সিঙাড়া
লিখেছেন লিখেছেন সাদাসিধে ঝুলিওয়ালা ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪, ১০:৪৩:৩৫ রাত
খপ্ করে একটা সিঙাড়া হাতে নিয়েই দিলাম দৌড়। পেছনে "এই চোর, চোর, ধর, ধর" করে চিৎকার করে উঠলো কেউ একজন। পেছনে ফিরে তাকানোর মতো সময় নাই। তাছাড়া পেছনে তাকালে দৌড়ের গতি কমে যেতে পারে। খালি গায়ে শুধু একটা লাল রংয়ের ময়লাযুক্ত হাফপ্যাণ্ট পরে আছি। তাও খুলে খুলে পড়ে যাবার উপক্রম। রোদেলা দুপুরে তপ্ত পিচ ঢালা সড়কে খালি পায়ে এই এগারো বছরের প্রাণটা নিয়ে কতক্ষণ দৌড়াতে পারবো তার কোনও হিসেবই করছিনা এখন। শুধু প্রাণপণে ছুটছি। পেছনে "ধর, ধর" বলা গলার আওয়াজগুলোর সংখ্যা বাড়তে থাকলো। দশ বারোজন হবে হয়তো।
হঠাৎ কেউ একজন পিঠে ধাক্কা দিল। দৌড়ে প্রচন্ড গতি থাকায় সামান্য ধাক্কাটিতেই ভারসাম্য হারিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। থুতনি, হাঁটু এবং কনুইয়ের চামড়া উঠে গেলো বোধহয়। সিঙাড়াটা হাত থেকে খসে গড়িয়ে যেতে লাগলো। সেটা ধরার জন্য উঠতে লাগলাম। প্রচন্ড জোরে কেউ একজন লাথি মারলো পিঠে। দম বন্ধ হয়ে গেলো। শ্বাস নিতে পারছিনা। এখনও তাকিয়ে আছি সিঙাড়াটার দিকে। গড়িয়ে গড়িয়ে গিয়ে পাশের ড্রেনটিতে পড়লো। বাম পাশ থেকে আবার লাথি আসলো। উল্টে চিৎ হয়ে গেলাম। আকাশে দুপুরবেলার খাড়া সূর্য। ভালো করে চোখ মেলে তাকাতে পারছিনা। আবছা ভাবে লোকগুলোর চেহারা দেখার চেষ্টা করলাম। আশপাশের সব দোকানদারই ইতোমধ্যে এসে গেছে বোধহয়। একটু একটু করে দম ফিরে আসতে লাগলো। একটি লাথি আসলো ঠিক আমার মুখমণ্ডল বরাবর। মাথাটা একটু পাশে সরিয়ে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। পারলাম না। তারপর একের পর এক লাথি ছুটি আসতে থাকলো। পাঁজরের হাড্ডিগুলো বোধহয় ভেঙ্গে যাচ্ছে। কতক্ষণ এমন চললো ঠিক বলতে পারবোনা কিন্তু মনে হলো যেন অনন্তকাল যাবৎ এমন চলছে।
"এরে নিয়া বাইন্ধা রাখ", বলে উঠলো কেউ একজন। আরেকজন টান দিয়ে তুললো আমাকে। ভাবলাম মারাধর এই বোধহয় শেষ। কিন্তু আমি লাথালাথির পর কিল ঘুষির পর্বের কথা ভুলেই গেছিলাম। পেছন থেকে ঠক্ করে কেউ একজন মাথায় ঘুষি মারলো। প্রচণ্ড ব্যথার সাথে মাথা ঘুরিয়ে উঠলো। বমির ভাব হচ্ছে। আমাকে কোথাও টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পেছন থেকে কিল ঘুষি চলতেই থাকলো। হঠাৎ কোমরে প্রচণ্ড জোরে কেউ লাথি মারলো। পড়ে গেলাম রাস্তায়। আবার তোলা হলো আমাকে। নিয়ে যাওয়া হলো সেই রেস্টুরেন্টটিতে যেখান থেকে সিঙাড়াটা নিয়ে পালিয়েছিলাম। রেস্টুরেন্টের সামনে যেখানে সিঙাড়া, সামুছা, পরোটা এসব বানানো হয় তার পাশেই একটি খুঁটির সাথে আমাকে বেঁধে রাখা হলো।
মাথাটা ঝিম ঝিম করছে। পিঠে হঠাৎ জ্বলা এবং ব্যথা অনুভব করলাম। কেউ হয়তো ব্লেড দিয়ে পোচ মেরে দিয়েছে মারধরের সময়। তার উপর মাত্র তিন হাত দূরে চোখের সামনে সিঙাড়া, সামুছার থাল রাখা। ক্ষুদার্ত একজন মানুষের জন্য এর চেয়ে বড় সাজা আর কি হতে পারে? খাবারের গন্ধে মুখে জল এসে গেলো। জানি একটু খাবার চাইলে কেউ দেবে না। তাই একটু পানি চাইলাম। প্রায় দুই ঘন্টা পর পানি পেলাম।
রাত সাড়ে দশটার দিকে আমাকে ছেড়ে দেয়া হলো। মাথা ঘুরাচ্ছে। কোন্ দিকে যাবো বুঝতে পারছিনা। কিছুক্ষণ হাঁটার পর একটু একটু ভালো লাগতে লাগলো। সারা গায়ে প্রচণ্ড ব্যথা। ঠোঁটটা ফুলে আছে। চোখের নিচটাতেও কালো দাগ আছে হয়তো। একটি স্ট্রিটলাইটের নিচে বসলাম কিছুক্ষণ। তারপর আবার হাঁটা শুরু করলাম।
চুপি চুপি ঘরে ঢুকলাম। ভাঙা বেড়ার ঘরে শুধুমাত্র মায়ের একটা পুরানো ছেঁড়া শাড়িই দরজার কাজ করছে। তাই ঢুকতে শব্দ হলোনা। ভাবলাম মা ঘুমিয়ে পড়েছে।
"ভাইয়া কি এনেছ? আমার খিদা লাগছে", মায়ের পাশে বসে থাকা আমার তিন বছরের ছোট্ট বোনটি বলে উঠলো। কি বলবো বুঝে উঠতে পারছিনা। শুধু কল্পনায় ভেসে উঠলো সিঙাড়াটা গড়িয়ে গড়িয়ে গিয়ে পাশের ড্রেনে পড়ছে। চোখের কোণায় এক ফোটা জল জমে গেলো। "এদিকে আয় বাবা", মা নড়েচড়ে উঠলো। রোগা শরীরে আওয়াজটা একদম ভাঙা ভাঙা শুনালো। পাশে গিয়ে বসলাম। মা চেয়ে আছে আমার মুখের দিকে। তারপর হঠাৎ চোখ সরু করে ভালো করে দেখতে লাগলো। আরও ভালো করে দেখার জন্য পাশে রাখা হারিকেন টা হাতে নিয়ে উঠে বসলো। ভালো করে ঠোঁট আর চোখ দেখার পর আমার পিঠ দেখার জন্য ওদিেক ঘুরালো। সাথে সাথেই আঁতকে উঠলো।
"আবারও, বাবা?"
হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম। আর কতক্ষণ আটকে রাখা যায়?
http://www.facebook.com/shadashidhe.jhuliwala
বিষয়: বিবিধ
১১৬১ বার পঠিত, ৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ধন্যবাদ আপনাকে।
মর্মস্পর্শীভাবে লিখেছেন যদিও চুরিকে কোন পর্যায়েই জায়েজ করা যায়না।
মন্তব্য করতে লগইন করুন