আমার হতভাগা বাবা ------------
লিখেছেন লিখেছেন আলোর আভা ২৪ এপ্রিল, ২০১৪, ০৭:১১:১৫ সন্ধ্যা
আমার বাবা গরীব ঘরের ছেলে ছিল কিন্তু বাবা ছিলেন অত্যন্ত শান্ত ,নম্র,ভদ্র,হাসি -খুশী ও প্রানচঞ্চল।
আমার বাবা অনেক কষ্ট করে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন মানুষের বাড়িতে লজিং থেকে মাদ্রাসা বোর্ড থেকে থার্ড ইষ্টান করে কামিল পাশ করেন ।
বাবার ইচ্ছা তিনি জেনারেল লাইনেও পড়াশুনা করবেন ।কিন্তু সমস্যা হল এত দিন মানুষের বাড়িতে লজিং থেকেছেন এখন থাকতে হবে হোষ্টেলে।হোষ্টেলের খরচ পড়াশুনার খরচ চালানোর মত সার্মথ আমার দাদার ছিল না । কিন্তু আমার বাবার অনেক স্বপ্ন তিনি আলেম হয়েছেন এবার জেনারেল লাইনে ইংরেজী নিয়ে পড়াশুনা করবেন ।
আমার বাবা আমার দাদা যখন এসব নিয়ে ভাবছেন কি ভাবে কি করা যায় ।তখন আমার বাবা শেষ যে এলাকায় লজিং ছিলেন সেই এলাকার সব চেয়ে ধনী ব্যাক্তি উনার মাত্র ১১ বছর বয়সী মেয়ের জন্য বিয়ের প্রস্তাব দেন বিনিময়ে সে আমার বাবার স্বপ্ন পূরনে সর্বাত্বক সাহায্য করবেন ।কারন আমার বাবা এই এলাকার না হলে মেধাবী ছাত্র হিসাবে বেশ পরিচিত ছিলেন ।
আমার দাদা আর বাবা এ প্রস্তাব খুশী মনেই মেনে নিলেন ও বিয়ে হয়ে গেল ।বিয়ের দিন আমার নানা আমার বাবাকে বলেছিল তোমাকে আমি একটি রত্ন দিলাম ।আমার মা আমার বাবার জীবনে রত্নের মতই ছিল এটা আমার বাবার কথা ।
আমার বাবার সময়ে মাদ্রাসা লাইনে কামিল এর সার্টিফিকেটকে জেনারেল লাইনে এস এস সির মান দেয়া হত ।এবার বাবা ভর্তি হলেন করটিয়া সাদত কলেজ ।আমার মা আমার নানী বাড়িতেই থাকতেন আর বাবা থাকতেন কলেজ হোষ্টেলে ।মাঝে মাঝেই বাবা আসতেন আমার নানা বাড়ি ।
এর পর বাবা ঢাকা কলেজ থেকে ইংরেজীতে অর্নাস পাশ করে ঢাকা বিশববিদ্যালয় থেকে ইংরেজীতে মাষ্টার্স পাশ করে ।এর মাঝে আমার বাবা তিন সন্তানের জনক ও হয়েছেন এক মেয়ে ও দুই ছেলে ।
এবার শুরু হল আমার বাবার চাকরী জীবন মাষ্টার্স শেষ করার সাথে সাথেই বাবার চাকরী হল ত্রিশাল কবি নজরুল কলেজে ।ত্রিশাল বাজারে বাবা বাসা ভাড়া নিয়ে আমার মাকে নিয়ে শুরু করলেন সংসার ।বাবা কলেজে থেকে এসেই সারা বিকাল রাত দশটা পর্যন্ত প্রাইভেট পড়ান ।আমার বাবা ক্লান্ত হন না এত পরিশ্রমেও বাবা এত বেশী হাসি খুশী প্রান চঞ্চল থাকতেন ।ছাত্র ছাত্রীরা বলত স্যারের মনে হয় বউ এর সাথে কখনো ঝগড়া হয়না
তা না হলে এত হাসি খুশী থাকে কি করে ।কথাটা আমার বাবা মার জীবনে পুরা পুরি সত্য ছিল ।
দুই বছর শিক্ষকতা করার করার পর বাবা ঐ কলেজের প্রিন্সিপাল হলেন ।এর ১ বছর পর আমার বাবার চাকরী হল "জমিয়তে দাওয়াতে ইসলাম "এই অর্গানাইজেশনটা লিবিয়া সরকারের তবে আমার বাবা কাজ করতেন বিভিন্ন বেশীর ভাগ অমুসলিম দেশে । তবে চাকরীটা বেশ ভাল বেতনটাও ভাল আর আমার বাবাকে সব সময় দেশের বাহিরে কাটাতে হত না ।হয়ত দুই মাসের জন্য ব্যাংকক গেলেন দেশে এসে এক মাস আবার শ্রীলংকা গেলেন তিন মাসের জন্য এভাবেই চলত ।এর মাঝে আমার বাবা মা আরো এক কন্যা সন্তান পেয়েছেন এবার জোড়া পূর্ন হল দুইছেলে দুই মেয়ে ।
আমার বাবা আর মা ছিলেন দুজন বিপরীত চরিত্রের মানুষ । মা ছিলেন একটু শক্ত ও কড়া ।আর বাবা অত্যান্ত নরম মনের মানুষ ।মা ছিলেন খুবই হিসেবী ,বাবা ছিলেন দিল দরিয়া ।
আমার বাবা উচ্চ শিক্ষীত , মা ছিলেন ফাইবপাশ (যদিও আমার মা নানী দাদী হওয়ার পরে উন্মুক্ত বিশবিদ্যালয় থেকে এস এস সি পাশ করেছিলেন )।
আমার মা শিক্ষীত না হলেও,জ্ঞান বুদ্ধিতে ছিলেন বাবার চেয়ে প্রখর ও বিচক্ষন এটা আমার বাবা স্বীকার করতেন নিঃসংকোচে ।
এই দুই মেরুর দুই জন মানুষের মাঝে কখনো ঝগড়া করতে দেখি নি ,কখনো মনোমালিন্য ও দেখি নি ।আমার জীবনে আমি দেখিনি যত ছোট কাজই হোক তারা দুজন পরামর্শ ছাড়া করেছেন ।
আমার বাবা এতটাই নরম মনের মানুষ ছিলেন আমাদের সাথে কখনো রাগ করতে পারতেন না এমন কি আমরা কোন ভুল করলে ও বাবা দেখে না দেখার ভান করতেন ।এটা নিয়ে মা প্রায় অভিযোগ করতেন তুমি ছেলে মেয়েদের শাসন করনা মায়ের চেয়ে ছেলেমেয়েদের বাবার শাসনের দরকার বেশী ।আমার বাবা হেসে বলতেন তুমি তো শাসন করই তাই আমি আদরই করি দুইজনেই যদি শাসন করি তাহলে ওরা যাবে কোথায় আর আমার ছেলে মেয়েরা তো দুষ্ট বা অবাধ্য নয় তাই যতটুকু শাসন দরকার এটা তুমিই কর ।
তাই আমরাও সব ভাই বোনেরা ছোট বেলায় আমার মাকে খুব না তবে ভয় যা পাওয়ার মাকেই পেতাম বাবাকে নয় ।আমাদের যত চাওয়া পাওয়া আবদার সবই ছিল বাবার কাছে । যখন টাকার প্রয়োজন পড়ত কখনো আমি বা আমার ভাই বোনেরা মায়ের কাছে চাই নি কারন আমার মায়ের কাছে ১০০টাকা চাইলে হাজারটা প্রশ্ন করে ৫০টাকা বড়জোর ৮০ টাকা দিতেন আর বাবার কাছে ১০০টাকা চাইলে ১০০ টাকাতো দিতেনই আর বলতেন আরো লাগবে কিনা আর এটা দেখে শুনে আমার মা রেগে বলত বাহ বেশ ভাল তো ছেলে , মেয়ে টাকা চাইল আর দিয়ে দিলে জানতেও চাইলা না টাকা দিয়ে কি করবে ।
আমার বাবা বলতেন আমি অনন্ত এটুকু জানি বা আমার বিস্বাস আছে আমার ছেলে মেয়ে টাকা দিয়ে খারাপ কিছু করবে না ।আমার বাবার টাকা ছিল না আমি অনেক কষ্ট করেছি আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন ওরা কেন কষ্ট করবে না ।
আর আস্তে আস্তে বাবার চাকরিটা এমন হয়ে গেল বছরে দুইবার বা তিন বার কোন দেশে যখন কনফারেন্স হয় শুধু তখন বাবাকে ১৫ বা বিশ দিনের জন্য যেতে হয় সারা বছর বাবা ঘরে বসেই বেতন পান ।এই অবস্থায় বাবা আবার আমাদের এলাকায় ঢাকার পাশেই একটা কলেজে জয়েন করলেন ।
আবার বাবার আবার পরিশ্রম শুরু করলেন ।কলেজের সময়ছাড়া বাকীসময় প্রাইভেট পড়ান ।
এভাবেই বাবা পরিশ্রম করে বাড়ি ঘর বিষয় সম্পত্তি বেশ ভালই করেছেন ,ছেলে মেয়েদের লেখা পরা শেষ করে সবাইকে বিয়ে শাদী দিয়েছেন ।
আমার বাবার কলেজটা সরকারিকরন করা হল তাই বাবা বিদেশের ঐ চাকরিটা ছেড়ে দিলেন ।
আমরা ভাই বোনেরা দেশে মোটামোটি ভাল অবস্থানে থাকার পর ও একে একে সবাই ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমালাম আমাদের রিজেক আমাদের টেনে নিয়ে আসছে আর এতেও আমার বাবার অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই ।
আমার বাবা মায়ের আমাদেরকে নিয়ে এত সুখের একটা সংসার ছিল আমাদের আশা পাশের মানুষ বলত সুখী পরিবার দেখতে চাও এদের দেখ যেমন বাবা মা তেমন ছেলে মেয়ে ।
আমার বাবা বদলী হয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে আসলেন ,এখানে তিন বছর শিক্ষকতা করে আমার বাবা রিটার্য়াট করলেন ।
আমরা সবাই খুশী আমার বাবা সারা জীবন কষ্ট করেছেন ,পরিশ্রম করেছেন অনেক টাকা আয় করেছেন তার টাকায় সুখ ভোগ করেছি আমরা ।তাকে তো দেখেছি সাধারন ও বাস্তময় জীবন কাটাতে ।দুইটা চাকরি সাথে সংগঠনের কাজ ।
আমরা সব ভাই বোনেরা বল্লাম আব্বা এবার আপনি মাকে নিয়ে দেশ বিদেশ ঘুড়ে বেড়ান ।
বাবা বলল হু তাই করব তোমার মাকে নিয়ে তো কোথাও যাওয়া হয় নাই এখন আমার অবসর এখন যাব ।
কিন্ত বিধির বিধান ছিল অন্য রকম । হঠাত আমার মায়ের অসুখ ধরা পড়ল ক্যানসার ডাক্তার সব দেখে শুনে বল্ল দেশে বিদেশে এর কোন চিকিৎসা নেই বড় জোর ২ মাস বাঁচবে ।
যেদিন মায়ের এই অবস্থার কথা শুনলাম প্রথমেই যে কথাটি মনে আসল আমার বাবার কি হবে বাবাকে কে দেখবে !
বাবার সাথে কথা বল্লাম বাবার একই কথা সে চলে গেলে কেমন হবে কি করে চলবে এই ঘর সংসার ।
আমরা ভাই বোনেরা সবাই দেশে আসলাম এর ১২দিন পর আমার অভাগী মা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন চিরদিনের জন্য ।না না ভুল বল্লাম আমার মা অভাগী নয় অভাগা আমার বাবা ।আমার মা ছিল ভাগ্যবতী ।আমার বাবা একজন আলেম সে রাতের আধারে চোখের জল ফেলে আমার মায়ের জন্য দুয়া করে সপ্তাহে অনন্ত একদিন আমার মায়ের কবর জিয়ারত করে একজন স্ত্রীর এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে।
কারো জন্য কিছুই থেমে থাকে না জীবন চলতে থাকে জীবনের নিয়মে কিন্তু আমার মনে হল আমার মায়ের চলে যাওয়াতে আমার বাবার জীবনটা আটকে গেল থেমে গেল ।
আমার বাবা তার ৪৫ বছরের সাথীকে হারিয়ে হয়ে পড়লেন নিঃসংগ।আমার হাসি খুশী প্রানচঞ্চল বাবা হয়ে গেলেন নিস্তব্ধ,নিথর ।যে বাবার চোখে শত কষ্টেও কখনো পনি দেখি নি সেই বাবার চোখে দেখলাম প্লাবনের ধারা ।যে কোন কথায় আমার বাবার চোখ দিয়ে পানি পড়ত ।আমার যে বাবার চোখে মুখে সারাক্ষন হাসি খুশীর আভা লেগে থাকত সেই বাবার চেহারার দিকে তাকালে মনে হয় একটা জনম দুঃখী মানুষ।
আমার বাবা কবি নয় কখনো বাবাকে কবিতা পড়তেও দেখি নি আমার বাবা আমার মায়ের বিরহে কয়েকটা কবিতাও লিখে ফেলেন ।
অশ্রু ভেজা নয়ন আমার
চেয়ে থাকি আকাশে
খুজে বেড়ায় তোমাকে ।
কোন নীলিমায় ভেসে বেড়াও
একা ফেলে আমাকে ।
বাতায়ন পাশে চেয়ে থাকি শুধু
কবে পাব তোমাকে ।
তুমি আমায় সাহস দিতে শক্তি দিতে
হয়ে ছিলে মোর প্রান
তুমি বিনে এখন আমার সবই হল ম্লান ।
কিজে কষ্ট মনের ভিতর আল্লাহ পাক জানে
দিন রাত্রি কাঁদি আমি একা সংগোপনে
সুখ দুঃখের কত স্বৃতি মনের মাঝে জাগে
কখনো হায় ভাবিনি তো থাকব আমি
তুমি যাবে আগে ।
এই আমার হতভাগা বাবা যে এখনও আমার মাকে প্রচন্ড ভালবাসে -- বাবা আমিও তোমাকে খুব খুব ভালবাসি -- আই লাভ ইউ বাবা ---
বিষয়: Contest_father
৩৩৮৩ বার পঠিত, ২৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
চেয়ে থাকি আকাশে
খুজে বেড়ায় তোমাকে ।
কোন নীলিমায় ভেসে বেড়াও
একা ফেলে আমাকে ।
এত কঠিন করে কবিতা লেখেন কেনো আমি যে থাকতে পারি না কষ্টে।
বাবার অন্তরে প্রশান্তির জন্য দোয়া রইল।জাযাকল্লাহ খায়ের
আমারটাও পরতে পারেন -Click this link
সহজ, সাবলীল ও প্রাণস্পর্শি বর্ণনা।
চেয়ে থাকি আকাশে
খুজে বেড়ায় তোমাকে ।
কোন নীলিমায় ভেসে বেড়াও
একা ফেলে আমাকে ।
বাবা মায়ের ভালবাসা। সত্যিই অসাধারণ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন