বর/কনে/শ্বশুর/শ্বাশুড়ির জন্য - ৩ (শেষ)
লিখেছেন লিখেছেন সূর্যের পাশে হারিকেন ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৩, ০৮:৩৬:৩০ রাত
(পর্ব-১) - (পর্ব-২)
প্রিয় ছাত্রটিকে আমি আরো বললাম, স্ত্রীকে বোঝানোর জন্য তার সন্তানকে সামনে আনতে হবে। অর্থাৎ তুমি তাকে বলবে, দেখো, জীবন কত গতিশীল! সবকিছু কত দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে! দু’দিন আগে আমরা শুধু যুবক-যুবতী ছিলাম, আজ হয়ে গেছি স্বামী-স্ত্রী। দু’দিন পরেই হয়ে যাবো মা-বাবা। আমি বাবা, তুমি মা! আল্লাহর কাছে একজন মায়ের মর্যাদা কত! তোমার কদমের নীচে হবে তোমার সন্তানের জান্নাত!
যেমন আমার মায়ের কদমের নীচে আমার জান্নাত। তো তোমার সন্তান কেমন হলে তুমি খুশী হবে? আমাকেও আমার মায়ের ঐরকম সন্তান হতে তুমি সাহায্য করো। আমি যদি ভুল করি, মায়ের কোন হক নষ্ট করি, মায়ের সামনে ‘উফ’ করি, তুমি আমাকে সাবধান করো, আমাকে সংশোধন করো। তাহলে ইনশাআল্লাহ তোমার সন্তানও তুমি যেমন চাও তেমন হবে।
প্রয়োজন হলে স্ত্রীকে মা-বাবার সামনে তিরস্কার করবে, তবে ঘরে এসে একটু আদর, একটু সোহাগ করে বোঝাতে হবে, কেন তুমি এটা করেছো?!
বোঝানোর এই তরযগুলো শিখতে হবে, আর এটা দু’একদিনের বিষয় নয়, সারা জীবনের বিষয়। কিন্তু আমরা ক’জন এভাবে ভারসাম্যপূর্ণ জীবন যাপন করি?! হয় মাতৃভক্তিতে স্ত্রীর প্রতি অবিচার করি, না হয়, স্ত্রীর ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে মা-বাবার দিলে আঘাত দেই, আর দুনিয়া-আখেরাত বরবাদ হয়। আমার একটা কথা মনে রেখো, মায়ের পক্ষ নিয়ে স্ত্রীর প্রতি অবিচার করা মূলত মায়ের প্রতি যুলুম, তদ্রূপ স্ত্রীর পক্ষ নিয়ে মায়ের হক নষ্ট করা আসলে স্ত্রীর প্রতি যুলুম। আমার একথার উৎস হলো,
أنصر أخاك ظالما أو مظلوما
অবশ্য সবকিছু হতে হবে হিকমত ও প্রজ্ঞার সঙ্গে।
একটি ঘটনা তোমাকে বলি, তোমার মত আলিমে দ্বীন নয়, সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত একজন মানুষ আমাকে বলেছেন, একবার তার মা তাকে বললেন, তোর বউ আজ তোর এত আপন হয়ে গেলো কীভাবে!
আমি বললাম, দেখো মা, তোমাকে আমি মা বলি; এই ‘মা’ ডাকটুকু পাওয়ার জন্য তোমাকে কত কষ্ট করতে হয়েছে! অথচ ‘পরের বাড়ীর মেয়েটি’র মুখ থেকে তুমি বিনা কষ্টে ‘মা’ ডাক শুনতে পাও! তোমাকে যে মা বলে ডাকে সে আমার আপন হবে না কেন মা?
আরেকটা ঘটনা, এক মা তার মেয়ের শাশুড়ী সম্পর্কে বললেন, মানুষ না, মেয়েটাকে আনতে পাঠালাম, দু’টো পিঠে বানিয়ে খাওয়াবো, দিলো না, ফেরত পাঠিয়ে দিলো!
দু’দিন আগে তিনিও একই কাজ করেছিলেন, ছেলের বউকে নিতে এসেছিলো মায়ের বাড়ী থেকে। তিনি বললেন, দু’দিন পরে আমার মেয়েরা আসবে এখন তুমি গেলে কীভাবে চলবে!
ভদ্রমহিলাকে বললাম, আপনার কাজটা কি ঠিক হয়েছিলো? আপনাকে কষ্ট দেয়া আমার উদ্দেশ্য নয়, সতর্ক করা উদ্দেশ্য। আল্লাহর কাছে যদি আটকা পড়েন তখন তো আপনিই বলবেন, তুমি তো হাদীছ-কোরআন পড়েছো, আমাকে সতর্ক করোনি কেন?
মোটকথা, মেয়েদেরকে তারবিয়াত করতে হবে যাতে তারা আদর্শ স্ত্রী, আদর্শ মা এবং আদর্শ শাশুড়ীরূপে আদর্শ জীবন যাপন করতে পারে। পুরুষ হচ্ছে কাওয়াম ও পরিচালক। সুতরাং তারবিয়াত ও পরিচালনা করা পুরুষেরই দায়িত্ব। স্ত্রী, মা ও শাশুড়ী, জীবনের এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ও কঠিন ধাপের জন্য ঘরে ঘরে আমরা যদি আমাদের মেয়েদের গড়ে তুলতে পারি, আদেশ দ্বারা, উপদেশ, সর্বোপরি নিজেদের আচরণ দ্বারা তাহলেই সংসার হতে পারে সুখের, শান্তির।
প্রিয় ছাত্রটিকে আরেকটি কথা বললাম, তোমার স্ত্রীর কোন আচরণ তোমার অপছন্দ হতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রথমে তোমাকে ভাবতে হবে, তোমার সব আচরণ কি সুন্দর, তোমার স্ত্রীর পছন্দের? তাছাড়া তোমার স্ত্রীর ভালো দিক কি কিছু নেই। সেই ভালো দিকগুলোর জন্য শোকর করো, আর যা তোমার কাছে মন্দ লাগে তার উপর ছবর করো। আর যদি সংশোধন করতে চাও তাহলে ভালো দিকগুলোর প্রশংসা করো, তারপর কোমল ভাষায় বলো, তোমার এই বিষয়টা যদি না থাকতো তাহলে তুমি আরো অনেক ভালো হতে। তবে আল্লাহর পেয়ারা হাবীব ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সেই প্রজ্ঞাপূর্ণ উপদেশ মনে রাখতে হবে, একটু বাঁকা থাকবেই, এই বক্রতা, সাহিত্যের ভাষায় যাকে বলে নায, আন্দায, মান, অভিমান, লাস্যতা, এই বক্রতা নারীর সৌন্দর্য, নারীর শক্তি। এটাকে সেভাবেই গ্রহণ করে তার সঙ্গে জীবন যাপন করতে হবে, পূর্ণ সোজা করতে চাইলে ভেঙ্গে যাবে, আর সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাবে।
সত্যি সত্যি যদি তোমার স্ত্রীর গুরুতর কোন ত্রুটি থাকে তবে সেটা সংশোধনের দায়িত্ব ও কর্তব্য অবশ্যই তোমার। তবে সেক্ষেত্রেও সংশোধনের জন্য অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে দিনের পর দিন চেষ্টা করে যেতে হবে। ধমক দিয়ে, জোর খাটিয়ে সংশোধন করা যায় না, ঘরে অশান্তি আনা যায়, ঘর ভাঙ্গা যায়, আর সন্তানদের জীবনে বিপর্যয় আনা যায়।
ইসলামপুরে আমার আববার দোকানের অপর দিকে এক ভদ্রলোকের দোকান ছিলো। অবস্থা ছিলো এই যে, দোকানে বসেই মদ খেতো। আববা তাকে দাওয়াত দিলেন, আর সে খুব দুর্ব্যবহার করলো, কিন্তু আববা ধৈর্যের সঙ্গে দাওয়াত চালিয়ে গেলেন। দু’বছর পর তিনি মসজিদমুখী হলেন এবং এমন মুবাল্লিগ হলেন যে, বউকে তালাক দেবেন। কারণ সে দ্বীনের উপর আসছে না।
আববা তাকে এভাবে বুঝালেন, ‘আমার সঙ্গে আপনার আচরণ কি মনে আছে? আমি যদি ধৈর্যহারা হয়ে আপনাকে ত্যাগ করতাম! এই পুরো কথাটা যেহেনে রেখে স্ত্রীকে তালিম করতে থাকেন। ছবর করেন, ছবর করলে আমার প্রতি আপনার যুলুম আল্লাহ মাফ করবেন। আল্লাহ যদি প্রশ্ন করেন আমার বান্দা তোমাকে আমার ঘরের দিকে ডেকেছে, তুমি তার প্রতি যুলুম করেছো কেন? তখন আপনি বলতে পারবেন, হে আল্লাহ, আমিও আপনার বান্দীর পিছনে ছবরের সঙ্গে মেহনত করেছি।’
সেই লোকের স্ত্রী কিন্তু পরবর্তী সময়ে পরদানশীন হয়েছিলো। অথচ জোশের তোড়ে লোকটা তো ঘরই ভেঙ্গে ফেলছিলো।
আসলে দোষ আমাদের। আমরা তারবিয়াত করার তরীকা শিখিনি। বোঝানোর তরয আয়ত্ত্ব করিনি।
প্রিয় ছাত্রটিকে আরো অনেক কথা বলেছিলাম, প্রায় দু’ঘণ্টা সময় তার জন্য ব্যয় করেছিলাম। সবকথা এখন মনেও নেই।
তবে একটা কথা তাকে বলা হয়নি, এখন তোমাদের মজলিসে বলি, স্ত্রীর সঙ্গে আচরণ কেমন হবে, এ সম্পর্কে একজনকে যা বলতে শুনেছিলাম, তা ছিল খুবই মর্মান্তিক। তিনি বলেছিলেন, ‘মেয়েলোক যেন তোমার মাথায় চড়ে না বসে, তাই প্রথম দিন থেকেই তাকে শাসনের মধ্যে রাখবা। পূর্ণ ইতা‘আত ও আনুগত্য আদায় করে নিবা, গোরবা কুশতান দর শবে আওয়াল।’
এ প্রবাদ এমনই বিশ্ববিশ্রুত যে, আমাদের নিরীহ বাংলাভাষায়ও বলে, ‘বাসর রাতেই বেড়াল মারতে হবে’। কিন্তু জীবনের সর্বক্ষেত্রের মত এক্ষেত্রেও আমাদের অনুসরণীয় হলো সুন্নাতে রাসুল, আর তিনি ইরশাদ করেছেন,
خيركم خيركم لأهله وأنا خيركم لأهلي
তো জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শরীয়তের সীমারেখায় থেকে স্ত্রীর সঙ্গে এমন আচরণই আমাকে করতে হবে, যাতে সে মনে করে, আমি সর্বোত্তম স্বামী, আমার মতো উত্তম স্বামী হয় না, হতে পারে না।
স্ত্রীগণের সঙ্গে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আচরণ কী ছিলো তা জানতে হবে এবং অনুসরণ করতে হবে। স্বামীর খেদমত করার মাধ্যমে স্ত্রী অনেক আজর ও ছাওয়াবের অধিকারিণী হতে পারে, এটা আলাদা কথা। তবে আমাকে মনে রাখতে হবে যে, এটা স্ত্রীর মহত্ত্ব, স্বামীর অধিকার নয়। তারা যদি কখনো মায়ের বাড়ী যেতে চায়, আমরা প্রশ্ন করি, ‘আমার খাওয়া-দাওয়ার কী হবে?’ অথচ এটা তার বিবেচনার বিষয় হতে পারে, আমার প্রশ্ন করার বিষয় নয়।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সামান্য কথা বলেই মজলিস শেষ করছি। সহবাস দাম্পত্য জীবনের একটি অপরিহার্য সত্য। এ বিষয়ে আলোচনাকে হায়া-শরমের খেলাফ মনে করা হয়। ফলে বিষয়টি অজ্ঞতার মধ্যে থেকে যায়। একারণে এমনকি অনেক সময় দাম্পত্য জীবন বিষাক্ত হয়ে পড়ে।
স্ত্রী তোমার সারা জীবনের সম্পদ এবং সেরা সম্পদ।
متاع মানে সম্পত্তি নয়, ভোগের বস্ত্ত নয় متاع মানে সম্পদ, ঐশ্বর্য। বিষয়টি বুঝতে না পেরে আধুনিক বুদ্ধিজীবীরা হাদীছের সমালোচনা করেন। আমরা হাদীছটির তরজমা ও ব্যাখ্যা এমন খন্ডিতভাবে করি যে, তারাও সুযোগ পেয়ে যায়।
তো স্ত্রী তোমার সম্পত্তি নয়, স্ত্রী হলো তোমার জীবনের সর্বোত্তম সম্পদ, যা যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে তোমাকে রাখতে হবে এবং ব্যবহার করতে হবে।
প্রথমেই বর্বর ও পাশবিকরূপে নিজেকে স্ত্রীর সামনে তুলে ধরা বিরাট মুর্খতা ছাড়া আর কিছু নয়। স্ত্রী স্বামীর ভোগের পাত্রী নয়, বরং স্বামী-স্ত্রী হলো পরস্পরকে উপভোগ করার জন্য। যত দিন লাগে, দীর্ঘ সাধনা করে প্রথমে হৃদয় জয় করো, মনের দুয়ার খোলো, অন্তরের গভীরে প্রবেশ করো।
যিন্দেগীর এই কঠিন মারহালা সম্পর্কে কত কিছু যে বলার আছে, কত কিছু যে শেখার আছে! দেখি, যদি আবার কখনো সুযোগ হয়।
দাম্পত্যজীবন সুখময় হওয়ার জন্য শুধু পুরুষের প্রচেষ্টা ও সচেতনতাই যথেষ্ট নয়, নারীরও সদিচ্ছা ও সচেতনতা অতি প্রয়োজন।
এ বিষয়ে তারও আছে অনেক দায়িত্ব। কিন্তু নারীর তালীম-তরবিয়তের ভারও তো পুরুষেরই উপর। বিয়ের আগে পিতামাতা তার তরবিয়ত করবেন, বিয়ের পর স্বামী। দাম্পত্যজীবনে নারীর দায়িত্ব কী কী, সেই সকল দায়িত্ব সম্পর্কে তাকে সচেতন করার পদ্ধতি কী এবং তার তালীম-তরবিয়ত কীভাবে করতে হবে-এটি আলাদা একটি বিষয়।
শেষ
এখানে - (দাম্পত্য জীবন বিষয়ক বই এর খুব ছোট্ট (সচিত্র) পর্যালোচনা) পোস্টে কিছু ভালোমানের বই এর নাম দেয়া আছে -ডাউনলোড লিংক সহ- যা (দাম্পত্য জীবনে সবধরনের সুখ, আনন্দকে তৃপ্তিসহকারে - কোনরকমের অস্বস্তি, আতঙ্ক ছাড়া - উপভোগ করার জন্য) প্রত্যেক মুসলিম ভাই/বোনদের স্টাডিকরা খুবই দরকার বলে মনে করি আমি।
আশা করি একটা বই হলেও পড়ে দেখবেন।
বিষয়: বিবিধ
৩৫৯৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন