ব্যবসা ও সুদের পার্থক্য

লিখেছেন লিখেছেন সৈয়দ জিল্লুর রহমান ১৫ অক্টোবর, ২০১৩, ১১:২২:১৫ রাত



ব্যবসা ও সুদের সংজ্ঞা: ব্যবসা ও সুদের পরিচয় জেনে নেয়া ইসলামী ব্যাংকিং সম্পর্কে ধারণা লাভের পূর্বশর্ত। এ দু'টি বিষয়ের জ্ঞান না থাকলে ইসলামী ব্যাংকিং সম্পর্কে কিছুই জানা যাবে না। আল্লাহ বলেন: وَأَحَلَّ اللهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا "আর আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন আর সুদকে করেছেন হারাম।" (সূরা আল বাকারা- ১৭৫)। ব্যবসা হল দু'টি পণ্য কিংবা সেবাকর্মের বিনিময়। যেমন মনে করুন 'টাকার বিনিময়ে খাদ্য' কিংবা 'কাজের বিনিময়ে খাদ্য' অথবা 'তেলের বিনিময়ে চাল'। এখানে 'টাকার বিনিময়ে খাদ্য' এবং 'তেলের বিনিময়ে চাল' হল দু'টি ভিন্ন পণ্যের বিনিময়ের উদাহরণ আর 'কাজের বিনিময়ে খাদ্য' হল সেবার বিনিময়ে পণ্যের উদাহরণ। কারণ টাকা, খাদ্য, তেল ও চাল হল ভিন্ন ভিন্ন পণ্য। আর কাজ হল সেবাকর্ম এবং খাদ্য হল পণ্য। এজন্য 'কাজের বিনিময়ে খাদ্য' হল সেবার বিপরীতে পণ্য বিনিময়ের উদাহরণ। আর সেবাকর্মের বিপরীতে সেবাকর্মও বিনিময় করা যায়। যেমন মনে করুন কোন লোক অপর একজন লোকের বাড়িতে ভাড়া থাকেন। তিনি ভাড়া নগদে পরিশোধ না করে যদি এর বিনিময়ে বাড়িওয়ালার সন্তানকে রোজ একঘণ্টা প্রাইভেট পড়ান, তবে তা জায়েয হবে। এ উদাহরণটি হল সেবাকর্মের বিনিময়ে সেবাকর্মের উদাহরণ। এখানে বাড়িভাড়া একটি সেবাকর্ম। আবার ছাত্রদেরকে প্রাইভেট পড়ানো আরেকটি সেবাকর্ম। এখানে এ উভয় সেবাকর্মের বিনিময়ে একটি ব্যবসা সংগঠিত হয়েছে। সুতরাং ব্যবসার উত্তম সংজ্ঞা হল: اَلْبَيْعُ هُوَ مُبَادَلَةُ الْمَالِ اَوِ الْخِدْمَةِ بِمَالٍ اَوْ خِدْمَةٍ آخَرَ نَقْدًا اَوْ اِلَي اَجَلٍ مُقَدَّرَةٍ عَلَي سَبِيْلِ التَّرَاضِىْ 'উভয় স্বত্তাধিকারীর সম্মতিতে নগদে অথবা নির্ধারিত মেয়াদের বাকীতে কোন পণ্য অথবা সেবাকর্মকে অপর ভিন্ন কোন পণ্য অথবা সেবাকর্মে বিনিময় করাকে ব্যবসা বলা হয়।'

সুদ হল 'অবৈধ বর্ধন'। সুদের সাথে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের উপরে বিশ্বাস এবং 'মূল পণ্যের সাথে অতিরিক্ত অংশের সংযোজন বা বর্ধন'- এ দু'টি বিষয়ের যোগসূত্র রয়েছে। সুতরাং সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক অবৈধ ঘোষিত কোন অতিরিক্ত পরিমাণ পণ্যকে সুদ বলা হয়। তাই যেখানে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের উপরে বিশ্বাস থাকবে না কিংবা যেখানে 'অতিরিক্ত পরিমাণ পণ্য' এর প্রসঙ্গ থাকবে না, সেখানে স্বভাবতই সুদের অস্তিত্বও থাকবে না। আমরা জানি ব্যবসার মাধ্যমে মুনাফা হয়। আর মুনাফার মাধ্যমে পুজি বৃদ্ধি পায়। হয় পণ্য মজুদের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে অথবা পুজির টাকার পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। এই যে ব্যবসার মাধ্যমে পুজি বৃদ্ধি পেল, তা কিন্তু সুদ নয়। কারণ ব্যবসাকে আল্লাহ হালাল ঘোষনা করেছেন। সুতরাং বুঝা গেল যে, 'সকল বৃদ্ধি' হারাম নয়, বরং 'একটি নির্দিষ্ট পন্থায় অর্জিত বৃদ্ধি' হারাম; যেটাকে সুদ নামে নামকরণ করা হয়েছে। এখন আমাদেরকে জানতে হবে সে নির্দিষ্ট পন্থাটি কি, যা হারাম করা হয়েছে। কুরআন মজীদে সুদের নিষেধাজ্ঞা আছে বটে কিন্তু সুদের কোন পরিচয় বা সংজ্ঞা দেয়া হয়নি। রাসূলুল্লাহ ছা. বলেন: اَلذَّهَبُ بِالذَّهَبِ وَالْفِضَّةُ بِالْفِضَّةِ وَالْبُرُّ بِالْبُرِّ وَالشَّعِيْرُ بِالشَّعِيْرِ وَالتَّمْرُ بِالتَّمْرِ وَالْمِلْحُ بِالْمِلْحِ مِثْلاً بِمِثْلٍ يَدًا بِيَدٍ فَمَنْ زَادَ أَوِ اسْتَزَادَ فَقَدْ أَرْبَى اَلآخِذُ وَالْمُعْطِىُ فِيْهِ سَوَاءٌ "স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ, রৌপ্যের বিনিময়ে রৌপ্য, গমের বিনিময়ে গম, যবের বিনিময়ে যব, খেজুরের বিনিময়ে খেজুর এবং লবনের বিনিময়ে লবন, পরিমাণে সমান, হাতে হাতে বিনিময় কর। যে অতিরিক্ত দিবে কিংবা চাইবে, সে সুদী লেনদেন করল। গ্রহীতা ও দাতা এ ক্ষেত্রে সমান।" (মুসলিম- ৪১৪৮, মুদ্রা বিনিময় এবং স্বর্ণের ব্যবসা সংক্রান্ত অধ্যায়)। এ হাদীছের মাধ্যমে জানা গেল যে, সমজাতীয় পণ্যের বিনিময় করার বেলায় মূল পরিমাণের অতিরিক্ত যা কিছু নেয়া হবে, সে অতিরিক্তটুকু হল সুদ। আরোও জানা গেল যে, বাকীতে বিনিময়ের মাধ্যমে অতিরিক্ত আরোপ করা হলে, সে অতিরিক্তটুকু 'সময়ের ভাড়া' বা ঋণের সুদ। অন্য হাদীছে এসেছে: جَاءَهُ صَاحِبُ نَخْلِهِ بِصَاعٍ مِنْ تَمْرٍ طَيِّبٍ وَكَانَ تَمْرُ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ هَذَا اللَّوْنَ فَقَالَ لَهُ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّى لَكَ هَذَا. قَالَ اِنْطَلَقْتُ بِصَاعَيْنِ فَاشْتَرَيْتُ بِهِ هَذَا الصَّاعَ فَإِنَّ سِعْرَ هَذَا فِى السُّوْقِ كَذَا وَسِعْرَ هَذَا كَذَا. فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَيْلَكَ أَرْبَيْتَ إِذَا أَرَدْتَ ذَلِكَ فَبِعْ تَمْرَكَ بِسِلْعَةٍ ثُمَّ اشْتَرِ بِسِلْعَتِكَ أَىَّ تَمْرٍ شِئْتَ "রাসূলুল্লাহ ছা. এর কিছু নিম্নমানের রং বিশিষ্ট খেজুরের বিপরীতে উত্তম মানের এক ছা খেজুর নিয়ে জনৈক ব্যক্তি আগমন করলে রাসূলুল্লাহ ছা. বললেন: 'এটা কোথায় পেলে ?' তখন তিনি জবাবে বললেন: 'আমি দু' ছা খেজুর নিয়ে গিয়েছিলাম। উহার বিনিময়ে এ খেজুর আমি খরীদ করেছি। কেননা বাজরে এ খেজুরের দাম এত এবং ঐ খেজুরের দাম এত।' তখন তিনি বললেন: 'তোমার ধ্বংস হোক! তুমি সুদী কারবার করলে। যখন তুমি এরকম ইচ্ছা করবে, তখন তুমি অর্থের বিনিময়ে তোমার খেজুর বিক্রী করে দিবে। অত:পর সে অর্থ দিয়ে তোমার ইচ্ছানুযায়ী খেজুর খরীদ করবে।" (মুসলিম- ৪১৭১, সমপরিমাণ খাদ্য বিনিময় সংক্রান্ত অধ্যায়)। এ হাদীছ দ্বারা জানা গেল যে, আরেক প্রকার সুদ রয়েছে। আর তা হল পণ্যের গুণগত মানের কারণে উন্নত মানের কম পরিমাণ পণ্যের বিনিময়ে মিম্নমানের অতিরিক্ত পরিমাণ পণ্য গ্রহণ করার সুদ। এ ক্ষেত্রে সে নিম্ন মানের পণ্যে গৃহীত অতিরিক্তটুকু 'পণ্যের মুনাফা' বা পণ্যের সুদ। ইসলামী অর্থনীতিতে এ দু' ধরণের সুদকে যথাক্রমে 'রিবা নাসিয়া' এবং 'রিবা ফদল' নামে অভিহিত করা হয়।

মোটকথা বাকীতে কিংবা নগদে সমজাতীয় পণ্য বিনিময়ের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত যা কিছু গ্রহণ করা হয়, মূল পণ্যের অতিরিক্ত সে পরিমাণ পণ্যটুকুকে ইসলামী শরীয়ায় সুদ বলা হয়।

বিষয়: বিবিধ

১১১২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File