জেকব, একাত্তর ও ইসরায়েল
লিখেছেন লিখেছেন অরণ্যে রোদন ১৪ জানুয়ারি, ২০১৬, ০১:৫৪:০৯ রাত
লে. জেনারেল জেকব আজ মারা গেছেন। তার বিদেহি আত্মার শান্তি কামনা করছি।
বাংলাদেশের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র তিনি। কিন্তু বাংলাদেশে তিনি আজও প্রকৃত প্রস্তাবে মনোযোগের সংগে আলোচিত নন। কেবল কিছু মুখস্থ কথা শোনানো হয় তাঁর সম্পর্কে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জেকবের ভূমিকা বুঝতে হলে একাত্তর সালের ওই যুদ্ধে ইসরায়েলের ভূমিকাকে গভীরভাবে বোঝা দরকার।
এ নিয়ে বাংলাদেশে ইতোমধ্যে কিছু কিছু লেখা হয়েছে- তবে বহির্বিশ্বে অনেক হয়েছে। সেসব আলোচনার সারমর্ম, এক লাইনে বললে, একাত্তরের যুদ্ধটি পূর্ববাংলার মানুষের কাছে স্বাধীনতা ও মুক্তির যুদ্ধ হলেও ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে তা ছিল ভিন্নভিন্ন স্বার্থমন্ডিত। এর মধ্যে ইসরায়েলের কাছে এটা ছিল মুসলমান অধ্যুষিত বৃহত্তম এক দেশকে দ্বিখন্ডিত করার যুদ্ধ। ফলে ‘মোসাদ’ যুদ্ধের বহু বহু আগে থেকে নানানভাবে পরিস্থিতিতে যুক্ত ছিল।
জেকব নিজে ছিলেন একজন ইহুদি। বাংলাদেশে অনেক ইতিহাসবিদেরই এটা চোখ এড়িয়ে যায় যে, পাকিস্তানকে দ্বিখন্ডিত করতে বিশেষ সফলতার প্রতীক হিসেবে ইসরায়েল তার সামরিক যাদুঘর ‘Latrum’-এ জেকবের সামরিক পোশাকটি বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে সংরক্ষণ করছে আজো।
এও উল্লেখ্য, জেকবকেই ভারত-ইসরায়েল সম্পর্কের প্রধান স্থপতি হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং প্রধানত তার ভূমিকার মধ্য দিয়েই ১৯৯২ সালে ইসরায়েল-ভারত কূটনৈতিক সম্পর্কও স্থাপিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধে ইসরায়েল ও জেকবের ভূমিকা নিয়ে সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর গ্রন্থ Beyond the Line-এ বেশ অনেকখানি আলোচনা করেছেন ইঙ্গিত আকারে। ঢাকা থেকেই বইটি প্রকাশিত হয়েছে। (Daily Star book, Dhaka, 2012, p. 218)।
নায়ার এই বইয়ে লিখেছেন, একাত্তরের ১৫ ডিসেম্বরই পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভারতীয় বাহিনীর কাছে অস্ত্রসমর্পণের জন্য প্রস্তুত থাকার পরও এবং সেভাবে প্রক্রিয়া শুরুর পরও বিষয়টি ঘটে ২৪ ঘণ্টা পরে এবং নজিরবিহীনভাবে খোলা মাঠে।
কেন এটা ঘটেছিল?
এ সম্পর্কে তখনকার ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের চীফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জে এফ আর জেকব সাংবাদিক নায়ারকে জানাচ্ছেন, New Delhi wanted to humiliate Islamabad by showing that Muslim country had laid down arms before a Jew.’
পরে কোন সময় জেকবকে নিয়ে আরও আলোচনা করা যাবে। তবে ভারত-ইসরায়েল সম্পর্ক নির্মাণে ১৯২৩ সালে কলকাতায় জন্মগ্রহণকারী এবং ১৯৭৮ সালে সামরিক বাহিনী থেকে অবসরে যাওয়া Jack Farj Rafael Jacob -এর ভূমিকা সম্পর্কে আগ্রহীরা আরও জানতে দেখতে পারেন, জিউশ জার্নালের ওয়েবসাই).
এছাড়া একাত্তরে ভারত-ইসরায়েল সম্পর্কের আরও চমকপ্রদ তথ্য-প্রমাণের জন্য দেখা যেতে পারে Srinath Raghavan- এর 1971: A Global History of the Creation of Bangladesh, Harvad University Press, 2013, p. 181-83. রাঘবন হলেন দিল্লির সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ-এর একজন ফেলো। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত তার এই গবেষণায় তিনি বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেছেন কীভাবে কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকার পরও ইসরায়েল একাত্তরে ভারতকে অস্ত্র ও ‘বিশ্বজুড়ে প্রপাগান্ডা সহায়তা’ দিয়েছিল।
ভারতের পক্ষে ফ্রান্সে নিযুক্ত তৎকালীন রাষ্ট্রদূত ডি এন চ্যাটার্জি এবং ইসরায়েলের পক্ষে Liechtenstein- এ অবস্থিত অস্ত্র নির্মাণ স্থাপনা Salgad- এর নির্বাহী পরিচালক পারস্পরিক ‘অমূল্য সহায়তা’র এই পুরো প্রক্রিয়াটি তদারক করতেন। এসব সূত্র এও জানাচ্ছে, যুদ্ধকালে তেলআবিব কেবল অস্ত্র নয়- সামরিক বিশেষজ্ঞ দিয়েও সহায়তা দিয়ে গেছে ভারতকে। এসব অস্ত্র ও ইন্সট্রাক্টরদের এয়ার লিফটিংয়ের মাধ্যমে সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে ফেলা হয়।
অন্যদিকে খ্যাতনামা সাংবাদিক Gary J. Bass নয়াদিল্লিতে নেহেরু মেমোরিয়াল মিউজিয়াম ও লাইব্রেরিতে রক্ষিত ‘হাকসার পেপার’ থেকে উদ্ধৃত করে তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন, উক্ত অস্ত্রের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক ছিলেন Shlomo Zabludowicz. প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মায়ারের নির্দেশে অস্ত্র সরবরারের এই নির্দেশটির তারিখ রয়েছে ২৩ আগস্ট ১৯৭১।
সরকার-সরকার এই সম্পর্কের বাইরেও ইসরায়েল তাদের একজন কর্মকর্তার মাধ্যমে সরাসরি বাংলাদেশি মুক্তিসেনাদের সাথেও যে যোগাযোগ রাখত--সে বিষয়েও তথ্যসূত্রের উল্লেখ করেছেন Gary J. Bass তার গবেষণায়। দেখুন : The Blood Telegram, Random House, India, 2013, p. 403.
আপাতত এটুকু। তবে জেকবকে নিয়ে এত অল্পে থামলে অতৃপ্তি থাকে। আর আমাদের যুদ্ধ কীভাবে ইসরায়েলেরো যুদ্ধ ছিল সে কাহিনী তো মহাকাব্যিক। ইতিহাসসৃষ্টিকারী এই যোদ্ধাকে অভিবাদন।
বিষয়: বিবিধ
১৪৯৮ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন