পৃথিবীর এই রঙ্গ মঞ্চে মানুষ চেনা দায়।
লিখেছেন লিখেছেন আলোর আভা ০১ নভেম্বর, ২০১৩, ১২:১৫:৫০ রাত
বড়ই বিচিত্র এই পৃথিবী ।তার চেয়েও বড় বিচিত্র এই পৃথিবীতে বসবাসকারী মানুষ ।অন্ধকার দেখে রাত চেনা যায়,সূর্যের আলো দেখে দিন কে চেনা যায়,কিন্তু মুখ দেখে মানুষ চেনা অনেক কঠিন ।তারপরও আমরা মানুষের মুখ মানে চেহারা দেখেই ধারনা করে বসি মানুষটা খারাপ বা ভাল আবার বিভিন্ন রকম মন্তব্য ও করে ফেলী পজেটিভ বা নিগেটিভ।
আমার মনে হয় এই বদ অভ্যাসটা আমার মাঝে একটু বেশীই আছে।
আমার টিচার Eva ballberg দেখতে লন্বা,শুকনা,চামরা সাদা,জাতিতে সুইডিস ধর্মে খৃষ্টান,বয়স প্রায় ৬২ ।
আমি দুই বছর যাবত তার ক্লাস করছি ,আমি তাকে কখনো তার মুখে একটু ও হাসি দেখিনি,কথাও বলেন কম,চেহারা দেখে মনে হয় রেগে আছেন ।Eva সম্পর্কে আমি মনে মনে ভাবতাম এ কেমন মহিলা , এর কি স্বামী বা ছেলে-মেয়ে আছে! আর থাকলে সে তাদের সাথে চলে কি ভাবে।আমার তো মনে হয় না এর ভিতর কোন মায়া মমতা বা প্রেম ভালবাসা আছে । তার সম্পর্কে এ রকম আরো বিভিন্ন ধরনের নিগেটিভ ধারনা আসত আমার মনে।
আজকে আমাদের ল্যাঞ্চ আওয়ারে সবাই যখন ডাইনিং এ ব্যস্ত আমি তখন এক কাপ কফি নিয়ে ক্যাফেটেরিয়ায় নিরিবিলিতে বসে আছি Eva ও কফি নিয়ে আমার টেবিলে আমার মুখো মুখি চেয়ারে এসে বসে ।তখন আমার কৌতুহল জাগে তার সম্পর্কে জানার (ক্লাসের বাহিরে কখনো তার সাথে আমার কথা হয়নি ,তার ব্যক্তি গত জীবন সম্পর্কে কিছু জানি না)।
জানার ইচ্ছাকেও দমন করতে পারছি না,আবার ভয় ও পাচ্ছি কিছু জানতে চাইলে যদি রেগে যায়।
ভয়ে ভয়েই জিঙ্গাসা করি Eva তুমি কোথায় থাক ?সে কেমন করে যেন আমার দিকে তাকিয়েও বল্ল সে কোথায় থাকে।
তার চাহনীকে ভয় পেয়েও আবার বললাম Eva তোমার কি ছেলে মেয়ে আছে্ ? আমার তিন ছেলে তারা সবাই বড় হয়েছে তারা আলাদা থাকে তাদের বউ বাচ্চা নিয়ে।আমি আমার তৃতীয় প্রশ্ন না করে থাকতে পারছিনা মুখ ফসকে বলেই ফেলি Eva তোমার কি স্বামী আছে ?কথাটা বলেই আমি মাথাটা নীচু করে ফেলি এবার নিশ্চয় আমাকে একটা ধমক দিবেই কিন্তু না ,Eva না আমার স্বামী তিন বছর আগে মারা গেছে ,এটা শুনে আমি তার দিকে তাকিয়ে দেখি তার চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে আর শুধু পানি না সে শব্দ করে কাঁদছে ।তার এ কান্না দেখে আমি তার স্বামীর প্রতি গভীর ভালবাসা দেখে আমি এত বেশী আশ্চর্য হয়েছি যা এর আগে কখনো হইনি।
যার ব্যপারে আমি ধারনা করতাম তার মনে কোন দয়া মায়া প্রেম ভালবাসা নেই তার মনে তার স্বামীর জন্য এত ভালবাসা।
এরপর সে বলতে থাকে আমাদের এখানে এক স্বামীর বা স্ত্রীর সাথে দীর্ঘ সময় সংসার করে এমন দম্পতী খুবই কম।আমি আর per দীর্ঘ ৪২ বছর সংসার করেছি, আমাদের পর পর তিনটা ছেলে হয় তাদের মানুষ করেছি তার পর তারা এক সময় যার যার মত আলাদা হয়ে যায়।আমি আর per শেষ পর্যন্ত ছিলাম নতন স্বামী স্ত্রীর মত ,দুজন দুজনকে ভালবাসতাম পাগলের মত,কেউ কাউকে ছাড়া এক মূহুর্ত কল্পনা করতে পারতাম না ।কোন অসুক ছাড়াই ২০১০ সালের ১১ই ডিসেন্বর সকালে ব্রেন ষ্টোক করে মারা যায়।
per এর এই মৃত্যু আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারি না ,আমি বিশ্বাস করতে পারি না per আমাকে ছেড়ে থাকতে পারে।per কে নিয়ে ৪২ বছরের কত হাসি -কান্না ,সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার সাথী ,আজকে শুধু সেই সাথীর স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছি তার নাম বেঁচে থাকা নয় ।সাথী হারা হয়ে বেঁচে থাকা যে কি কষ্ট সে ভুক্ত ভূগী ছাড়া কেউ বুঝবে না।
আমি ও তোমার মত হাসি খুশী ছিলাম(আমাকে সবাই বলে আমি নাকি খুব হাসি খুশী ,অনেকে বলে আমার চোখে মুখে সব সময় একটা খুশীর ঝিলিক লেগে থাকে) per মারা যাবার দিন থেকে আমি আর হাসতে পারি না, কোন কিছুতেই আমার আর হাসি আসে না ,কোন কিছুতেই আমি আনন্দিত হই না ।কারো সাথে কথা বলতে ও আমার ভাল লাগে না,আর বলিও না । আমি দুই বছর ধরে তোমাকে দেখছি তুমি সব সময় হাসি খুশী প্রানবন্ত থাক, তা ছাড়া তোমার চেহারাটাও ইনোসেন্ট মনে হয় তাই তোমার সাথে অনেক কথা বলে ফেললাম।
Eva র ক্লাসের টাইম হয়ে যায় সে ক্লাস নিতে চলে যায়,
আমার মনটা এত বেশী খারাপ হয়ে যায় ,আমি আর ক্লাসে যেতে পারলাম না,নিজেকে এত বেশী অপরাধী মনে হচ্ছিল ।তার ব্যপারে আমার এত দিনের ধারনা সম্পূর্ণতাই ছিল মিথ্যা আর ভূল।
,আর বার বার মনে পড়ছিল সুরা হুজরাতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,"হে ঈমানদারগন তোমরা বহু অনুমান থেকে বেঁচে থাক।নিঃসন্দেহে কোন কোন অনুমান হচ্ছে গুনাহ"।
আর রাসুল (সাঃ) বলেছেন,"তোমরা অনুমান পরিহার কর, কেননা অনুমান হচ্ছে নিকৃষ্টতম মিথ্যা।"(বুখারী)
Eva র কষ্ট দেখে বার বার এটাও মনে হচ্ছিল আল্লাহর রহমতে আমার ও একজন সাথী আছে যে আমার সুখে দুঃখে সব সময় পাশে থাকে । একটু মন খারাপ হলে মন ভাল হবে কি ভাবে সে চেষ্টা করে ,সামান্য একটু জ্বর হলেও উতালা হয়ে যায়।এই সাথী হাড়িয়ে গেলে আমিও কি Eva র মত হয়ে যাব।
হে আল্লাহ ,আমি Eva র মত সাথী হাড়িয়ে কষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই না।হে আল্লাহ আমাকে তুমি আমার সাথীর আগে নিয়ে নিও।
বিষয়: বিবিধ
৪৬৪৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন