উগ্রতা শুধু উগ্রতারই জন্ম দেবে, সমাধান নয়

লিখেছেন লিখেছেন তিমির মুস্তাফা ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১০:২৬:৩৫ রাত



(২০১৩'র লেখা, এখনও কি বদলেছে? )



পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ একটা গরীব দেশ, বিশ্বের হত-দরিদ্র দেশ গুলোর অধিবাসীরাও নাম শুনলে একটু করুণার দৃষ্টিতে তাকায়। সবুজ পাসপোর্ট দেখলে ভারত, পাকিস্তান শ্রীলংকার বিমানবন্দরে ও অতিরিক্ত সতর্কতা দেখা দেয়, অন্য দেশগুলোর পরিস্থিতি আর নাই বা বললাম । দেশ এর বাইরে গেছে এমন বাংলাদেশীদের যে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই, এর সত্যতা যাচাই করা যাবে।

তো আমাদের প্রধান প্রধান সমস্যা গুলো কি? যার জন্য পৃথিবী জোড়া আমাদের এত ‘সুখ্যাতি? ভেবে বলুন, সমস্যা তো একাধিক । নয় কি? কিন্তু টিভি দেখুন, পত্রিকা দেখুন – এটা দেখে যে কেউ ভাববে – আমাদের প্রথম এবং প্রধান সমস্যা- রাজাকার সমস্যা!

একজন মানুষের যুক্তি বুদ্ধি থাকলে সে কি তাই ভাববে ? ‘৭১ সালে এই দেশ স্বাধীন হয়েছে, ‘৭২ এ রাজাকারদের বিচার করাও হয়েছে আদালতেই শুধু নয়, রাস্তার বিচারও হয়েছে ! দেশের সুযোগ্য – গুণধর পুত্রগন সে বিচার করেছে – গাছে ঝুলিয়ে- পিটিয়ে মেরে, ঐ ভাবেই লাশ রেখে গেছে। তাদের আত্মীয় স্বজনদের সাহস হয়নি দিনে দুপুরে সে ঝুলানো লাশ নামিয়ে কবর দেয়ার । রাতের আঁধারে লাশের সৎকার হয়েছে। অবশ্য সে সময়ে তাদের জন্য জনমনে সহানুভূতিও ছিল না। অন্যায় ভাবে যে কাউকে ঝুলানো হয় নি, তা নয়, তবে ওটা ছিল যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি – যুদ্ধের সময় অনেক কিছুই ঘটে।

স্বাধীনতার ৪১ বৎসর পেরিয়ে গেছে, এখন তো যুদ্ধকালীন ‘জরুরি’ পরিস্থিতি নয়। তবে কৃত্তিম ভাবে যুদ্ধাবস্থা তৈরি করে – আদালত এর ‘নিরপেক্ষ বিচার’ কে নিশ্চিত না করে, আবার ‘রাস্তার বিচার’ কে উৎসাহিত করা হচ্ছে কেন? একটা স্বাধীন – সার্বভৌম দেশে – এর নাগরিকদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত না করে, রাস্তার ‘মব কে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় উৎসাহিত করা হচ্ছে কেন? এর মদদ দাতাদের আসল উদ্দেশ্য কি? একটা রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করতে হবে- গনতন্ত্রের দেশে এই দাবি কি যৌক্তিক ? গণতান্ত্রিক ?

আমি তোমার পক্ষের না হয়ে, বিপক্ষের ও একজন হতে পারি, রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রভেদ তোমাতে আমাতে থাকতেই পারে, কিন্তু তোমার বাক-স্বাধীনতা-(আমার বাক-স্বাধীনতার মতই) তোমার অধিকার, আর তোমার সে অধিকার রক্ষার জন্য প্রয়োজনে – তোমার সাথে –কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমি যুদ্ধ করব। তুমি যেটা বলতে চাও, হতে পারে তা আমি পছন্দ করি না, হতে পারে সেটা আমার আদর্শের বিরুদ্ধে, কিন্ত তার পরেও- এটা বলতে পারার অধিকার তোমার থাকতেই হবে। এর নাম বাক-স্বাধীনতা।

এটা ২০১৩, মানুষ এর মৌলিক অধিকার গুলোর অন্যতম হল বাক স্বাধীনতা, এ ব্যাপারে পৃথিবীর নিরক্ষর মানুষ গুলোও একমত। একজন সভ্য, শালীন মানুষ এর সাথে দ্বিমত পোষণ করতে পারে না। কিন্তু কি দুর্ভাগ্য আমার সোনার বাংলার।

জামাত – ই ইসলাম রাজনৈতিক, আদর্শিক ভাবে অনেকেরই গাত্রদাহের কারণ হতে পারে – কিছুটা ‘৭১ এ এদের কিছু নেতার রাজনৈতিক ভাবে পাকিস্তানের পক্ষ নেয়ার কারনে, কিছুটা যারা ইসলাম এর নাম শুনলেই ‘জেহাদ এর গন্ধ পায়- (অনেকটা পশ্চিমা দেশ গুলোর উগ্র খৃষ্টানদের অনুকরণে), আর কিছুটা হিন্দুয়ানী বা ভারতপ্রেমীদের –মুসলিম বিদ্বেষ এর কারনে । সেই জন্য কি তাদের ‘নিষিদ্ধ করতে হবে? তাদের বিনা বিচারে, বিচারের নামে ‘প্রহসন করে এর নেতাদেরকে যাবজ্জীবন কারা দণ্ড / ফাঁসী দেয়া যাবে? এটা গণতন্ত্রের কত নম্বর ‘ধারা? ভারতের বিজেপি’র মত সুইডেনে বা জার্মানির মৌলবাদী দল রয়েছে- জামাতে ইসলামীর চাইতেও কট্টর বর্ণবাদী ও হিংস্র দল- তাদেরতো কেউ নিষিদ্ধ করার জিকির তুলছে না!

গনতন্ত্র এমন কোন বাইবেল নয়। কিন্তু ‘ মন্দের ভাল বলে এটা গোটা পৃথিবীতে এখন স্বীকৃত শাসন ব্যবস্থা। কিন্তু এতে যদি মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষিত না হয়, তাহলে এটাকে গণতন্ত্র বলা যাবে কি? এটাকে বোধ হয় ‘আওয়ামী তন্ত্র বলা যাবে, কেন না, আওয়ামী লীগের বোদ্ধা এবং ‘যোদ্ধারা এই ‘নিষিদ্ধ কর, ‘মূলোৎপাটন কর, এই স্লোগান দীর্ঘ দিন আমাদের শুনিয়ে আসছে! আওয়ামী লীগের কাছে অবশ্য এটা নূতন কিছু নয়, এর ‘অসুস্থ নেতৃত্ব একবার ‘একদলীয় ‘বাকশালী শাসন ব্যবস্থা কার্যকর করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। হয়তো এদেরই মূলোৎপাটন হয়ে যেত, কিন্তু জেনারেল জিয়ার উদারতার কারনে মিসেস হাসিনা ওয়াজেদ দেশে ফিরে আসেন এবং বহুদলীয় রাজনীতির পথে আওয়ামী লীগ ও জামাত একই সাথে ধাপ ফেলতে শুরু করে। তাই ‘৯৬ তে জামাতের ‘বড় রাজাকার অধ্যাপক গোলাম আযমের দোয়া ( নাকি দয়া!) ভিক্ষা করতেও মিসেস হাসিনা ওয়াজেদ এর লজ্জা হয় নি। কিন্তু – এই ২০১৩ তে আবার সেই ফ্যাসীবাদী মতের পূনঃজাগরন হয়েছে । স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াকে রাজাকার বলতে বাধে নি, এরপর আওয়ামী লীগ কি বলবে? এরপর কি বি এন পি কে নিষিদ্ধ করার বানী শুনাবে?

অবশ্য বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আর তাদের ‘শয্যাসঙ্গী - ভারতীয় প্রভাব বলয় এবং এক সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এর চেনা মুখ গুলো বাদ দিলে, এদের সমর্থক - নেহায়েত হুজুগ পাগল- ক্ষমতা’ কেন্দ্রিক ‘দুধের মাছিরা, যারা ক্ষমতাসীনদের ঝুটো কাঁটার লোভে রাস্তা গরম করে রাখে- ভাল মন্দ বুঝে না, যুক্তি তর্কের ধার ধারে না, যৌক্তিক অযৌক্তিক চিন্তা করার অবকাশ যাদের নেই – এদের নিয়েই এক ‘সম্প্রদায় তৈরী হয়েছে। এরা জামাত –ই ইসলামীকে সাম্প্রদায়ীক রাজনীতি’ করে বলে অভিযোগ করলেও তারা নিজেরাই মূলতঃ সাম্প্রদায়িকতার বেড়াজালে বন্দী। এদেরই কণ্ঠে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামাত- ই ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার জোরালো দাবী উত্থাপন করতে দেখা গেছে। । শেখ হাছিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ , তার পারিবারিক প্রতিশোধের জের ধরে– এই ‘সাম্প্রদায়িক উস্কানীর বিষবাস্পকে পুঁজি করে – গোটা দেশ কে সেই ‘একাত্তর- চুয়াত্তর এর বৃত্তেই ফেলে রেখেছে – বাংলাদেশ রাজনৈতিক ভাবে আর এগুতে পারে নি।

দেশের হাজারো সমস্যা, পানি, বিদ্যুত এর মত মৌলিক সমস্যার সমাধান কি করতে পেরেছে আওয়ামী লীগ ? প্রতি বছর কত লোক রাস্তা ঘাটে, ট্রেনে বাস এ নদীতে দুর্ঘটনায় মারা যায়? কোন সমাধান? বিনা বিচারে গুম খুন! বেকার সমস্যা? কোন পরিসংখ্যান কি আছে বাংলাদেশের কি পরিমান মানুষ এই মুহূর্তে বেকার? যে সমস্ত বাপের সুপুত্র (কন্যারাও পিছিয়ে নেই ) এখন আন্দোলন করছে কয়েকজন মানুষকে ফাঁসিতে ঝোলানোর জন্য, উপরোল্লিখিত সমস্যা সমাধানের জন্য কি তারা আন্দোলন করেছে? এদের কত জনের চাকুরী আছে? বেকার মানুষ তো নিজের স্বার্থেই এই সমস্যা নিয়ে আন্দোলন করার কথা? ধরা যাক – এই রাস্তার ‘বিচারকদের দাবি মেণে নিয়ে, অভিযুক্তদের সবাই কে আওয়ামী নিয়োগ প্রাপ্ত বিচারক রা ‘ফাঁসির রায় দিয়ে দিল – এতে কি দেশের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? বরং এতে আরও প্রমাণ হবে- বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা ‘প্রভাব কলুষিত, নিরপেক্ষ নয়। যদিও ‘সেই বিচারকদের ‘স্কাইপী সংলাপ এই ‘আন্তর্জাতিক (পড়তে হবে আওয়ামী) বিচার কে ইতিমধ্যেই ডূবিয়ে দিয়েছে – বাকিটূকূ কফিনে শুধু শেষ পেরেকটা ঠূকবে।

জামাত শিবিরকে দেয়া হয়েছে – উগ্রতার অপবাদ, সত্যিকার উগ্রতা যারা দেখাচ্ছে – তারা পাচ্ছে পুলিশ প্রোটেকশন । পুলিশ পপুলার জনমতকে ( ডিসেন্ট) প্রকাশ করতে না দিয়ে –দমন আর দলন নীতির উগ্র পন্থা অনুসরণ করছে। যখন পত্রিকায় ছবিতে আসছে পুলিশ আর ছাত্রলীগ এর যৌথ ‘অভিযান, তখন সাধারণ মানুষ ঠিকই বূঝে নেয় – কী এদের উদ্দেশ্য ।

এই ছাত্রলীগের কোন সন্ত্রাসী বা এই পুলিশ যদি এখন কারো গুলী খেয়ে মারা যায়, মানুষ অবাক হবে না। যারা শান্তি রক্ষাকারী, তারা যখন গুম, খুন আর সন্ত্রাস করে, এর ফলাফল কখন ও ভাল হয় না। এই পুলিশের গায়ের উর্দি, পায়ের জুতা, হাতের পিস্তল আরে পিস্তলের বুলেট ওইসব মানুষদের ট্যাক্সের পয়সাতেই কেনা, আজ যারা তাদের মাসুল গুনছে । ঘুষ এর হারাম ইনকাম এর বোনাস এর সাথে, চাকুরীতে প্রমোশন আর মেডালের জন্য, এরা আওয়ামি লীগ এর কর্মচারী হয়ে গেছে, এরা রাষ্ট্রের বা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারি নয়। এজন্যই জন-নিরাপত্তা নয়, আওয়ামী এজেন্ডা বাস্তবায়নে এরা অতি উৎসাহী। ব্যাক্তিগত প্রতিহিংসা বা রাজনৈতিক / আদর্শিক শত্রুতা এক্ষেত্রে 'বোনাস হিসেবে যোগ হয়েছে মাত্র।

উগ্রতা শুধু উগ্রতারই জন্ম দেবে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এর শেখ হাসিনা যদি ভেবে থাকে, ‘হোসণি মোবারক এর মত কয়েক যুগ ক্ষমতায় থাকবে, তবে বিরাট ভুল করবে। পরবর্তী নির্বাচনেই ‘পাশা ঊল্টে যেতে পারে, তখন যদি আবার রাস্তায় রাস্তায়- এই মালীবাগ চত্তরে কিম্বা মতিঝিল গোল চত্তরে আওয়ামী লীগের দুর্নীতিবাজ ঘুষখোর নেতা ( তথাকথিত হাবুল হোসেন, সত্তর লাখ সেন এসব নামের দুর্গন্ধ কি আতর দিয়ে ধুলেও যাবে? ) সহ ছাত্রলীগের খুনিদের ফাঁসির দাবী শুরু হয়, অথবা পত্রিকা আর ভিডিও রেকর্ড দেখে দেখে ‘আওয়ামী পুলিশ আর ‘ক্রিমিনাল দেরকে খূজে বের করে, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে, ঝুলিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন এদের কেমন লাগবে?

কাজেই, উগ্রতা নয়, কিম্বা রাস্তার বিচার নয়, কেবল নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা নিশ্চিত করেই ক্ষমতাসীন দল দেশের জন্য এবং তাদের নিজেদের জন্য ও একটা বিরাট উপকার করতে পারে। এতে হয়তো ভবিষ্যতে তাদের নিজেদের ‘চামড়াও বাঁচবে। বাংলাদেশের গনতন্ত্রের জন্য এটা হবে অতি প্রয়োজনীয় এক মাইল ফলক।

বিষয়: বিবিধ

৭৬১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File