একজন ছেলের অর্ধেক হিস্সা পাবে। এ হিসাব ছেলে মেয়ে মিলিতভাবে থাকলে যেমন সত্য. বিচ্ছিন্নভাবে শুধু ছেলে কিংবা শুধু মেয়ে থাকলেও সেরকম সত্য, কোন ব্যত্যয় হবে না।
কিন্তু পরবর্তীতে আয়াতের অপর অংশে আল্লাহ তা’আলা বলেন: فَإِنْ كُنَّ نِسَاءً فَوْقَ اثْنَتَيْنِ فَلَهُنَّ ثُلُثَا مَا تَرَكَ وَإِنْ كَانَتْ وَاحِدَةً فَلَهَا النِّصْفُ وَلِأَبَوَيْهِ لِكُلِّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا السُّدُسُ مِمَّا تَرَكَ إِنْ كَانَ لَهُ وَلَدٌ “সুতরাং যদি তারা দু’এর অধিক কন্যা সন্তান হয়, তবে তারা দু’তৃতীয়াংশ পাবে সে যা কিছু ছেড়ে যাবে, তা থেকে। আর যদি একজন হয়, তবে সে পাবে অর্ধেক এবং তার পিতামাতার প্রত্যেকে এক ষষ্টাংশ করে পাবেন যদি তার কোন সন্তান থাকে।” (সূরা আল বাকারা-১১)। আয়াতের এ অংশ প্রথমাংশের সাথে বেমানান ও সাংঘর্ষিক মনে হয়। ব্যাখ্যার মাধ্যমে আয়াতের দু অংশের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করতে হবে, নতুবা এ সমস্যার সমাধান হবে না। মেয়েরা মাওলা হতে পারে কি না; মেয়েদের জন্য নির্ধারিত হিস্সা বর্ণণা করা হয়েছে কি না ও আওল কেন হয়- এ সকল প্রশ্নের উত্তর এখানেই নিহিত। আয়াতের প্রতি একটু গভীরভাবে লক্ষ্য করুন। আল্লাহ কি বলেছেন যে, ছেলে ও মেয়েরা মিশ্রিতভাবে থাকলে একজন ছেলে দু’জন মেয়ের সমান হিস্সা পাবে? বলেন নি। মিশ্রিতভাবে থাকার শর্ত মানুষ আরোপ করেছে, আল্লাহ নন। আর এ কারণে আওলের জন্ম হয়েছে। এবং আল্লাহ তা’আলা বলেন: وَإِنْ كَانَتْ وَاحِدَةً فَلَهَا النِّصْفُ ‘‘মেয়ে একজন হলে সে পাবে অর্ধেক।” কিসের অর্ধেক? মোট সম্পদের অর্ধেক ! অবশিষ্ট সম্পদের অর্ধেক! না একজন ছেলের হিস্সার অর্ধেক! এটা কি আল্লাহ পরিষ্কার করে বলেছেন? বলেন নি। আমরা যদি এ প্রশ্ন গুলোর উত্তর এ ভাবে সাজাই যে, ছেলে মেয়ে মিশ্রিতভাবে থাকুক আর না থাকুক সর্বাবস্থায় একজন ছেলে দু’জন মেয়ের সমান হিস্সা পাবে। বিপরীতপক্ষে একজন মেয়ে হলে সে সর্বাবস্থায় একজন ছেলের হিস্সার অর্ধেক পাবে; তাহলে আয়াতের দু’অংশের মধ্যে সামঞ্জস্য হয়ে যায়। আর ‘ইশারাতুন্ নাছ’ ও তাই বলে। একজন ছেলে যদি দু’জন মেয়ের সমান হিস্সা পায়, তাহলে একজন মেয়ে পাবে একজন ছেলের হিস্সার অর্ধেক। অন্যকথায় : وَإِنْ كَانَتْ وَاحِدَةً فَلَهَا نِصْفُ حَظِّ الذَّكَرِ - ছেলেমেয়েদের মধ্যে যদি একজন মাত্র মেয়ে হয়, তাহলে সে পাবে- একজন ছেলে থাকলে সে যতটুকু পেত তার অর্ধেক। ছেলে মোট সম্পদ পাবার হলে সে পাবে মোট সম্পদের অর্ধেক; ছেলে অবশিষ্ট সম্পদ পাবার হলে সে পাবে সেই অবশিষ্ট সম্পদের অর্ধেক। আর যদি মেয়ে দু’জন হয়, তাহলে তারা পাবে একজন ছেলে থাকলে যতটুকু পেত তার সমান হিস্সা। এ ব্যাখ্যা গ্রহন করলে কন্যাদেরকে মাওলাও গণ্য করা হয়ে যায়, আওল এড়ানোও সম্ভব হয় এবং সূরা নিসার ৭, ১১ ও ৩৩ নং আয়াতের মধ্যকার বিরোধও তিরোহিত হয়। তাছাড়া উপরে উল্লেখিত হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাসের বর্ণিত হাদীছ খানার ব্যাখ্যাও বোধগম্য হয়। উপরোক্ত ব্যাখ্যার ভিত্তিতে একজন মেয়ের ক্ষেত্রে কোন জটিলতা দেখা দেয় না। কিন্তু মেয়েদের সংখ্যা যদি একাধিক হয় এবং কোন ছেলে না থাকে, তাহলে মেয়েরা কতটুকু পাবে, তা নিয়ে বাহ্যিকভাবে একটু জটিলতা দেখা দেয়। আয়াতে করীমার অপর অংশে আল্লাহ তা’আলা বলছেন: ‘‘যদি তারা দু’এর অধিক কন্যা সন্তান হয়, তবে তারা দু’তৃতীয়াংশ পাবে মৃত লোক যা কিছু ছেড়ে যাবে, তা থেকে।” এর অর্থ কি এবং এখানে দু’জন মেয়ে হলে কতটুকু পাবে তা বলা হল নাইবা কেন, এ প্রশ্ন থেকে যায়। এর উত্তর হল- আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন এখানে গাণিতিক বিশ্লেষণে বিধান জারী করছেন। তিনি যখন বললেন- يُوصِيْكُمُ اللهُ فِيْ أَوْلَادِكُمْ لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الْأُنْثَيَيْنِ “তোমাদের সন্তানদের ব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশনা হল- একজন পুরুষ দু’জন নারীর সমান হিস্সা পাবে।” সেখানে তো তিনি দু’জন কন্যা সন্তানের অবস্থা বলেই দিলেন। আর একজন কন্যা হলে কতটুকু পাবে তা বলে দিলেন- وَإِنْ كَانَتْ وَاحِدَةً فَلَهَا النِّصْفُ “আর যদি একজন হয়, তবে সে অর্ধেক পাবে”- এ কথা বলে। দু’য়ের অধিক কন্যা সন্তানের জন্য দু’তৃতীংাংশ বলে যে কথা বলা হয়েছে সে কথার সাথে এও বলা হয়েছে যে, পিতামাতার জন্য এক ষষ্টাংশ করে বাকী এক তৃতীয়াংশ নির্ধারিত থাকবে। মধ্যখানে শুধু বলা হয়েছে- ‘‘আর যদি একজন হয়, তবে সে অর্ধেক পাবে।” আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন এ পদ্ধতিতে অন্যান্য স্থানেও নির্দেশনা দিয়েছেন। যেমন সূরা নিসার ১৭৬ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন:
يَسْتَفْتُونَكَ قُلِ اللَّهُ يُفْتِيكُمْ فِي الْكَلَالَةِ إِنِ امْرُؤٌ هَلَكَ لَيْسَ لَهُ وَلَدٌ وَلَهُ أُخْتٌ فَلَهَا نِصْفُ مَا تَرَكَ وَهُوَ يَرِثُهَا إِنْ لَمْ يَكُنْ لَهَا وَلَدٌ فَإِنْ كَانَتَا اثْنَتَيْنِ فَلَهُمَا الثُّلُثَانِ مِمَّا تَرَكَ وَإِنْ كَانُوا إِخْوَةً رِجَالًا وَنِسَاءً فَلِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الْأُنْثَيَيْنِ “হে নবী, তোমার কাছে তারা ফতোয়া জিজ্ঞাসা করে। তুমি বলে দাও যে, আল্ল¬াহ ‘কালালার’ ব্যাপারে ফতোয়া দিচ্ছেন: যদি কোন নি:সন্তান লোক মারা যায় আর তার একজন বোন থাকে, তবে সে বোন মৃত ব্যক্তি যা কিছু ছেড়ে যাবে তার অর্ধেক পাবে। - এবং সে ব্যাক্তিও তার মৃত বোনের উত্তরাধিকারী হবে তবে শর্ত হল সে (মৃত বোন) নি:সন্তান হতে হবে,- সুতরাং তারা (বোন) যদি সংখ্যায় দু’জন হয়, তবে তারা দু’তৃতীয়াংশ পাবে মৃত ব্যক্তি যা কিছু ছেড়ে যাবে, তা থেকে। আর যদি তারা (উত্তরাধিকারীগণ) পুরুষ ও নারী মিলে কয়েকজন ভাইবোন হয়, তবে একজন পুরুষ দু’জন নারীর সমান হিস্সা পাবে।” এখানে লক্ষ্য করুন- বোনদের কথার মধ্যখানে আল্লাহ বলছেন - এবং সে ব্যাক্তিও তার মৃত বোনের উত্তরাধিকারী হবে তবে শর্ত হল সে (মৃত বোন) নি:সন্তান হতে হবে,- একথা বলার পরে আবার বোনদের কথা বলে যাচ্ছেন। এটা আল্লাহ জাল্লা শানুহুর একটি বর্ণণা পদ্ধতি। কম কথায় বেশী মর্ম বুঝাতে এ পদ্ধতি খুবই কার্যকর। কিন্তু বাহ্যিকভাবে দেখলে বুঝা যায় যে, কন্যা একজন হলে অর্ধেক ও দু’এর অধিক হলে দু’তৃতীয়াংশ তাদের প্রাপ্য। এই মধ্যখানে বলা বাক্যটিকে আরবীতে ‘বিচ্ছিন্ন বাক্য’ বা اَلْجُمْلَةُ الْمُعْتَرِضَةُ বলা হয়।
প্রকৃতপক্ষে لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الْأُنْثَيَيْنِ - এ আয়াতাংশে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন গাণিতিক হিসাব পদ্ধতি ‘সমীকরণের’ দিকে ইংগিত দিয়েছেন। সমীকরণ বা ‘বয়ঁধঃরড়হ’ এর মাধ্যমে আমরা যেমন করে বীজগণিতের অংক মিলাই, আল্লাহ ঠিক সে পদ্ধতিতে এখানে হিসাব করতে ইংগিত করেছেন। যেমন নীচের ‘সমীকরণটির’ দিকে লক্ষ্য করুন:
১ জন ছেলে = ২ জন মেয়ে
অথবা ২ জন মেয়ে = ১ জন ছেলে
অথবা ১ জন মেয়ে = ১/২ জন ছেলে।
উহাকে আবার ভিন্নভাবেও ব্যাখ্যা করা যায়। যেমন মনে করি- ছেলে = ধ আর মেয়ে = ন। এখন ‘একজন ছেলের হিস্সা দুই জন মেয়ের সমান’ অথবা ‘একজন ছেলে পাবে দুইজন মেয়ের সমান হিস্সা’- এ কথাটিকে গাণিতিক ভাষায় ব্যাখ্যা করলে নীচে লিখিত সমীকরণটি সৃষ্টি হবে। আজ থেকে দেড় হাজার বছর পূর্বে আল্লাহ তা’আলা সমীকরণের সূত্রে ইলমুল ফারাইজের হিসাব করেছেন, একথা ভাবলে আল্লাহর প্রতি ঈমানের মাত্রা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী। এবার সমীকরণটি দেখুন:
a = ২ b
অথবা ২ b = a
অথবা b = ১/২ a
অতএব একজন মেয়ে = ১/২ জন ছেলে (ab এবং ab এর মান বসিয়ে)।
তথ্যসূত্র
১. বুখারী-৬৩৫২, বাবু মীরালি বানাত; মুসলিম- ৪২৯৬, বাবুল ওয়াছিয়্যাতি বিছ ছুলুছ; আবু দাউদ-২৮৬৬, বাবু মা জাআ ফী মালা ইয়াজুযু; ইবনু মাজাহ-২৭০৮, বাবুল ওয়াছিয়্যাতি বিছ ছুলুছ; তিরমিযী-২১১৬, আল ওয়াছিয়্যাতু বিছ ছুলুছ; নাসায়ি-৩৬৩২, পৃ-৫৫৩, ভ-৬; মুসনাদু আহমাদ-১৪৪০, পৃ-৫০, ভ-৩; মুয়াত্তা মালিক-২৮২৪, আল ওয়াছিয়্যাতু ফিছ ছুলুছ।
২. মুসলিম-৪২২৫, বাবু ইয়াহইয়া বিন ইয়াহইয়া; বুখারী-৬৩৮৩, বাবু লা ইয়ারিছুল মুসলিমু; তিরমিযী-২৭১১, ইবতালুল মীরাছি বইনাল মুসলিম; আবু দাউদ-২৯১১, বাবু হাল ইয়ারিছুল মুসলিমুল কাফির; ইবনু মাজাহ-২৭২৯, বাবু মীরাছি আহলিল ইসলামমুসলিম-৪২২৫, বাবু ইয়াহইয়া বিন ইয়াহইয়া; বুখারী-৬৩৮৩, বাবু লা ইয়ারিছুল মুসলিমু; তিরমিযী-২৭১১, ইবতালুল মীরাছি বইনাল মুসলিম; আবু দাউদ-২৯১১, বাবু হাল ইয়ারিছুল মুসলিমুল কাফির; ইবনু মাজাহ-২৭২৯, বাবু মীরাছি আহলিল ইসলাম।
৩. বুখারী-৬৩৫০, বাবু কাওলিন নাবী ছা. ওমান তারাকা; মুসলিম-৪২৪৬, বাবু মান তারাকা মালান; নাসায়ী-১৯৬১, পৃ-৩৬৭, ভ-৪; আবু দাউদ-২৯৫৮, বাবুন ফী আরযাকিয যুররিয়্যাহ; ইবনু মাজাহ-২৪১৬, বাবু মান তারাকা দাইনান; মুসনাদু আহমাদ-১৭২০৪, পৃ-৪৩৫, ভ-২৮; ইবনু হিব্বান-৩০৬৪, বাবুল মারীজ ওয়ামা ইয়াতাআল্লাকু বিহি।
৪. বুখারী-৬৩৫২, বাবু মীরালি বানাত; মুসলিম- ৪২৯৬, বাবুল ওয়াছিয়্যাতি বিছ ছুলুছ; আবু দাউদ-২৮৬৬, বাবু মা জাআ ফী মালা ইয়াজুযু; ইবনু মাজাহ-২৭০৮, বাবুল ওয়াছিয়্যাতি বিছ ছুলুছ; তিরমিযী-২১১৬, আল ওয়াছিয়্যাতু বিছ ছুলুছ; নাসায়ি-৩৬৩২, পৃ-৫৫৩, ভ-৬; মুসনাদু আহমাদ-১৪৪০, পৃ-৫০, ভ-৩; মুয়াত্তা মালিক-২৮২৪, আল ওয়াছিয়্যাতু ফিছ ছুলুছ।
৫. মুসলিম-৪২২৮, বাবু আলহিকুল ফারাইজা বিআহলিহা; মুসনাদু আহমাদ-২৮৬০, পৃ-৫৩, ভ-৫; ইবনু মাজাহ-২৭৪০, বাবু মীরাছিল আছাবা; তাবারাণী আল মু’জামুল কাবীর-১০৯০২, আহাদীছু আব্দিল্লাহ বিন আব্বাস; মুছান্নাফু আব্দির রাজ্জাক-১৯০০৪, কিতাবুল ফারাইজ।
৬. বায়হাকী কুবরা-১২৮৩৬, বাবুল আওল ফিল ফারাইজ; জামেউল আহাদীছ-২৯৯৫০, মুসনাদু উমার বিন খাত্তব, পৃ-২৭, ভ-২২৫।
৭. বুখারী-৬৩৫৫, কিতাবুল ফারাইজ বাবু মীরাছী ইবনাতি ইবনিন মাআ ইবনাতিন; তিরমিযী- ২০৯৩ কিতাবুল ফারাইজ, বাবু মীরাছী ইবনাতিল ইবনি মাআ ইবনাতিছ ছুলব; আবু দাউদ- ২৮৯২, বাবু মা জাআ ফী মীরাছিছ ছুলব; ইবনু মাজাহ- ২৭২১, কিতাবুল ফারাইজ; আল মুসতাদরাক-৭৯৫৮, কিতাবুল ফারাইজ; মুসনাদু আহমাদ-৩৬৯১, পৃ-২১৮, ভ-৬।
৮. বুখারী- ৬৩৫১, বাবু মীরাছিল ওয়ালাদ মিন আবীহি; মুসলিম-৪২২৬, বাবু আলহিকুল ফারাইজা বিআহলিহা; তিরমিযী-২০৯৮, বাবুন ফী মীরাছিল আছাবা।
৯. মুসলিম-৪২৩৭, বাবু আখিরু আয়াতিন উনযিলাত; বুখারী-৪৩৭৭, কিতাবুত তাফসীর।
১০. বুখারী-৬৩৫১, বাবু মীরাছিল ওয়ালাদ মিন আবীহি; মুসলিম-৪২২৬, বাবু আলহিকুল ফারাইজা বিআহলিহা; তিরমিযী-২০৯৮, বাবুন ফী মীরাছিল আছাবা।
১১. ইবনু আবী শাইবা-৩১৭৪৩, ফী রাজুলিন তারাকা ইবনাতাইহি ও বনী ইবনিহি।
১২. আল মুসতাদরাক-৭৯৭৯, কিতাবুল ফারাইজ; বায়হাকী কুবরা-১২৭০৬, বাবুল আখাওয়াত মাআল বানাত আছাবা; মুছান্নাফু আব্দির রায্যাক-১৯০২৩, কিতাবুল ফারাইজ।
১৩. মুছান্নাফু আব্দির রাজ্জাক- ১৯০৩০, কিতাবুল ফারাইজ।
১৪. বুখারী- ৬৩৫১, বাবু মীরাছিল ওয়ালাদ মিন আবীহি; মুসলিম- ৪২২৬, বাবু আলহিকুল ফারাইজা বিআহলিহা; তিরমিযী-২০৯৮, বাবুন ফী মীরাছিল আছাবা।
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيْمِ
কন্যা সন্তানের অধিকার ও প্রাপ্য
কন্যা সন্তান পুত্র সন্তানের মতই পিতামাতার বংশধারার রক্ষক। আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন কন্যার গর্ভজাত সন্তানের মাধ্যমে আমাদের প্রিয় নবী ছা. এর বংশধারা রক্ষা করেছেন। মৃতের সবচেয়ে অগ্রগণ্য উত্তরাধিকারী হলেন তার ছেলেমেয়ে ও নাতিপুতি। কন্যার অবস্থা পাঁচটি। প্রথমত: মৃতের একমাত্র সন্তান হিসাবে যদি একজন মাত্র কন্যা থাকে ও অন্য কোন উত্তরাধিকারী না থাকে, তাহলে সে কন্যা অন্য অংশীদার না থাকার কারণে সম্পূর্ণ সম্পদ লাভ করবে। দ্বিতীয়ত: অন্য উত্তরাধিকারীদের সাথে মৃতের একমাত্র সন্তান হিসাবে যদি একজন কন্যা সন্তান বর্তমান থাকে, তাহলে অন্য উত্তরাধিকারীদেরকে তাদের নির্ধারিত হিস্সা দেয়ার পরে যা কিছু অবশিষ্ট থাকবে, সে অবশিষ্ট অংশের অর্ধাংশ উক্ত কন্যা সন্তান লাভ করবে। তৃতীয়ত: মৃতের যদি একাধিক কন্যা থাকে ও অন্য কোন উত্তরাধিকারী না থাকেন, তাহলে কন্যাগণ মৃতের সমস্ত সম্পদ লাভ করবে। যেমন কোন ছেলে থাকলে সে সমস্ত সম্পদ লাভ করে। চতুর্থত: অন্য উত্তরাধিকারীর সাথে একাধিক কন্যা সন্তান বর্তমান থাকলে, তারা অন্য অংশীদারদেরকে তাদের জন্য নির্ধারিত হিস্সা দেয়ার পরে যা কিছু অবশিষ্ট থাকবে তার সবটুকু লাভ করবে। আর পঞ্চমত: যদি মৃতের সন্তান কয়েকজন ছেলেমেয়ে হয় এবং অপর কোন উত্তরাধিকারী না থাকে, তাহলে সমগ্র সম্পদ তাদের মধ্যে বণ্টিত হবে। সেক্ষেত্রে لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ اْلأُنْثَيَيْنِ - একজন পুরুষ দু’জন নারীর সমান হিস্সা পাবে। আর অন্য উত্তরাধিকারী থাকলে সে উত্তরাধিকারীগণ তাদের নির্ধারিত হিস্সা নেয়ার পরে যা কিছু অবশিষ্ট থাকবে, মৃতের সন্তানগণ সে অবশিষ্ট সম্পদ লাভ করবে।
আলোচনা ও পর্যালোচনা:
প্রথমত: কন্যা একমাত্র উত্তরাধিকারী: মানুষ তার জীবন কালে সন্তান সন্ততি হাসিল করে ও সম্পদ অর্জন করে। কিন্তু মানুষের কাছে সর্বদাই সম্পদের চেয়ে সন্তানের মূল্য সর্বাধিক। এজন্য সন্তানের কল্যান চিন্তা করে মানুষ সম্পদ খরচ করতে কুন্ঠিত হয় না। সন্তান যদি পুত্র হয়, তাহলে সে পুত্রের মাধ্যমে মানুষ তার বংশধারা রক্ষা করে। প্রাক ইসলামী যুগে মানুষ কন্যা সন্তানের ব্যাপারে একটু কম আগ্রহী ছিল। এজন্য তখন কন্যা সন্তানগণ সম্পদে অংশীদারিত্ব পেত না। আর সংগত কারণেই পুত্র না থাকলে মানুষ সম্পদ রেখে যেতে চাইত না। কিন্তু ইসলাম এসে মানুষের সে ধারণা পাল্টে দিল। হজরত সা’দ বিন আবু ওকাস রা. এর প্রশ্নের উত্তরে রাসূলুল্লাহ ছা. এরশাদ করলেন: اِنْ تَرَكْتَ وَلَدَكَ أَغْنِيَاءَ خَيْرٌ مِنْ اَنْ تَتْرُكَهُمْ عَالَّةً يَتَكَفَّفُوْنَ النَّاسَ ‘তোমার সন্তানকে সম্পদশালী রেখে যাওয়া অধিক উত্তম তাদেরকে এমন অভাবগ্রস্থ রেখে যাওয়ার চেয়ে যে তারা অন্যের কাছে হাত পেতে বেড়াবে।’ (বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, ইবনু মাজাহ, তিরমিযী, নাসায়ি, মুসনাদু আহমাদ, মুয়াত্তা মালিক)১। তাই ঈমানদারগণ তাদের ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সন্তানদের জন্য সম্পদ রেখে মৃত্যু বরণ করতে চান। এজন্য মানুষ মৃত্যুরপূর্বক্ষণ পর্যন্ত হালাল সম্পদ উপার্জনের চেষ্টা অব্যাহত রাখে। অপরদিকে জন্ম লগ্ন থেকেই সন্তানগণ তাদের পিতামাতার অর্থনৈতিক দায়িত্বশীলতার অধীনে থেকে প্রতিপালিত হয়ে থাকে। সন্তানের অর্থনৈতিক দায়িত্বশীল হলেন তাদের পিতামাতা। পিতামাতা মৃত্যু বরণ করলে সে সন্তানেরা যাতে অর্থনৈতিক দূরাবস্থার মধ্যে পতিত না হয়, সে জন্য আল্লাহ তা’আলা মৃত পিতামাতার সম্পদ সন্তানদের জন্য বরাদ্ধ দিয়েছেন। সন্তান ছেলে হোক অথবা মেয়ে হোক, তার প্রতিপালনের দায়িত্ব পিতামাতার। আর সে কারণেই পিতামাতা মারা গেলে সম্পদের উত্তরাধিকারও সে ছেলেমেয়েদেরই প্রাপ্য। তাদের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ভিত্তিও পিতামাতা থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদের উপর নির্ভর করে। এ কারণে সন্তানদের জন্য কোন অংশ উল্লেখ না করেই আল্লাহ তা’আলা ঘোষনা করেছেন:
يُوصِيْكُمُ اللهُ فِيْ أَوْلَادِكُمْ لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الْأُنْثَيَيْنِ
“তোমাদের সন্তানদের ব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশনা হল- একজন পুরুষ দু’জন নারীর সমান হিস্সা পাবে।” (সূরা নিসা-১১)। এখানে আয়াতের প্রথমাংশের দিকে তাকালে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, সমস্ত সম্পদ সন্তানদের জন্য। সেখানে শুধু ছেলে সন্তানদের জন্য একথা বলা হয়নি। বরং বলা হয়েছে যে, সন্তানদের পরস্পরের মধ্যে সম্পদের বন্টন পদ্ধতি হবে- ‘একজন পুরুষ দু’জন নারীর সমান হিস্সা পাবে’ -এ সূত্র মতে। ‘সিয়াকে কালাম’ বা বক্তব্যের ধরণ দেখে বুঝা যায় যে, ‘একজন পুরুষ দু’জন নারীর সমান হিস্সা হিসাবে’ সন্তানেরা সমস্ত সম্পদ পাবে। আর এ সূত্র মতে একজন মাত্র পুত্র থাকলে সে সম্পূর্ণ সম্পদের মালিক হবে আবার শুধুমাত্র একজন কন্যা থাকলে সেও সম্পূর্ণ সম্পদের মালিকানা লাভ করবে। কেননা উত্তরাধিকারী না থাকার কারণে সম্পদ বন্টনের প্রয়োজন নেই। একাধিক বৈধ ও যোগ্য উত্তরাধিকারী বর্তমান থাকলেই কেবল সম্পদ বন্টনের প্রয়োজন। যদি কোন লোক মারা যায় তার একজন অমুসলিম পুত্র ও একজন মুসলিম কন্যা রেখে, তখন সে কন্যা একা সমস্ত সম্পদের মালিকানা হাসিল করবে। অমুসলিম হওয়ার কারণে ছেলে কিছুই পাবে না। কারণ রাসূলুল্লাহ ছা. বলেছেন: لاَ يَرِثُ الْمُسْلِمُ الْكَافِرَ وَلاَ يَرِثُ الْكاَفِرُ الْمُسْلِمَ ‘কোন মুসলিম তার কোন অমুসলিম আত্মীয়ের উত্তরাধিকারী হবে না এবং কোন অমুসলিম তার কোন মুসলিম আত্মীয়ের উত্তরাধিকারী হবে না।’ (মুসলিম, বুখারী, তিরমিযী, আবু দাউদ, ইবনু মাজাহ)২। আবার যদি কোন লোক তার একজন মেয়ে ও একজন ভাই রেখে মারা যায়, তাহলেও মেয়েটি সমস্ত সম্পদ একা লাভ করবে; ভাই কিছুই পাবে না। কারণ আল্লাহ তা’আলা বলেছেন: وَهُوَ يَرِثُهَآ إِنْ لَمْ يَكُنْ لَهَا وَلَدٌ “এবং ভাই তার মৃত বোনের উত্তরাধিকারী হবে, তবে শর্ত হল বোনটি নি:সন্তান হতে হবে।” (সূরা নিসা-১৭৬)। এ আয়াতে সন্তান না থাকা ভাইর উত্তরাধিকারী হওয়ার জন্য শর্ত করা হয়েছে। আর আল্লাহ নিজে সন্তানের ব্যাখ্যা দিয়েছেন নিম্নোক্ত ভাষায় - يُوصِيْكُمُ اللهُ فِيْ أَوْلَادِكُمْ لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الْأُنْثَيَيْنِ “তোমাদের সন্তানদের ব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশনা হল- একজন পুরুষ দু’জন নারীর সমান হিস্সা পাবে।” এ আয়াতে সন্তানের আওতায় ছেলে ও মেয়ের কথা বলে আল্লাহ বুঝিয়ে দিলেন যে, সন্তান বলতে ছেলে ও মেয়ে উভয়কেই বুঝায়।
একমাত্র উত্তরাধিকারী একজন মাত্র কন্যাসন্তান হলে তার হিস্সা সমগ্র সম্পদ না আংশিক সম্পদ, তা নিয়ে ছাহাবায়ে কেরামের মধ্যে কিছুটা মতবিরোধ লক্ষ্য করা যায়। হজরত উমার, আলী, উসমান, আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস, আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ রা. সহ অধিকাংশ ছাহাবায়ে কেরামের মতে একমাত্র উত্তরাধিকারী একজন মাত্র কন্যা হলে সে সমস্ত সম্পদ লাভ করবে। কিন্তু হজরত যায়েদ বিন ছাবিত রা. সহ কিছু উলামায়ে কেরামের মতে একমাত্র কন্যাসন্তান অর্ধেক সম্পদ লাভ করবে। আর বাকী অর্ধেক লাভ করবে রাষ্ট্রীয় তহবিল বা ‘বাইতুল মাল’। বাইতুল মাল না থাকলে কিংবা কোন অমুসলিম দেশে মৃত্যু বরণ করলে কি হবে, তা অবশ্য তারা বলেন নি। তাদের দলীল - আল্লাহ তা’আলা বলেন: وَاِنْ كَانَتْ وَاحِدَةً فَلَهَا النِّصْفُ “আর যদি সে (কন্যা) একজন হয়, তাহলে সে পাবে অর্ধেক।” এ আয়াতে একজন মেয়ে হলে তার হিস্সা ‘অর্ধেক’ বলা হয়েছে। বাকী অর্ধেক বাইতুল মাল কেন পাবে, কোন্ দলীলের ভিত্তিতে পাবে, এ ব্যাপারে তাদের বক্তব্য হল: বাকী অর্ধেকের দাবীদার না থাকায় তা বাইতুল মালে জমা হবে যা সব মুসলমানের সম্পদ হিসাবে সবাই উপকৃত হবে।
প্রথম দলের মতে আয়াতে অর্ধেকের কথা বলা হলেও এখানে তা প্রযোজ্য হবে না। বরং অপর কোন দাবীদার না থাকায় ‘রদ্দ’ বা পুন:বণ্টণ করতে হবে সে মেয়ের অনুকুলে। বাইতুল মাল পাবে না। কারণ রাসূলুল্লাহ ছা. বলেছেন:
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ قَالَ أَنَا أَوْلَى بِالْمُؤْمِنِيْنَ مِنْ أَنْفُسِهِمْ فَمَنْ مَاتَ وَعَلَيْهِ دَيْنٌ وَلَمْ يَتْرُكْ وَفَاءً فَعَلَيْنَا قَضَاؤُهُ وَمَنْ تَرَكَ مَالاً فَلِوَرَثَتِهِ হজরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত। তিনি নাবী ছা. থেকে বর্ণণা করেন। তিনি বলেছন: ‘আমি মুমিনদের নিজেদের চেয়েও অধিক হকদার। কেউ ঋণ রেখে মারা গেলে এবং তা পরিশোধের কোন ব্যবস্থা না থাকলে, তা পরিশোধের দায়িত্ব আমার আর যে ব্যক্তি সম্পদ রেখে মারা যাবে, তার সে সম্পদ তার উত্তরাধিকারীগণ পাবেন।’ (বুখারী, মুসলিম, নাসায়ী, আবু দাউদ, ইবনু মাজাহ, মুসনাদু আহমাদ, ইবনু হিব্বান)৩। এ হাদীছের মাধ্যমে জানা যায় যে, ‘সম্পদ’ উত্তরাধিকারীগণ পাবে; রাসূলুল্লাহ ছা. কিংবা বাইতুল মাল নয়। কিন্তু সম্পদ না থাকলে ঋণ পরিশোধের দায়িত্ব ইসলামী সরকারের, যা বাইতুল মাল থেকে পরিশোধিত হবে। রাসূহুল্লাহ ছা. এর অপর একটি হাদীছ থেকেও জানা যায় যে, সমস্ত সম্পদ একমাত্র মেয়ে পাবে, বাইতুল মাল নয়। যেমন বর্ণিত আছে:
عَنْ عَامِرِ بْنِ سَعْدِ بْنِ اَبِيْ وَقَاصٍ عَنْ اَبِيْهِ قَالَ مَرِضْتُ بِمَكَّةَ مَرَضًا اَشْفَيْتُ مِنْهُ عَليَ الْمَوْتِ فَاتَانِي النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَعُوْدُنِي فَقُلْتُ يَا رَسُوْلَ اللهِ اِنَّ لِيْ مَالاً كَثِيْرًا وَلَيْسَ يَرِثُنِيْ اِلاَّ اِبْنَتِيْ اَفَاَتَصَدَّقُ بِثُلُثَيْ مَالِيْ فَقَالَ لاَ قُلْتُ فَالشَّطْرُ قَالَ لاَ قُلْتُ فَالثُّلُثُِ قَالَ الثُّلُثُِ كَثِيْرٌ اِنْ تَرَكْتَ وَلَدَكَ أَغْنِيَاءَ خَيْرٌ مِنْ اَنْ تَتْرُكَهُمْ عَالَّةً يَتَكَفَّفُوْنَ النَّاسَ
‘হজরত আমির বিন সা’দ বিন আবু ওকাছ রাহ. থেকে বর্ণিত, তিনি তার পিতা থেকে বর্ণণা করেন। তিনি বলেন: ‘আমি মক্কায় এমন অসুস্থ হয়ে পড়লাম যে আমি মৃত্যুর আশংকা করছিলাম। রাসূলুল্লাহ ছা. আমাকে দেখতে আসলেন। আমি তাঁকে জিঙ্গাসা করলাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল, আমার অনেক সম্পদ রয়েছে। আর একজন মাত্র কন্যা ছাড়া আমার অপর কেন উত্তরাধিকারী নেই; আমি কি দু’তৃতীয়াংশ সম্পদ দান করতে পারি ? তিনি বললেন: ‘না’, আমি বললাম, তাহলে অর্ধেক ? তিনি বললেন: ‘না’, আমি বললাম, তাহলে এক তৃতীয়াংশ, তিনি বললেন: ‘এক তৃতীয়াংশই তো বেশী। তোমার সন্তানকে সম্পদশালী রেখে যাওয়া অধিক উত্তম তাদেরকে এমন অভাবগ্রস্থ রেখে যাওয়ার চেয়ে যে তারা অন্যের কাছে হাত পেতে বেড়াবে।’ (বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, ইবনু মাজাহ, তিরমিযী, নাসায়ি, মুসনাদু আহমাদ, মুয়াত্তা মালিক)৪। এ হাদীছ থেকে জানা যায় যে, একমাত্র মেয়ে সমস্ত সম্পদ লাভ করবে; বাইতুল মালে কিছুই যাবে না। কারণ বাইতুল মাল প্রাপ্য হলে রাসূলুল্লাহ ছা. অবশ্যই তা উল্লেখ করতেন। তিনি উহা উল্লেখ না করে বরং বুঝাতে চাইলেন যে, তোমার একমাত্র কন্যা সম্পদশালী হলে তা তোমার জন্য অধিক কল্যানকর হবে।
দ্বিতীয়ত: অন্য উত্তরাধিকারীর সাথে একমাত্র কন্যার অবস্থা: অন্য উত্তরাধিকারীর সাথে যদি একজন কন্যা সন্তান অংশীদার হয় এবং মৃত ব্যক্তির কোন পুত্র সন্তান না থাকে, তবে অন্য উত্তরাধিকারীদেরকে সর্বাগ্রে হিস্সা দিতে হবে। তাদেরকে হিস্সা দেয়ার পরে যা কিছু অবশিষ্ট থাকবে, কন্যাটি সে অবশিষ্ট সম্পদের অর্ধেক পাবে এবং বাকী অর্ধেক সেই কন্যাসহ সকল উত্তরাধিকারীর মধ্যে পুন:বন্টন হবে। ছেলে-মেয়েরা আসলে মাওলার অন্তর্ভুক্ত অনির্ধারিত হিস্সাদার উত্তরাধিকারী। তারা সব সময় অবশিষ্টাংশ পায়। কিন্তু কন্যা মাওলা হলেও সে পূর্ণ মাওলা নয়, বরং অর্ধেক মাওলা। পুত্র হল পূর্ণ মাওলা। এজন্য অবশিষ্টাংশের সম্পূর্ণ অংশ ছেলে পায়। আর ছেলের প্রাপ্য হিস্সার অর্ধেক পায় মেয়ে। মেয়ে অর্ধেক মাওলা হলেও সে অন্য মাওলাদেরকে অনির্ধারিত হিস্সা পাবার সুযোগ বাতিল করে দেয়। সেজন্য একজন মেয়ের উপস্থিতিতে মৃতের পিতা মাওলা বলে বিবেচিত হবেন না। ছেলে থাকলে পিতা যেমন ‘যবিল ফুরূজ’ বলে গণ্য হয়ে নির্ধারিত হিস্সা লাভ করেন, এক বা একাধিত মেয়ে থাকার কারণেও পিতা ‘যবিল ফুরূজ’ বলে গণ্য হয়ে নির্ধারিত হিস্সা লাভ করবেন। এ কারণেই আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন:
وَلِأَبَوَيْهِ لِكُلِّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا السُّدُسُ مِمَّا تَرَكَ إِنْ كَانَ لَهُ وَلَدٌ
“আর পিতামাতার প্রত্যেকে মৃত ব্যক্তি যা কিছু ছেড়ে যাবে, তা থেকে এক ষষ্টাংশ করে পাবেন যদি মৃতের কোন সন্তান বর্তমান থাকে।” (সূরা নিসা-১১)। এ আয়াত থেকে জানা গেল যে, ছেলে হোক মেয়ে হোক, একজন হোক অথবা একাধিক হোক - কোন সন্তান থাকলে পিতা এক ষষ্টাংশের বেশী পাবেন না। একজন মেয়ে যে অবশিষ্ট সম্পদের অর্ধেক পায়, তার দলীল হল- এ আয়াত। আল্লাহ তা’আলা বলেন: وَإِنْ كَانَتْ وَاحِدَةً فَلَهَا النِّصْفُ “আর যদি সে (কন্যা) একজন হয়, তাহলে সে পাবে অর্ধেক।” (সূরা নিসা-১১)। কিসের অর্ধেক? মোট সম্পদের অর্ধেক? অবশিষ্ট সম্পদের অর্ধেক? না একজন পুত্রের হিস্সার অর্ধেক? এ প্রশ্নের উত্তর আল্লাহ পরিষ্কার করে বলেন নি। আয়াতের আগের অংশে আল্লাহ তা’আলা বলেন: لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ اْلأُنْثَيَيْنِ ‘‘একজন পুত্রের হিস্সা হল দু’জন কন্যার হিস্সার সমান।” দু’জন কন্যার হিস্সার সমান যদি একজন পুত্রের হিস্সা হয়, তাহলে একজন কন্যার হিস্সা হবে একজন পুত্রের হিস্সার অর্ধেক। যদি ব্যাখ্যা গুলোকে এ ভাবে সাজানো যায় যে, ছেলে-মেয়ে মিশ্রিতভাবে থাকুক আর না থাকুক সর্বাবস্থায় একজন ছেলে দু’জন মেয়ের সমান হিস্সা পাবে। বিপরীতপক্ষে একজন মেয়ে হলে সে সর্বাবস্থায় একজন ছেলের হিস্সার অর্ধেক পাবে; তাহলে আয়াতের দু’অংশের মধ্যে সামঞ্জস্য প্রতিষ্ঠিত হয়। আর ঐশীবাণীর ইঙ্গিত বা ‘ইশারাতুন্ নাছ’ ও তাই বলে। একজন ছেলে যদি দু’জন মেয়ের সমান হিস্সা পায়, তাহলে একজন মেয়ে পাবে একজন ছেলের হিস্সার অর্ধেক। এভাবে ধরলে যা দাড়ায় তা হল: وَاِنْ كَانَتْ وَاحِدَةً فَلَهَا نِصْفُ حَظِّ الذَّكَرِ ছেলেমেয়েদের মধ্যে যদি একজন মাত্র কন্যা হয়, তাহলে সে পাবে- একজন পুত্র থাকলে সে যতটুকু পেত- তার অর্ধেক। ছেলে মোট সম্পদ পাবার হলে সে পাবে মোট সম্পদের অর্ধেক; বাকী অর্ধেক পাবে রদ্দের কারণে যেমন আমরা প্রথম অবস্থায় দেখেছি। আর ছেলে অবশিষ্ট সম্পদ পাবার হলে, সে পাবে সেই অবশিষ্ট সম্পদের অর্ধেক। এ জন্য আয়াতের ব্যাখ্যা হবে وَاِنْ كَانَتْ وَاحِدَةً فَلَهَا النِّصْفُ اَيْ فَلَهَا نِصْفُ حَظِّ الذَّكَرِ । সমীকরণ বা ‘বয়ঁধঃরড়হ’ এর মাধ্যমেও বিষয়টি প্রমাণ করা যায়। যেমন নীচের ‘সমীকরণটির’ দিকে লক্ষ্য করুন:
১ জন পুত্র = ২ জন কন্যা
অথবা ২ জন কন্যা = ১ জন পুত্র
অথবা ১ জন কন্যা = ১/২ জন পুত্র ।
কারো কারো মতে কন্যা সন্তান নিছক নির্ধারিত হিস্সার অধিকারী যবীল ফুরূজের অন্তর্ভুক্ত একজন উত্তরাধিকারী। তাদের মতে কন্যা সন্তান একজন হলে মোট সম্পদের অর্ধেক পায়, একাধিক হলে দু’তৃতীয়াংশ পায় এবং তাদের সাথে ছেলে সন্তানও থাকলে একজন পুরুষ দু’জন নারীর সমান হিস্সা হিসাবে অতিরিক্ত অংশে অংশীদার হয়। তাদের মতে মেয়ে একজন হোক অথবা একাধিক, সর্বদাই যবীল ফুরূজ বলে বিবেচিত হবে। তারা মনে করেন যে, নারী মাওলা হতে পারে না। সমস্তরের বা নীচের স্তরের পুরুষ ভাইর উপস্থিতির কারণে বোন মাওলা হতে পারবে। এ কারণে তারা মনে করেন যে, মিশ্রিত আকারে থাকলে একজন পুরুষ দু’জন নারীর সমান হিস্সা পায়; কিন্তু সন্তান শুধু নারী হলে তারা যবীল ফুরূজ বলে গণ্য হন। সেজন্য তারা নারীকে মাওলা বা আছাবা গণ্য করতে ‘মিশ্রিত অবস্থায় থাকার’ শর্ত আরোপ করেন। তারা তাদের মতের সমর্থনে কুরআনের এ আয়াতে করীমাকে পেশ করেন, যেখানে আল্লাহ বলেন:
يُوصِيْكُمُ اللهُ فِيْ أَوْلَادِكُمْ لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الْأُنْثَيَيْنِ فَإِنْ كُنَّ نِسَاءً فَوْقَ اثْنَتَيْنِ فَلَهُنَّ ثُلُثَا مَا تَرَكَ وَإِنْ كَانَتْ وَاحِدَةً فَلَهَا النِّصْفُ
‘‘তোমাদের সন্তানদের ব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশনা হল- একজন পুরুষ দু’জন নারীর সমান হিস্সা পাবে। সুতরাং যদি তারা দু’এর অধিক কন্যা সন্তান হয়, তবে তারা দু’তৃতীয়াংশ পাবে সে যা কিছু ছেড়ে যাবে, তা থেকে। আর যদি একজন হয়, তবে সে মোট সম্পদের অর্ধেক পাবে।” (সূরা নিসা-১১)। আয়াতের মধ্যে ‘মোট সম্পদের’ কথাটি না থাকলেও তারা তা যোগ করে অনুবাদ করেন। তাদের এ মতের স্বপক্ষে আরো যুক্তি হল হজরত ইবনু আব্বাস রা. বর্ণিত হাদীছ। রাসূলুল্লাহ ছা. এরশাদ করেন:
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اِقْسِمُوا الْمَالَ بَيْنَ أَهْلِ الْفَرَائِضِ عَلَى كِتَابِ اللهِ فَمَا تَرَكَتْ الْفَرَائِضُ فَلِأَوْلَى رَجُلٍ ذَكَرٍ
হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছা. বলেছেন: ‘যবীল ফুরূজদের মধ্যে কুরআনে বর্ণিত হিস্সা অনুসারে সম্পদ বণ্টন কর। এ বণ্টণের পরে যে সম্পদ অবশিষ্ট থাকবে তা সর্বাধিক হকদার পুরুষ লোকদের জন্য।’ (মুসলিম, মুসনাদু আহমাদ, ইবনু মাজাহ, তাবারাণী আল মু’জামুল কাবীর, মুছান্নাফু আব্দির রাজ্জাক)৫।
পক্ষান্তরে খোদ হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. এর মতবাদ বিশ্লেষণ করলে ভিন্ন আরেক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। তার মতে মেয়ে ও বোনেরা মাওলার অন্তর্ভুক্ত। এজন্য তারা তাদের সমস্তরের ছেলে ও ভাইদের সাথে একত্রে থাকলেও মাওলা একা থাকলেও মাওলা বলে বিবেচিত হবে। এ কারণে তিনি নিম্নোক্ত ক্ষেত্রে অন্যদের সাথে ভিন্নমত পোষণ করেন। (১). তিনি পিতামাতা ও স্বামী-স্ত্রীর সাথে মেয়ে কিংবা বোনেরা উত্তরাধিকারী হলে তাদেরকে অবশিষ্টাংশ দেয়ার পক্ষপাতি। আর (২). যদি কোন লোক শুধু কন্যা সন্তান রেখে মারা যান এবং তার এক বা একাধিক বোন জীবিত থাকে, তাহলে তিনি বোনকে কিছুই দেয়ার পক্ষপাতি নন। তার মতের সমর্থনে তিনি দলীল পেশ করেন: ১. আল্লাহ তা’আলা বলেন:
وَلِكُلٍّ جَعَلْنَا مَوَالِيَ مِمَّا تَرَكَ الْوَالِدَانِ وَالْأَقْرَبُوْنَ
“আর আমরা পুরুষ নারীর প্রত্যেককে পিতামাতা ও আত্মীয় স্বজনেরা যা কিছু রেখে যাবে তাতে মাওলা বানিয়েছি।” (সূরা নিসা-৩৩)। ২. আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন:
يَسْتَفْتُوْنَكَ قُلِ اللهُ يُفْتِيْكُمْ فِي الْكَلَالَةِ إِنِ امْرُؤٌ هَلَكَ لَيْسَ لَهُ وَلَدٌ وَلَهُ أُخْتٌ فَلَهَا نِصْفُ مَا تَرَكَ وَهُوَ يَرِثُهَا إِنْ لَمْ يَكُنْ لَهَا وَلَدٌ
“হে নবী, তোমার কাছে তারা ফতোয়া জিজ্ঞাসা করে। তুমি বলে দাও যে, আল্ল¬াহ ‘কালালার’ ব্যাপারে ফতোয়া দিচ্ছেন: যদি কোন নি:সন্তান লোক মারা যায় আর তার একজন বোন থাকে, তবে সে বোন অর্ধেক পাবে মৃত ব্যক্তি যা কিছু ছেড়ে যাবে, তা থেকে। - এবং সে ব্যাক্তিও তার মৃত বোনের উত্তরাধিকারী হবে তবে শর্ত হল সে (মৃত বোন) নি:সন্তান হতে হবে।” (সূরা নিসা-১৭৬)। এ আয়াতের মাধ্যমে কন্যা সন্তান থাকলেও ভাইবোনকে বঞ্চিত করা হয়েছে। ৩. মেয়ে ও বোনদেরকে মাওলা উত্তরাধিকারী মেনে নিয়ে অবশিষ্ট সম্পদ দেয়ার স্বপক্ষে মতামত না দিলে হিসাবে গরমিল দেখা দেয়। যাকে ইলমুল ফারাইজে ‘আওল’ বলা হয়। যে আওলের কারণে কুরআনের সকল নির্দেশনা লঙ্ঘনের ঝুঁকি সৃষ্টি হয়। এ কারণে প্রায় সকল ফারাইজ বিশারদগণ আওল মেনে নিলেও হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. কোনমতেই আওলকে মেনে নেন নি। তিনি তার এ মতে এত শক্ত ভুমিকা নিয়েছিলেন যে, তিনি এ দাবীর উপরে শপথ করে বলেন:
قَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ : وَايْمُ اللهِ لَوْ قَدَّمَ مَنْ قَدَّمَ اللهُ وَأَخَّرَ مَنْ أَخَّرَ اللهُ مَا عَالَتْ فَرِيضَةٌ
আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. বলেন: ‘আর আল্লাহর শপথ, তিনি যদি তাদেরকে অগ্রাধিকার দিতেন, যাদেরকে আল্লাহ অগ্রাধিকার দিয়েছেন এবং ওদেরকে পশ্চাতে রাখতেন, যাদেরকে আল্লাহ পশ্চাতে রেখেছেন, তবে কোন উত্তরাধিবারেই আওল সৃষ্টি হত না।’ (বায়হাকী কুবরা, জামেউল আহাদীছ)৬। হিসাবে গরমিল দেখা দেয়ার উদাহরণ নিম্নরূপ:-
সমস্যা নং- ৩. যদি কোন নারী তার স্বামী, পিতামাতা ও একজন কন্যা সন্তান রেখে মৃত্যু বরণ করে, তাহলে তার সমাধানে ‘আওল’ সৃষ্টি হবে। [ফকীহদের মতানুসারে] :
সমাধান: ফকীহদের মতে তখন স্বামী পাবে ১/৪ অংশ, পিতা পাবেন ১/৬ অংশ, মাতা পাবেন ১/৬ অংশ এবং কন্যা পাবে ১/২ অংশ। ভগ্নাংশের হরের মধ্যে ৪, ৬ ও ২ থাকায় ল.সা.গু হবে ১২। সুতরাং মোট সম্পদকে ১২ ভাগ করে বণ্টন করতে হবে। সেক্ষেত্রে স্বামী পাবে ৩/১২, পিতা পাবেন ২/১২, মাতা পাবেন ২/১২ এবং কন্যা পাবে ৬/১২। তাতে যোগফল দাড়াবে (৩/১২ + ২/১২ + ২/১২ + ৬/১২) = ১৩/১২। তখন দেখা যাবে যে সম্পদ ১২ অংশ করা হয়েছে কিন্তু প্রাপ্য হিস্সা হল ১৩ অংশ। তারা বলেন, গত্যন্তর না থাকায় সম্পদকে ১২ এর স্থলে ১৩ অংশ করতে হবে এবং ১২ অংশের হিসাবেই সবাইকে দিতে হবে। যেমন মনে করুন সম্পদ হল মোট ৬,০০,০০০ টাকা। কুরআনের বিধান অনুসারে মৃতের সন্তান থাকলে স্বামী এক চতুর্থাংশ এবং পিতামাতার প্রত্যেকে এক ষষ্টাংশ করে পাওয়ার স্পষ্ট বিধান রয়েছে। কিন্তু একজন মেয়ে থাকলে সে মোট সম্পদের অর্ধাংশ পাবে বলে তারা মনে করেন। এ হিসাবে স্বামী ১,৫০,০০০ টাকা, পিতা ১,০০,০০০ টাকা ও মাতা ১,০০,০০০ টাকা পাওয়ার কথা থাকলেও ফকীহগণ হিসাবের গরমিল হওয়ার কারণে সবাইকে একটু একটু করে কম দেয়ার কথা বলেন। কারণ তাদের সম্পদের ১ অংশের স্থলে অংশ ১৩/১২ ভাগ হয়ে গরমিল হতে দেখা যায়। সেজন্য তারা উপরোক্ত মাসআলায় স্বামীকে ১,৩৮,৪৬১.৫৪ টাকা পিতাকে ৯২,৩০৭.৬৯ টাকা মাতাকে ৯২,৩০৭.৬৯ টাকা ও মেয়েকে ২,৭৬,৯২৩.০৮ টাকা দিয়ে সমাধান করেন। অথচ তাদের নিজেদের সূত্রমতে মেয়েকে ৩,০০,০০০ টাকা দেয়ার কথা।
কিন্তু হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. এর মতবাদের আলোকে অংশ ভাগ করলে হিসাবে গরমিল হবে না। তাঁর মতবাদের আলোকে উপরোক্ত মাসআলাটির সমাধান নীচের উদাহরণে দেখুন:-
সমস্যা নং- ৪. যদি কোন নারী তার স্বামী, পিতামাতা ও একজন কন্যা সন্তান রেখে মৃত্যু বরণ করে, তাহলে তার সমাধানে হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. এর মতানুসারে ‘আওল’ সৃষ্টি হবে না :
সমাধান: হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. এর মতে তখন স্বামী পাবে ১/৪ অংশ, পিতা পাবেন ১/৬ অংশ, মাতা পাবেন ১/৬ অংশ এবং কন্যা পাবে অবশিষ্ট সম্পদের ১/২ অংশ। এর পরে যা কিছু অবশিষ্ট থাকবে, তা সবার মধ্যে পুন:বণ্টন করতে হবে। ভগ্নাংশের হরের মধ্যে ৪, ৬ ও ২ থাকায় ল.সা.গুহবে ১২। সুতরাং মোট সম্পদকে ১২ ভাগ করে বণ্টন করতে হবে। সেক্ষেত্রে স্বামী পাবে ৩/১২, পিতা পাবেন ২/১২, মাতা পাবেন ২/১২ এবং কন্যা পাবে ২.৫/১২। তাতে যোগফল দাড়াবে (৩/১২ + ২/১২ + ২/১২ + ২.৫/১২) = ৯.৫/১২। তখন দ্বিতীয়বার ল.সা.গু. কে ২ দিয়ে গুণ করে ২৪ করতে হবে। তাতে যোগফল দাড়াবে (৬/২৪ + ৪/২৪ + ৪/২৪ + ৫/২৪) = ১৯/২৪। অর্থাৎ সে ২৪ অংশের মধ্যে স্বামী পাবে ৬, পিতা পাবেন ৪, মাতা পাবেন ৪ এবং কন্যা পাবে ৫। তখন দেখা যাবে যে সম্পদকে ২৪ অংশ করা হয়েছে কিন্তু প্রাপ্য হিস্সা হল ১৯ অংশ। সুতরাং পুন:বণ্টণের সূত্র মোতাবেক সম্পদকে ২৪ এর স্থলে ১৯ অংশ করতে হবে। যেমন মনে করুন সম্পদ হল মোট ৬,০০,০০০ টাকা। কুরআনের বিধান অনুসারে মৃতের সন্তান থাকলে স্বামী এক চতুর্থাংশ এবং পিতামাতার প্রত্যেকে এক ষষ্টাংশ করে পাওয়ার স্পষ্ট বিধান রয়েছে। আর একমাত্র মেয়ে অবশিষ্ট সম্পদের অর্ধাংশ পাবে বলে তিনি মনে করেন। এ হিসাবে স্বামী ১,৫০,০০০ টাকা, পিতা ১,০০,০০০ টাকা ও মাতা ১,০০,০০০ টাকা এবং কন্যা অবশিষ্ট অংশের অর্ধেক {৬,০০,০০০ - (১,৫০,০০০ + ১,০০,০০০ + ১,০০,০০০)}= ২,৫০,০০০ ২ = ১,২৫,০০০ টাকা পাওয়ার কথা থাকলেও পুন:বণ্টণের কারণে সবাইকে আনুপাতিক হরে অতিরিক্ত দিতে হবে। তাতে স্বামী মোট ১,৮৯,৪৭৩.৬৮ টাকা মাতা ১,২৬,৩১৫.৭৯ টাকা পিতা ১,২৬,৩১৫.৭৯ টাকা ও মেয়ে ১,৫৭,৮৯৪.৭৪ টাকা পেলন। তাতে হিসাবের গরমিল দেখা দেয়ার কোন কারণ নেই। প্রথমে ল.সা.গু হবে ১২, পরে উহাকে তাছহীহ করতে হয়েছে ২৪ দিয়ে। আর সম্পদ অতিরিক্ত থেকে যাওয়ার কারণে পুনর্বার তা এ উত্তরাধিকারীদের মধ্যে পুনর্বার বণ্টিত হয়েছে। তাতে ভগ্নাংশের হর পরিবর্তিত হয়ে ১৯ হয়েছে, যা রদ্দের সূত্র অনুসারে হয়েছে। আর সম্পদের ১ অংশের স্থলে ভগ্নায়শের যোগফলও ১৯/১৯ = ১ হয়েছে।
এখানে আরেকটি বিষয় খেয়াল করার মত- তা এই যে, ফকীহদের মতানুসারে হিস্সা দিলে একজন মেয়েকে এত পরিমাণ সম্পদ দেয়া হয়, যা মেয়ের স্থলে ছেলে হলে সে ছেলেও পেত না। কারণ স্বামী, মাতা ও পিতার সাথে একজন ছেলে থাকলে সে সর্বোচ্চ ৫/১২ অংশ পাবে, ৬,০০,০০০ টাকার সম্পদে তা টাকার অংকে ২,৫০,০০০ টাকা। অথচ তাদের হিসাবে একজন মেয়ে পায় ২,৭৬,৯২৩.০৮ (৩ নং উদাহরণ দেখুন) যা স্বাভাবিক বোধশক্তিতে গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ একজন পুত্রের চাইতে একজন কন্যা কোন অবস্থাতেই বেশী পেতে পারে না। নীচের ছকে স্বামী, মাতা ও পিতার সাথে একজন পুত্রের অবস্থান ও হিস্সা দেখানো হল।
সমস্যা নং- ৫. যদি কোন নারী তার স্বামী, পিতামাতা ও একজন পুত্র সন্তান রেখে মৃত্যু বরণ করেন, তাহলে তার সমাধান: [ঐক্যমত্য অনুসারে] :
সমাধান: তখন স্বামী পাবে ১/৪ অংশ, পিতা পাবেন ১/৬ অংশ, মাতা পাবেন ১/৬ অংশ এবং পুত্র পাবে অবশিষ্ট অংশ। ভগ্নাংশের হরের মধ্যে ৪ ও ৬ থাকায় ল.সা.গু হবে ১২। সুতরাং মোট সম্পদকে ১২ ভাগ করে বণ্টন করতে হবে। সেক্ষেত্রে স্বামী পাবে ৩/১২, পিতা পাবেন ২/১২, মাতা পাবেন ২/১২ এবং পুত্র পাবে অবশিষ্ট ৫/১২। তাতে যোগফল দাড়াবে (৩/১২ + ২/১২ + ২/১২ + ৫/১২) = ১২/১২। যেমন মনে করুন সম্পদ হল মোট ৬,০০,০০০ টাকা। কুরআনের বিধান অনুসারে মৃতের সন্তান থাকলে স্বামী এক চতুর্থাংশ এবং পিতামাতার প্রত্যেকে এক ষষ্টাংশ করে পাওয়ার স্পষ্ট বিধান রয়েছে। আর একজন পুত্র থাকলে সে মাওলা বা আছাবা হিসাবে অবশিষ্টাংশ পাবে। এ হিসাবে স্বামী ১,৫০,০০০ টাকা, পিতা ১,০০,০০০ টাকা ও মাতা ১,০০,০০০ টাকা ও পুত্র অবশিষ্ট ২,৫০,০০০ টাকা পাবে। এ সমাধানে কারো কোন ভিন্নমত নেই। সকল ছাহাবী ও উলামাগণ এ ক্ষেত্রে একমত।
এ বিষয়টি বিবেচনায় রেখে একথা দৃঢ়তার সাথে বলা যায় যে, হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. এর মতটিই সঠিক। কারণ ছেলে থাকলে সে যতটুকু পাবে, তার স্থলে মেয়ে থাকলে সে মেয়ে কখনোই এর চেয়ে বেশী পেতে পারে না।
তৃতীয়ত: শুধুমাত্র একাধিক কন্যাসন্তান উত্তরাধিকারী হলে, তাদের অবস্থা:
যদি মৃতের উত্তরাধিকারী কয়েকজন কন্যা সন্তানই হন এবং আপর কোন উত্তরাধিকারী না থাকেন, তাহলে সে কন্যাসন্তানগুলো মৃতের সকল সম্পদের মালিকানা লাভ করবে। কারণ আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন: لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الْأُنْثَيَيْنِ –“একজন ছেলে পাবে দু’জন মেয়ের সমান হিস্সা” এ কথাটুকুকে উল্টিয়ে চিন্তা করলে পাওয়া যায় যে, দু’জন মেয়ে পাবে একজন ছেলের সমান হিস্সা। একজন ছেলে যেহেতু অন্য উত্তরাধিকারী না থাকলে সমস্ত সম্পদের হকদার হয়, ঠিক তেমনি অন্য উত্তরাধিকারী না থাকলে দু’জন মেয়েও সমস্ত সম্পদের হকদার হবে। আল্লাহ তা’আলা আরোও এরশাদ করেন: وَلِكُلٍّ جَعَلْنَا مَوَالِيَ مِمَّا تَرَكَ الْوَالِدَانِ وَالْاَقْرَبُوْنَ আমরা পুরুষ নারীর প্রত্যেককে পিতামাতা ও আত্মীয় স্বজনেরা যা কিছু রেখে যাবেন তাতে মাওলা বানিয়েছি।” (সূরা নিসা, আয়াত-৩৩)। এ আয়াতে যেহেতু নারীকেও আল্লাহ মাওলা বা আছাবার মর্যাদা দিয়েছেন, সে জন্য একাধিক মেয়েও আছাবা হয়ে সমস্ত সম্পদের মালিকানা হাসিল করবে।
কন্যা সন্তান নিছক যবীল ফুরূজের অন্তর্ভুক্ত উত্তরাধিকারী বলে যারা মনে করেন, তারা দু’জন কন্যার হিস্সার ব্যাপারেও ভিন্ন মত পোষণ করেন। তাদের মতে কন্যা সন্তান একজন হলে মোট সম্পদের অর্ধেক পায়, একাধিক হলে দু’তৃতীয়াংশ পায় এবং তাদের সাথে ছেলে সন্তানও থাকলে একজন পুরুষ দু’জন নারীর সমান হিস্সা হিসাবে অতিরিক্ত অংশে অংশীদার হয়। একাধিক কন্যা সন্তান যে দু’তৃতীয়াংশ পায়, তার প্রমাণ হিসাবে তারা সূরা নিসার ১২ নং আয়াতকে পেশ করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন: فَإِنْ كُنَّ نِسَاءً فَوْقَ اثْنَتَيْنِ فَلَهُنَّ ثُلُثَا مَا تَرَكَ “সুতরাং যদি তারা দু’এর অধিক কন্যা সন্তান হয়, তবে তারা দু’তৃতীয়াংশ পাবে সে যা কিছু ছেড়ে যাবে, তা থেকে।” তাদের বক্তব্য হল এই যে, যদিও আয়াতে দু’জন কন্যা সন্তানের কথা বলা হয়নি কিন্তু হাদীছ থেকে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ ছা. হজরত সা’দ বিন রাবীয়’ রা. এর দু’জন মেয়েকে মোট সম্পদের দু’তৃতীয়াংশ দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাছাড়া দু’জন বোনের হিস্সার ক্ষেত্রেও কুরআনে দু’তৃতীয়াংশের কথা বলা হয়েছে। তাদের দ্বিতীয় দলীল হল: হজরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রা. বর্ণিত হাদীছ। তাকে একজন মেয়ে, একজন ছেলের তরফের নাতিন ও একজন বোনের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন:
أَقْضِيْ فِيْهَا بِمَا قَضَى النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِلاِبْنَةِ النِّصْفُ وَلاِبْنَةِ اْلاِبْنِ السُّدُسُ تَكْمِلَةَ الثُّلُثَيْنِ وَمَا بَقِيَ فَلِلأُخْتِ فَأَتَيْنَا اَبَاموْسَيْ فَاَخْبَرْناَهُ بِقَوْلِ اِبْنِ مَسْعُوْدٍ فَقَالَ لاَ تَسْأَلُوْنِيْ مَا دَامَ هَذَا الْحَبْرُ فِيْكُمْ
‘আমি এমন রায় দেব যে রকম রায় দিয়েছিলেন রাসূলুল্লাহ ছা.। মেয়ে অর্ধাংশ পাবে, নাতিন পাবে এক ষষ্টাংশ যাতে করে দু’জনের সম্মিলিত হিস্সা দু’তৃতীয়াংশ হয়। আর বাকীটুকু পাবে বোন। আমরা হজরত আবু মূসা আশআরী রা. এর কাছে ফেরত গিয়ে তার কাছে ইবনে মাসউদ রা. এর রায়ের কথা জানালে তিনি বললেন, ‘এ ‘পন্ডিত’ যতদিন আছে, ততদিন আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা কর না।’ (বুখারী, তিরমিযী, আবু দাউদ, ইবনু মাজাহ, আল মুসতাদরাক, মুসনাদু আহমাদ)৭। এ হাদীছ থেকে জানা যায় যে, কন্যা সন্তানেরা সর্বোচ্চ দু’তৃতীয়াংশ সম্পদ পেতে পারে, তার বেশী নয়। কারণ বলা হয়েছে- ‘দু’তৃতীয়াংশ পূর্ণ করার জন্য’ অর্থাৎ তাদের হিস্সা সর্বোচ্চ দু’তৃতীয়াংশ। তাদের তৃতীয় দলীল হল: হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. বর্নীত হাদীছ। রাসূলুল্লাহ ছা. বলেছেন: عَنْ اِبْنِ عَبَّاسٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَلْحِقُوا الْفَرَائِضَ بِأَهْلِهَا فَمَا بَقِيَ فَهُوَ لأَوْلَى رَجُلٍ ذَكَرٍ ‘হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ছা. বলেছেন: সম্পদ হকদারদেরকে দিয়ে দাও। পরে যা অবশিষ্ট থাকবে তা সর্বাধিক হকদার পুরুষ লোক পাবে।’ (বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী)৮। এ হাদীছ থেকে জানা যায় যে, আছাবা হওয়ার অধিকার শুধু পুরুষের। তাই মেয়েরা দু’তৃতীয়াংশ নেয়ার পরে বাকী এক তৃতীয়াংশ লাভ করবে পুরুষ আছাবাগণ। যেমন ভাই, ভাতিজা, চাচা, চাচাত ভাই প্রভৃতি পুরুষ আছাবাগণের মধ্যে সর্বাধিক ঘনিষ্ঠ পুরুষ আত্মীয়গণ। এ দলীল প্রমাণের ভিত্তিতে জামহুর ছাহাবায়ে এজাম ও উলামায়ে কেরাম মনে করেন যে, কন্যা সন্তান যবীল ফুরূজের অন্তর্গত উত্তরাধিকারী। আর এ কারণেই তাদের হিস্সা ফিক্্রড্ বা নির্ধারিত। একজন হলে অর্ধেক ও একাধিক হলে দৃ’তৃতীয়াংশ। কোন পুরুষ আছাবা বর্তমান থাকলে মেয়ে ও বোনেরা কোন অবস্থাতেই দু’তৃতীয়াংশের বেশী পেতে পারে না।
পক্ষান্তরে হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. এর মতবাদ বিশ্লেষণ করলে জানা যায় যে, মেয়ে ও বোনেরা মাওলার অন্তর্ভুক্ত। এজন্য তারা তাদের সমস্তরের ছেলে ও ভাইদের সাথে একত্রে থাকলেও মাওলা একা থাকলেও মাওলা বলে বিবেচিত হবেন। এ কারণে তারা মোট সম্পদ লাভ করতে পারেন। এ মতবাদের স্বপক্ষে দলীল হল নিম্নরূপ:-
১. আল্লাহ তা’আলা ঘোষনা করেছেন: لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الْأُنْثَيَيْنِ “একজন পুত্র সন্তানের হিস্সা হবে দু’জন কন্যা সন্তানের হিস্সার সমান।” এ আয়াতাংশ থেকে জানা যায় যে, একজন ছেলে ঠিক ততটুকু পাবে, দু’জন মেয়ে যতটুকু পাবে। এখন দু’জন মেয়ে সমস্ত সম্পদ লাভ করতে না পারলে একজন ছেলেও কোন ভাবেই সমস্ত সম্পদের অধিকারী হতে পারবে না। এখানে এ কথা বলার কোন সুযোগ নেই যে ছেলে মেয়ে মিশ্রিত অবস্থায় থাকলে এ হুকুম প্রযোজ্য হবে, অন্যথায় নয়। কারণ মিশ্রিত অবস্থায় থাকার কোন শর্ত কুরআনের আয়াতে বর্তমান নেই।
২. আল্লাহ তা’আলা ঘোষনা করেছেন: وَلِكُلٍّ جَعَلْنَا مَوَالِيَ مِمَّا تَرَكَ الْوَالِدَانِ وَالْأَقْرَبُونَ “আর আমরা পুরুষ নারীর প্রত্যেককে পিতামাতা ও আত্মীয় স্বজনেরা যা কিছু রেখে যাবেন তাতে মাওলা বানিয়েছি।” (সূরা নিসা-৩৩)। এ আয়াতে মাওলা অর্থই হল আছাবা, যা হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা, কাতাদা রাহ. মুজাহিদ রাহ. ইবনে যায়েদ রাহ. এর কৃত তাফসীর ও মহানবীর হাদীছের মাধ্যমে জানা যায়। আর মেয়েরা আছাবা হলে তারা সমস্ত সম্পদই পাবে।
. পুরুষ মাওলা বা আছাবাগণ কন্যা সন্তানের উপস্থিতিতে আছাবা বলে পরিগণিত নন। তখন তারা হয়ত যবীল ফুরূজ হবেন অথবা বঞ্চিত থাকবেন। যেমন আল্লাহ বলেন: وَلِأَبَوَيْهِ لِكُلِّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا السُّدُسُ مِمَّا تَرَكَ إِنْ كَانَ لَهُ وَلَدٌ
“আর মৃতের পিতামাতার প্রত্যেকে মৃত ব্যক্তি যা কিছু রেখে যাবেন তাতে এক ষষ্টাংশ করে পাবেন যদি তার কোন সন্তান থাকে।” (সূরা নিসা-১১)। এ আয়াতের মাধ্যমে জানা গেল যে, কন্যা সন্তান থাকলে পিতার মত সর্বাধিক শক্তিশালী আছাবাও ‘যবীল ফুরূজ’ বলে পরিগণিত হবেন এবং এক ষষ্টাংশ নির্ধারিত হিস্সা লাভ করবেন। তখন তিনি মাওলা বা আছাবা হিসাবে পরিগণিত হয়ে এক ষষ্টাংশের অতিরিক্ত পাবেন না। পিতার পরে দ্বিতীয় শক্তিশালী আছাবা হলেন ভাই। কন্যা সন্তানের উপস্থিতিতে সে ভাই কোন হিস্সাই পাবেন না। কারণ আল্লাহ পরিষ্কারভাবে নির্দেশ দেন: وَهُوَ يَرِثُهَا إِنْ لَمْ يَكُنْ لَهَا وَلَدٌ “আর ভাই বোনের মৃত্যুতে উত্তরাধিকারী হবেন, তবে শর্ত হল যদি সে মৃত বোনের কোন সন্তান না থাকে।” (সূরা নিসা-১৭৬)। এ আয়াতে ভাইয়ের হিস্সা পাওয়ার জন্য মৃতকে নি:সন্তান হওয়ার শর্ত রাখা হয়েছে। আর কন্যাও তো সন্তান বটে। কন্যা সন্তানের কারণে, এ আয়াতের বিধান মোতাবেক, ভাইসহ সকল পুরুষ আছাবাগণ বঞ্চিত থাকবেন। কারণ আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন দূর্বল অসহায় কন্যা সন্তানদেরকে বাদ রেখে সবল কর্মক্ষম আছাবাদেরকে কোন হিস্সা দিতে অনুমতি দেন নি। কন্যা সন্তান নিজে মাওলা হওয়ার কারণেই অপরাপর সকল আছাদেরকে দূরে তাড়িয়ে দিয়েছে।
৪. সূরা নিসার ১৭৬ নং আয়াতটি ইলমুল ফারাইজ সংক্রান্ত সর্বশেষ নাযিলকৃত আয়াত হওয়ার কারণে এ আয়াতের মাধ্যমে আগেকার সকল হুকুমের উপরে এ আয়াতের বিধান প্রাধান্য পেয়েছে। হজরত সা’দ বিন রাবীয়’ রা. সংক্রান্ত হাদীছ সহ কিছু হাদীছে কন্যাদেরকে নির্ধারিত হিস্সা দিয়ে বাকী সম্পদ ভাইদেরকে রাসূলুল্লাহ ছা. দিয়েছেন বলে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে, সর্বশেষ নাযিলকৃত এ আয়াতের মাধ্যমে উহার কার্যকারিতা মানসূখ হয়ে গিয়েছে। কারণ হজরত বারা বিন আযিব রা. বলেন: عَنِ الْبَرَاءِ قَالَ آخِرُ آيَةٍ أُنْزِلَتْ مِنَ الْقُرْآنِ يَسْتَفْتُوْنَكَ قُلِ اللهُ يُفْتِيْكُمْ فِيْ الْكَلاَلَةِ হজরত বারা রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: ‘সর্বশেষ কুরআনের যে আয়াত নাযিল হয় তা হল- يَسْتَفْتُوْنَكَ قُلِ اللهُ يُفْتِيْكُمْ فِيْ الْكَلاَلَةِ - অর্থাৎ সূরা নিসার এই ১৭৬ নং আয়াত।’ (মুসলিম, বুখারী)৯।
৫. فَإِنْ كُنَّ نِسَاءً فَوْقَ اثْنَتَيْنِ فَلَهُنَّ ثُلُثَا مَا تَرَكَ “সুতরাং যদি তারা দু’এর অধিক কন্যা সন্তান হয়, তবে তারা দু’তৃতীয়াংশ পাবে সে যা কিছু ছেড়ে যাবে, তা থেকে” -এ আয়াতাংশ দ্বারা মেয়েদের হিস্সা দু’তৃতীয়াংশ নির্ধারিত হয় না। কারণ এ আয়াতাংশের পরেই একই আয়াতে বাকী এক তৃতীয়াংশের মালিকানা পিতামাতার প্রাপ্য বলে আল্লাহ ঘোষনা করে বলেন: وَلِأَبَوَيْهِ لِكُلِّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا السُّدُسُ مِمَّا تَرَكَ إِنْ كَانَ لَهُ وَلَدٌ “আর তার পিতামাতার প্রত্যেকে সে মৃত ব্যক্তি যা কিছু রেখে যাবে তাতে এক ষষ্টাংশ করে পাবেন যদি তার কোন সন্তান থাকে।” (সূরা নিসা-১১)। আয়াতের এ দু’অংশের বিধান থেকে বুঝা যায় যে, পিতামাতা এক ষষ্টাংশ করে মোট এক তৃতীয়াংশ পাবেন আর সন্তান পুত্র হোক কন্যা হোক তারা পাবে বাকী দু’তৃতীয়াংশ। এখানে কন্যাদের অবস্থান কি তা বুঝতে হলে لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الْأُنْثَيَيْنِ “একজন পুত্র সন্তানের হিস্সা হবে দু’জন কন্যা সন্তানের হিস্সার সমান”-আয়াতাংশ এবং وَلِكُلٍّ جَعَلْنَا مَوَالِيَ مِمَّا تَرَكَ الْوَالِدَانِ وَالْأَقْرَبُونَ “আর আমরা পুরুষ নারীর প্রত্যেককে পিতামাতা ও আত্মীয় স্বজনেরা যা কিছু রেখে যাবেন তাতে মাওলা বানিয়েছি”- আয়াতাংশের বিধানকে সামনে রেখে বিবেচনা করতে হবে। এখানে স্মরণ রাখতে হবে যে, আল্লাহ তা’আলা কন্যাদেরকে প্রথমে শুধু হিস্সাদার ঘোষনা করেন, অনেক পরে ঘোষনা করেন যে, পুরুষ নারীর সবাইকে মাওলা বানিয়েছি। আর দশম হিজরী সনে বিদায় হজ্জের প্রাক্ষালে সন্তানদের উপস্থিতিতে ভাইবোন পাবে না বলে নির্দেশনা দান করেন। আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা জরুরী মনে করছি, তা হল: لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الْأُنْثَيَيْنِ আয়াতাংশ দ্বারা মূলনীতি বর্ণণা করা হয়েছে এবং فَإِنْ كُنَّ نِسَاءً فَوْقَ اثْنَتَيْنِ فَلَهُنَّ ثُلُثَا مَا تَرَكَ আয়াতাংশ দ্বারা পূর্বের অংশের ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এ কারণে ব্যাখ্যা অংশের শুরুতে فَ বর্ণটি প্রয়োগ করা হয়েছে, যাকে ব্যাখ্যাদানকারী বর্ণ বা اَلْفَاءُ لِلتَّفْسِيْرِ বলা হয়। সুতরাং আয়াতের এ অংশ দিয়ে নতুন কোন মূলনীতি নির্ধারিত হবে না বরং পূর্বের আয়াতাংশের বিশ্লেষণ ও তাফসীর হবে।
৬. হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. বর্নীত হাদীছে করীমায় রাসূলুল্লাহ ছা. বলেছেন: أَلْحِقُوا الْفَرَائِضَ بِأَهْلِهَا فَمَا بَقِيَ فَهُوَ ِلأَوْلَى رَجُلٍ ذَكَرٍ ‘তোমরা উত্তরাধিকারী লোকদেরকে তাদের হিস্সা দিয়ে দাও। যা অবশিষ্ট থাকবে, তা পাবে সর্বাধিক হকদার পুরুষ লোক।’ (বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী) ১০। এ হাদীছে করীমায় ‘সর্বাধিক হকদার পুরুষলোক’ বলতে আছাবাদেরকে বুঝায় না; উহা দ্বারা পুত্র সন্তান বুঝায়। কারণ পুত্রের চেয়ে অধিক হকদার কোন পুরুষ আত্মীয় নেই। দূরবর্তী পুরুষ আছাবাগণ কখনোই ‘সর্বাধিক হকদার পুরুষলোক’ হতে পারেন না। তাছাড়া ইসলামে ‘আছাবাগিরী’ নেই বলে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ ছা. ঘোষণা করেছেন।
৭. কুরআনের মোকাবেলায় হাদীছের দলীল গ্রহন যোগ্য নয়। তাছাড়া হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. বর্ণিত হাদীছখানা ‘খবরে ওয়াহিদ’ ও ‘মুজতারাব’ বলে চিহ্নিত। আর হজরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রা. বর্ণিত হাদীছখানা দ্বারা তার নিজের ফতোয়া প্রমাণীত হয়। ‘দু’তৃতীয়াংশ পূর্ণ করার জন্য’ বাক্যটি কখনোই রাসূলুল্লাহ ছা. এর নয়। হজরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রা. এমন দাবীও করেন নি। তিনি শুধু বলেছেন: ‘আমি এমন রায় দিব যার মত রায় রাসূলুল্লাহ ছা. দিয়েছিলেন।’ উহা দ্বারা রাসূলুল্লাহ ছা. এর আমল প্রমানীত হয়, ‘বক্তব্য’ প্রমাণীত হয় না। এ কারণে দু’জন মেয়ে ও কয়েকজন নাতি-নাতিনের ক্ষেত্রে হজরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রা. এর ফতোয়া হল: দু’জন মেয়ে মোট সম্পদের দু’তুতীয়াংশ পাবে। আর বাকী এক তৃতীয়াংশ পাবে নাতি। নাতিন কিছুই পাবে না। কারণ মেয়েরা দু’তৃতীয়াংশের অধিক সম্পদ পায় না। যেমন বর্ণিত হয়েছে: عَنْ إِبْرَاهِيْمَ : فِيْ رَجُلٍ تَرَكَ اِبْنَتَيْهِ وَبَنِيْ اِبْنِهِ رِجَالاً وَنِسَاءً : فَلاِبْنَتَيْهِ الثُّلُثَانِ ، وَمَا بَقِيَ فَلِلذُّكُوْرِ دُوْنَ الْإِنَاثِ ، وَكَانَ عَبْدُ اللهِ لاَ يَزِيْدُ الْأَخَوَاتِ وَالْبَنَاتِ عَلَى الثُّلُثَيْنِ ، وَكَانَ عَلِيٌّ وَزَيْدٌ يُشَرِّكُوْنَ فِيْمَا بَيْنَهُمْ ، فَمَا بَقِيَ {لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الْأُنْثَيَيْن}. হজরত ইবরাহীম রাহ. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: কোন লোক যদি দু’জন মেয়ে ও ছেলের তরফের কয়েকজন নাতি-নাতিন রেখে মারা যায়, তবে তার দু’মেয়ে পাবে দু’তৃতীয়াংশ আর যা কিছু বাকী থাকবে, তা পাবে নাতিগণ; নাতিনেরা কিছুই পাবে না। আর আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রা. মেয়ে ও বোনদেরকে দু’তুতীয়াংশের বেশী কিছুই দিতেন না। আর হজরত আলী ও যায়েদ রা. নাতি-নাতিন উভয়কে পরস্পরের শরীক রাখতেন। সুতরাং তারা যা কিছু বাকী থাকত, তাতে ‘এক পুরুষ দুই নারীর সমান হিস্সা পাবে- এ নীতিমালা অনুসারে প্রদান করতেন। (ইবনু আবী শাইবা) ১১।
কিন্তু উলামাগণ হজরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রা. এর ফতোয়া গ্রহন না করে নাতির সাথে নাতিনকেও সম্পদে হিস্সা দেয়ার পক্ষে ফতোয়া দেন। আরেকটি বিষয় আলোচনার দাবী রাখে। তা হল: সে নাতিন আপন নাতিন ছিলেন না পালক -পুত্রের তরফের নাতিন ছিলেন, তা নিশ্চিত নয়। কারণ মক্কা-মদীনা সহ সমগ্র আরব উপত্যকায় পালক-পুত্রদেরকে ‘পুত্র’ ও তাদের সন্তানদেরকে ‘নাতি-নাতিন’ বলার প্রচলন ছিল। এজন্য এ হাদীছ দ্বারা সন্দেহাতীতভাবে কিছুই প্রমাণীত হয় না।
৮. কন্যাদেরকে আছাবা স্বীকার না করলে এমন উত্তরাধিকারীদেরকে হিস্সা দিতে হয়, কন্যাদের উপস্থিতিতে যাদের কোন হিস্সা নেই বলে কুরআনের সুস্পষ্ট ঘোষনা রয়েছে। যেমন কোন লোক তার ১০ জন মেয়ে ও একজন ভাই অথবা বোন রেখে মৃত্যু বরণ করল। এ অবস্থায় ফকীহগণের মতামত হল ১০ জন মেয়ে পাবে ২/৩ অংশ আর একজন ভাই অথবা বোন একাই পাবে ১/৩ অংশ। অথচ কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন বলেন: إِنِ امْرُؤٌ هَلَكَ لَيْسَ لَهُ وَلَدٌ وَلَهُ أُخْتٌ فَلَهَا نِصْفُ مَا تَرَكَ وَهُوَ يَرِثُهَا إِنْ لَمْ يَكُنْ لَهَا وَلَدٌ “যদি কোন লোক মারা যায় নি:সন্তান অবস্থায় আর তার কোন বোন থাকে, তাহলে সে বোন মৃত ব্যক্তি যা কিছু রেখে যাবে তার অর্ধেক পাবে। আবার বোন মারা গেলে তার ভাই হিস্সা পাবে, তবে শর্ত হল সে বোনকে নি:সন্তান হতে হবে।” (সূরা নিসা-১৭৬)। এ আয়াতের শিক্ষা অনুসারে মৃতের সন্তান থাকলে ভাই বা বোন কোন হিস্সা পেতে পারে না। সে সন্তান পুত্র হোক অথবা কন্যা, তাতে নির্দেশের কোন তারতম্য হবে না। বর্নীত আছে যে, জনৈক ব্যক্তি হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. এর কাছে এ ব্যাপারে ফতোয়া চাইলে তিনি বললেন: ‘বোন কিছুই পাবে না।’ প্রশ্নকারী বললেন এ অবস্থায় হজরত উমার রা. তো বোনকে হিস্সা দেন। তখন তিনি রেগে গিয়ে বললেন: أَنْتُمْ أَعْلَمُ أَمِ اللهُ ‘তোমরা বেশী জান না আল্লাহ বেশী জানেন।’ (আল মুসতাদরাক, বায়হাকী কুবরা, মুছান্নাফু আব্দির রায্যাক) ১২।
৯. পুরুষের জন্য মাওলা বা আছাবা হওয়ার অধিকার সীমিত করে দেয়া কুরআনের হুকুমের সুস্পষ্ট খেলাফ। কারণ কুরআনের আয়াতে- لِلرِّجَالِ نَصِيبٌ مِمَّا تَرَكَ الْوَالِدَانِ وَالْأَقْرَبُونَ وَلِلنِّسَاءِ نَصِيبٌ مِمَّا تَرَكَ الْوَالِدَانِ وَالْأَقْرَبُونَ مِمَّا قَلَّ مِنْهُ أَوْ كَثُرَ نَصِيبًا مَفْرُوضًا - বলে কম হোক বেশী হোক সকল ‘সম্পদ ও অধিকার’ (اَلْأَمْوَالُ وَالْحُقُوْقُ) -এ পুরুষের যেমন অধিকার স্বীকার করা হয়েছে নারীর অধিকারও তেমনি স্বীকার করা হয়েছে। মাওলা বা আছাবা হওয়ার অধিকারে নারীকে শামিল না করলে এ আয়াতে বর্ণিত বিধানের সরাসরি লঙ্ঘন বলে বিবেচিত হবে।
চতুর্থত: অন্য উত্তরাধিকারীর সাথে একাধিক কন্যা সন্তানের অবস্থা:
যদি মৃতের কন্যা সন্তানদের সাথে অন্য নির্ধারিত হিস্সাদার উত্তরাধিকারী বা ‘যবীল ফুরূজ’ বর্তমান থাকেন, তাহলে তাদেরকে হিস্সা দেয়ার পরে যে সম্পদ অবশিষ্ট থাকবে, তা মৃতের কন্যাগণ লাভ করবে। কন্যাদের সাথে যারা হিস্সা পাবেন তারা মৃতের খুবই ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। যেমন মৃতের পিতা, মাতা, দাদা দাদী, নানা, নানী, স্বামী ও স্ত্রী। এ আত্মীয়দেরকে হিস্সা দেয়ার পরে যা কিছু অবশিষ্ট থাকবে, কন্যাগণ তার সবটুকু লাভ করবে। কারণ কন্যাগণ মাওলা বা আছাবাদের অন্তর্ভুক্ত। আর আছাবাগণ সর্বদা অবশিষ্টাংশ লাভ করেন।
কিন্তু জামহুর উলামায়ে কেরামের মতে তারা যবীল ফুরূজদের অন্তর্ভুক্ত হিস্সাদার, যা আগেই বলা হয়েছে। তাদের মতে কন্যা একজন হলে মোট সম্পদের অর্ধেক ও একাধিক হলে মোট সম্পদের দু’তৃতীয়াংশ তাদের জন্য নির্ধারিত। কিন্তু তাদের মতানুসারে হিস্সা ভাগ করলে হিসাবে গরমিল দেখা দেয়। একজন মেয়ের বেলায় যেমন গরমিল দেখা দেয়, একাধিক মেয়ের বেলায়ও ঠিক তেমনি গরমিল দেখা দেয়। আর এ গরমিল থেকেই বুঝা যায় যে, এ সমাধানটি বিশুদ্ধ নয়, উহাতে ত্র“টি রয়েছে। একাধিক মেয়ের বেলায় গরমিলের চিত্র নীচের ছকে দেখুন:-
সমস্যা নং- ৬. যদি কোন নারী তার স্বামী, পিতামাতা ও দু’জন কন্যা সন্তান রেখে মৃত্যু বরণ করে, তাহলে ফকীহদের মতানুসারে তার সমাধান ও ‘আওল’ সৃষ্টির উদাহরণ :
সমাধান: ফকীহদের মতে তখন স্বামী পাবে ১/৪ অংশ, পিতা পাবেন ১/৬ অংশ, মাতা পাবেন ১/৬ অংশ এবং দু’জন কন্যা পাবে ২/৩ অংশ। ভগ্নাংশের হরের মধ্যে ৪, ৬ ও ৩ থাকায় ল.সা.গু হবে ১২। সুতরাং মোট সম্পদকে ১২ ভাগ করে বণ্টন করতে হবে। সেক্ষেত্রে স্বামী পাবে ৩/১২, পিতা পাবেন ২/১২, মাতা পাবেন ২/১২ এবং দু’কন্যা পাবে ৮/১২। তাতে যোগফল দাড়াবে (৩/১২ + ২/১২ + ২/১২ + ৮/১২) = ১৫/১২। তখন দেখা যাবে যে সম্পদ ১২ অংশ করা হয়েছে কিন্তু প্রাপ্য হিস্সা হল ১৫ অংশ। গত্যন্তর না থাকায় সম্পদকে ১২ এর স্থলে ১৫ অংশ করতে হবে এবং ১২ অংশের হিসাবেই সবাইকে দিতে হবে বলে তারা ফতোয়া দেন। যেমন মনে করুন সম্পদ হল মোট ৬,০০,০০০ টাকা। কুরআনের বিধান অনুসারে মৃতের সন্তান থাকলে স্বামী এক চতুর্থাংশ এবং পিতামাতার প্রত্যেকে এক ষষ্টাংশ করে পাওয়ার স্পষ্ট হুকুম রয়েছে। কিন্তু দু’জন মেয়ে থাকলে তারা মোট সম্পদের দু’তৃতীয়াংশ পাবে বলে ফকীহগণ মনে করেন। এ হিসাবে স্বামী ১,৫০,০০০ টাকা, পিতা ১,০০,০০০ টাকা ও মাতা ১,০০,০০০ টাকা এবং দু’জন কন্যা ৪,০০,০০০ টাকা পাওয়ার কথা থাকলেও ফকীহগণ হিসাবের গরমিল হওয়ার অজুহাতে সবাইকে একটু একটু করে কম দেয়ার কথা বলেন। কারণ তাদের সম্পদের ১ (পূর্ণ) অংশের স্থলে অংশ ১৫/১২ ভাগ হয়ে গরমিল হতে দেখা যায়। সেজন্য তারা উপরোক্ত মাসআলায় স্বামীকে ১,২০,০০০ টাকা পিতাকে ৮০,০০০ টাকা মাতাকে ৮০,০০০ টাকা ও মেয়েকে ৩,২০,০০০ টাকা দিয়ে সমাধান করেন। অথচ তাদের নিজেদের সূত্রমতে মেয়েদেরকে ৪,০০,০০০ টাকা দেয়ার কথা।
কিন্তু হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. এর মতবাদের আলোকে অংশ ভাগ করলে হিসাবে গরমিল হবে না। তাঁর মতবাদের আলোকে উপরোক্ত মাসআলাটির সমাধান নীচের উদাহরণে দেখুন:-
সমস্যা নং- ৭. যদি কোন নারী তার স্বামী, পিতামাতা ও দু’জন কন্যা সন্তান রেখে মৃত্যু বরণ করে, তাহলে হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. এর মতানুসারে তার সমাধানে ‘আওল’ সৃষ্টি হবে না :
সমাধান: হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. এর মতে তখন স্বামী পাবে ১/৪ অংশ, পিতা পাবেন ১/৬ অংশ, মাতা পাবেন ১/৬ অংশ এবং দু’জন কন্যা পাবে অবশিষ্ট সম্পদ। ভগ্নাংশের হরের মধ্যে ৪ ও ৬ থাকায় ল.সা.গু হবে ১২। সুতরাং মোট সম্পদকে ১২ ভাগ করে বণ্টন করতে হবে। সেক্ষেত্রে স্বামী পাবে ৩/১২, পিতা পাবেন ২/১২, মাতা পাবেন ২/১২ এবং কন্যাগণ পাবে অবশিষ্ট ৫/১২। তাতে যোগফল দাড়াবে (৩/১২ + ২/১২ + ২/১২ + ৫/১২) = ১২/১২। যেমন মনে করুন সম্পদ হল মোট ৬,০০,০০০ টাকা। কুরআনের বিধান অনুসারে মৃতের সন্তান থাকলে স্বামী এক চতুর্থাংশ এবং পিতামাতার প্রত্যেকে এক ষষ্টাংশ করে পাওয়ার স্পষ্ট বিধান রয়েছে। আর দু’জন মেয়ে অবশিষ্ট সম্পদ পাবে বলে তিনি মনে করেন। এ হিসাবে স্বামী ১,৫০,০০০ টাকা, পিতা ১,০০,০০০ টাকা ও মাতা ১,০০,০০০ টাকা এবং কন্যাগণ অবশিষ্ট ২,৫০,০০০ টাকা পেলন। তাতে হিসাবের গরমিল দেখা দেয়ার কোন কারণ নেই।
সুতরাং দেখা গেল যে, ফকীহদের মতানুসারে কন্যাদেরকে নির্ধারিত হিস্সা দিতে গেলে আওলের এ উপস্থিতি ত্র“টিপূর্ণ সিদ্ধান্তের প্রমাণ। অথচ তারা একাধিক মেয়েকে যত হিস্সা দেন, মেয়েদের স্থলে এক বা একাধিক ছেলে থাকলে তাদেরকে ততটুকু দিতে রাজী নন। আর কুরআনের সুস্পষ্ট শিক্ষা হল এই যে, মেয়েরা কোন অবস্থাতেই ছেলের চাইতে বেশী পেতে পারে না। নীচের ছকে উপরের ছকের আত্মীয়দের উপস্থিতিতে মেয়েদের স্থলে ছেলের হিস্সা দেখানো হল।
সমস্যা নং- ৮. যদি কোন নারী তার স্বামী, পিতামাতা ও এক বা একাধিক পুত্র সন্তান রেখে মৃত্যু বরণ করেন, তাহলে তার সমাধান: [ঐক্যমত্য অনুসারে] :
সমাধান: তখন স্বামী পাবে ১/৪ অংশ, পিতা পাবেন ১/৬ অংশ, মাতা পাবেন ১/৬ অংশ এবং এক বা একাধিক পুত্র পাবে অবশিষ্ট অংশ। ভগ্নাংশের হরের মধ্যে ৪ ও ৬ থাকায় ল.সা.গু হবে ১২। সুতরাং মোট সম্পদকে ১২ ভাগ করে বণ্টন করতে হবে। সেক্ষেত্রে স্বামী পাবে ৩/১২, পিতা পাবেন ২/১২, মাতা পাবেন ২/১২ এবং এক বা একাধিক পুত্র পাবে অবশিষ্ট ৫/১২। তাতে যোগফল দাড়াবে (৩/১২ + ২/১২ + ২/১২ + ৫/১২) = ১২/১২। যেমন মনে করুন সম্পদ হল মোট ৬,০০,০০০ টাকা। কুরআনের বিধান অনুসারে মৃতের সন্তান থাকলে স্বামী এক চতুর্থাংশ এবং পিতামাতার প্রত্যেকে এক ষষ্টাংশ করে পাওয়ার স্পষ্ট বিধান রয়েছে। আর এক বা একাধিক পুত্র থাকলে তারা মাওলা বা আছাবা হিসাবে অবশিষ্টাংশ পাবে। এ হিসাবে স্বামী ১,৫০,০০০ টাকা, পিতা ১,০০,০০০ টাকা ও মাতা ১,০০,০০০ টাকা ও এক বা একাধিক পুত্র অবশিষ্ট ২,৫০,০০০ টাকা পাবে। এ সমাধানে কারো কোন ভিন্নমত নেই। সকল ছাহাবী ও উলামাগণ এ ক্ষেত্রে একমত।
সুতরাং প্রমাণীত হল যে, মেয়েদেরকে মাওলা গণ্য করে হিস্সাদান করাই কুরআনের সঠিক শিক্ষার উপর প্রতিষ্ঠিত।
পঞ্চমত: ছেলে মেয়ে মিলিত ভাবে থাকলে তাদের অবস্থা:
ছেলে মেয়ে মিলিতভাবে থাকলে, তারা সর্বদা অবশিষ্ট অংশ লাভ করেন। আর অন্য অংশীদার না থাকলে তারা মোট সম্পদ লাভ করেন। তখন তাদের মধ্যে সম্পদ বন্টনের মূলনীতি হয় لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الْأُنْثَيَيْنِ “একজন পুরুষ দু’জন নারীর সমান হিস্সা পাবে।” এ পঞ্চম অবস্থাটাই শুধু মতবিরোধ বিহীন। সকল ছাহাবী ও উলামায়ে কেরামের সকলে একই মত প্রকাশ করেন।
তুলনামূলক আলোচনা:
আসুন এবার যুক্তির বিচারে আলোচনা করে দেখি কোন্ দলের ব্যাখ্যা অধিক যুক্তি সংগত ও কুরআন হাদীছের চেতনার সাথে অধিক সংগতিপূর্ণ।
ক. হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. এর সমাধান গ্রহন করলে হিসাবের কোন গরমিল দেখা দেয় না। শুধু একজন কন্যা হলে তার অংশ মোট সম্পদের ১/২ অংশের স্থলে অবশিষ্ট সম্পদের ১/২ অংশে দাড়ায় আর একাধিক কন্যার বেলায় তাদের অংশ মোট সম্পদের ২/৩ অংশের স্থলে অবশিষ্ট সম্পদে পরিবর্তিত হয়। কুরআনে বর্ণিত আয়াতের দিকে গভীর দৃষ্টি দিয়ে অনুধাবন করার চেষ্টা করলে বুঝা যায় যে, এটাই যথার্থ ও সঠিক। কারণ উপরোক্ত অবস্থায় মেয়েদের স্থলে যদি ছেলে হত, তাহলে ছেলেও সেই অবশিষ্ট ৫/১২ অংশই পেত টাকার অংকে যা ২,৫০,০০০ টাকা। আর এ কথাটা স্বত:সিদ্ধ যে, মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে বেশী পেতে পারে না। আশ্চর্য জনক কথা হল এই যে, একজন ছেলে যেখানে ২,৫০,০০০ টাকা পায়, সেখানে ছেলের স্থলে একজন মেয়ে হলে সে কেমন করে ২,৭৬,৯২৩.০৮ টাকা পাবে? (৩ নং সমস্যা মোতাবেক) কিংবা একাধিক মেয়ে হলে তারা ৩,২০,০০০ টাকা পাবে? (৬ নং সমস্যা মোতাবেক) অথচ আওলের প্রবক্তাগণ তাই বলেছেন।
খ. আওল হওয়াই প্রমাণ করে অংকে কোথাও ভুল হয়েছে। অংক ও গণিত শাস্ত্রের স্রষ্টা হলেন আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন। তিনি তো কোন ভুল করতে পারেন না। আর তিনি বলেছেন: مَا تَرَى فِي خَلْقِ الرَّحْمَنِ مِنْ تَفَاوُتٍ “তুমি রাহমানের সৃষ্টিতে কোন খুঁত দেখতে পাবে না।” (সূরা আল্ মুল্ক - ৩)। নিশ্চয়ই কুরআনের ব্যাখ্যা গ্রহন ও ভগ্নাংশের হিসাবে ফকীহদের ভুল হয়েছে। কিন্তু হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. এর হিসাবে গরমিল বা কোন ভুল নেই।
গ. হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. এর পেশ করা সূরা নিসার ৩৩ নং আয়াতের দলীলের বিপরীতে ফকীহদের কাছে সন্তোষজনক কোন জবাব নেই।
ঘ. আছাবা সংক্রান্ত হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. বর্ণিত হাদীছখানা একটি বিচ্ছিন্ন হাদীছ বা খবরে ওয়াহিদ। তাছাড়া তিনি নিজে বর্ণণাকারী হওয়া সত্বেও এ হাদীছের বাইরে গিয়ে যখন মত প্রকাশ করলেন, তাতে এ হাদীছখানার ব্যাপারে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। উপরন্তু ইমাম তাহাবী রাহ. এ হাদীছখানাকে ‘মুজতারাব’ বা ‘জটিলতা সৃষ্টিকারী’ বলে অভিহিত করেছেন।
ঙ. একাধিক কন্যাসন্তানকে মোট সম্পদের দু’তৃতীয়াংশ দেয়ার ব্যাখ্যাটি সূরা নিসার ১১ নং আয়াতের প্রথমাংশের মর্মার্থের স্পষ্ট বিরোধী। কারণ একজন ছেলে যদি সম্পূর্ণ সম্পদ পায়, তাহলে দু’জন মেয়েও তো সম্পূর্ণ সম্পদ পাওয়ার কথা। আবার এর বিপরীত অর্থে- আলোচ্য অংকে দু’জন মেয়ে ঠিক ততটুকু পাবে, তাদের স্থলে একজন ছেলে হলে সে যতটুকু পেত। দু’জন মেয়েরাও তো একজন ছেলের সমান হিস্সার অতিরিক্ত পেতে পারে না। এ বিষয়টি নিশ্চিত করলে কোন আওল হবে না।
চ. মেয়েরা মাওলা হতে পারে না- এ মতটি আয়াতের প্রথমাংশের বিরোধী। আয়াতাংশের মর্ম অনুসারে দু’জন মেয়ে যতটুকু সম্পদ পায় ও অধিকার ভোগ করে একজন ছেলে ঠিক ততটুকু পাবে, এর চেয়ে বিন্দু পরিমান বেশী পেতে পরে না।
ছ. ছেলেমেয়েরা মিশ্রিত অবস্থায় থাকলে ‘একজন ছেলে দু’জন মেয়ের সমান হিস্সা পাবে’ অন্যথায় নয় - ফকীহদের এ দাবী কুরআন সমর্থিত নয়। আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন ‘মিশ্রিত অবস্থায়’ থাকার কোন শর্ত আরোপ করেন নি। কোন দলীল ব্যাতীত আয়াতের সাধারণ বা ‘আম’ হুকুমকে স্পেশাল বা ‘খাছ’ করা অর্থাৎ শর্তহীন হুকুমকে শর্তযুক্ত করা কোনভাবেই জায়েয নয়।
উপরোক্ত যুক্তি সমূহকে বিবেচনায় রেখে আয়াতে করীমার দু’অংশের মর্মার্থকে ব্যাখ্যা করলে যা দাড়ায়, তা হল:
يُوصِيكُمُ اللَّهُ فِي أَوْلَادِكُمْ لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الْأُنْثَيَيْنِ فَإِنْ كُنَّ نِسَاءً فَوْقَ اثْنَتَيْنِ فَلَهُنَّ ثُلُثَا مَا تَرَكَ (وَالثُلُثُ اْلاَخِيْرُ لِلوَالِدَيْنِ) وَإِنْ كَانَتْ وَاحِدَةً فَلَهَا النِّصْفُ اَىْ نِصْفُ حَظِّ الذَّكَرِ وَلِأَبَوَيْهِ لِكُلِّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا السُّدُسُ مِمَّا تَرَكَ إِنْ كَانَ لَهُ وَلَدٌ اَىْ لِاَبَوَيْهِ الثُّلُثُ
“সন্তানদের ব্যাপারে আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশনা দিচ্ছেন: ‘একজন পুরুষ দু’জন নারীর সমান হিস্সা পাবে। সুতরাং যদি তারা দু’এর অধিক কন্যা সন্তান হয়, তবে তারা মৃত লোক যা কিছু ছেড়ে যাবে তার দু’তৃতীয়াংশ পাবে (বাকী এক তৃতীয়াংশ পিতামাতার জন্য থাকবে); আর যদি একজন হয়, তবে সে পাবে অর্ধেক অর্থাৎ ছেলের হিস্সার অর্ধেক। আর সন্তান থাকলে পিতামাতার প্রত্যেকে এক ষষ্টাংশ করে পাবে অর্থাৎ মোট এক তৃতীয়াংশ পাবে।” এ ব্যাখ্যা গ্রহন করলে মেয়ে একজন হলে অবশিষ্ট অংশের অর্ধেক, একাধিক হলে কিংবা ছেলেমেয়ে মিলিতভাবে থাকলে অবশিষ্ট অংশ লাভ করবে।
এবার পিতামাতার সাথে একজন মেয়ের হিস্সা নীচের ছকে দেখুন:-
সমস্যা নং - ৯. যদি কোন নারী কিংবা পুরুষ তার পিতামাতা ও একজন কন্যা সন্তান রেখে মৃত্যু বরণ করেন, তাহলে তার সমাধান হবে নিম্নরূপ:
সমাধান: কুরআন মোতাবেক কোন সন্তান থাকলে পিতামাতার প্রত্যেকে পান এক ষষ্টাংশ করে। এ হিসাবে পিতা পাবেন ১/৬ অংশ, মাতা পাবেন ১/৬ অংশ এবং একজন কন্যা সন্তান অর্ধেক মাওলা হওয়ার কারণে সে পাবে অবশিষ্টাংশের অর্ধেক। পিতামাতার অংশের পরে অবশিষ্ট থাকে {১ - (১/৬ + ১/৬)}= {১ - ২/৬} = ৪/৬ অংশ যা ছেলে থাকলে পেত। তার অর্ধেক মেয়েকে দেয়া হল, আর তা হল ৪/৬ ২ = ২/৬ অংশ। বাকী থেকে যায় = (৪/৬ - ২/৬ ) = ২/৬ অংশ, যার কোন হকদার নেই, তাই রদ্দ বা পুন:বণ্টণ হল। রদ্দের নিয়ম অনুসারে সম্পদকে ছয় ভাগ না করে চার ভাগ করা হল। যে চার ভাগের মধ্যে পিতা ১ অংশ, মাতা ১ অংশ ও মেয়ে ২ অংশ পাবে। মনে করি মোট সম্পদ হল ৬,০০,০০০ টাকা। তার মধ্যে পিতা পাবেন ১,৫০,০০০/- টাকা, মাতা পাবেন ১,৫০,০০০/- টাকা ও কন্যা পাবে ৩,০০,০০০/- টাকা। তাতে দেখা গেল যে, মেয়ে মোট সম্পদের অর্ধেকই পেয়েছে। এখানে পিতাকে মাওলা বানিয়ে অতিরিক্ত অংশ দেয়া হয়নি, কারণ কুরআন দ্বারা উহা স্বীকৃত নয়। অপরদিকে পিতামাতার হিস্সাও সমান হয়েছে, যা আয়াতের বর্ণিত হিস্সার সমতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কারণ সন্তান থাকলে পিতামাতার হিস্সা সমান করে আল্লাহ বিধান দিয়েছেন।
এবার দু’জন বা তার চেয়ে অধিক মেয়ের হিস্সা নীচের ছকে দেখুন:-
সমস্যা নং - ১০. যদি কোন নারী কিংবা পুরুষ তার পিতামাতা ও দু’ বা ততোধিক কন্যা সন্তান রেখে মৃত্যু বরণ করে, তাহলে তার সমাধান হবে নিম্নরূপ:
সমাধান: কুরআন মোতাবেক কোন সন্তান থাকলে পিতামাতার প্রত্যেকে পান এক ষষ্টাংশ করে। এ হিসাবে পিতা পাবেন ১/৬ অংশ, মাতা পাবেন ১/৬ অংশ এবং কন্যাগণ মাওলা হওয়ার কারণে পাবে অবশিষ্টাংশ। পিতামাতার অংশের পরে অবশিষ্ট থাকে {১ - (১/৬ + ১/৬)}= {১ - ২/৬} = ৪/৬ অংশ। মোট সম্পদকে ছয়ভাগ করে সে ছয় ভাগের মধ্যে পিতা ১ অংশ, মাতা ১ অংশ ও মেয়েরা অবশিষ্ট ৪ অংশ পাবে। মনে করি মোট সম্পদ হল ৬,০০,০০০ টাকা। তার মধ্যে পিতা পাবেন ১,০০,০০০/- টাকা, মাতা পাবেন ১,০০,০০০/- টাকা ও কন্যাগণ পাবে ৪,০০,০০০/- টাকা। তাতে দেখা যাচ্ছে যে, কন্যাগণ মোট সম্পদের দু’তৃতীয়াংশ ও পিতামাতা যৌথভাবে এক তৃতীয়াংশ পেয়েছেন।
ছেলেমেয়েরা যে অবশিষ্ট অংশ পায় তার প্রমাণ: ছেলেমেয়েরা পিতামাতার প্রকৃত উত্তরাধিকারী। তাদের জন্য কোন হিস্সা নির্দিষ্ট নেই। যে সম্পদ তাদের পিতামাতা অর্জন করে ছিলেন তা প্রকৃত পক্ষে তাদের জন্যই অর্জন করে ছিলেন। অন্য হকদারগণ তাতে যবীল ফুরূজ হিসাবে নির্ধারিত অল্প কিছু হিস্সা পাবেন ও বাকীটুকু সন্তানদের জন্য থাকবে। এ বক্তব্য নীচের দলীলগুলো দ্বারা প্রমানীত হবে:
ক. আল্লাহ বলেন: وَإِنِّيْ خِفْتُ الْمَوَالِيَ مِنْ وَرَائِيْ وَكَانَتِ امْرَأَتِيْ عَاقِرًا فَهَبْ لِيْ مِنْ لَدُنْكَ وَلِيًّا يَرِثُنِيْ وَيَرِثُ مِنْ آَلِ يَعْقُوْبَ وَاجْعَلْهُ رَبِّ رَضِيًّا “আর আমার পরে কে আমার উত্তরসূরী হবে তা নিয়ে আমি শংকিত আছি এবং-(কারণ) আমার স্ত্রী হল বন্ধ্যা। সুতরাং হে আল্লাহ, তুমি আমাকে একজন ‘ওলী’- সন্তান দান কর; যে আমার ও ‘ইয়াকুব বংশের’ (প্রকৃত) উত্তরাধিকারী হবে। আর হে প্রভু, তাকে তোমার সন্তুষ্টি হাসিলের উপযোগী বানাও। (সূরা মরিয়াম-৫-৬)।
খ. কুরআনে দু’জন মেয়ের হিস্সা না বলে দু’জনের অধিক মেয়ের হিস্সা বলার দ্বারাই প্রমাণীত হয় যে, মেয়ের সংখ্যা দু’জন হলে এবং কোন ছেলে না থাকলে তারা অবশিষ্ট সম্পদ পাবে যেমন একজন ছেলে থাকলে পেত। আল্লাহ দু’জন মেয়ের হিস্সার কথা এ কারণে স্পষ্ট করে বলেন নি কারণ لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الْأُنْثَيَيْنِ বলার সাথে সাথে দু’জন মেয়ের হিস্সার কথা বর্ণিত হয়েছে।
গ. এ ব্যাখ্যা সঠিক হওয়ার সবচেয়ে বড় প্রমাণ আওল না হওয়া। অন্য ব্যাখ্যা মোতাবেক হিস্সা দিলে অংক মিলে না; কারণ সূত্রে ভুল। আর আলোচ্য সূত্র সঠিক হওয়ার কারণে কন্যাগণকে মাওলা গণ্য করে অবশিষ্ট সম্পদ দিতে রাজী হলে আওল হয় না বরং অংক মিলে যায়।
ঘ. আল্লাহ যখন বললেন ‘একজন ছেলের হিস্সা দু’জন মেয়ের হিস্সার সমান’, তখন একথা স্বাভাবিকভাবেই আসে যে, তাহলে একজন মেয়ের হিস্সা হবে একজন ছেলের হিস্সার অর্থেক। আর এ কথাটাই আল্লাহ বলেছেন: وَإِنْ كَانَتْ وَاحِدَةً فَلَهَا النِّصْفُ ‘‘মেয়ে একজন হলে সে পাবে অর্ধেক” এই বলে। যুক্তি অন্তত তাই বলে।
ঙ. যদি মেয়ের সংখ্যা দু’জনের অধিক হয়, তাহলে তারা দু’তৃতীয়াংশ পায় বলে কুরআনে যে কথা বলা হয়েছে সে কথার সাথে এ কথাও যুক্তভাবে বলা আছে যে, পিতামাতার পত্যেকে এক ষষ্টাংশ করে পাবেন। আল্লাহ বলেন:
فَإِنْ كُنَّ نِسَاءً فَوْقَ اثْنَتَيْنِ فَلَهُنَّ ثُلُثَا مَا تَرَكَ وَإِنْ كَانَتْ وَاحِدَةً فَلَهَا النِّصْفُ وَلِأَبَوَيْهِ لِكُلِّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا السُّدُسُ مِمَّا تَرَكَ إِنْ كَانَ لَهُ وَلَدٌ “সুতরাং যদি তারা দু’এর অধিক কন্যা সন্তান হয়, তবে তারা দু’তৃতীয়াংশ পাবে সে যা কিছু ছেড়ে যাবে, তা থেকে। আর যদি একজন হয়, তবে সে পাবে অর্ধেক এবং তার পিতামাতার প্রত্যেকে এক ষষ্টাংশ করে পাবেন যদি তার কোন সন্তান থাকে।” (সূরা নিসা-১১)। এখানে লক্ষ্য করুন- ‘পিতামাতার প্রত্যেকে এক ষষ্টাংশ করে পাবেন’ এ কথাটির আগে সংযুক্ত পদ বা ‘হরফে আত্ফ’ ব্যবহার করা হয়েছে। এর মাধ্যমে আগের নির্দেশের ধারাবাহিকতা বুঝা যায়। অর্থাৎ মেয়েদের হিস্সার সাথে পিতামাতার হিস্সা সংযুক্ত। এখন দু’জনের অধিক মেয়ে যদি দু’তৃতীয়াংশ পায় আর বাকী এক তৃতীয়াংশ পিতামাতা পান তাহলে ২/৩ + ১/৩ = ১ সূত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এখন যদি দু’জনের অধিক মেয়ের স্থলে এক বা একাধিক ছেলে থাকে, তাহলে তারা কতটুকু পায়? উত্তর হল তখন এক বা একাধিক ছেলে পাবে দু’তৃতীয়াংশ আর এক তৃতীয়াংশ পাবেন পিতামাতা। তাহলে কি দাড়াল? পিতামাতার হিস্সা সর্বাবস্থায় এক তৃতীয়াংশ আর বাকী দু’তৃতীয়াংশ এক বা একাধিক ছেলে থাকলে সে পাবে অথবা একাধিক মেয়ে থাকলে তারা লাভ করবে।
চ. হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. বলেন: اَلْمِيْرَاثُ لِلْوَلَدِ فَاِنْتَزَعَ اللهُ تَعَالَي مِنْهُ لِلزَّوْجِ وَالْوَالِدِ ‘সম্পদ মূলে সন্তানের জন্য ছিল। আল্লাহ সেখান থেকে পিতামাতা ও স্বামী-স্ত্রীকে ছিনিয়ে নিয়ে হিস্সা দিয়েছেন।’ (মুছান্নাফু আব্দির রাজ্জাক) ১৩। তার এ বক্তব্য ‘সম্পদে সন্তানের হক বেশী’ এ দাবীকে সত্যায়িত করে। আয়াতের প্রথম অংশে আল্লাহ তা’আলা সন্তানদের ব্যাপারে মৌলিক নীতিমালা জারী করেছেন। আর পরবর্তী অংশে উদাহরণ দিয়েছেন। তিনি বললেন সম্পদ বন্টণে একজন পুরুষ সন্তানের হিস্সা দু’জন নারী সন্তানের সমান। এ কথা থেকে জানা গেল যে, ছেলেমেয়ে দু’রকম সন্তান যদি একসাথে থাকেন, তাহলে একজন ছেলে দু’জন মেয়ের সমান হিস্সা পাবে। কিন্তু যদি কোন মেয়ে না থাকে শুধু ছেলে থাকে তাহলে সেই ছেলের হিস্সা কত, তা বলেন নি। প্রচ্ছন্নভাবে এটা ধারণা করা যায় যে, ছেলে তো সম্পূর্ণ সম্পদ পাবে। কিন্তু নিছক ধারণার ভিত্তিতে কোন কিছু প্রমাণ করা যায় না। কেউ কেউ বলেন শুধুমাত্র একজন ছেলে হলে তার হিস্সা কত তা প্রমাণীত হয় একজন মেয়ের হিস্সা দেখে। একমাত্র সন্তান যদি একজন মেয়ে হয় তাহলে তার হিস্সা হল মোট সম্পদের অর্ধেক। সুতরাং একমাত্র সন্তান যদি একজন ছেলে হয় তাহলে তার হিস্সা হবে মোট সম্পদের অর্ধেকের দ্বিগুণ অর্থাৎ সম্পূর্ণ সম্পদ। কারণ আল্লাহ বলেছেন ‘একজন পুরুষ দু’জন নারীর সমান হিস্সা পাবে’। এখানে মিশ্রিত অবস্থা ছাড়া বিচ্ছিন্ন অবস্থায় শুধু মেয়ের অবস্থা দিয়ে শুধু ছেলের অবস্থা প্রমাণ করা হল। সুতরাং যুক্তি অনুসারে এদাবীটা এ সাথে প্রমাণীত হয়ে যায় যে, মিশ্রিত অবস্থা ছাড়া একমাত্র সন্তান একজন ছেলে যদি সম্পূর্ণ সম্পদ পেতে পারে, তাহলে মিশ্রিত অবস্থা ছাড়া একমাত্র সন্তান দু’জন মেয়েও সম্পূর্ণ সম্পদ পাবে। আমরা আয়াতে করীমার প্রথম অংশ দিয়ে প্রমাণ করলাম যে, একমাত্র সন্তান দু’জন মেয়ে হলে তারা সম্পূর্ণ সম্পদের হকদার। এবারে আসুন আলোচনা করি যে, অন্য যবীল ফুরূজ থাকলে একমাত্র সন্তান ছেলে কতটুকু পায়। এর উত্তর হাদীছ শরীফ থেকে জানা যায়। বর্ণিত আছে: عَنْ اِبْنِ عَبَّاسٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَلْحِقُوا الْفَرَائِضَ بِأَهْلِهَا فَمَا بَقِيَ فَهُوَ لأَوْلَى رَجُلٍ ذَكَرٍ ‘হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ছা. বলেছেন: সম্পদ হকদারদেরকে দিয়ে দাও। পরে যা অবশিষ্ট থাকবে তা সর্বাধিক হকদার পুরুষ লোক পাবে।’ (বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী) ১৪। এ হাদীছ থেকে জানা গেল যে, অন্যান্য যবীল ফুরূজ নিজেদের হিস্সা নেয়ার পরে যা কিছু অবশিষ্ট থাকবে তা পাবে মৃতের একমাত্র ছেলে। কারণ সর্বোৎকৃষ্ট পুরুষ লোক ছেলে ছাড়া অন্য কেউ নয়। এ ব্যাখ্যা থেকে একথাও প্রমাণীত হল যে, মেয়ে যদি দু’জন হয়, তাহলে তারা একজন ছেলের সমান হিস্সা পাবে আর যদি মেয়ে একজন হয়, তাহলে সে একজন ছেলের অর্ধেক হিস্সা পাবে। এ হিসাব ছেলে মেয়ে মিলিতভাবে থাকলে যেমন সত্য. বিচ্ছিন্নভাবে শুধু ছেলে কিংবা শুধু মেয়ে থাকলেও সেরকম সত্য, কোন ব্যত্যয় হবে না।
কিন্তু পরবর্তীতে আয়াতের অপর অংশে আল্লাহ তা’আলা বলেন: فَإِنْ كُنَّ نِسَاءً فَوْقَ اثْنَتَيْنِ فَلَهُنَّ ثُلُثَا مَا تَرَكَ وَإِنْ كَانَتْ وَاحِدَةً فَلَهَا النِّصْفُ وَلِأَبَوَيْهِ لِكُلِّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا السُّدُسُ مِمَّا تَرَكَ إِنْ كَانَ لَهُ وَلَدٌ “সুতরাং যদি তারা দু’এর অধিক কন্যা সন্তান হয়, তবে তারা দু’তৃতীয়াংশ পাবে সে যা কিছু ছেড়ে যাবে, তা থেকে। আর যদি একজন হয়, তবে সে পাবে অর্ধেক এবং তার পিতামাতার প্রত্যেকে এক ষষ্টাংশ করে পাবেন যদি তার কোন সন্তান থাকে।” (সূরা আল বাকারা-১১)। আয়াতের এ অংশ প্রথমাংশের সাথে বেমানান ও সাংঘর্ষিক মনে হয়। ব্যাখ্যার মাধ্যমে আয়াতের দু অংশের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করতে হবে, নতুবা এ সমস্যার সমাধান হবে না। মেয়েরা মাওলা হতে পারে কি না; মেয়েদের জন্য নির্ধারিত হিস্সা বর্ণণা করা হয়েছে কি না ও আওল কেন হয়- এ সকল প্রশ্নের উত্তর এখানেই নিহিত। আয়াতের প্রতি একটু গভীরভাবে লক্ষ্য করুন। আল্লাহ কি বলেছেন যে, ছেলে ও মেয়েরা মিশ্রিতভাবে থাকলে একজন ছেলে দু’জন মেয়ের সমান হিস্সা পাবে? বলেন নি। মিশ্রিতভাবে থাকার শর্ত মানুষ আরোপ করেছে, আল্লাহ নন। আর এ কারণে আওলের জন্ম হয়েছে। এবং আল্লাহ তা’আলা বলেন: وَإِنْ كَانَتْ وَاحِدَةً فَلَهَا النِّصْفُ ‘‘মেয়ে একজন হলে সে পাবে অর্ধেক।” কিসের অর্ধেক? মোট সম্পদের অর্ধেক ! অবশিষ্ট সম্পদের অর্ধেক! না একজন ছেলের হিস্সার অর্ধেক! এটা কি আল্লাহ পরিষ্কার করে বলেছেন? বলেন নি। আমরা যদি এ প্রশ্ন গুলোর উত্তর এ ভাবে সাজাই যে, ছেলে মেয়ে মিশ্রিতভাবে থাকুক আর না থাকুক সর্বাবস্থায় একজন ছেলে দু’জন মেয়ের সমান হিস্সা পাবে। বিপরীতপক্ষে একজন মেয়ে হলে সে সর্বাবস্থায় একজন ছেলের হিস্সার অর্ধেক পাবে; তাহলে আয়াতের দু’অংশের মধ্যে সামঞ্জস্য হয়ে যায়। আর ‘ইশারাতুন্ নাছ’ ও তাই বলে। একজন ছেলে যদি দু’জন মেয়ের সমান হিস্সা পায়, তাহলে একজন মেয়ে পাবে একজন ছেলের হিস্সার অর্ধেক। অন্যকথায় : وَإِنْ كَانَتْ وَاحِدَةً فَلَهَا نِصْفُ حَظِّ الذَّكَرِ - ছেলেমেয়েদের মধ্যে যদি একজন মাত্র মেয়ে হয়, তাহলে সে পাবে- একজন ছেলে থাকলে সে যতটুকু পেত তার অর্ধেক। ছেলে মোট সম্পদ পাবার হলে সে পাবে মোট সম্পদের অর্ধেক; ছেলে অবশিষ্ট সম্পদ পাবার হলে সে পাবে সেই অবশিষ্ট সম্পদের অর্ধেক। আর যদি মেয়ে দু’জন হয়, তাহলে তারা পাবে একজন ছেলে থাকলে যতটুকু পেত তার সমান হিস্সা। এ ব্যাখ্যা গ্রহন করলে কন্যাদেরকে মাওলাও গণ্য করা হয়ে যায়, আওল এড়ানোও সম্ভব হয় এবং সূরা নিসার ৭, ১১ ও ৩৩ নং আয়াতের মধ্যকার বিরোধও তিরোহিত হয়। তাছাড়া উপরে উল্লেখিত হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাসের বর্ণিত হাদীছ খানার ব্যাখ্যাও বোধগম্য হয়। উপরোক্ত ব্যাখ্যার ভিত্তিতে একজন মেয়ের ক্ষেত্রে কোন জটিলতা দেখা দেয় না। কিন্তু মেয়েদের সংখ্যা যদি একাধিক হয় এবং কোন ছেলে না থাকে, তাহলে মেয়েরা কতটুকু পাবে, তা নিয়ে বাহ্যিকভাবে একটু জটিলতা দেখা দেয়। আয়াতে করীমার অপর অংশে আল্লাহ তা’আলা বলছেন: ‘‘যদি তারা দু’এর অধিক কন্যা সন্তান হয়, তবে তারা দু’তৃতীয়াংশ পাবে মৃত লোক যা কিছু ছেড়ে যাবে, তা থেকে।” এর অর্থ কি এবং এখানে দু’জন মেয়ে হলে কতটুকু পাবে তা বলা হল নাইবা কেন, এ প্রশ্ন থেকে যায়। এর উত্তর হল- আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন এখানে গাণিতিক বিশ্লেষণে বিধান জারী করছেন। তিনি যখন বললেন- يُوصِيْكُمُ اللهُ فِيْ أَوْلَادِكُمْ لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الْأُنْثَيَيْنِ “তোমাদের সন্তানদের ব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশনা হল- একজন পুরুষ দু’জন নারীর সমান হিস্সা পাবে।” সেখানে তো তিনি দু’জন কন্যা সন্তানের অবস্থা বলেই দিলেন। আর একজন কন্যা হলে কতটুকু পাবে তা বলে দিলেন- وَإِنْ كَانَتْ وَاحِدَةً فَلَهَا النِّصْفُ “আর যদি একজন হয়, তবে সে অর্ধেক পাবে”- এ কথা বলে। দু’য়ের অধিক কন্যা সন্তানের জন্য দু’তৃতীংাংশ বলে যে কথা বলা হয়েছে সে কথার সাথে এও বলা হয়েছে যে, পিতামাতার জন্য এক ষষ্টাংশ করে বাকী এক তৃতীয়াংশ নির্ধারিত থাকবে। মধ্যখানে শুধু বলা হয়েছে- ‘‘আর যদি একজন হয়, তবে সে অর্ধেক পাবে।” আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন এ পদ্ধতিতে অন্যান্য স্থানেও নির্দেশনা দিয়েছেন। যেমন সূরা নিসার ১৭৬ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন:
يَسْتَفْتُونَكَ قُلِ اللَّهُ يُفْتِيكُمْ فِي الْكَلَالَةِ إِنِ امْرُؤٌ هَلَكَ لَيْسَ لَهُ وَلَدٌ وَلَهُ أُخْتٌ فَلَهَا نِصْفُ مَا تَرَكَ وَهُوَ يَرِثُهَا إِنْ لَمْ يَكُنْ لَهَا وَلَدٌ فَإِنْ كَانَتَا اثْنَتَيْنِ فَلَهُمَا الثُّلُثَانِ مِمَّا تَرَكَ وَإِنْ كَانُوا إِخْوَةً رِجَالًا وَنِسَاءً فَلِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الْأُنْثَيَيْنِ “হে নবী, তোমার কাছে তারা ফতোয়া জিজ্ঞাসা করে। তুমি বলে দাও যে, আল্ল¬াহ ‘কালালার’ ব্যাপারে ফতোয়া দিচ্ছেন: যদি কোন নি:সন্তান লোক মারা যায় আর তার একজন বোন থাকে, তবে সে বোন মৃত ব্যক্তি যা কিছু ছেড়ে যাবে তার অর্ধেক পাবে। - এবং সে ব্যাক্তিও তার মৃত বোনের উত্তরাধিকারী হবে তবে শর্ত হল সে (মৃত বোন) নি:সন্তান হতে হবে,- সুতরাং তারা (বোন) যদি সংখ্যায় দু’জন হয়, তবে তারা দু’তৃতীয়াংশ পাবে মৃত ব্যক্তি যা কিছু ছেড়ে যাবে, তা থেকে। আর যদি তারা (উত্তরাধিকারীগণ) পুরুষ ও নারী মিলে কয়েকজন ভাইবোন হয়, তবে একজন পুরুষ দু’জন নারীর সমান হিস্সা পাবে।” এখানে লক্ষ্য করুন- বোনদের কথার মধ্যখানে আল্লাহ বলছেন - এবং সে ব্যাক্তিও তার মৃত বোনের উত্তরাধিকারী হবে তবে শর্ত হল সে (মৃত বোন) নি:সন্তান হতে হবে,- একথা বলার পরে আবার বোনদের কথা বলে যাচ্ছেন। এটা আল্লাহ জাল্লা শানুহুর একটি বর্ণণা পদ্ধতি। কম কথায় বেশী মর্ম বুঝাতে এ পদ্ধতি খুবই কার্যকর। কিন্তু বাহ্যিকভাবে দেখলে বুঝা যায় যে, কন্যা একজন হলে অর্ধেক ও দু’এর অধিক হলে দু’তৃতীয়াংশ তাদের প্রাপ্য। এই মধ্যখানে বলা বাক্যটিকে আরবীতে ‘বিচ্ছিন্ন বাক্য’ বা اَلْجُمْلَةُ الْمُعْتَرِضَةُ বলা হয়।
প্রকৃতপক্ষে لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الْأُنْثَيَيْنِ - এ আয়াতাংশে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন গাণিতিক হিসাব পদ্ধতি ‘সমীকরণের’ দিকে ইংগিত দিয়েছেন। সমীকরণ বা ‘বয়ঁধঃরড়হ’ এর মাধ্যমে আমরা যেমন করে বীজগণিতের অংক মিলাই, আল্লাহ ঠিক সে পদ্ধতিতে এখানে হিসাব করতে ইংগিত করেছেন। যেমন নীচের ‘সমীকরণটির’ দিকে লক্ষ্য করুন:
১ জন ছেলে = ২ জন মেয়ে
অথবা ২ জন মেয়ে = ১ জন ছেলে
অথবা ১ জন মেয়ে = ১/২ জন ছেলে।
উহাকে আবার ভিন্নভাবেও ব্যাখ্যা করা যায়। যেমন মনে করি- ছেলে = ধ আর মেয়ে = ন। এখন ‘একজন ছেলের হিস্সা দুই জন মেয়ের সমান’ অথবা ‘একজন ছেলে পাবে দুইজন মেয়ের সমান হিস্সা’- এ কথাটিকে গাণিতিক ভাষায় ব্যাখ্যা করলে নীচে লিখিত সমীকরণটি সৃষ্টি হবে। আজ থেকে দেড় হাজার বছর পূর্বে আল্লাহ তা’আলা সমীকরণের সূত্রে ইলমুল ফারাইজের হিসাব করেছেন, একথা ভাবলে আল্লাহর প্রতি ঈমানের মাত্রা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী। এবার সমীকরণটি দেখুন:
a = ২ b
অথবা ২ b = a
অথবা b = ১/২ a
অতএব একজন মেয়ে = ১/২ জন ছেলে (ab এবং ab এর মান বসিয়ে)।
তথ্যসূত্র
১. বুখারী-৬৩৫২, বাবু মীরালি বানাত; মুসলিম- ৪২৯৬, বাবুল ওয়াছিয়্যাতি বিছ ছুলুছ; আবু দাউদ-২৮৬৬, বাবু মা জাআ ফী মালা ইয়াজুযু; ইবনু মাজাহ-২৭০৮, বাবুল ওয়াছিয়্যাতি বিছ ছুলুছ; তিরমিযী-২১১৬, আল ওয়াছিয়্যাতু বিছ ছুলুছ; নাসায়ি-৩৬৩২, পৃ-৫৫৩, ভ-৬; মুসনাদু আহমাদ-১৪৪০, পৃ-৫০, ভ-৩; মুয়াত্তা মালিক-২৮২৪, আল ওয়াছিয়্যাতু ফিছ ছুলুছ।
২. মুসলিম-৪২২৫, বাবু ইয়াহইয়া বিন ইয়াহইয়া; বুখারী-৬৩৮৩, বাবু লা ইয়ারিছুল মুসলিমু; তিরমিযী-২৭১১, ইবতালুল মীরাছি বইনাল মুসলিম; আবু দাউদ-২৯১১, বাবু হাল ইয়ারিছুল মুসলিমুল কাফির; ইবনু মাজাহ-২৭২৯, বাবু মীরাছি আহলিল ইসলামমুসলিম-৪২২৫, বাবু ইয়াহইয়া বিন ইয়াহইয়া; বুখারী-৬৩৮৩, বাবু লা ইয়ারিছুল মুসলিমু; তিরমিযী-২৭১১, ইবতালুল মীরাছি বইনাল মুসলিম; আবু দাউদ-২৯১১, বাবু হাল ইয়ারিছুল মুসলিমুল কাফির; ইবনু মাজাহ-২৭২৯, বাবু মীরাছি আহলিল ইসলাম।
৩. বুখারী-৬৩৫০, বাবু কাওলিন নাবী ছা. ওমান তারাকা; মুসলিম-৪২৪৬, বাবু মান তারাকা মালান; নাসায়ী-১৯৬১, পৃ-৩৬৭, ভ-৪; আবু দাউদ-২৯৫৮, বাবুন ফী আরযাকিয যুররিয়্যাহ; ইবনু মাজাহ-২৪১৬, বাবু মান তারাকা দাইনান; মুসনাদু আহমাদ-১৭২০৪, পৃ-৪৩৫, ভ-২৮; ইবনু হিব্বান-৩০৬৪, বাবুল মারীজ ওয়ামা ইয়াতাআল্লাকু বিহি।
৪. বুখারী-৬৩৫২, বাবু মীরালি বানাত; মুসলিম- ৪২৯৬, বাবুল ওয়াছিয়্যাতি বিছ ছুলুছ; আবু দাউদ-২৮৬৬, বাবু মা জাআ ফী মালা ইয়াজুযু; ইবনু মাজাহ-২৭০৮, বাবুল ওয়াছিয়্যাতি বিছ ছুলুছ; তিরমিযী-২১১৬, আল ওয়াছিয়্যাতু বিছ ছুলুছ; নাসায়ি-৩৬৩২, পৃ-৫৫৩, ভ-৬; মুসনাদু আহমাদ-১৪৪০, পৃ-৫০, ভ-৩; মুয়াত্তা মালিক-২৮২৪, আল ওয়াছিয়্যাতু ফিছ ছুলুছ।
৫. মুসলিম-৪২২৮, বাবু আলহিকুল ফারাইজা বিআহলিহা; মুসনাদু আহমাদ-২৮৬০, পৃ-৫৩, ভ-৫; ইবনু মাজাহ-২৭৪০, বাবু মীরাছিল আছাবা; তাবারাণী আল মু’জামুল কাবীর-১০৯০২, আহাদীছু আব্দিল্লাহ বিন আব্বাস; মুছান্নাফু আব্দির রাজ্জাক-১৯০০৪, কিতাবুল ফারাইজ।
৬. বায়হাকী কুবরা-১২৮৩৬, বাবুল আওল ফিল ফারাইজ; জামেউল আহাদীছ-২৯৯৫০, মুসনাদু উমার বিন খাত্তব, পৃ-২৭, ভ-২২৫।
৭. বুখারী-৬৩৫৫, কিতাবুল ফারাইজ বাবু মীরাছী ইবনাতি ইবনিন মাআ ইবনাতিন; তিরমিযী- ২০৯৩ কিতাবুল ফারাইজ, বাবু মীরাছী ইবনাতিল ইবনি মাআ ইবনাতিছ ছুলব; আবু দাউদ- ২৮৯২, বাবু মা জাআ ফী মীরাছিছ ছুলব; ইবনু মাজাহ- ২৭২১, কিতাবুল ফারাইজ; আল মুসতাদরাক-৭৯৫৮, কিতাবুল ফারাইজ; মুসনাদু আহমাদ-৩৬৯১, পৃ-২১৮, ভ-৬।
৮. বুখারী- ৬৩৫১, বাবু মীরাছিল ওয়ালাদ মিন আবীহি; মুসলিম-৪২২৬, বাবু আলহিকুল ফারাইজা বিআহলিহা; তিরমিযী-২০৯৮, বাবুন ফী মীরাছিল আছাবা।
৯. মুসলিম-৪২৩৭, বাবু আখিরু আয়াতিন উনযিলাত; বুখারী-৪৩৭৭, কিতাবুত তাফসীর।
১০. বুখারী-৬৩৫১, বাবু মীরাছিল ওয়ালাদ মিন আবীহি; মুসলিম-৪২২৬, বাবু আলহিকুল ফারাইজা বিআহলিহা; তিরমিযী-২০৯৮, বাবুন ফী মীরাছিল আছাবা।
১১. ইবনু আবী শাইবা-৩১৭৪৩, ফী রাজুলিন তারাকা ইবনাতাইহি ও বনী ইবনিহি।
১২. আল মুসতাদরাক-৭৯৭৯, কিতাবুল ফারাইজ; বায়হাকী কুবরা-১২৭০৬, বাবুল আখাওয়াত মাআল বানাত আছাবা; মুছান্নাফু আব্দির রায্যাক-১৯০২৩, কিতাবুল ফারাইজ।
১৩. মুছান্নাফু আব্দির রাজ্জাক- ১৯০৩০, কিতাবুল ফারাইজ।
১৪. বুখারী- ৬৩৫১, বাবু মীরাছিল ওয়ালাদ মিন আবীহি; মুসলিম- ৪২২৬, বাবু আলহিকুল ফারাইজা বিআহলিহা; তিরমিযী-২০৯৮, বাবুন ফী মীরাছিল আছাবা।
বিষয়: বিবিধ
১৬৮০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন