গল্প্ : গুম
লিখেছেন লিখেছেন আলোর আভা ০৩ জুন, ২০১৪, ০৭:৫৫:৩১ সন্ধ্যা
শায়লার আজ আনন্দের দিন মানে আজ বৃহস্পতিবার অফিস শেষে আজ সাহেদ বাড়ি ফিরবে শুক্র ,শনিবার থেকে রবিবার সকালে এখান থেকে যেয়ে অফিস করবে ।এভাবেই সাহেদ শায়লার বিবাহীত জীবনের দুই বছর পার হয়ে যাচ্ছে ।
সাহেদদের অবস্থা বেশ সচ্ছল ।সাহেদের বাবার জায়গা জমি বেশ ভালই আছে তাছাড়া সাহেদের বাবা প্রাইমারী স্কুলের হেডমাষ্টার ছিল এখন রিটায়ার্ড ।
সাহেদের বাবা মা সাহেদকে অনেক বার বলেছে বাসা ভাড়া করে শায়লাকে নিয়ে যেতে সাহেদই রাজী হয়নি ।সাহেদের এক কথা তোমরা যতদিন বেঁচে আছ শায়লা তোমাদের কাছেই থাকবে ।আমি সব সময় তোমাদের কাছে থেকে তোমাদের সেবা করতে পারছি না শায়লা সেটা করবে ।তাছাড়া ঢাকা তো আমাদের এখান থেকে খুব দুরে নয় আমি তো প্রতি সপ্তাহে আসছি ।
শায়লারও এতে কোন আপত্তি নেই শশুর শাশুরীর সেবা যত্নের পাশা পাশি তাদের আদর উপভোগ করতে শায়লার বেশ ভাল লাগে ।আর সাহেদ তো প্রতি বৃহস্পতি বার আসেই ।
তাই এই বৃহস্পতিবার শায়লার কাছে বিশেষ দিন ।এই দিনে শায়লার ঘুম ভাংগে খুশীর আমেজে ।এই খুশীর আভা সারা দিন শায়লার চোখে মুখে বিরাজ করে ।
সকাল বেলা উঠেই তারাতারি সমস্ত কাজ গুছাতে থাকে সাহেদের প্রিয় খাবার গুলো রান্না করবে ।কাজের মাঝেই আনমনা হয়ে ভাবে আজ কোন ড্রেসটা পড়বে কেমন করে সাজবে সাহেদের সাথে কি কি কথা বলবে মনে মনে সেগুলো গোছাতে থাকে ।
শায়লা ভাবে আজ তো ভরা পূর্মিণা অনেক জোস্না থাকবে সাহেদ এলে খাওয়া দাওয়া শেষে দুজনে মিলে ছাদের উপরে খোলা আকাশের নীচে সাহেদের কোলে মাথা রেখে মনের সব কথা সাহেদকে বলবে সেই সাথে সাহেদকে খুশীর খবরটাও দিবে ।
খবরটা শুনে সাহেদ কি বলবে খুশীতে সাহেদের চেহারাটা দেখতে কেমন হবে এসব ভেবে শায়লা নিজেই লজ্জায় লাল হয়ে যায় ।
এসব ভাবতেই ভাবতেই সকাল গড়িয়ে দুপুর শেষের দিকে শায়লা সব শেষে গোছল করে এখন একেবারে ফ্রী ।এই সময়টা আর কাটতে চায় না সাহেদের আসতে প্রায় সারে ৭টা -৮টা বাজবে এখন কেবল বাজে ৩টা ।
শায়লা শুয়ে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করে ঘুম আসে না এপাশ ওপাশ করে করেই ঘড়ির দিকে তাকিয়ে শায়লার মনটা খুশীতে ভরে উঠে ৫টা বাজে এই তো সাহেদ এখন অফিস থেকে বের হবে এখন আসতে যতক্ষন সময় লাগে ।
শায়লা তারা তারি বিছানা থেকে উঠে অজু করে আসরের নামাজ পড়ে শশুর শাশুরীকে বিকালের চা নাস্তা দিয়ে আসে ।
মাগরিবের নামাজ পরে শায়লা গতবার সাহেদ যে ড্রেসটা এনেছিল সে ড্রেসটা পড়ে সাথে ম্যাস করে হাতে,কানে ,গলার অনামেন্টস পড়ে হালকা সেজে আয়নায় নিজেকে বার বার দেখে আর মনে মনে ভাবে আমাকে কেমন লাগছে সাহেদের পছন্দ হবে তো ।সাহেদ আমাকে দেখে খুশী হবে তো ।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে শায়লা চমকে ও খুশীতে শায়লার মনটা নেচে উঠে সারে সাতটা বেজে গেছে এখন যে কোন সময় সাহেদ চলে আসবে ।
শায়লার বুকের ভিতর টিপ টিপ করতে থাকে আর খুশীতে শিহরীত পুলকিত হতে থাকে এখন যে কোন সময় কলিং বেল বেজে উঠবে ।
৮টা বেজে প্রায় নয়টা বেজে যায় কলিং বেল বাজে না শায়লার বুকের টিপ টিপের সাথে আস্থিরতা বাড়তেই থাকে সাহেদ কেন আসছে না এত দেরী হচ্ছে কেন ?
নিজেই মনে মনে ভাবে মনে হয় আজকে আিফিস থেকে বের হতে দেরী হয়েছে নয়ত গাড়ী পেতে দেরী হয়েছে ।
১০টা বেজে যায় সাহেদ আসে না ।শায়লার মনে এবার চিন্তা দেখা দেয় কি হল এখনো সাহেদ এল না যে ।
সাহেদের বাবা মাও চিন্তিত হয়ে শায়লাকে বউমা এখনো যে শাহেদ এল না দেশের অবস্থা ভাল না ।প্রতি দিন একসিডেন্টে কত মানুষ মারা যাচ্ছে কত মানুষ গুম খুন হচ্ছে ।
শায়লা নিজের মনের অবস্থা গোপন করে শশুর শাশুরীরে শান্তনা দেয় আপনারা চিন্তা করিয়েন না ইনশা আল্লাহ সে ভালয় ভালয় চলে আসবে হয়ত কোন কারনে দেরী হচ্ছে ।
শায়লা শশুর শাশুরীকে খাইয়ে বিছানা ঠিক করে আপনারা শুয়ে পড়ুন আমি জেগে আছি সাহেদ এলে আমি আপনাদের জানাব ।
রাত বাড়তে থাকে শায়লার অস্থিরতাও বাড়তে থাকে। এক অজানা আশংকায় শায়লার চোখে পানি চলে আসে ।
শায়লা এতটাই অস্থির হয়ে উঠে সে না পারছে বসে থাকতে না শুয়ে সে একবার গেটের কাছে যায় আবার ঘরে আসে ।এদিকে সাহেদের বাবা মাও একটু পর পর বউমা সাহেদ কি এল ।
শায়লার এখন আর কথাও বলতে ইচ্ছে করছে না ।সাহেদের মা উঠে এসে শায়লার মাথায় হাত বুলিয়ে বউমা সাহেদ মনে হয় আজকে আর আসবে না তুমি শুয়ে পড় ।শায়লা শাশুরীকে জড়িয়ে ধরে মা এই দুই বছরে একদিন ও তো এরকম হয়নি এবার কেন এরকম হল বলে কান্না করে উঠে ।
কেদ না বউমা আল্লার উপর ভরষা রাখ আর দুয়া করতে থাক যেখানেই থাকুক সাহেদকে যেন আল্লাহ ভাল রাখে ।
শায়লা শুয়ে পড়ে কিন্তু তার চোখে ঘুম আসে না একটু চোখটা লাগে তো চমকে উঠে এভাবেই ফজরের আজান হয় শায়লা উঠে অজু করে ফজরের নামাজ পরে কান্না কাটি করে আল্লাহর কাছে মোনাজাত করে ।
সারাটাদিন সাহেদের বাবা মা ও শায়লার অস্থিরতার মাঝে কেটে যায় ।কোন কিছুর একটু শব্দ হলেই শায়লা চমকে উঠে মনে করে গেটে বুঝি শব্দ হল এই বুঝি সাহেদ এল না সারা দিন কেটে যায় সাহেদ এল না ।
শায়লার চেহারা মনিল হয়ে যায় মুখের কথা বন্ধ হয়ে যায় সারা রাত দুঃচিন্তা আর অস্থিরতায় নির্ঘুম কেটে যায় ।
ফজরের নামাজ পড়েই শশুর শাশুরীর ঘরে যেয়ে শাশুরীকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেংগে পরে মা আমি তো আর পারছি সাহেদের কোন খবর পাচ্ছি না ।
সাহেদের মাও কান্না করে ।
সাহেদের বাবার মনটাও অস্থির এক মাত্র সন্তান কিন্তু তাকে তো ভেংগ পড়লে চলবে সেতু পুরুষ মানুষ তাকে যে শক্ত থাকতে হবে ।
তোমরা এত আস্থির হইও না তো দেখি কি করা যায় ।
সাহেদের অফিসের একটা ফোন নাম্বার আছে কিন্তু আজকে তো আফিস বন্ধ ।তাই সাহেদের বাবা কাজের ছেলেটাকে নিয়ে ঢাকায় সাহেদের বাসার উদ্দেশ্যে গাড়ীতে উঠে ।সাহেদ ও তার বন্ধু কবীর দুজনে মিলে দুই রুমের একটা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকে ।
তারা সেখানে পৌছলে কবীর চাচা আপনি হঠাত ?
বাবা, সাহেদ তো প্রতি বৃহস্পতিবার বাড়ী যায় এবার যায় নি বাড়ীতে তো সাবাই কান্না কাটি করছে তাই আমি এলাম ওর খোজ নিতে ।
চাচা কি বলেন ! সাহেদ বৃহস্পতিবার সকালে বলে গেছে ও বাড়ী যাবে সেতু আর ফিরে নি ।
সাহেদের বাবার চোখ বেয়ে পানি পড়ে কি বল বাবা তাহলে সে গেল কোথায় ।
চাচা আপনি শান্ত হন দেখি কি করা যায় আজকে তো আফিস বন্ধ আমি কালকে ওর অফিসে যেয়ে খবর নিব আর আজকের মধ্যেই ওর ও আমার পরিচিত বন্ধুদের কাছে খবর নিয়ে আমি কালকে আপনাদের বাড়ি গিয়ে জানিয়ে আসব আর এর মাঝে যদি সাহেদ চলে আসে ভাল ।
অনেক বুঝিয়ে ও শান্তনা দিয়ে কবীর সাহেদের বাবাকে গাড়ীতে উঠিয়ে দেন ।
সাহেদের মা ও শায়লা সারাদিন নাওয়া খাওয়া ভুলে অনেক আশা নিয়ে গেটের দিকে চেয়ে আছে নিশ্চয় সাহেদের বাবা সাহেদকে সাথে নিয়ে আসবে ।
কলিং বেলের আওয়াজে শায়লা দৌড়ে যেয়ে দরজা খুলে সাহেদকে না দেখে চিৎকার করে বাবা সাহেদ আসেনি ?
সাহেদের বাবা কোন কথা না বলে মাথা নীচু করে ঘরে ডুকে দপাস করে খাটের উপর বসে ।
সাহেদের মা চুপ করে আছেন কেন বলেন আমার সাহেদের খবর কি সে আসে নাই কেন ?
সাহেদের বাবা আস্তে আ্স্তে সব খুলে বলে ।সব শুনে শায়লা চিৎকার দিয়ে অঙ্গান হয়ে যায় ।
ডাক্তার ডাকা হয় ।ডাক্তার সব দেখে শায়লা যে খুশীর খবরটা শশুর শাশুরীর কাছে গোপন রেখেছিল প্রথমে সাহেদকে জানাবে বলে ডাক্তার সে খবরটা সবাইকে জানিয়ে দিলেও এত খুশীর খবরেও কারো মুখে হাসি বের হয় না এই মূহুর্তে ।
পরের দিন কবীর সাহেদের অফিসে যেয়ে ও একই কথা শুনে সেতু প্রতি বৃহস্পতিবার বাড়ী যায় আর আজকে ও অফিসে আসে নি এর বেশী কেউ কিছু বলতে পারে না ।চেনা জানা বন্ধু বান্ধব যারা ছিল তাদের কাছে খবর নেয় কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারে না ।
কবীর সন্ধ্যায় সাহেদদের বাড়ী এসে সে খবরই জানিয়ে যায় ।
শায়লা সাহেদের মা কান্না কাটি করে সাহেদের বাবা পুরুষ মানুষ যা কিছু করার তাকেই তো করতে হবে কিন্তু একমাত্র ছেলের এরকম নিরুদ্দেশ এর খবরে সে হয়ে পড়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ ।
এভাবেই দিনে দিনে মাস যায় সাহেদের কোন খবর পাওয়া যায় না একটা জলজ্যান্ত মানুষ কোথায় হাড়িয়ে গেল কেউ বলতে পারে না ।মানুষ মারা যায় তার লাশ দাফন কাফন করা যায় মনকে শান্তনা দেয়া যায় আল্লাহ নিয়ে নিয়েছে ।এটা কি ভাবে সহ্য করা যায় ।
শায়লা প্রতি দিন সাহেদের অপেক্ষায় থাকে বিশেষ করে বৃহস্পতিবার এলেই শায়লার ভিতর এক অন্য রকম অস্থিরতা দেখা দেয় ।শায়লার মনে হয় এই বুঝি সাহেদ এল তাকে জড়িয়ে ধরে বলবে শায়লা আমি এসেছি ।
না সাহেদ আসে না ।তবে শায়লার কোল আলো করে আসে সাহেদের ওরসের সন্তান রুশান ।
দেখতে দেখতে রোশানের বয়স ও দুই বছর হয়ে যায় শায়লার অপেক্ষার শেষ হয় না ।
সাহেদের বাবা মা শায়লা ,রুশানকে দিয়ে ছেলের অভাব পূরণ না হলে কিছুটা হলে ভাল আছে এটা বুঝে তারা শায়লাকে বুঝায় বউমা তুমি আর কতদিন আমার ছেলের জন্য অপেক্ষা করে তোমার জীবন নষ্ট করবে ।
তোমার বয়স কম এভাবে তোমার দিন কি ভাবে যাবে তুমি নতুন করে কিছু চিন্তা ভাব না কর মা ।
শশুর শাশুরী একথা বললেই শায়লার চোখ বেয়ে পানি নেমে আসে ।
আমি কি ভাবে নতুন কিছু চিন্তা করব মা আমি তো সাহেদের মৃত্যুর খবর পাইনি আমি তো তার লাশ দেখি নি ।আমার মন বলে সে বেঁচে আছে সে ফিরে আসবে ।আমি অপেক্ষা করব তার ফিরে আসার না হয় তার লাশ দেখার ।তার লাশ দেখে আমি নিশ্চিত হতে চাই সে সত্যি মারা গেছে ।
শায়লার এই অনিশ্চিত অপেক্ষার শেষ হবে কি ................।?
বিষয়: বিবিধ
১৯৮৪ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
গল্প পড়েছি কিন্তু মন্তব্য একটাই সুষ্ট সমাজ চাই ,,ধন্যবাদ
"শাহেদ এর মোবাইলও বন্ধ" ..... এ কথাটা মনেহয় উল্ল্যেখ করা উচিত ছিলো। ধ্যাত আমি বেশি কথা বলা আবার শুরু করছি মনে হচ্ছে, তাইনাপ্পি?
মন্তব্য করতে লগইন করুন