ইসলাম তাত্ত্বিক এবং ব্যাবহারিকভাবেই পুঁজিবাদ বিরোধীঃ পলিটিক্যাল ইসলাম মাত্রই তাই অ্যান্টি ক্যাপিটালিস্টিক লাইন আপ
লিখেছেন লিখেছেন পাথরের প্রতিবাদ ১৯ অক্টোবর, ২০১৩, ১০:১১:৪০ রাত
আমাদের সমাজে অনেকেই মনে করেন পুঁজিবাদ বিরোধিতা সমাজতান্ত্রিক আদর্শ/কম্যুনিজম ছাড়া সম্ভব না। ইসলামের পুঁজিবাদ বিরোধিতার যে মতাদর্শিক বয়ান তা সম্পর্কে অনেকেই পরিচিত নন। পুঁজিবাদ বিরোধিতা মাত্রই সমাজতন্ত্রের বয়ান এই ধরণের একটা মিথ আমাদের মনে মগজে বদ্ধমূল করে দিয়েছে অনেক সেকুলার বামপন্থিরা। এমনকি তারা ধর্ম সম্পর্কে মার্কসের পর্যালোচনা তুলে ধরে বলেন ধর্ম হচ্ছে শোষণ জুলুম কিংবা নিপীড়নের হাতিয়ার ফলে পুঁজিবাদের শাসন-ত্রাসন উদ্ভূত বৈষম্য এবং নিপীড়নের বিরুদ্ধে ধর্ম তো কিছুই করবে না বরং তা পুঁজিবাদের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে। ধর্ম সম্পর্কে বিশেষ করে যখন ইসলাম প্রশ্ন চলে আসে তখন এই মার্ক্সবাদী সরলীকরণ কতটা যৌক্তিক তা পর্যালোচনার চেষ্টা থাকবে এই লেখায়।
ইসলাম তাত্ত্বিকভাবেই পুঁজিবাদ বিরোধী এবং তা মানুষের অর্থনৈতিক কার্যাবলীর ক্ষেত্রে পুঁজিবাদের বিপরীত অবস্থান নেয়।
পুঁজিবাদের সাথে ইসলামের মৌলিক দ্বন্দঃ
১। নিরঙ্কুশ ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারনা নাকচ করে আল্লাহ কেন্দ্রিক সামাজিক মালিকানার ধারনার প্রবর্তন
পুঁজিবাদ যেখানে সম্পত্তিতে নিরঙ্কুশ ব্যক্তিগত মালিকানার কথা বলে সেখানে ইসলামে মালিকানা প্রশ্নটি সমাধানে আল্লাহর নিরঙ্কুশ মালিকানা অন্যদিকে মানুষের সাময়িক মালিকানার কথা বলা হয়েছে যেখানে তত্ত্বাবধায়ক/আমানতদার হিসেবে ব্যক্তি মালিকানাকে স্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু ব্যক্তি মালিকানাকে স্বীকার করলেও অধিকাংশ সম্পদ সমাজের গুটি কয়েক মানুষের হাতে কুক্ষিগত হয়ে থাকাকে সে একেবারেই বরদাশত করে না। কেননা সকল সম্পদের একচ্ছত্র মালিক স্বয়ং আল্লাহ তা‘য়ালা। সাময়িকভাবে তাকদিরের কারণে কেউ সম্পদের মালিক হলেও সেখানে রয়েছে গরীবের অধিকার। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছেঃ
অর্থাৎ- তাদের সম্পদের মধ্যে নির্ধারিত অধিকার রয়েছে প্রার্থী ও গরীবের/বঞ্চিতের ।(সূরা মা‘য়ারিজ: ২৪-২৫)
“আর তাহাদের (ধনীদের) ধন-সম্পদে ভিক্ষুক ও দীনহীনদেরও অধিকার রয়েছে।” –সূরা আয্-যারিয়াত: ১৯
সম্পত্তিতে প্রার্থী ও গরীবের, ভিক্ষুক ও দীনহীনদের অধিকার রয়েছে বলে ইসলাম নিরঙ্কুশ ব্যক্তিমালিকানাকে নাকচ করে দিয়েছে বরং সামগ্রিকভাবে সম্পত্তির সামাজিক মালিকানার ধারনা তুলে ধরেছে, কেননা ইসলাম মনে করে সম্পত্তি বা ক্যাপিটাল সামাজিকভাবে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের কর্ম প্রচেষ্টা এবং মহান আল্লাহর অনুগ্রহের ফল [যেমন কোরআনে বলা হয়েছে, আমরাই জমিতে ফসল উৎপাদন করি- এর মধ্য দিয়ে ইসলাম ফসল উৎপাদক, জমির সাময়িক মালিক এবং মহান আল্লাহর প্রাকৃতিক অনুগ্রহ এইসব কিছুকেই আমরা বলে উল্লেখ করেছেন] এবং এই দৃষ্টিভঙ্গির উপর ভিত্তি করেই ইসলাম সম্পত্তির সামাজিক বণ্টনের তাগিদ দেয়।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গী তুলে ধরতে গিয়ে ইমাম খোমেনী (রঃ) বলেছেন, "যে পুঁজিবাদ অত্যাচারী, বেহিসাবী এবং মজলুম জনগণকে বঞ্চিত করে, ইসলাম সে পুঁজিবাদকে সমর্থন করে না, বরং কোরআন ও সুন্নাহ এ ধরনের ব্যবস্থার সাংঘাতিক নিন্দা করেছে। ইসলাম এ ধরনের পুঁজিবাদকে ন্যায় বিচারের বিরোধী বলে জানে। একইসাথে ইসলাম কমিউনিজম ও মার্কসবাদী লেনিনবাদী সরকার ও তার অর্থনৈতিক ব্যবস্থারও বিরোধী। কারণ কমিউনিজম ব্যক্তিমালিকানার বিরোধী এবং অভিনব মালিকানার নীতিতে বিশ্বাসী। ইসলাম এ দুয়ের মাঝামাঝি বা ভারসাম্যপূর্ণ পন্থা তথা সীমিত মালিকানাকে সমর্থন করে ।"
ইসলামী আইনে একজন শ্রমিক পুঁজি বিনিয়োগকারীর সাথে মুনাফার অংশিদার। কোন কোন মালেকী ফকীহ এতদূর পর্যন্ত বলেছেন যে, শ্রমিক ও মালিক লভ্যাংশ সমান ভাগে ভোগ করবে। একজন মূলধন বিনিয়োগ করে আর অন্যজন বিনিয়োগ করে শ্রম। এ দুটি উদ্যোমই স্বমহিমায় সমমর্যাদা সম্পন্ন। অতএব লাভের বেলাও উভয়ই সমান অংশ পাবে।
ইসলামী অর্থনীতি তৌহিদ ভিত্তিক। ইসলামের দৃষ্টিতে সব কিছুর মালিক হলেন আল্লাহ এবং মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডসহ সব কাজেরই লক্ষ্য হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। ইসলামের বিধান অনুযায়ী সমাজের যিনি শাসক তার অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা সমাজের সবচেয়ে নিচু পর্যায়ের ব্যক্তির চেয়ে বেশী হবে না বরং সমান হতে হবে ।
ইসলামের এ সব নীতি ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় ইসলামের মহান উদ্যোগ ও উদ্বেগের কথাই প্রমাণ করে। এখানে মজার বিষয় হলঃ ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় ইসলামের এসব উদ্যোগ সম্পূর্ণ স্বেচ্ছা প্রণোদিত ও স্বত্বপ্রবৃত্ব। অর্থনীতির চাপে অথবা শ্রেণী সংগ্রামের ফলে ইসলাম এটি করেনি। (কোন কোন অর্থনৈতিক প্রবক্তাদের মতে অর্থনীতির চাপ ও শ্রেণী সংগ্রাম অর্থনৈতিক ক্রমবিকাশের একমাত্র নিয়ামক।)
২। উৎপাদন পদ্ধতিতে লুণ্ঠন, মজুদদারি এবং আত্মসাতের মাধ্যমে পুঁজির উদ্ভাবনের বিরোধিতা ঃ
ইসলাম এর নির্দেশনা অনুযায়ী প্রাথমিক পুঁজি গঠনের ক্ষেত্রে লুণ্ঠন, মজুদদারি এবং আত্মসাতের কোন ফুরসৎ নেই। তাই পুঁজিবাদের উদ্ভব এবং বিকাশের ক্ষেত্রে কালো টাকার বা পুঁজির ভূমিকা পালনের কোন সুযোগ নেই।
“হে ঈমানদারগন! তোমরা পরষ্পরের ধন-সম্পদ অবৈধ ভাবে ভক্ষন করো না। তবে পারষ্পরিক সম্মতি অনুযায়ী ব্যবসায়িক লেনদেন করতে পারো। আর তোমরা নিজেরা নিজেদেরকে (অথবা পরষ্পর পরষ্পরকে) ধ্বংস করো না।আল্লাহ তোমাদের অবস্থার প্রতি করুণাশীল। যে ব্যক্তি সীমা অতিক্রম করে যুলুম সহকারে এরূপ করবে তাকে আমি অগ্নির মধ্যে নিক্ষেপ করবো” ।(সূরা আন নিসাঃ২৯-৩০)
ফলে ব্যক্তিগত সম্পত্তি অর্জনের অধিকার দিলেও ইসলাম অবৈধ ভাবে ধন-সম্পদ অর্জনের রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে মানুষের অবাধে সম্পত্তি অর্জনের পুঁজিবাদী সিস্টেমকে প্রত্যাখ্যান করে। উৎকোচ (আল বাকারা ১৮৮ আয়াত), ব্যক্তি সমষ্টি নির্বিশেষে সবার সম্পদ আত্নসাৎ (আল বাকারা ২৮৩ ও আলে ইমরান ১৬১ আয়াত), চুরি (আল মায়েদা ৩৮ আয়াত), এতিমের অর্থ অন্যায়ভাবে তসরুফ (আন নেসা ১০ আয়াত), ওজনে কম করা (আল মুতাফফিফীন ৩ আয়াত), চারিত্রিক নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী উপকরনসমূহের ব্যবসায় (আন নূর ১৯ আয়াত), বেশ্যাবৃত্তি ও দেহ বিক্রয় লব্ধ অর্থ (আন নূর ২,৩৩ আয়াত), মদ উৎপাদন, মদের ব্যবসায় ও মদ পরিবহন (আল মায়েদা ৯ আয়াত), জুয়া ও এমন সব উপায় উপকরণ যেগুলোর মাধ্যমে নিছক ঘটনাচক্রে ও ভাগ্যক্রমে একদল লোকের সম্পদ অন্য একদল লোকের নিকট স্থানান্তরিত হয় (আল মায়েদা ৯০ আয়াত), ভাগ্য গননা ও জ্যোতিষীর ব্যবসায় (আল মায়েদা ৯০ আয়াত), সুদ খাওয়া (আল বাকারা ২৭৫, ২৭৮ থেকে ২৮০ এবং আলে ইমরান ১৩০ আয়াত) এই সব কিছুকে অবৈধ ঘোষণা করে ইসলাম।
এছাড়া ইসলাম প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতায় নিজেদের মোহাচ্ছন্ন করে রাখার বিরোধী এবং ফলে পুঁজিবাদী সংস্কৃতির যে ভোগবাদী মানসিকতা তাকে প্রত্যাখ্যান করে ইসলাম সমাজে অ্যান্টি ক্যাপিটালিস্টিক কালচার তৈরি করতে বদ্ধপরিকর।
“প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা তোমাদেরকে মোহাচ্ছন্ন রাখে যতক্ষণ না তোমরা কবরে উপনীত হও। ইহা সংগত নয়, তোমরা শীঘ্রই ইহা জানতে পারবে; আবার বলি, ইহা সংগত নয়, তোমরা শীঘ্রই ইহা জানতে পারবে। সাবধান! তোমাদের নিশ্চিত জ্ঞান থাকলে অবশ্যই তোমরা মোহাচ্ছন্ন হতে না; তোমরা তো জাহান্নাম দেখবেই;তোমরা তো ওটা দেখবেই চাক্ষুষ প্রত্যয়ে, এর পর অবশ্যই সেদিন তোমাদেরকে নিয়ামত সম্বন্ধে প্রশ্ন করা হবে” [সূরা আত্ তাকাছুর, আয়াত ১-৮]
৩। শোষণের উৎসমূল সুদ ভিত্তিক কাঠামোর অপনোদন
অর্থনীতির ইতিহাসবেত্তারা বলেনঃ পুঁজিবাদ এর প্রাথমিক কল্যাণমূখী অবস্থা থেকে শুরু করে বর্তমান ব্যাধিগ্রস্থ অবস্থা পর্যন্ত সবসময়ই এটি জাতীয় ঋণের উপর নির্ভরশীল। এর ফলেই ব্যাংকিং ব্যবস্থার জন্ম হয়। এ ব্যাংক এর যাবতীয় কার্যক্রম সম্পাদন করে সূদের উপর নির্ভর করে। এখানে অগ্রীম ঋণের ভিত্তিই হল সূদ। অথচ ইসলাম এ সূদকে প্রকাশ্যভাবে নিষিদ্ধ বা না জায়েজ ঘোষণা করেছে। কুরআনে ইরশাদ হয়েছেঃ
অর্থাৎ- আল্লাহ তা‘য়ালা ব্যবসাকে বৈধ করেছেন আর সূদকে হারাম বা অবৈধ ঘোষণা করেছেন। (সূরা বাকারা: ২৭৫)
“যারা সুদ খায় তারা কিযামতে দণ্ডায়মান হবে, যেমন দণ্ডায়মান হয় সে ব্যক্তি যাকে শয়তান স্পর্শ করে পাগল করে দিয়েছে । তাদের এই অবস্থায় উপনীত হবার কারণ হচ্ছে এই যে, তারা বলে: "ব্যবসা তো সুদেরই মতো।" অথচ আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করে দিয়েছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম”।(সূরা বাকারাঃ ২৭৫)
“হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় করো এবং লোকদের কাছে তোমদের যে সুদ বাকি রয়ে গেছে তা পরিত্যাগ কর, যদি যথার্থই তোমরা ঈমান এনে থাকো।যদি তোমরা এমনটি না করো তাহলে জেনে রাখো, আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে তোমাদের বিরোদ্ধে যুদ্ধ অবধারিত। আর যদি তাওবা করে নাও, তাহলে তোমরা তোমাদের মূলধনের অধিকারী হবে। তোমরা জুলুম করবে না এবং তোমাদের প্রতিও জুলুম করা হবে না”।(সূরা বাকারা: ২৭৮-৭৯)
“আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দানকে বর্ধিত করেন। আর আল্লাহ অবিশ্বাসী পাপীকে পছন্দ করেন না”।(সূরা বাকারাঃ ২৭৬)
মরহুম ইমাম খোমেনী (রঃ) সুদ প্রথার কঠোর বিরোধিতা করে গেছেন। পবিত্র কোরআন সুদ গ্রহণকে আল্লাহর সাথে যুদ্ধের শামিল বলে উল্লেখ করেছে। এরই আলোকে তিনি বলেছেন, " সুদ কল্যাণকর অর্থনৈতিক তৎপরতায় বাধা সৃষ্টি করে এবং সুদ অর্থনৈতিক তৎপরতাকেই কমিয়ে দেয় । সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে চড়া সুদে ঋণ দিয়ে তাদেরকে এমনভাবে শোষণ করছে যে তারা চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ দিতে হিমশিম খাচ্ছে। বর্তমানে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর কাছে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর দেনার পরিমাণ প্রায় দশ হাজার বিলিয়ন ডলার। সুদের অন্য একটি কুফল হলো এর ফলে ধনীরা আরো ধনী এবং গরীবরা আরো গরীব হয়। সুদ গ্রহীতা তেমন কোনো পরিশ্রম না করেই নির্দিষ্ট পরিমাণ লাভ গ্যারান্টি সহকারে পেয়ে থাকে, কিন্তু যে ব্যক্তি ঋণ গ্রহণ করলো সে যে তার ব্যবসা বা কারবারে লাভ করতে পারবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই, এমনকি সুদ পরিশোধ করতে গিয়ে হয়তো তাকে আসল পুঁজিরও কিছু অংশ হারাতে হয়। সুদ মানব সমাজে কল্যাণকামীতার চেতনা কমিয়ে দেয় এবং সুদখোর ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দিন দিন বেশী স্বার্থপর বা মুনাফাকামী হতে থাকে।"
৪। ধন সঞ্চয়ের নিষেধাজ্ঞা অর্থাৎ পুঁজির নিরঙ্কুশ পুঞ্জীভবনের উপর চরম নিষেধাজ্ঞা
ধন সম্পদ পুঞ্জিভূত করে রাখা পুঁজিবাদী অর্থনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কিন্তু ইসলামের নীতি অনুসারে বৈধ উপায়ে যে ধন উপার্জন করা হবে তা পুঞ্জিভূত করে রাখা যাবে না। কারণ এর ফলে ধনের আবর্তন বন্ধ হয়ে যায় এবং ধন-বন্টনে ভারসাম্য থাকে না। যে ব্যক্তি ধন সঞ্চয় করে রাশীকৃত ও পুঞ্জীভূত করে রাখে সে সম্পত্তিকে কুক্ষিগত করে ওই সম্পদের উপর যাদের ন্যায্য অধিকার রয়েছে তা পূরণ করে না যা সামাজিক ভাবে অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং জুলুমকে তরান্বিত করে । এজন্য কুরআন কার্পণ্য এবং কারুনের ন্যায় সম্পদ কুক্ষিগত ও পুঞ্জীভূত করে রাখার কঠোর বিরোধিতা করেছে। কুরআন বলেঃ
“যারা আল্লাহ প্রদত্ত অনুগ্রহে কৃপনতা করে, তারা যেন একথা মনে না করে যে, তাদের এ কাজ তাদের জন্য মংগলজনক বরং প্রকৃতপক্ষে এটা তাদের জন্য ক্ষতিকর ।”-(সূরা আলে ইমরানঃ ১৮০)
“যারা স্বর্ণ-রৌপ্য সঞ্চয় করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সংবাদ দাও ।”- (সূরা আত তাওবাঃ ৩৪)
“.......দুর্ভাগ্য তার যে সম্পদের পাহাড় গড়ে এবং নিয়মিত তা গুণে রাখে;
ধারণা করে যে, তার ঐশ্বর্য্য তাকে অমর করবে। না কখনও না ! অবশ্যই সে হুতামায় নিক্ষিপ্ত হবে [যা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করবে ]” [সূরা হুমাযাঃ ১-৪]
“জাহান্নাম সে ব্যক্তিকে ডাকবে, যে সত্যের প্রতি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেছিল ও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, যে সম্পদ পুঞ্জীভূত এবং কুক্ষিগত করে রেখেছিল”। (সূরা মা'আরিজঃ১৭-১৮)
কোরআনের এই আয়াতগুলো মূলত পুঁজিবাদের ভিত্তিতে আঘাত হানে। উদ্বৃত্ত অর্থ জমা করে রাখা এবং জমাকৃত অর্থ আরো অধিক পরিমান অর্থ সংগ্রহে খাটানো- এটিই হচ্ছে পুঁজিবাদের মূল কথা। কিন্তু ইসলাম আদতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ জমা করে রাখা পছন্দ করেনা। এই আয়াতগুলোতে ধন সঞ্চয়ের নিষেধাজ্ঞা অর্থাৎ পুঁজির নিরঙ্কুশ পুঞ্জীভবনের উপর চরম নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে পুঁজিবাদী অর্থনীতির মর্মমূলে আঘাত করা হয়েছে।
৫। একচেটিয়া মজুদদারীর উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ
‘তীব্র প্রতিযোগিতা পুঁজিবাদের প্রধানতম বৈশিষ্ট’। এ তীব্র প্রতিযোগিতা ছোট ছোট কম্পানীগুলোকে হয়তো বিলুপ্ত করে দেয় নতুবা বড় বড় কম্পানীর লেজুরবৃত্তি করতে বাধ্য করে। ফলে একচেটিয়া মজুদদারী ব্যবসার উদ্ভব হয়। সিন্ডিকেট তৈরী করে মূল্য বৃদ্ধি ও নিয়ন্ত্রন করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। সুবিধাভোগী মুনাফাখোরের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম এ মজুদদারীকে স্পষ্টভাবে হারাম ঘোষণা করেছে।
অর্থাৎ- যে একচেটিয়া মজুদদারী করে সে অন্যায়কারী (বুখারী ও মুসলিম)
একচেটিয়া মজুদদারী যা ছাড়া পুঁজিবাদ দাঁড়াতে পারে না, চলতে পারেনা ও সর্বগ্রাসী ব্যাপকতা লাভ করতে পারেনা তাকে ইসলাম পুঁজিবাদ এর জন্মের হাজার বছর আগেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।
৬। পুঁজি কিংবা সম্পত্তির কেন্দ্রীভবন নয় সামাজিক সুষম বণ্টনের নির্দেশনা
ইসলাম দ্ব্যার্থহীন কন্ঠে পৃথিবীর সম্পদের সুষম বন্টনের কথা ঘোষণা করেছে। পুজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সমাজের গুটি কয়েক মানুষের হাতে [বুর্জোয়া শ্রেণী] সব সম্পদ কুক্ষিগত হয়ে থাকে বলেই অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রবল হয়ে উঠে এবং তা শোষণ, জুলুম ও বঞ্চনার জন্ম দেয়। ইসলাম তাই পুঁজি কিংবা সম্পত্তির কেন্দ্রীভবন নয় সামাজিক সুষম বণ্টনের নির্দেশনা দেয় অত্যন্ত কঠোরভাবে।
“আল্লাহ জনপদবাসীদের কাছ থেকে তাঁর রসূলকে যা দিয়েছেন, তা আল্লাহর, রসূলের, তাঁর আত্নীয়-স্বজনের, ইয়াতীমদের, অভাবগ্রস্তদের এবং মুসাফিরদের জন্যে, যাতে ধনৈশ্বর্য্য কেবল তোমাদের বিত্তশালীদের মধ্যেই পুঞ্জীভূত না হয়। রসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাক এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা”।(সূরা হাশর ঃ৭)
“ তাদের সম্পদের মধ্যে নিরধারিত অধিকার রয়েছে প্রার্থী ও গরীবের ।(সূরা মা‘য়ারিজ: ২৪-২৫) এ সব বিধানের মাধ্যমে ইসলাম সম্পদের সুষম বন্টনকে তার অন্যতম অর্থনৈতিক নীতি হিসেবে গ্রহন করে । ইসলামী অর্থনৈতিক সিস্টেম যাকাত, সদকা, সদকায়ে ফিতর, সিয়ামের কাফ্ফারা, খোমস ইত্যাদির মাধ্যমে নানান ভাবে সম্পদশালীর সম্পদকে গরীবের হাতে পৌঁছানোর ব্যাবস্থা করে।
৭। জনকল্যাণে অর্থ ব্যয় করার নির্দেশ ঃ শ্রেণী বৈষম্য দূর করা এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার তাগিদ
১৯৭৯ এর ইরানের ইসলামী বিপ্লবের নেতা ইমাম খোমেনীর মতে ইসলামী অর্থনীতির লক্ষ্য তথা সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার অর্থ হলো ধনী ও দরিদ্রের ব্যবধান কমিয়ে দেয়া এবং অনাকাঙ্ক্ষিত বৈষম্যগুলো দূর করে প্রত্যেক মানুষকে তার প্রাপ্য অধিকার দেয়া । তাঁর মতে, " বিশ্বনবী হযরত মোঃ (সঃ) সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার জন্যেই ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মহানবী (সঃ)'র আহলে বাইতভূক্ত পবিত্র ইমামগণও সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুবিচার প্রতিষ্ঠাকে তাদের প্রধান নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন । ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা ছাড়া শুধু শাসন ক্ষমতা হাতে নেয়ার প্রতি তাদের বিন্দুমাত্রও আকর্ষণ ছিলনা ।"
ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ন্যায়বিচারের বিশেষ অর্থ রয়েছে৷ সম্পদের সুষম বন্টন এবং উৎপাদন ও সেবার খাতে প্রাথমিক সুবিধাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রধান দ্রব্যগুলোর সমবন্টন এই ন্যায়বিচারের অন্তর্ভুক্ত৷ইসলামের দৃষ্টিতে অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার দুটি বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল৷ প্রথমতঃ সম্পদের ভারসাম্য এবং দ্বিতীয়ত জনকল্যাণ৷ ইসলামী সমাজে অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার সবারই প্রাপ্য, এমনকি অমুসলমানরাও এ ন্যায়বিচার পাবার অধিকার রাখে৷ ইসলাম মনে করে মানুষের জীবন যাপনের উপকরণগুলো এমনভাবে বন্টিত হওয়া উচিত যাতে সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তি স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা, খাদ্য ও বাসস্থানসহ জীবনের সব ক্ষেত্রে যথেষ্ট মাত্রায় সুযোগ সুবিধা পায়৷ইসলাম বাধ্যতামূলক দান ও স্বেচছায় দান করাকে জনকল্যাণের একটি পন্থা বলে মনে করে৷ মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে দরিদ্র ও বঞ্চিত মানুষের প্রাপ্য অধিকার আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন৷ এছাড়াও হাদীস ও বিভিন্ন ইসলামী বর্ণনায় দরিদ্র বা বঞ্চিতদের সাহায্য করার ওপর ব্যাপক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে৷ এসব বর্ণনায় দেখা যায় বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এবং তাঁর পবিত্র বংশে জন্মগ্রহণকারী ইমামগণ দরিদ্র ও বঞ্চিতদের ব্যাপকভাবে সাহায্য সহযোগিতা করতেন৷ মহানবী (সাঃ)'র আহলে বাইত বা তাঁর পবিত্র বংশে জন্মগ্রহণকারী ষষ্ঠ ইমাম হযরত জাফর সাদেক (আঃ) বলেছেন, দরিদ্র ব্যক্তিকে এতোটা পরিমাণে দেয়া দরকার যাতে সে পানাহার ও পোশাক পরা ছাড়াও বিয়ে করতে পারে এমনকি সদকা দিতে পারে ও হজ্বেও যেতে পারে৷ উন্নয়ন সম্পর্কিত ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গীতে সম্পদের মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণর্ বিষয়৷ ইসলামী সমাজে জীবন যাপনের প্রয়োজনীয় বস্তুগত সামগ্রীর অধিকারী হবার ক্ষেত্রে ব্যাপক ব্যবধান বা বৈষম্য থাকা বৈধ নয়৷ যদিও সম্পদ অর্জনের ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে পার্থক্য থাকতেই পারে এবং তা অগ্রাহ্য করা যায় না৷ কারণ, সৃষ্টিশীলতা এবং শারীরিক ও মানসিক ক্ষমতার দিক থেকে অথবা কাজ করার দৃষ্টিভঙ্গীর দিক থেকে মানুষের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে৷ ইসলাম এ পার্থক্যকে স্বীকৃতি দেয়৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও ইসলাম সমাজের মানুষের মধ্যে জীবন যাপনের প্রয়োজনীয় বস্তুগত সামগ্রীর অধিকারী হবার ক্ষেত্রে ব্যাপক ব্যবধান বা বৈষম্যকে স্বীকৃতি দেয় না ৷ বরং ইসলাম সম্পদের সমবন্টনের ওপর ব্যাপক গুরুত্ব আরোপ করেছে৷ ইসলামের দৃষ্টিতে সমাজের অল্প সংখ্যক মানুষের কাছে অধিকাংশ সম্পদ কেন্দ্রীভূত হলে তারা খোদাদ্রোহী বা উদ্ধত প্রকৃতির হয়ে পড়বে এবং অন্যদিকে দরিদ্র লোকেরাও দারিদ্র্যের কারণে বিভিন্ন অপরাধ বা অনুপযোগী কাজে জড়িয়ে পড়বে৷
আর তাই এ পবিত্র ধর্ম মানুষকে কাজ করতে ও চেষ্টা সাধনা করতে বলে যাতে মানুষ কাঙিক্ষত পর্যায়ে উন্নীত হয়, একইসাথে ইসলাম ধনীদেরকে তাদের সম্পদ থেকে দরিদ্রদের দান করতে বলে৷ইসলামী আইন অনুযায়ী এ দান বাধ্যতামূলক৷ আর এভাবে ইসলাম দান খয়রাতকে সমাজে সম্পদের বিকেন্দ্রীকরণের বা সম্পদে ভারসাম্য সৃষ্টির অন্যতম পন্থা বলে মনে করে৷ দান খয়রাত করতে উৎসাহ যুগিয়ে ইসলাম সমাজ থেকে দারিদ্র্যও বঞ্চনা দূর করতে চায় ৷ কারণ দানের অর্থ সম্পদ দিয়ে বঞ্চিত শ্রেণীর মানুষ অর্থনৈতিক তৎপরতা চালানোর সুযোগ পায়৷
হযরত আলী (আঃ)'র দৃষ্টিতে উন্নয়ন বলতে শুধু ব্যক্তির অর্থ-সম্পদ বা উপার্জন বৃদ্ধিকে বোঝায় না, সম্পদের সমবন্টন, সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের সম্পদ ভোগ বা ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টি করাও উন্নয়নের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য৷ আমিরুল মোমেনিন আলী (আঃ)'র মতে সমাজে যদি কোনো দরিদ্র মানুষ ক্ষুধার্ত থাকে এবং কোনো ধনী ব্যক্তির সম্পদ বাড়তে থাকে, তাহলে তা হলো দরিদ্রদের সম্পদ লুন্ঠিত হবার ও রাষ্ট্রের সম্পদ সমানভাবে বন্টিত না হবার লক্ষণ৷
ইসলাম সঞ্চয় করার পরিবর্তে অর্থ সম্পদ এমনভাবে ব্যয় করার শিক্ষা দেয় যেন তা নির্যাতিত, অবহেলিত হতদরিদ্রদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা পালন করতে পারে। বিলাসিতা ও আয়েস-আরামের জীবনযাপনে নয়, সমাজের কোন ব্যক্তির নিকট প্রয়োজনের অতিরিক্ত যে উদ্বৃত্ত অর্থ থাকে সমাজের জন্য কল্যানমূলক কাজে তা ব্যয় করাকে ইসলাম বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে। এটিই হবে আল্লাহর পথে ব্যয়।
“আল্লাহ্ তা‘আলার নেক বান্দা হলো ঐ সকল লোক যারা ব্যয়ের ক্ষেত্রে অপব্যয়কে প্রশ্রয় দেয় না আর কৃপণতাও করে না। বরং এই দু’টি পথের মধ্যে অবস্থান করে ব্যয় করে থাকে।” –সূরা আল ফুরকান: ৬৭
“তারা তোমাকে জিজ্ঞেস করছে যে, তারা কি ব্যয় করবে? তাদেরকে বলে দাও, যা তোমাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত (তাই ব্যয় করো)”–(সূরা আল বাকারাঃ ২১৯)
“লোকেরা জিজ্ঞেস করছে, আমরা কি ব্যয় করবো? বলে দাও, যে উত্তম বস্তুই তোমরা ব্যয় কর না কেন তা হবে- পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম, মিসকিন ও মুসাফিরদের জন্য আর তোমরা যে সৎকাজই করবে সে সম্পর্কে আল্লাহ সম্যক অবগত”।(সূরা বাকারাঃ ২১৫)
“তোমাদের মুখ পূর্ব দিকে বা পশ্চিম দিকে ফিরানোর মধ্যে কোন পূণ্য নেই। বরং পূণ্য হচ্ছে, মানুষ আল্লাহ, কিয়ামতের দিন, ফেরেশতা, আল্লাহর অবতীর্ণ কিতাব ও নবীদের প্রতি ঈমান আনবে এবং সম্পদ দান করবে আল্লাহর প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে আত্মীয়-স্বজন, এতীম, মিসকীন, মুসাফির, সাহায্য প্রাথর্ীগণকে এবং দাস মুিক্তর জন্য। আর নামায কায়েম করবে, যাকাত প্রদান করবে, অংগীকার করলে তা পূর্ণ করবে এবং বিপদে-অনটনে ও (হক-বাতিলের) সংগ্রাম- সংকটে ধৈর্যধারণ করবে। তারাই সত্যাশ্রয়ী এবং তারাই মুত্তাকী” । (সূরা বাকারাঃ ১৭৭)
“সে তো বন্ধুর গিরিপথে প্রবেশ করেনি।তুমি কী জান বন্ধুর গিরিপথ কী?তা হচ্ছে: দাসমুক্তি অথবা দুর্ভিক্ষের দিনে আহার্য দান ইয়াতীম আত্মীয়কে, অথবা দারিদ্র-নিষ্পেষিত নিঃস্বকে,তদুপরি সে অন্তর্ভুক্ত হয় মুমিনদের এবং তাদের, যারা পরস্পরকে উপদেশ দেয়, ধৈর্য ধারণের ও দয়া-দাক্ষিণ্যের;” (সূরা বালাদঃ ১১-১৭)
“আর সদ্ব্যবহার করো নিজের মা-বাপ, আত্নীয়-স্বজন, অভাবী-মিসকীন, আত্নীয় প্রতিবেশী, অনাত্নীয় প্রতিবেশী, নিজের মোলাকাতি বন্ধুবর্গ, মুসাফির ও মালিকানাধিন দাস-দাসীদের সাথে।” (সূরা আন নিসাঃ ৩৬)
“নিজের নিকটাত্নীয়কে তার অধিকার পৌঁছিয়ে দাও এবং মিসকিন ও মুসাফিরদেরকেও তাদের অধিকার দান করো। বাজে খরচ করোনা। যারা অযথা ও বাজে খরচ করে তারা শয়তানের ভাই। আর শয়তান তার রব-প্রতিপালকের প্রতি অকৃতজ্ঞ না-ফরমান।”–(বনী ইসরাঈলঃ ২৬-২৭)
“আর এ কথাও জেনে রাখ যে, কোন বস্তু-সামগ্রীর মধ্য থেকে যা কিছু তোমরা গনীমত হিসাবে পাবে, তার এক পঞ্চমাংশ হল আল্লাহর জন্য, রসূলের জন্য, তাঁর নিকটাত্নীয়-স্বজনের জন্য এবং এতীম-অসহায় ও মুসাফিরদের জন্য; যদি তোমাদের বিশ্বাস থাকে আল্লাহর উপর এবং সে বিষয়ের উপর যা আমি আমার বান্দার প্রতি অবতীর্ণ করেছি ফয়সালার দিনে, যেদিন সম্মুখীন হয়ে যায় উভয় সেনাদল। আর আল্লাহ সব কিছুর উপরই ক্ষমতাশীল”। (সূরা তওবাঃ ৪১)
“পুনরায় তাকে শৃঙ্খলিত কর সত্তর হাত্ দীর্ঘ এক শিকলে', সে মহান আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল না,এবং অভাবগ্রস্তকে খাদ্যদানে উৎসাহিত করতো না”।(সূরা হাককাঃ৩২-৩৪)
“তুমি কি দেখেছ তাকে, যে দীনকে অস্বীকার করে? সে তো সে-ই, যে ইয়াতীমকে রূঢ়ভাবে তাড়িয়ে দেয়,এবং সে অভাবগ্রস্তকে খাদ্যদানে উৎসাহ দেয় না”। (সুরা আল মাউন: ১-৩)
“ খাদ্যের প্রতি আসক্তি সত্ত্বেও তারা অভাবগ্রস্ত, ইয়াতীম ও বন্দীকে খাদ্য দান করে,এবং বলে, 'কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে আমরা তোমাদেরকে আহার দান করি, আমরা তোমাদের নিকট হতে প্রতিদান চাই না, কৃতজ্ঞতাও নয়” (সূরা- দাহর বা ইনসানঃ ৮-৯)
“যে স্বীয় সম্পদ দান করে আত্মশুদ্ধির জন্য, এবং তার প্রতি কারও অনুগ্রহের প্রতিদানে নয়, কেবল তার মহান প্রতিপালকের সন্তুষ্টির প্রত্যাশায়; সে তো অচিরেই সন্তোষ লাভ করবে” ( সূরা লায়লঃ১৮-২১)
“ না, কখনও না। বরং তোমরা ইয়াতীমকে সম্মান কর না, এবং তোমরা অভাবগ্রস্তদেরকে খাদ্যদানে পরস্পরকে উৎসাহিত কর না, এবং তোমরা উত্তরাধিকারীদের প্রাপ্য সম্পদ সম্পূর্ণরূপে খেয়ে ফেল, এবং তোমরা ধন-সম্পদ অতিশয় ভালবাস; ইহা সংগত নয়”।(সূরা ফাজরঃ১৭-২১)
“যারা নিজেদের ধন-সম্পদ দিনরাত প্রকাশ্যে ও গোপনে ব্যয় করে, তাদের প্রতিদান রয়েছে তাদের রবের কাছে এবং তাদের কোন ভয় ও দুঃখ নেই” ।(সূরা বাকারাঃ ২৭৪)
৮। জনকল্যাণে অর্থ ব্যয় প্রশ্নে ইসলাম ও পুঁজিবাদী দৃষ্টিভঙ্গীর মনস্তাত্ত্বিক এবং চেতনাগত পার্থক্য
ক। বিত্তবান মনে করে, অর্থ ব্যয় করলে দরিদ্র হয়ে যাবে এবং সঞ্চয় করলে বিত্তশালী হবে। কিন্তু ইসলাম বলে,অর্থ ব্যয় করলে কমে যাবেনা বরং বরকত ও বৃদ্ধি হবে।
“শয়তান তোমাদেরকে দারিদ্র্যের ভয় দেখায় এবং কার্পণ্যের ন্যায় লজ্জাকর কাজের হুকুম দেয় কিন্তু আল্লাহ তোমাদের নিকট মাগফেরাত ও অতিরিক্ত দানের ওয়াদা করেন।”(সূরা বাকারাঃ ২৬৮)
খ। বিত্তবান মনে করে কোনো কিছু ব্যয় করা হলে তা নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু ইসলাম বলে,না,তা নষ্ট হয়ে যায়নি বরং তার সর্বোত্তম লাভ তোমাদের নিকট ফিরে আসবে।
“সৎকাজে তোমরা যা কিছু ব্যয় করবে তা তোমরা পুরোপুরি ফেরত পাবে এবং তোমাদের ওপর কোনোক্রমেই যুলুম করা হবেনা।”(সূরা আল বাকারাঃ ২৭২)
“যারা আমার প্রদত্ত রেজেক থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে তারা এমন একটি ব্যবসায়ের আশা রাখে, যাতে কোনোক্রমেই লোকসানের সম্ভাবনা নেই। আল্লাহ তাদেরকে এর বিনিময়ে পুরোপুরি ফল প্রদান করবেন বরং মেহেরবানি করে তাদেরকে কিছু বেশী দান করবেন।” (সূরা আল ফাতির ২৯-৩০)
গ। বিত্তবান মনে করে, সম্পদ আহরন করে সুদী ব্যবসায়ে নিয়োগ করলে সম্পদ বেড়ে যায়। কিন্তু ইসলাম বলে, না, সুদের মাধ্যমে বরং সম্পদ কমে যায়। সৎকাজে অর্থ নিয়োগ করলেই সম্পদ বেড়ে যায়।
“আল্লাহ সুদ নির্মূল করেন ও দান-সাদকাকে প্রতিপালন ও ক্রমবৃদ্ধি করেন।”(সূরা আল বাকারাঃ ২৭৬)
“তোমরা এই যে সুদ দাও মানুষের ধন-সম্পদ বৃদ্ধির আশায়, জেনে রাখো, আল্লাহর নিকট তা কখনো বৃদ্ধি লাভ করে না। তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে যাকাত বাবদ যে দান করে থাকো একমাত্র তার মধ্যেই ক্রমবৃদ্ধি হয়ে থাকে।”(সূরা আর রূমঃ ৩৯)
ইসলামের অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী/ফিলোসফি পুঁজিবাদের সম্পূর্ণ বিপরীত ধর্মী। “ব্যয় করলে অর্থ বেড়ে যাবে এবং ব্যয়িত অর্থ কেবল নষ্টই হবে না বরং কিছুটা অতিরিক্ত লাভ ও কল্যাণসহ পূর্ণ মাত্রায় ফিরে আসবে, অন্যদিকে সুদী ব্যবসায় অর্থ বৃদ্ধির পরিবর্তে অর্থ হ্রাস ও লোকসানের সূচনা করবে এবং যাকাত ও সাদকার মাধ্যমে অর্থ হ্রাসের পরিবর্তে বৃদ্ধি প্রাপ্ত হবে- ইসলামের এই দৃষ্টিভঙ্গী আপাত দৃষ্টিতে অদ্ভূত ও বিষ্ময়কর মনে হবে। অনেকেই মনে করে সম্ভবত এগুলো নিছক আখেরাতের সওয়াবের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যাপার। নিঃসন্দেহে আখেরাতের সওয়াবের সাথে এসব কথার সম্পর্ক রয়েছে এবং ইসলামের দৃষ্টিতে এটিই আসল গুরুত্বের অধিকারী। কিন্তু গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে যে, এ দুনিয়াতেও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এ মতাদর্শটি একটি শক্তিশালী ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। পুঁজিবাদী কাঠামোতে উন্নয়নের মডেল ব্যক্তির সর্বাধিক মুনাফা অর্জনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় বলে ব্যক্তির নিরঙ্কুশ অর্থনৈতিক উন্নয়নকেই প্রাধান্য দেয়, কিন্তু ইসলামের অর্থনৈতিক ফিলোসফি অনুযায়ী উন্নয়ন দর্শন ব্যক্তি নয়, সমষ্টির সামগ্রিক উন্নয়নকেই প্রাধান্য দেয়। এই দিকটি খেয়াল করলে আমরা বুঝতে পারব কেন কোরআনে বলা হয়েছে সুদ প্রত্যাখ্যান করলে এবং যাকাত ও সাদকার মাধ্যমে অর্থ হ্রাসের পরিবর্তে বৃদ্ধি প্রাপ্ত হবে? ধন সঞ্চয় করে সুদি ব্যবসায়ে নিয়োগ করার অবশ্যম্ভাবী ফল স্বরূপ চতুর্দিক থেকে ধন আহরিত হয়ে মুষ্টিমেয় কয়েকজনের হাতে চলে আসবে, প্রকট হবে শ্রেণী বৈষম্য। সাধারণ মানুষের ক্রয়-ক্ষমতা প্রতিদিন কমে যেতে থাকবে। কৃষি, শিল্প ও ব্যবসায় সর্বত্র মন্দাভাব দেখা দেবে। রাসূলে কারীম (স) নিম্নোক্ত হাদীসটিতে একথার প্রতিই ইংগিত করেছেনঃ অর্থাৎ “সুদের পরিমান যত বেশীই হোক না কেন অবশেষে তা কম হতে বাধ্য”। বিপরীত পক্ষে অর্থ-সম্পদ ব্যয় করলে এবং যাকাত ও সাদকা করলে পরিণামে জাতির সকল ব্যক্তির হাতে এ সম্পদ ছড়িয়ে পড়ে, প্রত্যেক ব্যক্তি যথেষ্ট ক্রয়-ক্ষমতার অধিকারী হয়,অল্প কিছু লোকের হাতে দেশের সম্পদ কুক্ষিগত না থেকে সুষম বণ্টন তরান্বিত হয় বলে সামাজিক বৈষম্য ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে।
“ইসলাম পুঁজিবাদী মানসিকতা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর এক মানসিকতা সৃষ্টি করে। পুঁজিপতি একথা কল্পনাই করতে পারেনা যে, সুদ ছাড়া এক ব্যক্তি তার অর্থ সম্পদ আর এক ব্যক্তিকে কেমন করে দিতে পারে। সে অর্থ ঋণ দিয়ে তার বিনিময়ে কেবল সুদই আদায় করে না, বরং নিজের মূলধন ও তার সুদ আদায় করার জন্য ঋণগ্রহীতার বস্ত্র ও গৃহের আসবাবপত্রাদি পর্যন্ত ক্রোক করে নেয় (ইউনুসের ক্ষুদ্র ঋণ)। কিন্তু ইসলামের শিক্ষা হচ্ছে,অভাবীকে কেবল ঋণ দিলে হবে না বরং তার আর্থিক অনটন যদি বেশী থাকে তাহলে তার নিকট কড়া তাগাদা করা যাবে না, এমন কি ঋণ আদায়ের ক্ষমতা না থাকলে তাকে মাফ করে দিতে হবে”।
“ঋণ গ্রহিতা যদি অত্যধিক অনটন পীড়িত হয় তাহলে তার অবস্থা সচ্ছল না হওয়া পর্যন্ত তাকে সুযোগ দাও আর যদি তাকে মাফ করে দাও তাহলে তা হবে তোমাদের জন্য উত্তম। যদি তোমরা কিছু জ্ঞান রাখতে, তাহলে এর কল্যাণকারিতা উপলব্ধি করতে পারতে।”-(সূরা বাকারাঃ ২৮০)
“যদি প্রকাশ্যে সাদকা দাও তাও ভালো কিন্তু যদি গোপনে দাও এবং দরিদ্রদের নিকট পৌঁছিয়ে দাও, তাহলে এটিই উত্তম হবে।”–(সূরা আল বাকারাঃ ২৭১)
“তোমরা যাকিছু উপার্জন করেছো উৎকৃষ্ট সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করো, যেন বাছাই করে নিকৃষ্টতর বস্তু ব্যয় করো না”– (সূরা আল বাকারাঃ ২৬৭)
“ খাদ্যের প্রতি আসক্তি সত্ত্বেও তারা আল্লাহর প্রতি ভালোবাসায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অভাবগ্রস্ত, ইয়াতীম ও বন্দীকে খাদ্য দান করে,এবং বলে, 'কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে আমরা তোমাদেরকে আহার দান করি, আমরা তোমাদের নিকট হতে প্রতিদান চাই না, কৃতজ্ঞতাও নয়” (সূরা- দাহর বা ইনসানঃ ৮-৯)
“অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইসলাম যে দৃষ্টিভংগী পেশ করেছে তার সারমর্ম হচ্ছে এই যে, ধন-সম্পদ মুষ্টিমেয় লোকের কাছে পুঞ্জীভূত ও জমাটবদ্ধ হয়ে থাকতে পারবে না; ইসলামী সমাজের যে কয়জন লোক তাদের উচ্চতর যোগ্যতা ও সৌভাগ্যের কারনে নিজেদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত ধন-সম্পদ আহরণ করেছে ইসলাম চায় তারা যেন এ সম্পদ পুঞ্জীভূত করে না রাখে বরং এগুলো ব্যয় করে এবং এমন সব ক্ষেত্রে ব্যয় করে যেখান থেকে ধনের আবর্তনের ফলে সমাজের স্বল্প বিত্ত ভোগীরাও যথেষ্ট অংশ লাভ করতে সক্ষম হবে। এ উদ্দেশ্যে ইসলাম একদিকে উন্নত নৈতিক শিক্ষা প্রদান এবং উৎসাহ দান ও ভীতি প্রদর্শনের শক্তিশালী অস্ত্র প্রয়োগ করে দানশীলতা ও যথার্থ পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগীতার প্রবণতা সৃষ্টি করে। এভাবে লোকেরা নিজেদের মনের স্বাভাবিক ইচ্ছা-আকাংক্ষা অনুযায়ী ধন-সম্পদ সঞ্চয় করাকে খারাপ জানবে এবং তা ব্যয় করতে উৎসাহী ও আগ্রহী হবে। অন্যদিকে ইসলাম এমন সব আইন প্রণয়ন করে, যার ফলে বদান্যতার এ শিক্ষা সত্ত্বেও নিজেদের অসৎ মনোবৃত্তির কারণে যেসব লোক সম্পদ আহরণ করতে ও পুঞ্জীভূত করে রাখতে অভ্যস্ত হয় অথবা যাদের নিকট কোনোভাবে সম্পদ সঞ্চিত হয়ে যায়, তাদের সম্পদ থেকে সমাজের কল্যাণ ও উন্নতি বিধানার্থে কমপক্ষে একটি অংশ অবশ্যই কেটে নেয়া হবে। একেই যাকাত বলা হয়। ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এ যাকাতকে অত্যধিক গুরুত্ব দান করা হয়েছে, এমনকি একে ইসলামের একটি মূল স্তম্ভের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। নামযের পরে এ যাকাতের ওপরই সবচেয়ে বেশী জোর দেয়া হয়েছে এবং দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে ঘোষণা করা হয়েছেঃ যে ব্যক্তি অর্থ-সম্পদ সঞ্চয় করে, যাকাত না দেয়া পর্যন্ত তার ঐ সম্পদ হালাল হতে পারেনা”।
“এবং নামায কায়েম করো ও যাকাত দাও” (সূরা বাকারাঃ১১০)
“যারা ঈমান আনে, সৎকাজ করে, নামায কায়েম করে ও যাকাত দেয়, তাদের প্রতিদান নিসন্দেহে তাদের রবের কাছে আছে এবং তাদের কোন ভয় ও দু:খ নেই”।(সূরা বাকারাঃ ২৭৭)
“তারা তো আদিষ্ট হয়েছিল আল্লাহর আনুগত্যে বিশুদ্ধ অন্তরে একনিষ্ঠভাবে তাঁর ইবাদত করতে এবং নামাজ কায়েম করতে ও যাকাত দিতে, এটাই সঠিক দ্বীন” ।(সূরা বায়্যিনাঃ ৫)
“(হে নবী!) তাদের ধন-সম্পদ থেকে একটি সাদকা গ্রহন করো, যা ঐ ধন-সম্পদকে পাক-পবিত্র ও হালাল করে দেবে,”–(সূরা তাওবাঃ ১০৩)
আয়াতের শেষ শব্দটি থেকে সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে,বিত্তশালী ব্যক্তির নিকট যে অর্থ সম্পদ সঞ্চিত হয় ইসলামের দৃষ্টিতে তা অপবিত্র এবং তার মালিক তা থেকে প্রতি বছর কমপক্ষে একটি বিশেষ পরিমাণ আল্লাহর পথে ব্যয় না করা পর্যন্ত তা পবিত্র হতে পারেনা। আল্লাহর পথে এ শব্দটির অর্থ কী? আল্লাহ কারোর মুখাপেক্ষী নন। তাঁর পথ বলে একথাই বুঝানো হয়েছে যে, বিত্তশালীদের সম্পদ ব্যয় করে জাতির দরিদ্র ও অভাবি লোকদেরকে সচ্ছল করার চেষ্টা করতে হবে এবং এমন সব কল্যাণমূলক কাজে এ সম্পদ নিয়োগ করতে হবে যা থেকে সমগ্র জাতি লাভবান হতে পারবে।
“মূলত সাদকা-যাকাত হচ্ছে ফকির ও মিসকিনদের জন্য এবং তাদের জন্য যাদেরকে সাদকা আদায়ের কাজে নিযুক্ত করা হয়, তাদের জন্য যাদের হৃদয়কে শক্তিশালী করার প্রয়োজন হয়৩, লোকদেরকে বন্দীত্ব থেকে মুক্ত করার জন্য আল্লাহর পথে ব্যয় করার জন্য এবং মুসাফিরদের৪ জন্য।”–(সূরা আত তাওবাঃ ৬০)
“এখানে আবার দেখা যায়, পুঁজিবাদ ও ইসলামের নীতি ও পদ্ধতির মধ্যে পরিপূর্ণ বৈপরীত্য। পুঁজিবাদের দাবী হচ্ছে,অর্থ সঞ্চয় করতে হবে এবং তার পরিমান বাড়াবার জন্য সুদ নিতে হবে। যার ফলে নালা গড়িয়ে আশে-পাশের লোকদের সবার টাকা-পয়সা এ পুকুরে এসে পড়বে। বিপরীত পক্ষে ইসলাম নির্দেশ দেয় প্রথমত টাকা-পয়সা জমা করে বা আটকে রাখা যাবে না আর যদি কখনো জমা হয়ে যায় তাহলে এ পুকুর থেকে নালা কেটে দিতে হবে , যাতে শুকিয়ে যাওয়া ক্ষেতগুলোতে পানি পৌছে যায় এবং আশেপাশের সমস্ত জমি তরতাজা ও সবুজ শ্যামলে ভরে উঠে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ধন আবদ্ধ ও জমাটবদ্ধ হয়ে থাকে কিন্তু ইসলামী ব্যবস্থায় তা মুক্ত, স্বাধীন ও অবাধ গতিশীল”।
উপরের আলোচনায় এটাই সুস্পষ্ট হয় যে ইসলাম সমাজের জন্য আফিম নয়, বরং আর্থ -সামাজিক শোষণ-জুলুম-অবিচার- বৈষম্য দূর করে ইসলাম নায়ভিত্তিক সমাজ গঠনে বদ্ধপরিকর। ইসলাম মতাদর্শিক ভাবেই পুঁজিবাদী সিস্টেমের প্রচণ্ড বিরোধী এবং পুঁজিবাদের মোকাবেলায় মানবতার সার্বিক কল্যাণের সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা প্রদান করছে ইসলামের সফল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। যারা ধর্ম সম্পর্কে মার্কসের পর্যালোচনা তুলে ধরে বলেন ধর্ম হচ্ছে শোষণ জুলুম কিংবা নিপীড়নের হাতিয়ার ফলে পুঁজিবাদের শাসন-ত্রাসন উদ্ভূত বৈষম্য এবং নিপীড়নের বিরুদ্ধে ধর্ম তো কিছুই করবে না বরং তা পুঁজিবাদের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে তারা হয় ইসলামী মতাদর্শ সম্পর্কে অজ্ঞ না হলে তারা বুদ্ধিবৃত্তিক সন্ত্রাস চলাচ্ছেন। পুঁজিবাদের বিরোধিতার জন্য সমাজতন্ত্রের কাছেই আসতে হবে এই হেজিমনিক প্রচার প্রতিষ্ঠার জন্যই অনেক তাত্ত্বিক বুদ্ধিজীবী ইসলামের সাম্রাজ্যবাদ এবং পুঁজিবাদ বিরোধী আদর্শকে চেপে যান উল্টা ইসলামকে নিপীড়নের হাতিয়ার বলে চরম ইডিওলজিকেল মিথ্যাচার করছেন। বর্তমানে পুঁজিবাদী শাসন ত্রাসনে শ্রেণী বিভক্ত এবং শ্রেণী শোষণে জর্জরিত মানব সমাজকে মুক্ত করার জন্য বিপ্লবী ইসলাম ভূমিকা রাখতে সক্ষম। তাই পুঁজিবাদ বিরোধিতার জন্য সমাজতন্ত্রের কাছে ধর্না দেয়ার দরকার নেই আমাদের। তবে সমাজতন্ত্র যে মতাদর্শ নিয়ে পুঁজিবাদ এর বিরুদ্ধে দাঁড়ায় তা পর্যালোচনার দাবি রাখে। পরবর্তীতে পুঁজিবাদ বিরোধিতায় সমাজতন্ত্রের মতাদর্শ আর বিপ্লবি ইসলামের মতাদর্শ এর মধ্যকার পার্থক্য নিয়ে আলোচনার ইচ্ছে আছে।
বিষয়: বিবিধ
১৪৪৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন