'তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (সংশোধন) আইন, ২০১৩' এর আমূল সংশোধন চাই
লিখেছেন লিখেছেন পাথরের প্রতিবাদ ২০ অক্টোবর, ২০১৩, ১০:৫৪:১৮ রাত
লিবারেল ডেমোক্রেসি পুঁজিতান্ত্রিক মতাদর্শের রাজনৈতিক হাতিয়ার হলেও এখানে চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার একটা জায়গা রাখা হয়েছে, কেননা লিবারেলিজম মানুষের ব্যক্তিগত বিকাশের জন্য নিজস্ব চিন্তা ও তৎপরতার স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে। লিবারেলিজমের এই প্রত্যয় ও ধারণার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের সংবিধানও-চিন্তা, মতপ্রকাশ ও বাক স্বাধীনতার স্বীকৃতি এবং সুরক্ষাকে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে গণ্য করে। কিন্তু বাংলাদেশের শাসক গোষ্ঠী বর্তমানে এই লিবারেলিজমের বয়ানও আর অনুসরণ করতে রাজি নয়। বাক স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার লিবারেল স্পেসও ক্রমান্বয়ে কমে আসছে। গণমাধ্যমে প্রকাশ্য এবং অপ্রকাশ্য নিয়ন্ত্রণ আরোপের প্রচেষ্টার পাশাপাশি রাষ্ট্রযন্ত্র এখন ফেসবুক, টুইটারের মতো সোশ্যাল মিডিয়ার এক্টিভিজমও সরাসরি রাষ্ট্রীয় ও আইনি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে চায়! সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণের নামে সোশ্যাল মিডিয়াকে কেন্দ্র করে দানা বেঁধে ওঠা যে কোন সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের উদ্ভব ঠেকিয়ে দেয়াই এই নিয়ন্ত্রণের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য।
সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতে পারে 'তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (সংশোধন) আইন, ২০১৩। তবে এই আইনের মাধ্যমে নাগরিক অধিকার হরণের দায়ভার বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারেরও। ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারই এই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন প্রণয়ন করে। বর্তমান সরকার মূল আইনকে ঠিক রেখে এই আইনের অধীনে বিবেচিত অপরাধকে জামিন অযোগ্য করে, পুলিশকে বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতারের অবাধ ক্ষমতা দিয়ে আর শাস্তির মেয়াদ বৃদ্ধি করে এই আইনটিকে আরও ভয়াবহ এবং নিপীড়নমূলক করে তুলেছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের নির্যাতন-নিপীড়ন ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী নানান চুক্তি ও প্রকল্পের বিরুদ্ধে যেন জনগণের মাঝে কোন প্রতিবাদী মনোভাব জাগ্রত না হয় সেজন্য প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়াকেও নিয়ন্ত্রণে আনার তাগিদ অনুভূত হতে থাকে শাসক গোষ্ঠীর মাঝে। সোশ্যাল মিডিয়ার ভার্চুয়াল প্রতিবাদও সম্ভবত শাসকগোষ্ঠীর কাছে এখন অসহনীয় ঠেকছে। তিউনিসিয়া, মিসরসহ মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে সোশ্যাল মিডিয়া কেন্দ্রিক গণআন্দোলনের দিকটি মাথায় রাখলে এই মিডিয়া নিয়ে অস্বস্তিতে ভোগার মতো যথেষ্ট কারণ রয়েছে। তবে বাংলাদেশের ভার্চুয়াল আন্দোলন সর্বদা ভার্চুয়ালই রয়ে গেছে, এটা কখনোই খুব একটা মাঠে গড়ায়নি। তাহলে শাসক গোষ্ঠীর এতো সোশ্যাল মিডিয়া ফোবিয়ার কারণ কি? তবে একটা বিষয় পরিষ্কার, বিগত বছরগুলোতে দেখা গেল মূল ধারার অনেক মিডিয়া যখন নানান কারণে রাষ্ট্রীয় জুলুম- নির্যাতনের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত গণমুখী ভূমিকা পালনে শৈথিল্য প্রদর্শন করেছে তখনও সোশ্যাল মিডিয়ায় সচেতন তরুণ সমাজ ছিল সোচ্চার, দেশবিরোধী ও জাতীয় স্বার্থ পরিপন্থী নানান কর্মকা-ের তির্যক সমালোচনা করতে তারা কখনো কুণ্ঠিত বোধ করে নাই। সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা সচেতন বুদ্ধিদীপ্ত তরুণ জাগরণের উপস্থিতি আমরা দেখতে পাই যারা নানান ইস্যুতে যুক্তি, তথ্য-উপাত্তসহ তাদের মতামত ব্যক্ত করছে এবং এর ফলে রাষ্ট্রযন্ত্রের নির্যাতন-নিপীড়ন ও জাতীয় স্বার্থ পরিপন্থী কর্মকা-ের পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে প্রচলিত রাজনৈতিক কাঠামোর বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়া একটা পটেনশিয়াল প্লাটফর্ম হিসেবে কাজ করছে। জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে মার্কিন স্বার্থে টিকফা চুক্তি স্বাক্ষর, বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী পণ্যের ওপর পেটেন্ট আগ্রাসন, সুন্দরবন বিধ্বংসী রামপাল তাপ বিদ্যুৎ প্রকল্প, দেশের তেল-গ্যাসের ওপর বহুজাতিক কোম্পানির মালিকানা নিরঙ্কুশ করে স্বাক্ষরিত পিএসসি মডেল-২০০৯/২০১২ অনুমোদন, সীমান্তে ভারতীয় হানাদার বিএসএফ কর্তৃক নির্বিচার বাংলাদেশের নাগরিক হত্যাযজ্ঞ, ক্রসফায়ারসহ নানান মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়ার ভার্চুয়াল প্রতিবাদ লক্ষ্য করা গেছে। অনেকের মতে, এই ভার্চুয়াল আন্দোলন যেন কোন ক্রমেই সামাজিক আন্দোলনে রূপ না নেয় তার জন্যই এই কঠোর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের প্রণয়ন।
'তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (সংশোধন) আইন, ২০১৩' জনগণের মৌলিক মানবাধিকার এবং বাক স্বাধীনতা হরণ করবে বলে অনেক আইন বিশেষজ্ঞ এবং মানবাধিকার কর্মী আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এর মাধ্যমে অনলাইনে বা ওয়েবসাইট বা ফেসবুকে বা ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যমে স্বাধীন মতপ্রকাশ এবং মুক্তবুদ্ধির চর্চা বাধাগ্রস্ত হবে কেননা মতামত প্রদানকারীকে সর্বদা তাড়া করে ফিরবে বিপজ্জনক ৫৭ ধারা যে ধারায় বলা হয়েছে, 'কোন ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোন ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়লে, দেখলে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ কাজে আগ্রহী হতে পারেন অথবা যার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি প্রদান করা হয়, তাহলে তার এই কাজ হবে একটি অপরাধ।' অর্থাৎ এই ধারায় সাইবার ক্রাইমকে এমনভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে যার ফলে যে কোন ব্যক্তির যে কোন অনলাইনভিত্তিক পোস্ট, মতামত, নোটকে অপরাধ হিসেবে অভিযুক্ত করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে পারবেন যে কেউই। এ প্রসঙ্গে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার তানজীব উল আলম বলেন, 'এই আইনে অপরাধ সংঘটনের যে বর্ণনা দেয়া আছে তাতে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। অর্থাৎ ৫৭ ধারায় এমনভাবে অপরাধ সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে যে ইন্টারনেটে যে কোন কর্মকা-কেই এই আইনের আওতায় অপরাধ হিসেবে গণ্য করার একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েই আছে। এরকম একটি আইনে এতদিন যে রক্ষাকবচ (সেফগার্ড) ছিল এই সরকারের আনীত সংশোধনীর ফলে সেটিও উঠে গেছে। অর্থাৎ এতদিন মামলা করতে হলে সরকারের অনুমতির প্রয়োজন হতো। এখন আর অনুমতির প্রয়োজন লাগবে না।'
এখানে বলা হয়েছে অনলাইনে কারও কোন মতামত বা স্ট্যাটাস যদি কেউ সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় পড়লে, দেখলে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন তাহলে তাও অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এটা অত্যন্ত দুর্বল আইনি সংজ্ঞায়ন এবং একই সঙ্গে চরম বিভ্রান্তিকর। ইন্টারনেট ব্যবহারকারী কী করে নিশ্চিত হবেন তার মতামত কেউ দেখলে, শুনলে কিংবা পড়লে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হবেন না? কিসের মাপকাঠিতে এর বিচার করা হবে? নীতিভ্রষ্টতা এবং অসৎ হওয়া এসবের সুনির্দিষ্টকরণের অভাব এই ধারার অপপ্রয়োগের সুযোগ তৈরি করবে। আর কেউ নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হলে নৈতিকভাবে তার নিজের দায়ও আছে, সেক্ষেত্রে তার বিচারও হবে কিনা? এছাড়া সংবাদপত্রের অনলাইনে বা ওয়েবসাইট বা ফেসবুকে বা ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যমে প্রকাশ বা সমপ্রচার করা কোন কিছু মিথ্যা বলে প্রমাণিত হলেও ৭-১৪ বছরের জেল হবে! কোন তথ্য মিথ্যা, অশ্লীল অথবা মানহানিকর হবে তা কীভাবে কে ঠিক করবে? দুনিয়াজুড়ে তথ্য নিয়ে নানান গ্রুপের সঙ্গে দ্বন্দ্ব সংঘাত হাঙ্গামা তো আছেই, এক পক্ষ নিজের তথ্য সত্য ধরে নিয়ে বাকিগুলোকে মিথ্যা বলবে আর বাকি সব পক্ষ মেনে নিবে? ধরেন, সিরিয়ায়কে রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করল এটা নিয়েই তো তাবৎ দুনিয়া দুই ভাগ হয়ে গেল। তাহলে কোনটা সত্য? অশ্লীল আর মানহানিকর প্রত্যয় তো আরও বিভ্রান্তিকর! রামপাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়েই তো দেশের বিশেষজ্ঞরা দুই ভাগ হয়ে গেল। এখন এই প্রকল্পের পক্ষের বিশেষজ্ঞদের তথ্য সত্য ধরে নিলে তো আইসিটি আইন অনুযায়ী বিপক্ষের সবার জেলে নিক্ষেপ করা উচিত! তাই এসব দিক বিবেচনায় এই আইনের নির্বিচার অপপ্রয়োগের সব সম্ভাবনা রয়েছে। সবচেয়ে বড় আশঙ্কা এর রাজনৈতিক অপব্যবহারের দিকটি যার মাধ্যমে সরকার তার বিরোধী রাজনৈতিক মতামত প্রদানকারী শক্তিশালী এবং প্রভাব বিস্তারকারী অনলাইন এক্টিভিস্টদের বিরুদ্ধে মামলা আরোপ করে বিরুদ্ধ মত দমনের কাজে একে হাতিয়ার হিসেবে প্রয়োগ করতে পারে। এই তো কিছুদিন আগেই এই আইনের ভিত্তিতে ফেসবুক এক্টিভিস্ট জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের শিক্ষক একেএম ওহেদুজ্জামানের বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলা দায়ের করা হয়, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে পুলিশ তাকে গ্রেফতারও করে। অনেকের মতে অনলাইনে বর্তমান সরকারের নানান কর্মকা-ের তুমুল সমালোচনা করায় তার বিরুদ্ধে এই মামলা দায়ের করা হয়েছে যদিও মামলা করার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পরিবারকে কটাক্ষ করে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। একই রকমভাবে আগামীতে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসলে আওয়ামী লীগের প্রতি সংবেদনশীল জনপ্রিয় অনলাইন যোদ্ধাদের বিরুদ্ধেও সরকার বিরোধিতার অপরাধে (!) এই আইনের ভিত্তিতে মামলা দায়ের হতে পারে। সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে এই প্রযুক্তিগত নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্য হচ্ছে সাইবার অপরাধ দমন। সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধ দরকার, কিন্তু এই আইনে এই অপরাধ প্রতিরোধের যে ধারা যুক্ত করা হয়েছে তা সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের স্বাভাবিক কর্মকা-েও ভীতির সৃষ্টি করবে এবং ফলে স্বাধীন মতামত প্রকাশের পরিবেশ বিঘি্নত হবে। এ প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার তানজীব বলেন, 'এই আইন আপনাকে ইন্টারনেটে বস্নগিং বা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিতে বারণ করছে না। কিন্তু যখন আপনি এ কাজগুলো করতে যাবেন তখনই আপনার মনে এক ধরনের ভীতি কাজ করবে। ওই ভীতি কাজ করা বা ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করাটাই তো বাক স্বাধীনতার পরিপন্থী। বাক স্বাধীনতার মত যেসব মৌলিক অধিকার আছে তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আমার মধ্যে কি ধরনের ভীতি কাজ করছে। আমি তো মনে করি এই আইনে এক ধরনের ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে আছে যা আমাদের বাক স্বাধীনতাকে খর্ব করছে।' এই আইনের ৫৭ ধারায় অপরাধের অস্পষ্টতা, সুনির্দিষ্টকরণের অভাব এবং হালকা অপরাধেও ভয়াবহ শাস্তির বিধান রাখা, সর্বোপরি বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতারের সুযোগ রাখা এবং এই অভিযোগে গ্রেফতারকৃত আসামির জামিন না পাওয়া এসব কিছু মিলিয়েই সাইবার ক্রাইম দমনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে নানান ইস্যুতে নাগরিকদের প্রতিবাদী ভার্চুয়াল ভূমিকা প্রতিরোধ করার আশঙ্কা আছে! ৫৭ ধারা অনুযায়ী সোশ্যাল মিডিয়ায় দেয়া রাষ্ট্রযন্ত্রের জুলুম নির্যাতন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে দেয়া স্ট্যাটাস বা নোট রাষ্ট্রযন্ত্রের কর্মকর্তারা দেখলে বা শুনলে ভাবতে পারেন এতে তাদের মানহানি ঘটতে পারে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটতে পারে কিংবা, রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রনায়কদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতে পারে। আবার সামাজিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে দেয়া স্ট্যাটাসকে সমাজপতিরা, জাতীয় স্বার্থবিরোধী রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দেয়া পোস্টকে রাজনৈতিক নেতারা তাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়া বা মানহানি ঘটার অভিযোগে পোস্টদাতার বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবে এবং বিনা ওয়ারেন্টে অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে জামিন না দিয়ে লঘু পাপে গুরুদ- দিতে পারবে! যদি তাই হয় তাহলে এই সমাজে আমরা যে পুরালিজমের কথা বলি, আমরা যে গণতান্ত্রিক মতপ্রকাশের অধিকারের কথা বলি তা মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হবে! এসব আমাদের আশঙ্কার কথা, আমরা চাই এই আশঙ্কা যেন ভুল প্রমাণিত হয়! তবে বাংলাদেশের সমাজ আর রাষ্ট্রে বিরুদ্ধ মত অবদমনের যে সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে তাতে এ ধরনের আশঙ্কাই বাস্তবে সত্য হয়ে থাকে!
'তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০১৩' এ এমনভাবে লঘু পাপে গুরু দ- দেয়ার বিধান রাখা হয়েছে যার ফলে অনলাইনভিত্তিক বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও মতামত প্রকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশ দ-বিধির ৫০০ ধারা অনুযায়ী প্রিন্টেড কোন কিছুর মাধ্যমে বা অন্য কোন উপায়ে কারও মানহানি করলে বা কুৎসা রটালে শাস্তি হবে সর্বোচ্ছ ২ বছরের জেল কিন্তু অনলাইনে কারও লেখায় যদি প্রমাণিত হয় মানহানি বা কুৎসা রটনা করা হয়েছে তাহলে তার শাস্তি হবে সর্বনিম্ন ৭ বছর এবং সর্বোচ্চ ১৪ বছরের জেল সঙ্গে ১ কোটি টাকার জরিমানা। বাংলাদেশ দ-বিধির ১৪৭ ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় কোন দাঙ্গা, সহিংসতা বা রায়টে যোগদান করলে শাস্তি হবে সর্বোচ্চ ২ বছরের জেল কিন্তু অনলাইনে কেউ যদি এমন কিছু প্রকাশ করে যার ফলে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে কিংবা ঘটানোর সম্ভাবনা সৃষ্টি হয় তাহলে তার শাস্তি হবে সর্বনিম্ন ৭ বছর এবং সর্বোচ্ছ ১৪ বছরের জেল সঙ্গে ১ কোটি টাকার জরিমানা। আপনি যদি অন্য কারও কম্পিউটারে তার অনুমতি ব্যতিরেকে প্রবেশ করেন বা অন্য কোন ব্যক্তিকে প্রবেশ করতে সহায়তা করেন তাহলে আপনার ৭ থেকে ১৪ বছরের জেল হতে পারে। ২০০৬ সালের আইনে নূ্যনতম সাজার বিষয়টি ছিল না, সর্বোচ্চ সাজার বিষয়টি (অনধিক ১০ বছর, এই শাস্তিও লঘু পাপে গুরু দ-) উল্লেখ ছিল। ফলে অপরাধের গুরুত্ব অনুযায়ী যে কোন ধরনের দ- প্রদানের ক্ষমতা আদালতের ছিল। ফেসবুকে দেয়া স্ট্যাটাসের ফলে কারও মানহানি হয়েছে প্রমাণিত হলে মানহানির পরিমাণ অনুযায়ী সেই পরিমাণ শাস্তি দেয়াই ন্যায়বিচারের দাবি। মানহানি কতটুকু হয়েছে সেটি তো আদালতের বিচার্য বিষয়। কিন্তু এই আইনে নূ্যনতম সাজা ৭ বছর উল্লেখ করে দিয়ে কোর্টের হাত-পা বেঁধে দেয়া হয়েছে। কারণ কাউকে যদি সাজা দিতে হয়, তাহলে তাকে ৭ বছর সাজা দিতে হবে। নূ্যনতম সাজার বিধান করে নাগরিকদের এক ধরনের অসহায় অবস্থার মধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছে।
এই আইনের অধীনে অপরাধগুলো অজামিনযোগ্য এবং আমলযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। ২০০৬ সালের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে মামলা করতে হলে মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতে হতো। কিন্তু ২০১৩ সালের আইনে অপরাধ আমলযোগ্য হওয়ায় আদালতের পরোয়ানা ছাড়াই আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে পুলিশ যে কাউকে গ্রেফতার করতে পারবে। গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়া যে কোন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা ও তার জামিনের অধিকার হরণ করা আমাদের সংবিধানের মৌলিক অধিকারের চেতনার পরিপন্থী, এটা মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং চরম অগণতান্ত্রিক। এই আইনে পুলিশকে যে অসীম ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তা পুলিশকে আরও বেপরোয়া করবে। পুলিশ চাইলে যে কাউকেই এই আইনে মামলা দিয়ে দীর্ঘকাল কারাগারে রাখতে পারবে।
চিন্তা, ভাব প্রকাশ, মতামত প্রকাশ এবং বাক স্বাধীনতা বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম মৌলিক কাঠামো। সংবিধানের ৩৯(১) এবং ৩৯(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে প্রত্যেক নাগরিকের চিন্তা, বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের নিশ্চয়তাদান করা হয়েছে। যেহেতু তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন বাক স্বাধীনতা খর্ব করছে সেহেতু আইনটি সংবিধান বিরোধী। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে এই আইনের ৫৭ ধারা সংবিধান বিরোধী। এই আইনের দ-বিধি সংবিধানের মূল চেতনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সংবিধানের তৃতীয় ভাগের ২৬(২) ধারায় বলা হয়েছে, 'রাষ্ট্র এই ভাগের কোন বিধানের সহিত অসামঞ্জস্য কোন আইন প্রণয়ন করিবেন না এবং অনুরূপ কোন আইন প্রণীত হইলে তাহা এই ভাগের কোন বিধানের সহিত যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে।' সংবিধানের এই ধারা অনুযায়ী ৩৯ ধারার বিধানের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন প্রণয়ন অসাংবিধানিক এবং এই আইনের ৫৭ ধারা বাতিলযোগ্য।
আমরা সাইবার ক্রাইম দমনে আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের পক্ষে এবং তা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার জন্য আবশ্যকও। আমরা অবশ্যই মনে করি অসৎ বা অশুভ উদ্দেশ্যে কম্পিউটারের তথ্য নষ্ট করা, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ অনুমোদন ছাড়া তথ্য পাচার করা, অন্যের কম্পিউটার ব্যবস্থায় অনধিকার প্রবেশ, অশ্লীল বা মানহানিকর তথ্য, ছবি প্রকাশ করা ইত্যাদি অপরাধ অবশ্যই বিচারযোগ্য। কিন্তু বিদ্যমান আইনে সাইবার অপরাধের অস্পষ্টতা, সুনির্দিষ্টকরণের অভাব এবং হালকা অপরাধেও ভয়াবহ শাস্তির বিধান রাখা, বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতারের সুযোগ রাখা এবং গ্রেফতারকৃত আসামির জামিন না পাওয়া এসব কিছুই আইনটিকে কালাকানুনে পরিণত করেছে বলে এই আইন দেশের নাগরিকদের মৌলিক নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ন করবে বলে অনেকেই মত দিয়েছেন। সাইবার অপরাধের সংজ্ঞা ও তার দ-বিধি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকারের সঙ্গে যেন কোনক্রমেই সাংঘর্ষিক না হয় সে দিকে দৃষ্টি রেখেই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন প্রণয়ন করা দরকার ছিল। আমরা এই নিবর্তনমূলক আইন বাতিল করে পাবলিকের সাংবিধানিক অধিকার সুরক্ষা করার দাবি জানাই। বিদ্যমান আইন থেকে বাক স্বাধীনতা হরণের ৫৭ ধারা বাতিল, ওয়ারেন্ট ছাড়া পুলিশের গ্রেফতার ক্ষমতা প্রত্যাহার, বিবেচিত অপরাধকে জামিনযোগ্য করা এবং অপরাধের শাস্তির পরিমাণ ন্যায়সঙ্গত করে নতুন দ-বিধি প্রণয়ন করে নতুন করে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন প্রণয়নের দাবি জানাই।
- See more at: http://www.thedailysangbad.com/index.php?ref=MjBfMTBfMjBfMTNfMl8yM18xXzE0NTAzOQ%3D%3D#sthash.nrHGSUfC.dpuf
যোবায়ের আল মাহমুদ
বিষয়: বিবিধ
১০৬৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন