সাংবাদিক কম হলে গৃহ পালিত রওশনের সুবিধা!

লিখেছেন লিখেছেন অরণ্যে রোদন ১৪ জানুয়ারি, ২০১৬, ০৪:২০:৪১ বিকাল

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘এরশাদ’ চরিত্রটি একটি ‘কমিক’ চরিত্র। এমনই ‘কমিক’ যে, এই চরিত্রের আগে ‘রওশন’ বা ‘বিদিশা’ যা-ই যুক্ত হোক না কেন সেটাও কমেডিতে পরিণত হয়। তাতে রওশন বা বিদিশার কোনো দোষ থাকে না, দোষ বোধহয় ওই ‘এরশাদ’ চরিত্রের। অনেকটা ‘যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবন’ টাইপ।

গণতন্ত্রে উত্তোরণের গত আড়াই দশকে এই এরশাদ চরিত্রকে বিভিন্নভাবে লাই দিয়ে কাঁধে তুলেছে বড় দুই রাজনৈতিক দল। তবে সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে আরেকটু লাই দিয়ে এই চরিত্রকে মাথায় তুলে নেয়া হয়েছে। আর একটি বিশেষ প্রজাতির প্রাণী মাথায় উঠলে যা হয়, তারও হয়েছে সেই রোগ। রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই, এটা এই দেশে ব্যবহারিক সত্য। শুধু শেষ কথা নয়, এদেশের রাজনীতিতে আসলে নীতি বলেও কিছু নেই। উদাহরণের জন্য আরেকটি ‘এরশাদ’ চরিত্রের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এরশাদ শিকদারের মতো কুখ্যাত ও ঘৃণিত সিরিয়াল কিলারও এই দেশের বড় দু’দলের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে রাজনীতি করেছেন, দলের পতাকা নিয়ে কমিশনারও হয়েছেন! এদেশে এটা সম্ভব!!

এবার মূল এরশাদের কথা বলি। সারা জীবন ‘স্বৈরাচার-স্বৈরাচার’ জিগির তোলা হয়েছে যার বিরুদ্ধে তিনি এখন হয়েছেন বিশেষ দূত। তিনি কীসের দূতিয়ালি করেন বা এ পর্যন্ত করেছেন তা অবশ্য আমরা এখনও জানতে পারিনি। অন্যদিকে তৈরী করা হয়েছে একটা ‘ভজঘট’ বিরোধীদল। এই বিরোধীদল তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে বিভ্রান্ত-উদভ্রান্ত-দিকভ্রান্ত। বিরোধীদল হিসেবে কীসের বিরোধিতা করবে, কার বিরোধিতা করবে, কেন বিরোধিতা করবে এর কিছুই তারা জানে না। বিরোধীদলের চরিত্র অনুযায়ী মাঠে ময়দানে মিছিল-মিটিং বা সমাবেশ করতে হচ্ছে না আবার ওদিকে বিরোধিতার কোনো মুখও তাদের নেই। এই কর্মহীনতার প্রভাব পড়েছে তাদের আচরণ আর কথাবার্তার মধ্যে। তারা ‘ধরাকে সরা জ্ঞান’ করেন। সকালে যা বলেন, বিকালে তা অবলীলায় অস্বীকার করেন।

এদেশের রাজনীতিবিদদের বাকপ্রণালি নিয়ে আগেও কথা হয়েছে, এখনও হচ্ছে, সামনেও হয়তো হবে। তাদের অনেকেই নিরাময়ের অযোগ্য অদ্ভুত এক বাক-অসুখে ভোগেন। তাদের মুখ থেকেও এমন কথা শোনা যায় যার চর্চা ভদ্রজন উপেক্ষিত বস্তি সমাজেও হয় কী-না সন্দেহ রয়েছে। চূড়ান্ত রকমের অপ্রয়োজনীয় কথাও বলেন মাঝে মাঝে। এরশাদ চরিত্রের ভগ্নাংশ রওশন এরশাদ এবার অনেকটা গায়ে পড়েই সাংবাদিকদের নিয়ে মন্তব্য করলেন। তার ক্ষোভের জায়গাটা হল, সাংবাদিকরা তাকে বার বার মনে করিয়ে দেন তিনি বিরোধীদলীয় নেতা! অথচ এটা ভুলে থাকতে পারলেই তিনি যেন বাঁচেন। যার নুন খান তার গুণ গাইতে গেলেই সাংবাদিকরা বাগড়া দেয়। তাই সীমাহীন যোগ্যতার অধিকারী আমাদের এই বিরোধীদলীয় নেতা সাংবাদিকদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না থাকায় দেশে এত সাংবাদিক, এত ইলেকট্রনিক মিডিয়া। আমি গুণে গুণে দেখেছি, দেশে ৪০টি ইলেকট্রনিক মিডিয়া, যেখানে ১০টি হলেই যথেষ্ট ছিল। যেহেতু আমাদের কর্মসংস্থান নেই, তাই এই দশা। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা থাকলে সাংবাদিকরা এই পেশায় আসতো না।’ অন্যদিকে এই বাক-অসুখ এরশাদেরও আছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকেও তিনি ‘শোপিস’ বানাতে কসুর করেন না! তিনি বলেন, আমরা কথায় কথায় বলি, আমাদের প্রধানমন্ত্রী নারী, স্পিকার নারী, সংসদ উপনেতা নারী, বিরোধীদলীয় নেত্রী নারী, কিন্তু এরা শোপিস।’

রওশন এরশাদ কোন্ যোগ্যতার সিঁড়ি মাড়িয়ে বিরোধীদলীয় নেতা হয়েছেন, সেটা তিনি একবারও ভেবে দেখেননি। ভাবলে তিনি সাংবাদিকদের ব্যাপারে এই প্রশ্ন তুলতে পারতেন না। রাজনৈতিক ‘কূটচালে’র ফাঁক গলিয়ে বিরোধীদলীয় নেতা হলে এমনই হয়। এরশাদ অসুস্থ হলে রওশন এরশাদ বিরোধীদলীয় নেতারূপে আবির্ভূত হয়ে বলেছিলেন, তিনি এরশাদের পরামর্শেই সব করছেন। তারপর থেকে এরশাদ পূর্ব বললে তিনি পশ্চিম বলেন। এমন গোঁজামিলে চলছে বর্তমান সংসদের বিরোধীদল। এরশাদ যখন বলেন, দেশে গণতন্ত্র নেই তখন রওশন এরশাদ গণতন্ত্রের জোয়ার দেখতে পান! সাংবাদিকের সংখ্যা নিয়ে তার গাত্রদাহের কারণটা কী পরিস্কার নয়। তবে শানে নযুলটা বুঝতে মোটেই বেগ পেতে হয় না। আর সেটা হলো, ৪০ টি ইলেকট্রনিক মিডিয়ার জায়গায় ১০ টি হলে তাকে সংবাদ সম্মেলনে আরও ৩০ টি প্রশ্নের উত্তর কম দিতে হতো, যেটা এখন তিনি চাইলেও পারছেন না!

সাংবাদিকদের নিয়ে রওশন এরশাদ-ই প্রথম বলেন নি, আবার এটাই হয়তো শেষ বলা নয়। বিরোধীতার এই আকালে সাংবাদিকরাই সামান্য বিরুদ্ধবাদী। এইটুকুও মোড়লদের সইছে না! মরহুম সমাজকল্যাণমন্ত্রীর অকল্যানকর বাক-অসুখের কথা সর্বজনবিদিত। মন্ত্রী মহোদয় তার শব্দ উচ্চারণের স্বাভাবিক ভদ্রতার সকল সীমা উপেক্ষা করে সাংবাদিকদের ‘খবিশ’ ও ‘চরিত্রহীন’ বলেই থামেননি বরং এরপর যা বলেছেন তা আমি লিখলেও সম্পাদক ছাপতে পারবেন না! অথচ এটা তিনি বলেছেন প্রকাশ্য জনসভায়। তিনি সভা-সেমিনারকে নিজের আড্ডাস্থল ভাবতেন আর এটা নিয়ে সাংবাদিকরা কথা বললেই সেটা হতো ‘মহা অন্যায়’।

শামিম ওসমান নামে আমাদের রাজনীতির আরেক মোড়ল আছেন যিনি সাংবাদিকদের ‘কুকুর’ আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘সাংবাদিকরা হচ্ছে কুকুর। আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন পাড়ার অনেকে পয়সা হলে বাড়িতে কুকুর পুষত। ওদের বাড়ির সামনে গেলে কুকুরগুলো মুখ ভেংচাত। এরপর যাদের আরও পয়সা হলো, তারা মিডিয়া পোষা শুরু করল। এগুলো হলো অ্যালসেশিয়ান কুকুর। প্রশিক্ষিত।’ এ দেশের রাজনৈতিক চরিত্র অনুযায়ী ঘড়ির কাঁটা ঘুরতেই অবশ্য অস্বীকার করে বসলেন সেটা! যাক, ভাগ্যিস সাংবাদিকদেরকে তিনি রাস্তার কুকুর বলেননি, বলেছেন পোষা কুকুর। আহসান হাবিবের ‘ধন্যবাদ’ কবিতার কথা মনে পড়ে। কত আয়োজন ‘ডলি’র জন্য। এদেশের রাজনৈতিক স্যারদের রাজত্বে আমরা যদি ডলিদের মতোও থাকতে পারি তাহলে সেটাই বা কম কীসে! জার্মান দার্শনিক আর্থার শোপেনহাওয়ারও বলেছেন, ‘সাংবাদিকরা হল কুকুরের মতো, কোথাও একটু নড়চড় হলেই তারা ঘেউ ঘেউ করে ওঠে।’ এই সময়ের বঙ্গ রাজনীতির দার্শনিক শামিম ওসমান সেটার পুনরাবৃত্তি করে সাংবাদিকদেরকে তাদের কর্তব্যের কথা মনে করিয়ে দিলেন। সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে এজন্য তাকে ধন্যবাদ দেয়া উচিৎ। আমি মনে করি, এদেশে এমন আরো বেশি সংখ্যক কুকুর দরকার।

রাজা-রাজড়ারা সাংবাদিকদের এমনভাবে বলবেন এটা আশ্চার্যের কিছু নয় বরং স্বাভাবিক। কিন্তু সপ্তম আশ্চর্যের চেয়েও ভয়ংকর আশ্চর্য, হল, সাংবাদিকরা এসবের প্রতিবাদ করেন না! সাংবাদিকদের এত এত সংগঠন, মাঝে মাঝে নাম বিভ্রাটে পড়তে হয়। কিন্তু তারা কেউেই নিদেনপক্ষে একটা বিবৃতি দেয়ার তাগিদও বোধ করেননি। এদেশে রাজনীতির যে ছোবল তার বিষ ছড়িয়ে গেছে সবখানে। সব সংগঠন, সব পেশা, সব শ্রেণী-ই হয় অমুকের না হয় তমুকের; কেউ নিজেদের নয়। সাংবাদিকদের মধ্যে অনেকেই তরুন বুদ্ধিজীবী, কেউ মাঝবয়সী বুদ্ধিজীবী, কেউবা প্রবীণ বুদ্ধিজীবী। তারা টকশোতে যান, কাগজে লিখেন, সেমিনারে বক্তব্য দেন সেটা শুধুমাত্র নিজের আখেরাত গোছানোর জন্য আর লেজুড়বৃত্তির দলীয় রাজনীতি স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে।

রওশন এরশাদ দেশে কর্মসংস্থানের অভাবের কথা বলেছেন। আসলে বাংলাদেশে যেটার অভাব সবচেয়ে বেশি সেটা হল মেরুদন্ড, আর যেটার অভাব নেই সেটা হল ভাঁড়। সব শ্রেণীর মোড়লরা তাদের মেরুদণ্ড বন্ধক রেখেছেন। তাই সাংবাদিকদের অপমানে এই শ্রেণীর মোড়লরা অপমানিত হন না, প্রতিবাদ করেন না। শিক্ষকদেরকে অপমান করা হলে এই শ্রেণীর মোড়লরা চট করে রাজনৈতিক চশমাটা চোখে লাগান। নিজের সহকর্মীর আন্দোলনের অযৌক্তিকতা খোঁজেন। এমনিভাবে আইনজীবী, ডাক্তার, ব্যবসায়ী সবাই্ এক কাতারে শামিল হয়েছেন।

আমাদের সব শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রীহীনতা এবং দললেহন মানসিকতা এখন চরম অবস্থায় পৌঁছেছে। বুদ্ধিজীবী হলেও তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক চৈতন্যের সততা এখন মৃত। তারা একশ বনাম একহাজারে ভাগ হয়েছেন বেশ আগেই। মিডিয়ায় যেসব বুদ্ধিজীবীকে আমরা অহরহ দেখি তাদের বেশিরভাগই এখন জিন্দা লাশ। তাই এখানেই শেষ নয়, দলদাস মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে সামনে সব শ্রেণীর জন্যই আরো খারাপ দিন অপেক্ষা করছে। যেখানে চৈতন্য ঘুমিয়ে পড়ে সেখানে অনাচার জেগে উঠে। আর সেখানেই হাজির হন রওশন এরশাদের মতো রাজনীতিবিদরা, প্রদর্শন করেন তাদের বাক্-প্রতিভা।

সাইদ রহমান

বিষয়: বিবিধ

১৩০১ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

356944
১৪ জানুয়ারি ২০১৬ রাত ১০:২৯
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : সাংবাদিক রাই এই চরিত্রহীন দের উপরে তুলে আর তার ফল ভোগ করে।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File