কুরবানীর ফযীলত সংক্রান্ত হাদীস : একটি বিশ্লেষণ
লিখেছেন লিখেছেন পরবাসী ০২ অক্টোবর, ২০১৩, ০৫:৪০:০৭ বিকাল
কুরবানীর গুরুত্ব ও ফযীলত :
কুরবানী একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের অন্যতম মাধ্যম । এতে ইবরাহীম (আঃ) এর সুন্নাত আদায়ের সাথে সাথে আমাদের প্রিয় নাবী মুহাম্মাদ (সাঃ) এর সুন্নাতও পালন করা হয় । কেননা তিনি নিজে কুরবানী করেছেন । এমনকি কুরবানীর প্রতি গুরুত্ব আরোপ করতে গিয়ে বলেছেন :
“কুরবানী দেওয়ার সামর্থ্য থাকার পরও যে কুরবানী দেয় না সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটবর্তী না হয়” । (আহমাদ , ইবনু মাজাহ হা/৩১২৩ , সনদ হাসান ; দেখুন সহীহ ইবনু মাজাহ (আলবানী) হা/২৫৩২)
এ কারণেই ওলামায়ে দ্বীন বলেছেন , সামর্থ্যবান ব্যক্তির উপর কুরবানী দেওয়া ওয়াজিব । তাদের অন্যমত হলেন – ইমাম আবু হানীফা , ইমাম রাবীয়াহ , আওযাঈ , লাইছ প্রমূখ । মালেকী মাযহাবের কারো কারো মতেও ধনী শ্রেনীর উপর কুরবানী দেওয়া ওয়াজিব । ইমাম মালেক ও নাখঈ (রাহিঃ) থেকেও কেউ কেউ অনুরুপ বর্ণনা করেছেন । (আত-তালীকাতুর রাযিইয়াহ আলার রাওয়াতিন নাদিইয়াহ , ৩/১২৬ পৃঃ)
শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়া (রাহিঃ) এরও একই অভিমত । (নুযুমুল ফারায়েদ ওয়াক্তিনাসুল আওয়াবিদ মিম্মা ফী শারহি কিতাবাইতা – তাওহীদ ওয়া রিয়াযিছ ছালেহীন মিনাল ফাওয়াইদ , পৃঃ ৩৬ ; আশ-শারহুল মুমতি আলা যাদিল মুস্তকীন ৭/৫১৮ পৃঃ)
শায়খ আলবানী (রাহিঃ) ও এই মতের প্রবক্তা । শায়খ উছায়মীন (রাহিঃ) ও এই মতকেই শক্তিশালী বলেছেন । (আশ-শারহুল মুমতি ৭/৫১৯)
কুরবানীর ফযীলত সংক্রান্ত স্বতন্ত্র কোন সহীহ বা হাসান হাদীস নেই । তবে নিন্মে বর্ণিত হাদীস দ্বারা উল্লেখযোগ্য ফযীলত প্রমাণিত হয় । -
ইবনু আব্বাস (রাঃ) নাবী কারীম (সাঃ) থেকে বর্ণনা করেন , তিনি বলেন , যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশকের এই দিনগুলোর নেক আমলের চেয়ে অন্য কোন আমল আল্লাহর কাছে অধিক উত্তম নয় । সাহাবীগণ বললেন , হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ! আল্লাহর পথে জিহাদও কি নয় ? তিনি বললেন , না জিহাদও নয় । তবে ঐ ব্যক্তির কথা ভিন্ন , যে নিজের জান ও মাল নিয়ে (জিহাদের উদ্দেশ্যে) বেরিয়েছে এবং সে আর কিছুই নিয়ে ফিরে আসেনি । (বুখারী , জুমআ অধ্যায় , হা/৯১৬ ; আবু দাউদ , হা/২০৮২ ; তিরমিযী , হা/৬৮৮ ; ইবনু মাজাহ , হা/১৭১৭ ; আহমাদ হা/১৮৬৭ ।
যেহেতু কুরবানী করারও ১০ই যিলহজ্জ এর অন্যতম নেক আমল । কাজেই কুরবানীও উক্ত হাদীসের আওতাভুক্ত হওয়ায় তার গুরুত্ব ও ফযীলত প্রমাণিত হয় ।
কুরবানী উপলক্ষে যঈফ ও জাল হাদীসের ছড়াছড়ি :
কুরবানীর ফযীলত সম্পর্কে বর্ণিত কোন হাদীসই বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত নয় ; বরং এ সম্পর্কে বর্ণিত সবগুলো হাদীসই যঈফ ও জাল । তারপরও কুরবানীর সময় নিকটবর্তী হলে ব্যাপক আকারে এই হাদীসগুলোর ছড়াছড়ি দেখা যায় । ব্ক্তা , লেখক , প্রবন্ধকার সমানভাবে ঐ যঈফ ও জাল হাদীসগুলো চর্চা করেন । কেউ সেগুলি জুমআর খুৎবায় মধুর সুরে পাঠ করেন , কেউ তা নিজ প্রবন্ধে পরিবেশন করে প্রবন্ধের শ্রী বৃদ্ধি করেন । আবার কেউ বক্তৃতার মঞ্চে পাঠ করে মঞ্চ গরম করেন । আর কুরবানীর ঈদের খুৎবার সময় তো শতকরা ৯৫ ভাগ খত্বীবই ঐ হাদীসগুলিকে খুৎবার মূল পুঁজি হিসাবে গ্রহণ করে থাকেন । এর একমাত্র কারণ হ’ল চরম উদাসীনতা ও অজ্ঞতা । ইমাম মুসলিম (রাহিঃ) এর ভাষায় , “যারা যঈফ ও জাল হাদীস জেনে শুনে (সতর্কীকরণ ছাড়াই) বলে বেড়ান তারা আলেম উপাধী পাওয়ার চেয়ে জাহেল উপাধী পাওয়ার অধিক হক্কদার এবং তারা সাধারণ মুসলিম সমাজকে ধোঁকাদানকারী বলে গণ্য হবে” । (মুসলিম শরীফের ভূমিকা)
সতর্কীকরণ ছাড়া যঈফ ও জাল হাদীস বর্ণনা পরিণতি ভয়াবহ :
যঈফ ও জাল হাদীস বর্ণনা করার পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ । রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন ,
“যে ব্যক্তি এমন হাদীস বর্ণনা করে , যে সম্পর্কে তার ধারণা যে তা মিথ্যা হ’তে পারে , তবে সে মিথ্যুকদের দলভুক্ত বা মিথ্যুকদের একজন ।” (মুকাদ্দামা মুসলিম ১/৬২ পৃঃ ; তিরমিযী , হা/২৬৬২ ; ইবনু মাজাহ , মুকাদ্দামা , হা/৪১ ; ইবনু হিব্বান , হা/২৯)
তিনি আরো বলেন ,
“নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি আমার উপর মিথ্যারোপ করবে তার জন্য জাহান্নামে একটি ঘর নির্মাণ করা হবে” । (মুসনাদে আহমাদ , হা/৪৫১২ , ৫৫৩৬ , ৬০২৭)
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আরো বলেন ,
“যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে আমার উপর মিথ্যারোপ করবে সে যেন জাহান্নামে তার স্থান নির্ধারণ করে নেয় ।” (বুখারী , জানাযা অধ্যায় , হা/১২০৯ , আদব অধ্যায় , হা/৫৭২৯ , হা/৩২০২ ; মুসলিম ভূমিকা , হা/৪ , ৫ , উল্লেখ্য , হাদীসটি মুতাওয়াতীর সূত্রে বর্ণিত । দ্রঃ সহীহুল জামে হা/৬৫১৯)
আলী (রাঃ) বলেন , “হে জনগণ ! আপনারা লক্ষ্য করুন কার থেকে এই ইলম গ্রহণ করছেন ? কারণ এটা দ্বীনের বিষয় ।” (দ্রঃ ইবনে আদী , কামেল ১/১৫৬ পৃঃ , আল খত্বীব ফিল ক্বেফায়াহ , পৃঃ ১৪৯)
একথাটিই সাহাবীদের মধ্য হ’তে আবু হুরায়রা (রাঃ) ও আনাস বিন মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে । এছাড়াও অনুরুপ কথা বহু তাবেঈ থেকেও বর্ণিত হয়েছে । এজন্যই সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতেন । ইবনু আদী বলেন , রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর অনেক সাহাবী তাঁর নিকট থেকে হাদীস বর্ণনা করা হ’তে বিরত থাকতেন এ কারণে যে , না জানি শ্রুত বিষয়ে কম-বেশী হয়ে যায় । আর এটা এজন্যই করতেন যেন তারা নাবী কারীম (সাঃ) এর নিন্মোক্ত বাণীর অন্তর্ভুক্ত না হন । যেখানে তিনি বলেছেন , “যে ব্যক্তি জেনে বুঝে আমার উপরে মিথ্যারোপ করবে সে যেন তার স্থান জাহান্নামে নির্ধারণ করে নেয় ।” (বুখারী ও মুসলিম প্রভৃতি , দ্রঃ সহীহুল জামে , হা/৬৫১৯)
আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) বলেন , আমাকে রাসূল (সাঃ) থেকে অধিক হাদীস বর্ণনা করতে এটা বাধা দেয় যে , রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন , “যে ব্যক্তি জেনে বুঝে আমার উপর মিথ্যারোপ করবে , সে যেন তার স্থান জাহান্নামে নির্ধারণ করে নেয় ।” (মুসলিম , নাসাঈ , তিরমিযী , ইবনু মাজাহ প্রভৃতি)
আব্দুল্লাহ ইবনু যুবায়ের (রাঃ) কে বলা হ’ল , অনেকেই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর নিকট থেকে হাদীস বর্ণনা করছেন অথচ আপনি করছেন না কেন ? তিনি বললেন , হে আমার বৎস ! আল্লাহর কসম আমি যেদিন থেকে ইসলাম গ্রহণ করেছি সেদিন থেকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) থেকে পৃথক হইনি । আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে বলতে শুনেছি , “যে ব্যক্তি জেনে বুঝে আমার প্রতি মিথ্যারোপ করবে সে যেন স্বীয় স্থান জাহান্নামে নির্ধারণ করে নেয় ।” (আল কিফায়াহ , পৃঃ ১৩৫ এর বরাতে ফিৎনায়ে ওয়াযয়ে হাদীস আওর মওযু আহাদীস কি পেঁহচান , পৃঃ ৪০)
উল্লেখ্য , অনেকে মনে করেন ফযীলতের ক্ষেত্রে যঈফ হাদীস গ্রহণযোগ্য , তাদের এ ধারণা ঠিক নয় । বরং ফযীলত ও আহকাম সর্বক্ষেত্রেই যঈফ হাদীস বর্জনীয় ।এটাই হক্বপন্থী বিদ্বানগণের চুড়ান্ত ফায়সালা । আল্লাম জামালুদ্দীন ক্বাসেমী বলেন , ইমাম বুখারী , মুসলিম , ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন , ইবনুল আরাবী , ইবনু হাযম এবং ইবনু তাইমিয়াহ (রাহিঃ) প্রমূখ মনীষীগণ বলেছেন , ফযীলত কিংবা আহকাম কোন ক্ষেত্রেই যঈফ হাদীস আমলযোগ্য নয় । (ক্বাওয়ায়েদুত তাহদীছ , পৃঃ ৯৫)
বর্তমান যুগের শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দীস আল্লামা নাসিরুদ্দীন আলবানী (রাহিঃ) এই মতটিকেই সঠিক বলেছেন এবং এর বিপরীত মতটি বাতিল বলে গণ্য করেছেন । (সহীহ তারগীব ওয়া তারহীব (মাকতাবাতুল মাআরিফ) ভূমিকা , ১/২১-৪০ পৃঃ)
কুরবানীর ফযীলত সংক্রান্ত হাদীসগুলির পর্যালোচনা :
সহীহ বুখারীর ভাষ্যকার হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রাহিঃ) বলেন , কুরবানীর ফযীলত সম্পর্কে অনেকগুলো হাদীস বর্ণিত হয়েছে । তবে এর একটির সনদও বিশুদ্ধ নয় । বরং সবগুলোই যঈফ অথবা জাল । বিশিষ্ট মুহাদ্দিস ইমাম ইবনুল আরাবী বলেন ,
কুরবানীর ফযীলত সম্পর্কে কোন সহীহ হাদীস নেই । মানুষ এ সম্পর্কে অনেক আজগুবী কথা বর্ণনা করছে , যা মোটেও সহীহ নয় । (আরেযাতুল আহওয়ারী , ৬/২৮৮ পৃঃ)
নিম্নে কুরবানীর ফযীলত সম্পর্কিত সমাজে প্রচলিত কতিপয় জাল ও যঈফ হাদীস পাঠকদের উদ্দেশ্যে উপস্থাপন করা হ’ল :
(১) . আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত , রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন , ‘কুরবানীর দিনে কোন বান্দা কুরবানীর পশুর রক্ত ঝরানোর চেয়ে আল্লাহর নিকট অধিক পছন্দনীয় কোন আমল করে না । সে ক্বিয়ামত দিবসে উক্ত পশুর শিং , খুর , লোম প্রভৃতি নিয়ে উপস্থিত হবে এবং তার রক্ত জমীনে পড়ার পূর্বেই আল্লাহর নির্ধারিত মর্যাদার স্থানে পতিত হয় । অতএব তোমরা প্রফুল্ল চিত্তে কুরবানী কর’ । (ইবনু মাজাহ , হা/৩১২৬ ; তিরমিযী , হা/১৪৯৩ ; হাকেম ৪/২২১-২২২ পৃঃ দ্রঃ , ফিক্বহুল উযহিয়্যাহ , পৃঃ ৯)
হাদীসটি যঈফ । এর সনদে কয়েকটি ত্রুটি রয়েছে –
১ – উক্ত হাদীসের সনদে আব্দুল্লাহ ইবনু নাফে’ নামক একজন রাবী রয়েছে , যার স্মৃতিশক্তি দূর্বল ।
২ – আবুল মুছান্না নামক জনৈক রাবী রয়েছে । তার আসল নাম হ’ল সুলাইমান ইবনু ইয়াযীদ । সে অত্যন্ত দূর্বল । (ফিক্বহুল উযহিয়্যা , পৃঃ ৯)
উল্লেখ্য , উক্ত হাদীসের প্রায় অনুরুপ হাদীস আব্দুর রাযযাক তার ‘মুছান্নাফ’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন (হা/৮১৬৭) । এর সনদেও আবু সাঈদ শামী নামক জনৈক রাবী রয়েছে । সে একজন পরিত্যক্ত রাবী ।(ফিক্বহুল উযহিয়্যা , পৃঃ ৯)
(২) . যায়েদ ইবনু আরক্বাম (রাঃ) হ’তে বর্ণিত , তিনি বলেন , সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন , হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ! এই কুরবানীর তাৎপর্য কি ? (কেন এটা আমরা যবেহ করে থাকি?) তিনি বললেন , এটা তোমাদের পিতা ইবরাহীম (আঃ) এর সুন্নাত । তারা জিজ্ঞেস করলেন , এতে আমাদের কি সওয়াব রয়েছে ? তিনি বললেন , প্রত্যেকটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকী রয়েছে । তারা আবার জিজ্ঞেস করলেন , লোমের মধ্যে যে ছোট ছোট লোম রয়েছে সেগুলোর বিনিময় কি ? তিনি বললেন , হ্যাঁ ঐ সমস্ত ছোট ছোট লোমের এক একটির বিনিময়ে একটি করে নেকী রয়েছে । (ইবনু মাজাহ , হা/৩১২৭ ; আহমাদ ৪/৩৬৮ ; ইবনু হিব্বান ফিল মাজরুহীন ৩/৫৫ পৃঃ)
হাদীসটি যঈফ । এর সনদে আবু দাউদ আল আম্মী রয়েছে । তার নাম হ’ল নুফাই ইবনুল হারিছ । সে একজন পরিত্যক্ত রাবী । এত আরো একজন রাবঈ রয়েছে তার নাম হ’ল । আয়েযুল্লাহ । সেও দূর্বল রাবী ।
(৩) . আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত , তিনি বলেন , রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ফাতেমা (রাঃ) কে বললেন , ‘তুমি তোমার কুরবানীর পশুর নিকটে (যবেহকালীন) দাঁড়াও এবং উপস্থিত থাক । কারণ তার প্রথম ফোঁটা রক্ত (যমীনে) পড়ার সাথে সাথে তোমার অতীতের সকল গুণাহ মাফ করে দেয়া হবে । ফাতেমা (রাঃ) বললেন , তে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ! এটা কি আমাদের নাবী পরিবারের জন্যই খাছ , নাকি আম ভাবে আমাদের ও সকল মুসলিমের জন্য ? তিনি বললেন , আমাদের জন্য এবং সকল মুসলিমের জন্য ।’ (হাকেম , ৪/২২২ পৃঃ , বাযযার ২/৫৯ পৃঃ)
হাদীসটি যঈফ । এর সনদে আব্দুল হামীদ নামক একজন রাবী রয়েছে , সে যঈফ । এতে আত্বিইয়া আল-আওফী নামক আরো একজন রাবী রয়েছে সেও যঈফ এবং মুদাল্লিস । আবু হাতীম তার ‘ইলাল’ গ্রন্থে (হা/৩৮) বলেন , এটি একটি মুনকার বা অগ্রহণযোগ্য হাদীস । (ফিক্বহুল উযহিয়্যাহ , ১০ পৃঃ)
(৪) . আলী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত , তিনি বলেন , রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন , ‘হে ফাতেমা ! তুমি তোমার কুরবানীর পশুর নিকট উপস্থিত হও । জেনে রেখ , ঐ পশুর প্রথম ফোঁটা রক্ত পড়ার সাথে সাথে তোমার গুণাহ বিমোচিত হবে । জেনে রেখ ! কুরবানীর ঐ পশুগুলোকে তার রক্ত , মাংস সমেত সত্তরগুণ করে ক্বিয়ামত দিবসে নিয়ে আসা হবে এবং তোমার দাঁড়িপাল্লায় তা রাখা হবে’ । (বায়হাক্বী ৯/২৮৩ পৃঃ ; আবদ ইবনু হুমাইদ ৭/৮ পৃঃ)
এ হাদীসের সনদে আমর ইবনু খালিদ ওয়াসেত্বী রয়েছে । সে একজন পরিত্যক্ত রাবী । এছাড়া হাদীসটি ইমাম আব্দুর রাযযাক যুহরী মুরসাল হিসেবে বর্ণনা করেছেন । এর সনদে আব্দুল্লাহ ইবনু মুহাররার নামক একজন রাবী রয়েছে । সে অত্যন্ত যঈফ । হাদীসটি ইমরান ইবনু হুছাইন হ’তেও বায়হাক্বী (৯/২৮৩) , ও হাকিম (৪/২২২) এবং তাবারাণী (১৮/২৩৯) প্রমুখ তাদের স্ব স্ব কিতাবে বর্ণনা করেছেন । এছাড়া ইমাম তায়ালিসী (মুসনাদ তায়ালিসী , হা/২৫৩০) ও ইবনু আদী (৭/২৪৯২) বর্ণনা করেছেন । তবে এর সনদেরও নাযর ইবনু ইসমাঈল ও আবু হামযাহ শেমালী নামে দু’জন যঈফ রাবী রয়েছে ।
(৫) . আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত , তিনি নাবী করীম (সাঃ) থেকে বর্ণনা করেন , (তিনি বলেন) হে জনগণ ! তোমরা কুরবানী কর এবং তার রক্তকে সওয়াব লাভের মাধ্যম মনে কর । নিশ্চয়ই এর রক্ত যমীনে পতিত হ’লে তা আল্লাহর হেফাযতে চলে যায়’ । (আবু দাউদ , তায়ালিসী , হা/৮৩১৫)
হাদীসটির সনদে সূসা ইবনু যাকারিয়া এবং আমর ইবনু হুসাইন রয়েছে । তারা উভয়ই পরিত্যক্ত ।
(৬) . ইবনু আব্বাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত , তিনি বলেন , রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন , ‘চাঁদি যেসব ক্ষেত্রে খরচ করা হয় তার মধ্যে আল্লাহর নিকট বেশী প্রিয় হ’ল কুরবানী , যা ঈদের দিনে যবেহ করা হয় ।’ (তাবারানী ১১/১৭ পৃঃ ; দারাকুতনী ৪/২৮২ পৃঃ)
হাদীসটির সনদে ইবরাহীম ইবনু ইয়াযীদ আল খুযী নামক একজন পরিত্যক্ত রাবী রয়েছে ।
(৭) . হুসাইন ইবনু আলী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত , তিনি বলেন , রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন , ‘যে ব্যক্তি কুরবানীর পশুকে খুশী মনে ও নেকীর আশায় যবেহ করবে তার এই কুরবানীর পশু জাহান্নাম থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পর্দা স্বরুপ হয়ে যাবে ।’ (তাবারানী ৩/৮৪ পৃঃ)
এই হাদীসটি মওযু বা বানাওয়াট হাদীস । এর সনদে আবু দাউদ নাখঈ (সুলায়মান বিন আমর) নামক একজন মিথ্যুক রাবী রয়েছে ।
(৮) . আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত , তিনি বলেন , রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কুরবানীর দিন বলেছেন , ‘কোন আদম সন্তান এই দিনে (পশুর) খুন প্রবাহিত করার চেয়ে অধিক সৎ আমল করে না । তবে ছিন্ন আত্মীয়তার সম্পর্ককে আবার অবিচ্ছিন্ন করার কথা স্বতন্ত্র ।’ (তাবারানী ১১/৩২ পৃঃ)
হাদীসটি যঈফ । এর সনদে হাসান ইবনু ইয়াহইয়া আল খোশানী রয়েছে । তিনি সত্যবাদী তবে অধিক হারে ভুলকারী । আরো রয়েছে লাইছ ইবনু আবী সুলাইম । সে একজন যঈফ রাবী । এতে ইসমাঈল ইবনু আইয়্যাশ নামক অপর একজন রাবী রয়েছে , সে এক প্রকার যঈফ । আর এখানে তাই ঘটেছে । হাদীসটি ইবনু আব্দুল বার্র ‘ইস্তিযকার’ (৫/১৬৪ পৃঃ) ও ‘তামহীদ’ (২৩/১৯২পৃঃ) গ্রন্থে ইবনু আব্বাসের সূত্রে এনেছেন এবং তিনি গারীব বা অপরিচিত হাদীস বলেছেন । এর সনদে সাঈদ ইবনু যায়দ নামক একজন যঈফ রাবী রয়েছে । সে ইমাম মালিক হ’তে মুনকার বা অগ্রহণীয় অনেক কিছু বর্ণনা করেছে । (ফিক্বহুল উযহিয়্যাহ , পৃঃ ১১)
(৯) . আবু হুরায়রা (রাঃ) নাবী করীম (সাঃ) হ’তে বর্ণনা করেন , তিনি বলেন , ‘তোমরা তোমাদের কুরবানীর পশু শুক্তিশালী , মোটা-তাজা দেখে চয়ন কর । কারণ এগুলো তোমাদের পুলসিরাতের উপর চড়ে যাওয়ার বাহন হবে ।’ (মুসনাদুল ফিরদাউস ১/৮৫ পৃঃ)
হাদীসটি অত্যন্ত যঈফ । হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রঃ) ‘তালখীছুল হাবীরে’ (৪/১৩৮ পৃঃ) বলেন , এর সনদে বর্ণিত ইয়াহইয়া অত্যন্ত যঈফ । হাদীসটিকে আল্লামা নাসিরুদ্দীন আলবানীও যঈফ বলেছেন । (যঈফুল জামে’ হা/৯২৪)
(১০) . আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত , রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন , আমাকে কুরবানীর দিনকে ঈদ হিসাবে গ্রহণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে । এটা আল্লাহ এই উম্মাতের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন । এক ব্যক্তি বলল , এ ব্যাপারে আপনার কি মত , আমি যদি একমাত্র দানকৃত দুধাল ছাগল ছাড়া আর কিছু না পাই , তবে কি আমি ওটাই যবেহ (কুরবানী) করব ? নবী করীম (সাঃ) বললেন , না বরং তুমি তোমার চুল , নখ , গোঁফ ও নিম্নভাগের লোম কাটবে , এটাই আল্লাহর দরবারে তোমার পূর্ণাঙ্গ কুরবানী বলে গণ্য হবে ।’ (আবু দাউদ ‘কুরবানী’ অধ্যায় , হা/২৭৮৮ ; নাসাঈ ‘কুরবানী’ অধ্যায় হা/৪২৮৯ ; হাকেম (বৈরুত) ৪/২২৩ পৃঃ)
হাদীসটি যঈফ । (যঈফ আবু দাউদ হা/৫৯৫ ; যঈফ নাসাঈ হা/২৯৪) এর সনদে ঈসা বিন হেলাল নামক একজন অজ্ঞাত রাবী রয়েছে । ইবনু হিব্বান ব্যতীত তাকে অন্য কেউ নির্ভরযোগ্য বলেননি । উল্লেখ্য , ইবনু হিব্বান যে রাবীর পক্ষে বা বিপক্ষে হাদীস বিশারদগণের কোন আলোচনা না পান তাকে তিনি নির্ভরযোগ্য বলে রায় দেন । অথচ তার এই অনুসৃত আজব তরীকার কঠোর সমালোচনা করেছেন অন্যান্য হাদীস বিশারদগণ । তাদের অন্যতম হ’লেন ইমাম যাহাবী হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী এবং আল্লামা নাসিরুদ্দীন আলবানী (রাহিঃ) । (দ্রঃ লিসানুল মীযান লিল হাফেয , তামামুল মিন্নাহ , পৃঃ ২০-২৫ প্রভৃতি)
(১১) . আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত , তিনি বলেন , হে লোক সকল ! আপনারা কুরবানী করুন এবং তা খুশী মনে করুন । কারণ আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে বলতে শুনেছি , ‘যদি কোন ব্যক্তি তার কুরবানীর পশু সহ কিবলামুখী হয় (এবং যবেহ করে) তাহ’লে তার রক্ত , শিং এবং লোম নেকীতে পরিণত হবে , যা ক্বিয়ামত দিবসে তার দাঁড়িপাল্লায় উপস্থিত করা হবে । কুরবানীর পশুর খুন যদিও মাটিতে পড়ে কিন্তু প্রকৃত অর্থে আল্লাহর হিফাযতে পড়ে । তিনিই এর প্রতিদান তাকে ক্বিয়ামত দিবসে প্রদান করবেন’ (কিতাবুত তামহীদ – এর বরাতে তাফসীরুল কুরতুবী) । উক্ত হাদীসটির সূত্রও যঈফ ।
(১২) .ইবনু আব্বাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত , তিনি বলেন , নাবী কারীম (সাঃ) এরশাদ করেছেন , ‘আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্র ব্যতীত এমন কোন খরচ নেই যা আল্লাহর নিকট কুরবানীর পশুর খুন ঝরানোর চেয়ে উত্তম হ’তে পারে’ (তাফসীরে কুরতুবী দ্রঃ) ।
আবু ওমর ইবনু আব্দুল বার্র বলেন , এটা ইমাম মালিকের সূত্রে বর্ণিত একটি গরীব হাদীস (প্রগুক্ত দ্রঃ) । এখানে গরীব বলতে অপরিচিত হাদীস উদ্দেশ্য ।
(১৩) . হানাশ (রাঃ) বলেন , একদা আমি আলী (রাঃ) কে দু’টি দুম্বা কুরবানী করতে দেখে জিজ্ঞেস করলাম এমনটা কেন ? উত্তরে তিনি বললেন , রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাকে অসিয়ত করেছেন যে , আমি যেন তার পক্ষ থেকে কুরবানী করি । তাই আমি তাঁর পক্ষ থেকে কুরবানী করছি । (আবু দাউদ , তিরমিযী , মিশকাত হা/১৬৪২)
বর্ণনাটি যঈফ । এর সনদে শারীক নামক দুর্বল রাবী রয়েছে । তার উস্তায আবুল হাসালাও অপরিচিত । (আলবানী , তাহক্বীক্ব মিশকাত হা/১৬৪২ এর টিকা দ্রঃ ; যঈফ আবু দাউদ হা/২৭৯০ ; যঈফ তিরমিযী হা/২৫৫)
কুরবানীর ফযীলত সংক্রান্ত উপরোক্ত হাদীস সমূহ যঈফ বা জাল হ’লেও কুরবানীর গুরুত্ব নিঃসন্দেহে অপরিসীম । পবিত্র কুরএনর বর্ণনা ও সহীহ হাদীসের বিবরণ অনুযায়ী সামর্থ্যবান সকল মুমিনের জন্য কুরবানী করা আবশ্যক । এর মাধ্যমেই বান্দার আত্মত্যাগের অনুপম দৃষ্টান্ত পরিস্ফুট হয়ে ওঠে । পশু কুরবানীর পাশাপাশি মানব জীবনের যাবতীয় পাপাচার যুলম-নির্যাতন ও পাশবিকতাকে কুরবানী করতে পারলেই আমাদের এই কুরবানী সার্থক হবে । আল্লাহ আমাদের সকলকে সকলকে কুরআন ও সহীহ হাদীসের উপর আমল করার তাওফীক্ব দান করুন । আমীন !
বিষয়: বিবিধ
১৭৭১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন